মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

৪. নামায অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬৭
সূর্যগ্রহণের নামায
১৬৭। হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, নবী (ﷺ)-এর পুত্র হযরত ইবরাহীম (রাযিঃ)-এর ইনতিকালের দিন সূর্য গ্রহণ হয় (লোকজন বলতে থাকে যে, হযরত ইবরাহীমের ইনতিকালের কারণেই সূর্য গ্রহণ লেগেছে)। নবী করীম (ﷺ) নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে যান এবং এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে (قيام) থাকেন যে, যার ফলে লোকজন মনে করেন তিনি রুকূ' করবেন না। অতঃপর তিনি রুকূ'র মধ্যে কিয়ামের (قيام) মত দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। এরপর রুকূ' থেকে পবিত্র মাথা উত্তোলন করেন এবং রুকূর মত দীর্ঘক্ষণ কিয়াম করেন। অতঃপর সিজদা করেন এবং কিয়ামের মত দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। এরপর তিনি বসেন এবং এই দু'সিজদার মধ্যে বসায় সিজদার মত দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। অতঃপর বসার ন্যায় দীর্ঘক্ষণ সিজদা করেন। এরপর প্রথম রাকাআতের ন্যায় দ্বিতীয় রাকাআত আদায় করেন এবং দ্বিতীয় রাকাআতের সিজদায় গিয়ে তিনি তীব্রভাবে কাঁদতে থাকেন। আমরা তাঁকে এই বলতে শুনেছি যে, হে আল্লাহ্! তুমি কি আমার নিকট এই ওয়াদা করনি যে, তুমি তাদেরকে আযাব দেবে না যতক্ষণ আমি তাদের মধ্যে অবস্থান করি। অতঃপর তিনি বসেন এবং তাশাহহুদ পাঠ করেন। এরপর নামায শেষ করেন এবং আমাদের দিকে মুখ করে ইরশাদ করেন : সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ আল্লাহর চিহ্ন ও প্রমাণসমূহের মধ্যে একটি প্রমাণ। আল্লাহ্ এরদ্বারা তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়ে থাকেন। কারে মৃত্যু বা জন্মের কারণে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ হয় না। সুতরাং এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হলে নামায আদায় কর (এবং আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর)। নিঃসন্দেহে আমি দেখেছি, বেহেশত আমার এমনি নিকটবর্তী করা হয়েছিল যে, যদি আমি ইচ্ছে করতাম তা হলে এর বৃক্ষসমূহের কোন এক বৃক্ষের ডাল আমার দিকে নিয়ে আসতে পারতাম। আবার আমি দেখেছি, দোযখ আমার এমন নিকটবর্তী করা হয়েছিল যে, আমি এর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছি। এছাড়া আমি দেখেছি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর চোর (অর্থাৎ যারা তাঁর লাশ চুরি করতে চেয়েছিল) অন্য রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, আমি রাসূলের ঘরের চোরকে শাস্তি দিতে দেখেছি। আমি আরো দেখেছি, আব্দা ইবনে দা'দা" (عبد بن دعدع) নামক এক ব্যক্তিকে, যে হাজীদের কাপড় ইত্যাদি তার বাঁকা লাকড়ির দ্বারা চুরি করেছে, আমি আরো দেখেছি যে, হিমায়ার গোত্রের একজন সুন্দরী মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কারণ সে ঐ বিড়ালটি বেঁদে রেখেছিল, এটাকে কোন খাদ্যও দেয়নি আবার ছেড়েও দেয়নি যাতে বিড়ালটি মাটি থেকে পোকা-মাকড় খেতে পারে।
অন্য এক রিওয়ায়েতে একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে, এতে বর্ণিত আছে, আমি আব্দা ইবনে দা'দা' নামক এক ব্যক্তিকে দেখেছি যে তার বাঁকা লাঠি দ্বারা হাজীদের কাপড় চুরি করে থাকে। যদি কেউ না দেখে, তা হলে উড়িয়ে নিয়ে যায়। যদি কেউ দেখে ফেলে, তা হলে বলে, আমার বাঁকা লাঠির সাথে এটা আটকিয়ে গেছে।
অন্য এক রিওয়ায়েতে আছে, যদি কোন বস্তু কারো দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে যেত, তখন সে তা নিয়ে যেত এবং যখন তা কেউ দেখে ফেলত, তখন বলত, এটা আমার লাঠির সাথে আটকে গেছে।
عَنْ عَطَاءِ بْنِ السَّائِبِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ ابْنِ عَمْرٍو، قَالَ: انْكَسَفَتِ الشَّمْسُ يَوْمَ مَاتَ إِبْرَاهِيمُ ابْنُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ النَّاسُ: انْكَسَفَتِ الشَّمْسُ لِمَوْتِ إِبْرَاهِيمَ، فَقَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قِيَامًا طَوِيلًا حَتَّى ظَنُّوا أَنَّهُ لَا يَرْكَعُ، ثُمَّ رَكَعَ، فَكَانَ رُكُوعُهُ قَدْرَ قِيَامِهِ، ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ، فَكَانَ قِيَامُهُ قَدْرَ رُكُوعِهِ، ثُمَّ سَجَدَ قَدْرَ قِيَامِهِ، فَكَانَ جُلُوسُهُ بَيْنَ السَّجْدَتَيْنِ قَدْرَ سُجُودِهِ، ثُمَّ سَجَدَ قَدْرَ جُلُوسِهِ، ثُمَّ صَلَّى الرَّكْعَةَ الثَّانِيَةَ، فَفَعَلَ مِثْلَ ذَلِكَ حَتَّى إِذَا كَانَتِ السَّجْدَةُ مِنْهَا، بَكَى، فَاشْتَدَّ بُكَاؤُهُ، فَسَمِعْنَا، وَهُوَ يَقُولُ: " أَلَمْ تَعِدْنِي أَنْ لَا تُعَذِّبْهُمْ وَأَنَا فِيهِمْ، ثُمَّ جَلَسَ فَتَشَهَّدَ، ثُمَّ انْصَرَفَ وَأَقْبَلَ عَلَيْهِمْ بِوَجْهِهِ، ثُمَّ قَالَ: «إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ، يُخَوِّفُ اللَّهُ تَعَالَى بِهِمَا عِبَادَهُ لَا يَكْسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلَا لِحَيَاتِهِ، فَإِذَا كَانَ كَذَلِكَ، فَعَلَيْكُمْ بِالصَّلَاةِ، وَلَقَدْ رَأَيْتُنِي أُدْنِيتُ مِنَ الْجَنَّةِ حَتَّى لَوْ شِئْتُ أَنْ أَتَنَاوَلَ غُصْنًا مِنْ أَغْصَانِ شَجَرِهَا فَعَلْتُ، وَلَقَدْ رَأَيْتُنِي أُدْنِيتُ مِنَ النَّارِ حَتَّى جَعَلْتُ أَتَّقِي، وَلَقَدْ رَأَيْتُ فِيهَا سَارِقَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» ، وَفِي رِوَايَةٍ: «سَارِقَ بَيْتِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعَذَّبُ بِالنَّارِ، وَلَقَدْ رَأَيْتُ فِيهَا عَبْدَ بْنِ دَعْدَعٍ سَارِقَ الْحُجَّاجِ بِمِحْجَنِهِ، وَلَقَدْ رَأَيْتُ فِيهَا امْرَأَةً أَدْمَاءَ حِمْيَرِيَّةً تُعَذَّبُ فِي هِرَّةٍ لَهَا رَبَطَتْهَا، فَلَمْ تُطْعِمْهَا، وَلَمْ تَدَعْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الْأَرْضِ وَحَشَرَاتِهَا» .
وَفِي رِوَايَةٍ نَحْوُهُ.
وَفِيهِ: " لَقَدْ رَأَيْتُ عَبْدَ بْنِ دَعْدَعٍ سَارِقَ الْحَاجَّ بِمِحْجَنِهِ، فَكَانَ إِذَا خَفَى ذَهَبَ، وَإِذَا رَآهُ أَحَدٌ، قَالَ: إِنَّمَا تَعَلَّقَ بِمِحْجَنِي ".
وَفِي رِوَايَةٍ: " كَانَ إِذَا خَفِيَ لَهُ شَيْءٌ، وَإِذَا ظَهَرَ عَلَيْهِ، قَالَ: إِنَّمَا تَعَلَّقَ بِمِحْجَنِي

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কুসুফের নামায আদায়ের পদ্ধতি অর্থাৎ প্রতি রাকাআতে এক রুকূ' অথবা দুরুত্ব আদায় করতে হবে এটা নিয়ে হযরত ইমাম শাফিঈ (র), ইমাম মালিক (র) এবং ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফিঈ ও ইমাম মালিক (র)-এর মতে প্রতি রাকাআতে দু'টি রুকূ' আদায় করতে হবে। ইমাম আবূ হানীফা (র) অন্যান্য নামাযের মত প্রতি রাকাআতে একটি রুকূ' আদায় করার পক্ষে মতামত পেশ করেছেন। ইমাম শাফিঈ (র) ও ইমাম মালিক (র) সিহাহ সিত্তাহ গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত রুকুর সংখ্যা সম্পর্কিত এই হাদীসে দ্বিধা ও সংশয় রয়েছে। যার ফলে এই হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন হযরত আয়েশা (রা) থেকে দু' এবং তিন রুকুর কথাই হাদীসে বর্ণিত আছে। হযরত জাবির (রা) থেকে দু এবং তিন রুকুর কথা বর্ণিত আছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে চার রুকু রিওয়ায়েত বর্ণিত আছে, হযরত উবাই (রা) থেকে পাঁচ রুকুর কথা হাদীসে বর্ণিত আছে। সুতরাং হযরত ইমাম আবূ হানীফা (র) বাধ্য হয়ে হুযুর (সা)-এর বর্ণনা ও আমলের ( قولى و فعلى) সাথে সংযুক্ত ঐ সমস্ত রিওয়ায়েত গ্রহণ করেছেন, কিয়াসের সাথেও যার মিল রয়েছে। قولى হাদীস নাসাঈ শরীফে হযরত নু'মান ইবনে বশীর (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেনঃ إذا خسفت الشمس والقمر فصلوا كأحدث صلاة صليتموها من المكتوبة "যখন সূর্য অথবা চন্দ্ৰ গ্রহণ হয়, তখন তোমরা এরূপভাবে নামায পড় যেরূপ তোমরা কিছুক্ষণ পূর্বে (ফজর) নামায় আদায় করেছ।” কেননা হযরত সামুরা (রা) বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী এমন সময় গ্রহণ লেগেছিল যখন সূর্য দু'বর্শা পরিমাণ উপরে উঠেছিল। فعلى হাদীস হিসেবেও এই হাদীস দলীল রূপে পেশ করা হয়েছে। কেননা এতে এক রুকুর কথা প্রমাণিত আছে। এরপর সম্ভবত অত্যাধিক কারণে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। হুযূর (সা) যেহেতু রুকুর মধ্যে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেছেন, তখন সামনের কাতারের লোকজন ধোকায় পড়ে রুকু থেকে মাথা উঠিয়ে ফেলেন, তাদেরকে মেখে পিছনের কাতারের লোকজনও একই পন্থা অবলম্বন করেন। অতঃপর সামনের কাতারের লোকজন যখন দেখতে পান যে, হুযুর (সা) এখনো রুকূতে অবস্থান করছেন, তখন তাঁরা পুনরায় করতে ফিরে যান। তখন পিছনের কাতারের লোকজনও একইভাবে পুনরায় রুকূ করেন। অত্যধিক ভীলো কারণে এরূপ হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান