ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১১২২
সালাতুল জানাযার বিস্তারিত পদ্ধতি
(১১২২) আবু ইবরাহীম আনসারি তার পিতা থেকে বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে সালাতুল জানাযায় বলতে শুনেছেন, 'হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমা করুন আমাদের জীবিতদেরকে এবং আমাদের মৃতদেরকে এবং আমাদের উপস্থিতদেরকে এবং আমাদের অনুপস্থিতদেরকে এবং আমাদের পুরুষদেরকে এবং আমাদের নারীদেরকে এবং আমাদের ছোটদেরকে এবং আমাদের বড়দেরকে।
عن أبي إبراهيم الأنصاري عن أبيه أنه سمع النبي صلى الله عليه وسلم يقول في الصلاة على الميت: اللهم اغفر لحينا وميتنا وشاهدنا وغائبنا وذكرنا وأنثانا وصغيرنا وكبيرنا... من أحييته منا فأحيه على الإسلام ومن توفيته منا فتوفه على الإيمان... اللهم لا تحرمنا أجره ولا تضلنا بعده

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. গ্রন্থকার বলেন, জানাযার দুআর বিষয়ে বিভিন্ন সহীহ হাদীসে আরো অনেক দুআ বর্ণিত হয়েছে।

২. এ হাদীছটিতে জানাযার নামাযের মশহুর একটি দু'আ বর্ণিত হয়েছে। এ দু'আটি অনেকেরই মুখস্থ আছে। এতে জীবিত, মৃত, ছোট, বড়, পুরুষ, নারী, উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্যই পাঁচটি বিষয় প্রার্থনা করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হল পাপমার্জনা। বলা হয়েছে- ...اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا (আল্লাহ! আপনি ক্ষমা করুন আমাদের জীবিতকে, মৃতকে...)। অর্থাৎ সমস্ত মুমিন-মুসলিম নর-নারীর সগীরা-কবীরা সবরকম গুনাহ ক্ষমা করে দিন। যদিও মূল উদ্দেশ্য মায়্যিতের জন্য দু'আ করা, কিন্তু দু'আ যত ব্যাপক হয় ততোই তা কবুলের সম্ভাবনা বেশি। আল্লাহ তা'আলার ক্ষমাশীলতা সর্বব্যাপী। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ
'নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমাশীল’। (সূরা নাজম, আয়াত ৩২)

তাই ক্ষমাপ্রার্থনাসহ যে-কোনও কল্যাণের দু'আয় ব্যাপকভাবে সবাইকে শামিল করে নেওয়া চাই। বিশেষত অন্যের গুনাহের মাগফিরাত কামনাকালে নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা তো অধিকতর জরুরি। অন্যের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইব আর নিজ গুনাহের কথা ভুলে থাকব, এটা কী করে সম্ভব? এটা নিজ সম্পর্কে এক রকম সুধারণার মধ্যে পড়ে, যদিও তা মুখে না বলা হয়।

এ দু'আয় প্রথমে যে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা হয়েছে, এটাও দু'আর এক নিয়ম। প্রথমে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা বিনয় ও বন্দেগীর দাবি। একজন গুনাহগারের পক্ষে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার পরেই অন্য কিছু কামনা করা সাজে। গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা না করে অন্যকিছু কমনা করা এক রকম ধৃষ্টতা। বান্দার পক্ষে তা কিছুতেই শোভনীয় নয়।

লক্ষণীয়, মাগফিরাতের দু'আয় صغير (ছোট)-কেও শামিল রাখা হয়েছে। ছোট দ্বারা যদি তুলনামূলক ছোটকে বোঝানো হয়, অর্থাৎ এমন ছোট, যে বালেগ বটে কিন্তু অন্যান্য বয়স্কদের তুলনায় বয়সে ছোট, তবে কোনও প্রশ্ন থাকে না। কেননা এরূপ ছোট গুনাহগার হতে পারে। তাই তারও মাগফিরাত প্রয়োজন। পক্ষান্তরে ছোট যদি হয় নাবালেগ, তখন তার তো কোনও গুনাহ নেই। এ অবস্থায় তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করার কী অর্থ?

কেউ কেউ বলেছেন, এ ক্ষেত্রে মাগফিরাত দ্বারা মর্যাদা উঁচু করা বোঝানো উদ্দেশ্য। যেন বলা হচ্ছে, হে আল্লাহ! আপনি এ শিশুকে উচ্চমর্যাদা দান করুন। এমনও হতে পারে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য শিশুর পরবর্তী জীবন। অর্থাৎ বড় হওয়ার পর তার দ্বারা যদি কোনও গুনাহ হয়ে যায়, তবে আপনি তার জন্য মাগফিরাত নসীব করুন। কারও কারও মতে এখানে ছোটর উল্লেখ কেবলই দু'আর ভেতর অধিকতর ব্যাপকতা আনয়নের জন্য, যেহেতু দু'আ যত বেশি ব্যাপক হয়, ততো বেশি কবুলের সম্ভাবনা থাকে।

দু'আটির দ্বিতীয় বিষয়বস্তু হল ইসলামের উপর অবিচল থাকার কামনা। বলা হয়েছে– اللهم مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الْإِسْلام (হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্যে যাকে জীবিত রাখেন, তাকে জীবিত রাখুন ইসলামের উপর)। অর্থাৎ আমরা যে ইসলামের উপর আছি, এটা আপনারই দান। হে আল্লাহ! মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের উপর আপনার এ দান অব্যাহত রাখুন। আমরা যেন কোনও অবস্থায়ই ইসলাম থেকে সরে না যাই। যতদিন জীবিত থাকি, যেন মুসলিমরূপেই জীবিত থাকি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন ইসলামের শিক্ষা মেনে চলি।

দু'আটির তৃতীয় বিষয় হল ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু। বলা হয়েছে– وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِيمَانِ (আর যাকে মৃত্যুদান করেন, তাকে মৃত্যুদান করুন ঈমানের উপর)। ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু মানবজীবনের পরম কামনা। এটা মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয়। কেউ যদি সারা জীবনও ইসলামের উপর জীবনযাপন করে, কিন্তু মৃত্যু ঈমানের সঙ্গে না হয়, তবে সে কিছুতেই নাজাত পাবে না। নাজাতের জন্য ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু জরুরি। অনেক সময় মুমিন-মুসলিম ব্যক্তিও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ঈমানহারা হয়ে যায় এবং বেঈমান অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে শয়তানও জোর তৎপরতা চালায়। এটা তার জন্য মানুষকে ঈমানহারা করার শেষ সুযোগ। মৃত্যুযন্ত্রণার ভেতর শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে অনেকে ঈমান হারিয়েও ফেলে। তাই ঈমানের সঙ্গে যাতে মৃত্যু হয়, প্রত্যেকেরই সেই আশা ও চেষ্টা থাকা উচিত। সে চেষ্টা হচ্ছে সর্বদা ঈমান সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসীব হওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকা। এ দু'আ অতীব জরুরি হওয়ায় জানাযার নামাযের মধ্যেও একে দাখিল করে দেওয়া হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেক মুসলিমের উচিত মায়্যিতসহ জীবিত ও মৃত সকল মুমিন নর-নারীর জন্য কল্যাণকামী থাকা।

খ. গুনাহ থেকে মাগফিরাতলাভ সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয়। তাই যে-কোনও অবকাশে নিজের ও অন্যদের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে হবে।

গ. দু'আ যত ব্যাপক হয়, ততো বেশি কবুলের আশা থাকে। তাই যে-কোনও কল্যাণের দু'আয় নিজের সঙ্গে অন্যদেরও শামিল রাখা চাই।

ঘ. আখিরাতের নাজাতের জন্য ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ জরুরি। তাই সদাসর্বদা নিজ ঈমান সম্পর্কে সচেতন থাকার পাশাপাশি আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আও করা উচিত যাতে তিনি ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুদান করেন।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান