ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

১৩. রাষ্ট্র ও প্রশাসন

হাদীস নং: ১৯৭৫
বুদ্ধিমান অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোরের ইসলাম গ্রহণ শুদ্ধ। এইরূপ কিশোর ধর্মত্যাগ করলে (নাউযু বিল্লাহ) তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যাবে না, বরং তাকে চাপ দিতে হবে
(১৯৭৫) আনাস রা. থেকে বর্ণিত, একজন ইয়াহুদি বালক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর খেদমত করত । বালকটি অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে দেখতে যান। তিনি তার মাথার কাছে বসেন এবং বলেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। বালকটির পিতা তার পাশেই ছিল। বালকটি তার পিতার দিকে তাকায় (তার মতামত জানার আশায়) । তার পিতা বলেন, তুমি আবুল কাসিম (রাসূলুল্লাহ) এর যিনি তাকে (ﷺ) কথা শোনো । তখন বালকটি ইসলাম গ্রহণ করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি বলেন, প্রশংসা আল্লাহর, জাহান্নাম থেকে রক্ষা করলেন।
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: كان غلام يهودي يخدم النبي صلى الله عليه وسلم فمرض فأتاه النبي صلى الله عليه وسلم يعوده فقعد عند رأسه فقال له: أسلم فنظر إلى أبيه وهو عنده فقال له: أطع أبا القاسم صلى الله عليه وسلم فأسلم فخرج النبي صلى الله عليه وسلم وهو يقول: الحمد لله الذي أنقذه من النار

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. গ্রন্থকার বলেন, এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, এইরূপ অপ্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিমান শিশু-কিশোর ইসলাম ত্যাগ করলে তাকে ইসলামে ফিরে আসার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে, কিন্তু তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্করা আইনের আওতায় পড়ে না এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করা বা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা থেকে বিভিন্ন হাদীসে সাধারণভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

২. যে বালকটি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করত, তার নাম বলা হয়ে থাকে আব্দুল কুদ্দুস। সে কখনও কখনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওযুর পানির ব্যবস্থা করে দিত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সে খেদমতের মূল্যায়ন করেন। যে-কোনও ব্যক্তিরই খেদমতকে তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করতেন। কোনও না কোনওভাবে তার বিনিময় দেওয়ার প্রতিও লক্ষ রাখতেন। তিনি যেমন উপকারীর উপকার স্বীকার করা ও তার কৃতজ্ঞতা আদায় করার শিক্ষাদান করেছেন, তেমনি অন্যান্য শিক্ষার মতো এ ক্ষেত্রেও তিনি নিজে এ শিক্ষার উপর আমলের নমুনাও দেখিয়ে দিয়েছেন। আলোচ্য বালকটির বেলায়ও সে নমুনা লক্ষ করা যায়। বালকটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তাকে দেখতে গিয়েছেন। তিনি শিয়রে বসেছেন। মমতার সঙ্গে তাকে ইসলামগ্রহণের দাওয়াত দিয়েছেন।

হাদীছটির প্রতি লক্ষ করলে বোঝা যায় বালকটি ইসলামগ্রহণে আগ্রহী ছিল। কিন্তু সে তার বাবাকে ভয় পাচ্ছিল, পাছে সে তার ইসলামগ্রহণে ক্রদ্ধ্ব হয়। তাই সে তার বাবার দিকে তাকাচ্ছিল। তার বাবা ইহুদি হলেও এই ভদ্রতবোধটুকু ছিল যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যখন তার পুত্রকে দেখতে এসেছেন, তখন তার সম্মানটক রক্ষা করা উচিত, বিশেষত যখন তাঁর দাওয়াতের প্রতি এই মৃত্যুক্ষণে তার পুত্র আগ্রহও প্রকাশ করছে। কাজেই সে তাকে ইসলামগ্রহণের অনুমতি দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বালকটি ইসলাম গ্রহণ করল। এর দ্বারা এ কথাও বোঝা গেল যে, মৃত্যুর আগে আগে যখন হুঁশ ও চেতনা থাকে, তখনও ইসলাম গ্রহণ করলে তা আল্লাহ তা'আলার কাছে গৃহীত হয়। বালকটির ইসলামগ্রহণ গৃহীত হয়েছিল বলেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে আনন্দ প্রকাশ করেছেন এবং আল্লাহর শোকর আদায় করেছেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছেন।

হাদীছটি দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়েরও পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন সকল সৃষ্টির সেরা। সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যমণি। মদীনার সত্যিকারের বাদশাও বটে। তা সত্ত্বেও এক সাধারণ ইহুদি বালকের বাড়িতে চলে গেছেন। তার রোগশয্যায় হাজির হয়েছেন।

এর দ্বারা তাঁর দরদি মনেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বালকটি যাতে ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারে আর এভাবে জাহান্নাম থেকে সে বেঁচে যায়, সেজন্য তিনি তার মৃত্যুর আগে আগে তার কাছে ঈমানের দাওয়াত নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর স্নেহ-মমতায় আগে থেকেই বালকটি তাঁর প্রতি নিবেদিত ছিল। তা না হলে এক ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও সে তাঁর সেবা করবে কেন? হয়তো নিজ পিতা ও নিজ সম্প্রদায়ের ভয় না থাকলে আগেই ইসলাম গ্রহণ করত। কিন্তু তার জীবনের এ শেষ মুহূর্তে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তার শিয়রে উপস্থিত হয়েছেন, তখন তার পক্ষে তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বরং সে দাওয়াতগ্রহণে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। আল্লাহ তা'আলা তার আবেগ কবুল করে নেন। ঈমান নিয়েই তার কবরযাত্রা সম্ভব হয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অমুসলিমদের সেবা খ. অমুসলিম গ্রহণ করা জায়েয।

খ. অমুসলিম ব্যক্তি অসুস্থ হলে তাকেও দেখতে যাওয়া একটি সৎকর্ম।

গ. অমুসলিম রোগীকে দেখতে গেলে হিকমতের সঙ্গে তাকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া চাই।

ঘ. কোনও মুসলিম ইসলাম গ্রহণ করলে সেজন্য খুশি হওয়া ও আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা চাই।

ঙ. খাদেম-সেবকদের প্রতি স্নেহশীল থাকা উচিত।

চ. কাউকে ছোট বা সাধারণ বলে তুচ্ছ ও অবহেলা করতে নেই। সকলের প্রতি বিনয়ের আচরণ বাঞ্ছনীয়।

ছ. প্রত্যেক অমুসলিমের প্রতি অন্তরে দরদ পোষণ করা এবং তারা যাতে ঈমান এনে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে যায় সে লক্ষ্যে দাওয়াতী কার্যক্রম অব্যাহত রাখা উচিত।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ১৯৭৫ | মুসলিম বাংলা