মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১৯. পানাহারের দ্রব্যাদি, কুরবানী, শিকার এবং যবেহ সম্পর্কে বর্ণনা

হাদীস নং: ৪২৬
নাবীয পান করা
হাদীস নং- ৪২৬

হযরত ইব্ন আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, শরাব বা মদ কম হোক বা বেশী হোক, হারাম করা হয়েছে। যে কোন শরাবে নেশা রয়েছে।
عَنْ أَبِي عَوْنٍ مُحَمَّدٍ الثَّقَفِيِّ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ شَدَّادٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «حُرِّمَتِ الْخَمْرُ قَلِيلُهَا، وَكَثِيرُهَا مَا بَلَغَ السُّكْرَ مِنْ كُلِّ شَرَابٍ» ، وَفِي رِوَايَةٍ: عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «حُرِّمَتِ الْخَمْرُ بِعَيْنِهَا قَلِيلُهَا وَكَثِيرُهَا، وَالسُّكْرُ مِنْ كُلِّ شَرَابٍ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীসে ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমদ ও ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মতপার্থক্যের বিষয় হলো এই যে, তিনজন আয়িম্মার মতে প্রত্যেক নেশাজাতীয় দ্রব্যকে خمر (শরাব বা মদ) বলা হয় এবং এর কম বা বেশি সমস্ত হারাম এবং এটা পানকারী যে কোন পরিমাণ হোক না কেন, শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তাঁরা বলেন, خمر মূলত مخامرت থেকে উৎসারিত অর্থাৎ জ্ঞান বা বিবেক লুপ্তকারী। এখন যে কোন শরাব নেশার কারণে জ্ঞান লুপ্ত বা শূন্য করে দেয়, তাই খুমুরের (خمر ) বিধানে পড়ে এবং কম হোক বা বেশি, তা হারাম। রিওয়ায়েতের দৃষ্টিতে তাঁরা মুসলিম শরীফে বর্ণিত এ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন যে, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ كل مسكر حرام (প্রত্যেক নেশা জাতীয় বস্তু হারাম)। অথবা ঐ হাদীস, যেমন হুযূর (সা) বলেছেনঃ الخمر من هاتين الشجرتين الكرمة والنخلة (খুমুর বা শরাব এ দু' গাছ থেকে তৈরি হয় এক আঙ্গুরের গাছ, অপরটি খেজুরের গাছ)। অর্থাৎ আঙ্গুরের সাথে খেজুরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন,خمر শব্দের উৎস হলো تخمر যার অর্থ সবল ও শক্তি যা অন্য কোন বস্তুর মধ্যে পাওয়া যায় না। তাই এটাকে ام الخبائث বা অপবিত্রতা ও দুষ্কর্মের মূল বলা হয়েছে। অভিধানের দৃষ্টিতে বা আরবের জনসাধারণের ভাষায় خمر আঙ্গুরের কাঁচা পানিকে বলা হয়, যখন এটা নেশায় পরিণত হয়। এ অর্থে এর হারাম হওয়া অকাট্য বা নিশ্চিত। পবিত্র কুরআনেও এর হারাম হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট আয়াতে বলা হয়েছে: يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (হে বিশ্বাসীগণ। নিশ্চয়ই শরাব জুয়া ও শর)।............. (৫ঃ৯০) সুতরাং কুরআন ও হাদীস দ্বারা এর হারাম প্রমাণিত হয়েছে। বাকী অন্যান্য বস্তুর হারাম হওয়া অকাট্য বা নিশ্চিত নয়, বরং ظنى বা অনুমান বা কিয়াসনির্ভর। যেমন, গম, বার্লি ইত্যাদি দ্বারা তৈরি শরাব বা মদ। এগুলো সম্পর্কে خمر শব্দ ব্যতিরেকে অন্য বাক্য ব্যবহার হয়েছে। যেমন নাবীয, নাকী, সাকার (نبيذ - نقيع - سكر )ইত্যাদি। সুতরাং এগুলোর ঐ বিধান নয়, যা আঙ্গুরের তৈরি শরাবের জন্য রয়েছে যে, কম হোক বা বেশি হোক, হারাম এবং সামান্য পানকারীও শাস্তির যোগ্য। বরং অন্যান্য শরাব, যা সামান্য ব্যবহারে নেশা সৃষ্টি হয় না, তা হারাম নয়। হাঁ, যদি নেশা সৃষ্টি হওয়ার মত পান করে, তা হলে হারাম এবং পানকারীর উপর শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে। এমনিভাবে উভয়ের মধ্যে এ পার্থক্য রয়েছে যে, আঙ্গুরের শরাব হারাম হওয়ার ব্যাপারে অস্বীকারকারী কাফির হবে কিন্তু অন্যান্য শরাবের হারাম হওয়া অস্বীকারকারী কাফির হবে না। কেননা এগুলোর প্রমাণ হলো অনুমান বা কিয়াসনির্ভর, অকাটা নয়।
ইমাম আবু হানীফার মাযহাবের স্বপক্ষে হযরত ইব্ন আব্বাস (রা)-এর বর্ণিত হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করা যায়, যাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে,خمر (আঙ্গুরের তৈরি শরাব) কম এবং বেশি যে কোন পরিমাণ সম্পূর্ণভাবে হারাম। অন্যান্য শরাবের হারাম হলো হালালের জন্য নেশাকে পৃথক করার সীমা অথবা পার্থক্য করার চিহ্ন হিসেবে স্থির করা হয়েছে এবং নেশার উদ্রেক করতে পারে এতটুকু পরিমাণ শরাব হারাম, এর চেয়ে কম পরিমাণে নয়। তবে আঙ্গুরের শরাবে এরূপ নয়। এর মধ্যে এক ফোঁটাও এরূপ হারাম যেরূপ পূর্ণ বোতল বা এর চেয়ে বেশি পরিমাণ।
ইমামত্রয়ের দলীল হিসেবে পেশকৃত হাদীসের (كل مسكر خمر) জওয়াব হলো এই যে, ইয়াহইয়া ইব্ন মুঈন এর উপর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনটি হাদীস রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণিত, এর প্রমাণ নেই। প্রথম لا نكاح إلا بولى وشاهدى عدل, দ্বিতীয় مس ذكره فليتوضا এবং তৃতীয় হলো ইয়াহইয়া ইব্ন মুঈন এরূপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি যে, ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল (র) বলেছেন, যে হাদীস সম্পর্কে ইয়াহইয়া ইব্ন মুঈন অবগত নন, ঐ হাদীস মূলত হাদীস নয়। দ্বিতীয় হাদীসের জওয়াব হলো এই যে, আঁ হযরত (সা) خمر এর মূলতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেননি, বরং এর বিধান বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর এটা কাজ নয় যে, তিনি বাক্যের আভিধানিক বা মৌলিক বিষয়ে আলোচনা করবেন। বরং এখানে হলো শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা। এবার প্রতিপক্ষ বর্ণিত হাদীসের السكر শব্দের সহীহ হওয়াকে অত্যন্ত কঠোরভাবে বাতিল করেন- যার উপর সম্পূর্ণ মাযহাবের ভিত্তি রয়েছে। এবং এটা বলেন যে, مسكر সহীহ, অথচ বিভিন্ন সূত্রে السكر শব্দটি বর্ণিত হয়েছে। তিবরানী বলেন, حرم الله الخمر والسكر من كل شراب আল্লাহ তাআলা মূল خمر (শরাব) হারাম করেছেন এবং প্রত্যেক শরাবের মধ্যে নেশাকে হারাম করেছেন। বাযযার ও দারে কুতনী একইভাবে মরফু ও মওকূফ হাদীস বর্ণনা করেছেন। নাসাঈ সিকাহ (ثقه) বা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে এ হাদীস একই বাক্যে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এ শব্দ স্বীয় স্থানে সহীহ।
অতঃপর প্রতিপক্ষ বলেন, হাদীসের সংযোগ ও বিছিন্ন এবং তুলে দেয়া ও অটল থাকার (وصل وانقطا) এবং (رفع وقف) মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে যা এ হাদীসের দুর্বলতার (ضعيف) দলীল। আমরা বলছি যে, এ মতপার্থক্য হাদীসের সহীহ হওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা নয়। যেমন (رفع) অতিরিক্ত এবং বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য (ثقه) হলে তার অতিরিক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্য। এটাও প্রমাণিত হলো যে, মাসয়ালায় ইজতিহাদের অধিকার নেই, এর وقف, মূলত رفع -এর বিধানে নিহীত। অথবা যেমন انقطاع হাদীসের সহীহ হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আনয়ন করে না, যখন বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য (ثقه) হন। বরং এরূপ হাদীস মুরসালের (مرسل) বিধানে পড়ে। এ ব্যাপারে এখনো সহীহ ও সঠিক মীমাংসার প্রয়োজন।
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ৪২৬ | মুসলিম বাংলা