মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১৫. শরীআতের দন্ড বিধি অধ্যায়

হাদীস নং: ৩১৪
যে পরিমাণ মাল চুরি করলে হাত কর্তন করা যায়
হাদীস নং- ৩১৪

হযরত আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়ে দশ দিরহাম পরিমাণ মালামাল চুরি করার অপরাধে হাত কর্তন করা হতো। অপর এক রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, দশ দিরহামের মাল চুরিতে হাত কাটার শাস্তি দেয়া যায়।
عَنِ الْقَاسِمِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: «كَانَ يُقْطَعُ الْيَدُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي عَشْرَةِ دَرَاهِمَ» ، وَفِي رِوَايَةٍ: «إِنَّمَا كَانَ الْقَطْعُ فِي عَشْرَةِ دَرَاهِمَ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ন্যূনতম কি পরিমাণ মাল চুরি করলে হাত কর্তন করা যাবে, এটা নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে এক-চতুর্থাংশ দীনারের সমমূল্য পরিমাণ মাল চুরি করলে হাত কর্তন করা যাবে। তা তিন দিরহাম মূল্যের হোক বা এর চেয়ে কম অথবা এর চেয়ে বেশি। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ (র)-এর মতে এক-চতুর্থাংশ দীনার অথবা তিন দিরহাম মূল্যে মালের জন্য হাত কর্তন করা যাবে, এর চেয়ে কমের জন্য নয়। এঁদের দলীল হলো বুখারী শরীফে হযরত ইব্‌ন উমর (রা) বর্ণিত হাদীস : إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قطع سارقا في مجن قيمة ثلاثة دراهم (তিন দিরহামের মূল্যের একটি ঢাল চুরির অপরাধে রাসূলুল্লাহ (সা) এক চোরের হাত কর্তন করেছেন)। অথবা বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রা)-এর বর্ণিত হাদীস : لا يقطع يد السارق إلا في ربع دينار فصاعدا (এক-চতুর্থাংশ দীনার অথবা এর চেয়ে বেশি না হলে চোরের হাত কর্তন করা যাবে না)।
ইমাম শাফিঈ (রা)-এর মতে নবী করীম (সা)-এর আমলে এক দীনারের মূল্য ছিল বার দিরহাম। ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতে কমপক্ষে দশ দিরহাম মূল্যের মাল হলে চোরের হাত কাটা যাবে। হানাফী মাযহাবের স্বপক্ষে বেশ কিছু সহীহ মরফু ও মওকুফ হাদীস রয়েছে। হাদীসসমূহের মধ্যে এ হাদীসই দলীল ও প্রমাণ হিসেবে শক্তিশালী যে, দশ দিরহাম মূল্যের মালে হাত কাটা যাবে। মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকে হযরত ইব্ন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিতঃ لا يقطع اليد إلا فى دينار اوعشرة دراهم (এক দীনার বা দশ দিরহামের কম হলে হাত কর্তন করা যাবে না)। সমস্ত ইমামের মতে, ঢাল চুরির অপরাধে আঁ হযরত (সা)-এর নির্দেশে হাত কর্তনের প্রমাণ রয়েছে। মতপার্থক্য শুধু এ বিষয়ে যে, ঐ সময়ে ঢালের মূল্য কত ছিল। এর মূল্য দশ দিরহাম থেকে কম ছিল বলে যারা মত প্রকাশ করেন, তারা হযরত ইব্ন উমর (রা) অথবা একই ধরনের হাদীস পেশ করে থাকেন এবং এর উপর স্বীয় মাযহাবের ভিত্তি নির্ধারণ করেছেন। হানাফী মাযহাবের দলীলসমূহ সিহাহ সিত্তায় বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে। যেমন আবূ দাউদ শরীফে আতার সূত্রে হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে :
قطع رسول الله صلى الله عليه وسلم يد رجل في مجن قيمة دينار أو عشرة دراهم
(রাসূলুল্লাহ (সা) এক দীনার অথবা দশ দিরহাম মূল্যের একটি ঢাল চুরির অপরাধে এক চোরের হাত কর্তন করেছেন)। হাকিম মুসতাদরাকে এ হাদীস বর্ণনা করে বলেছেন, এ হাদীস মুসলিম শরীফের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। ইমাম তাহাভীও এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইব্ন আবদুল বারও এ হাদীস ভূমিকায় বর্ণনা করেছেন। মোটকথা এ হাদীস অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণেই সহীহ। এছাড়া নাসাঈ শরীফে হযরত আয়মান থেকে আতা এবং মুজাহিদ দুটি সূত্রে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। لم يقطع النبي صلى الله عليه وسلم السارق إلا في ثمن المجن يومئذ دينار (নবী করীম (সা) একটি ঢাল চুরির অপরাধে এক চোরের হাত কর্তন করেছেন, ঐ সময় এর মূল্য ছিল এক দীনার)।
আয়মান বর্ণিত হাদীসে একটু সমালোচনা রয়েছে এবং মতপার্থক্য রয়েছে যে, তিনি কি সাহাবী ছিলেন, না তাবিঈ।সাহাবী হলে তিনি কি হুনায়নের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেছেন অথবা আঁ হযরত (সা)-এর ইনতিকালের পরও জীবিত ছিলেন? এখানে বেশি আলোচনা না করে শুধু এটুকু বলা যায় যে, যদি তাঁকে সাহাবী হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তাহলে এ হাদীস মরফূ হিসেবে প্রমাণিত হয়। আর যদি তাবিঈ বলা হয়, তা হলে এ হাদীস মুরসাল হিসেবে গণ্য হয় যা হানাফী ও অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের মতে নিঃসন্দেহে গ্রহণীয় এবং নির্ভরযোগ্য। কেননা তিনি তো অবশ্যই সিকাহ (ثقه) বা নির্ভরযোগ্য। যেমন, আবূ যুরআর মত সম্মানিত ইমাম এবং ইব্ন হিব্বান ও অন্যান্যগণ এ হাদীসের ব্যাখ্যা করেছেন। এ ছাড়া হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত হাদীস আয়মানের হাদীসের সমর্থন করে থাকে যা এ হাদীসের সহীহ হওয়ার ব্যাপারে আরো শক্তিশালী দলীল হিসেবে গণ্য করা যায়। অধিকন্তু ইব্ন আবী শায়বা স্বীয় মুসান্নাফে আবদুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্ন আস (রা) থেকে রিওয়ায়েত করেন। كان ثمن المجن عشرة دراهم (ঢালের মূল্য ছিল দশ দিরহাম)। সুতরাং এ সমস্ত রিওয়ায়েতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অবশ্যই মানতে হবে যে, বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক-চতুর্থাংশ দীনার সম্পর্কিত হাদীস রহিত (منسوخ) করা হয়েছে।
শরীয়তের নীতিমালা অনুযায়ী হানাফী মাযহাবের বাস্তবতার প্রকাশ হয়ে যায় যে, এ বিষয়টি মূলত শাস্তির সাথে যুক্ত। যদি কেউ পক্ষপাতিত্ব করে এ সমস্ত রিওয়ায়েতের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সমালোচনা করে, তা হলে কমপক্ষে এ সমস্ত রিওয়ায়েত তাদের মতে শাস্তির ব্যাপারে কমবেশি সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে যে, চুরির নিসার দশ দিরহামের মধ্যে তিন দিরহাম অথবা এক-চতুর্থাংশ দীনার হবে। আসার ও আখবার থেকে এ নীতিমালা প্রমাণিত আছে যে, সন্দেহের দ্বারা শাস্তি (حدود) রহিত হয়ে যায় এবং এতে সতর্কতামূলক দিকটি বিবেচনায় রাখা হয়। এখানেও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে এবং সতর্কতামূলক দিকটি অধিক অর্থাৎ দশ দিরহাম হওয়ার বাঞ্ছনীয়, এক-চতুর্থাংশ দীনার অথবা তিন দিরহাম নয়। সুতরাং দশ দিরহামের মাযহাবই সঠিক। এক-চতুর্থাংশ দীনারের সমর্থনকারীগণও বিয়াসের দ্বারা তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং একটি সাধারণ নীতিমালাকে সামনে রেখে থাকেন যার এখানে মূলত কোন সুযোগ বা স্থান নেই। কেননা তাঁদের মাযহাবের অধিকতর নির্ভরতা ঢালের মূল্যের উপর। এর মূল্য আঁ হযরত (সা)-এর যুগে কত ছিল? তাঁদের মতে তিন দিরহাম এবং এটাই হলো তাঁদের মাযহাব। অথবা হানাফী মাযহাব মতে দশ দিরহাম। বলা হয়েছে যে, মতানৈক্যের সময় সর্বনিম্ন সংখ্যার উপর আমল করা বাধ্যতামূলক নীতি। এখানে সর্ব নিম্ন সংখ্যা বা পরিমাণ হলো তিন দিরহাম কিন্তু শাস্তির মধ্যে এ নীতি বা বিধান পালিত হয় না। যদি শাস্তির মধ্যে এ বিধান পালিত হয়, তাহলে এতে নির্যাতন বৃদ্ধি পাবে।অপরাধীর মুক্তি ও নিষ্কৃতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে যা শরীয়তের বিধানের পরিপন্থী। বরং শাস্তির ব্যাপারে বিষয়টি এর বিপরীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে ক্ষমা প্রদর্শন এবং যতটুকু সম্ভব শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার বিষয়টি দায়িত্বের মধ্যে এসে যায়। এমন কি সন্দেহের দ্বারা শাস্তি বাতিল হয়ে যায়। তিন থেকে দশ নিরহাম পর্যন্ত সন্দেহ থেকে যায় এবং ক্ষমা ও শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকার কারণ দশ নিরহামের উপর সীমাবদ্ধ। এরপর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।