আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৫৯৭২
৩১৬৫. পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া জিহাদে যাবে না।
৫৫৪৭। মুসাদ্দাদ ও মুহাম্মাদ ইবনে কাসীর (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলঃ আমি কি জিহাদে যাব? তিনি বললেনঃ তোমার কি পিতা-মাতা জীবিত আছে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তাহলে তাদের (সেবার) মাঝে জিহাদ করো।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে জিহাদের উদ্দেশ্যে আগমনকারী ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিহাদে যাওয়ার আরয করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চাইলেন তার পিতা-মাতা জীবিত কি না। যখন জানালেন যে তার পিতা-মাতা জীবিত, তখন তাকে ফিরিয়ে দিলেন এবং পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকতে বললেন। কেননা জিহাদ হয়তো তখন তার উপর ওয়াজিব ছিল না, অন্যদিকে পিতা-মাতার হক আদায় করা ওয়াজিব। তাই জিহাদ অপেক্ষা পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকাই তার কর্তব্য ছিল। আর যদি জিহাদ তখন তার উপর ওয়াজিব হয়েও থাকে, তবুও পিতা-মাতার হক যেহেতু তারচে'ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে ছুটি দিয়ে দেন।

লক্ষণীয়, ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালীন সে সময়ে জিহাদ কতইনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল! তখন প্রতিটি যুদ্ধে শত্রুবাহিনী অপেক্ষা মুসলিম মুজাহিদদের অস্ত্র ও জনবল ছিল নিতান্তই নগণ্য। স্বাভাবিকভাবেই তখন মুসলিম বাহিনীর পক্ষে একজন সৈন্যেরও অনেক মূল্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সাহাবীর জন্য জিহাদে যোগদান অপেক্ষা পিতা-মাতার খেদমতে নিয়োজিত থাকাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টি ও বিবেচনাবোধ ছিল কতইনা প্রশস্ত, নিরপেক্ষ ও নিঃস্বার্থ!

পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকাকে 'জিহাদ' শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে- ففيهما فجاهد ‘তবে তাদের মধ্যেই (সদাচরণ বজায় রাখার) জিহাদ কর'। অর্থাৎ জিহাদ দ্বারা যদি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করাই তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকার জিহাদ অবলম্বন কর। এটাও জিহাদ ও মুজাহাদাই বটে। এতে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হয়। তাদের প্রয়োজন পূরণে যত্নবান থাকা, তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা ও তাদের মনোতুষ্টি বজায় রেখে চলা খুব সহজ কাজ নয়। অনেক সময়ই মন এর বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়। কখনও মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সে উস্কানি উপেক্ষা করা ও মনের বিদ্রোহ দমন করার জন্য কঠিন সংগ্রামের প্রয়োজন হয়। এমনিতেও মনের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অনেক কঠিন কাজ। তাই তো এ জিহাদকে 'জিহাদে আকবার' বলা হয়েছে। কাজেই সসস্ত্র সংগ্রাম দ্বারা যার উদ্দেশ্য কেবলই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করা, তার কিছুতেই পিতা-মাতাকে অসহায় ও অরক্ষিত অবস্থায় রেখে যাওয়া উচিত নয়। তাদের খেদমতের কোনও ব্যবস্থা করা না গেলে জিহাদে না গিয়ে বরং নিজেই সে দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া চাই। এ দায়িত্ব পালন তার পক্ষে জিহাদরূপে গণ্য হবে এবং এর মাধ্যমে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, পিতা-মাতার সেবাযত্নে নিয়োজিত থাকা জিহাদে যাওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

খ. আরও শিক্ষা পাওয়া যায়, নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের নাম দীন নয়; বরং দীন হলো আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ-নিষেধ পালনের নাম।

গ. এ হাদীছের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে দীনী কাজসমূহেও গুরুত্বের পর্যায়ক্রম বিবেচনায় রাখা চাই। একইসঙ্গে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে এসে গেলে তখন যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ঘ. নেতার কর্তব্য নিজ স্বার্থ-সুবিধার দিকে না তাকিয়ে কর্মী ও সঙ্গীর ব্যক্তিগত ও আনুষাঙ্গিক অবস্থাদি বিবেচনায় রাখা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন