মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

২৩. অপরাধ ও সাজার অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৮৫
অপরাধের বর্ণনা
হাদীস নং- ৪৮৫

হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ ইয়াহুদী ও নাসারাদের রক্তমূল্য মুসলমানদের মতই সমান।
عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «دِيَةُ الْيَهُودِيِّ وَالنَّصْرَانِيِّ مِثْلُ دِيَةِ الْمُسْلِمِ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীসে দিয়্যত (ديت) বা রক্তমূল্যের মাসয়ালা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম মালিক (রা)-এর মতে ইয়াহুদী ও নাসারাদের রক্তমূল্য মুসলমানের রক্তমূল্যের অর্ধেক। অর্থাৎ ছ' হাযার দিরহাম। কেননা তাঁর মতে পূর্ণ দিয়্যত বা রক্তমূল্য হলো বার হাযার দিরহাম। হযরত ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে, ইয়াহুদী ও নাসারাদের রক্তমূল্য এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ চার হাযার দিরহাম।
হযরত ইমাম আযম আবূ হানীফা (রা)-এর মতে ইয়াহুদী ও নাসারাদের রক্তমূল্য ও আযাদ মুসলমানের রক্তমূল্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। প্রত্যেকের জন্য একই রক্তমূল্য অর্থাৎ দশ হাযার দিরহাম। কেননা তাঁর মতে পূর্ণ রক্তমূল্যের পরিমাণ এটা। ইমাম মালিকের মাযহারের পক্ষে সুনানে আরবাআ (তিরমিযী আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ) আমর ইব্ন উমায়র (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ دية المعاهد نصف دية الحر “মুআহিদ বা চুক্তিকারীর রক্তমূল্য হলো আমাদের অর্ধেক।
তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে : عقل الكافر نصف عقل المؤمن "কাফিরের রক্তমূল্য মু'মিনের অর্ধেক।” ইমাম শাফিঈ (র) তাঁর মাযহাবের স্বপক্ষে স্বীয় মুসনাদে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ইয়াহুদী ও নাসারার রক্তমূল্য চার হাযার দিরহাম এবং মজুসীর (অগ্নি উপাসক বা যরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী) আট শ' দিরহাম। অথবা তিনি মুসান্নিফে ইব্ন আবদুর রাযযাকে আমর ইব্ন শুআয়বের সূত্রে মরফু হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেছেন :
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم فرض على كل مسلم قتل رجلاً من أهل الكتاب أربعة الأف
"রাসূলুল্লাহ (সা) প্রত্যেক ঐ মুসলমানের উপর চার হাজার দিরহাম রক্তমূল্য প্রদান ওয়াজিব করেছেন যে কোন আহলে কিতাবকে হত্যা করবে।" ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহাবের স্বপক্ষে বর্ণিত হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করেছেন যে, আহলে কিতাব ও মুসলমানের রক্তমূল্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ হাদীসের সনদে কোন সন্দেহ এবং অর্থের কোন জটিলতা নেই। অধিকন্তু এ হাদীস হলো মরফু। এ ছাড়া আবু দাউদ মারাসিলে (مراسيل)) সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেব (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন:دية كل ذي عهد في عهده ألف دينار “প্রত্যেক চুক্তিকারীর রক্তমূল্য চুক্তির সময়ে এক হাযার দীনার।" অতঃপর একই হাদীস হযরত ইমাম শাফিঈ (র) হযরত সাঈদ ইব্‌ন মুসাইয়্যেব থেকে মওকুফ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী শরীফে হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে :
إن النبي صلى الله عليه وسلم ودى العامرين بدية المسلمين وكان لها عهد من رسول الله صلى الله عليه وسلم
"নবী করীম (সা) মুসলমানের সমপরিমাণ আমেরাইনের রক্তমূল্য আদায় করেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে তাদের চুক্তি ছিল। অন্য সহীহ রিওয়ায়েতে এর প্রমাণ রয়েছে যে, হুযূর (সা) এবং খুলাফায়ে রাশেদার পবিত্র সময়ে এ বিধানই প্রচলিত ছিল। এমনকি হযরত মুআবিয়া (রা)-এর শাসনকালে এটা প্রচলিত ছিল যে, অর্ধেক রক্তমূল্য নিহতের উত্তরাধিকারীদেরকে এবং বাকী অর্ধেক বায়তুলমালে জমা করা হতো। সুতরাং আবূ দাউদ স্বীয় মারাসিলে (مراسيل) রাবিয়াতুর-রায়-এর সূত্রে বর্ণনা করেনঃ
كان عقل الذمي مثل عقل المسلم في زمن رسول الله صلى الله عليه وسلم وزمن أبي بكر وزمن عثمان حتى كان صدرا من خلافة معاوية الحديث
"রাসূলুল্লাহ (সা), হযরত আবু বকর, হযরত উসমান (রা)-এর পবিত্র যুগে ফিম্মীদের রক্তমূল্য মুসলমানদের সমপরিমাণ ছিল। এবং এটা হযরত মুআবিয়া (রা)-এর শাসনকালের প্রথমভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
আবদুর রাযযাক ও ইমাম যুহরী থেকে একই হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন। হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত আছেঃ إنما بذلوا الجزية ليكون دمائهم كدمائنا وأموالهم كأموالنا "তারা (চুক্তিকারী ইয়াহুদী ও নাসারা) এ জন্য জিযিয়া প্রদান করত, যাতে তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মত এবং তাদের মাল আমাদের মালের সমপরিমাণ মূল্য হয়।"
এ হাদীস তো সমস্ত বিতর্কের অবসান করে দিয়েছে এবং এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে। যে, যিম্মীদের রক্তমূল্য এবং মুসলমানদের রক্তমূল্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং হুযূর (সা) ও খুলাফায়ে কিরামের আমলের দ্বারা সহীহ সনদের মরফু, মারাসিল ও মওকুফ হাদীসের দৃষ্টিতে বিশ্বস্ততা প্রতীয়মান হয়। কেননা অন্য দু'জন আয়িম্মার হাদীসসমূহ প্রসিদ্ধ, বিশুদ্ধতা এবং সূত্রের আধিক্যের মধ্যে এ মর্যাদা নেই। যদি প্রতিপক্ষ মারাসিলে ইরসালের (ارسال) দোষত্রুটি বের করে এবং মওকুফের মধ্যে মওকুফ হওয়া প্রকাশ করে যে, মারাসিল সর্বসম্মতিক্রমে মকবুল বা গ্রহণযোগ্য। এ ছাড়া ঐ মওকুফ হাদীস, যাতে কিয়াসের কোন অবকাশ নেই, তা মরফু হাদীসের বিধানের অন্তর্ভুক্ত এবং এতে কিয়াসের এজন্য অধিকার নেই যে, উভয়ের মধ্যে বাহ্যিক সাদৃশ্য নেই যে, কিয়াস করা যাবে। অতঃপর কিয়াসও হানাফী মাযহাবের পক্ষ সমর্থন করে। কেননা বিভিন্ন দলীল যখন পরস্পর বিরোধী হয়, তখন সতর্কতা অবলম্বন করা জ্ঞান ও রিওয়ায়েতের অতি নিকটবর্তী এবং এ সতর্কতা (احتياط) হানাফী মাযহাবে রয়েছে, যা অন্য মাযহাবে নেই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ৪৮৫ | মুসলিম বাংলা