মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ
৪. নামায অধ্যায়
হাদীস নং: ১৫০
সফরে (ভ্রমণে) নামায কসর করা
১৫০। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) সফরে দু'রাকাআত পড়তেন এবং হযরত আবু বকর (রাযিঃ) ও উমর (রাযিঃ) এর উপর অতিরিক্ত কিছু করতেন না।
عَنْ حَمَّادٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: «كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصلِّي فِي السَّفَرِ رَكْعَتَيْنِ، وَأَبُو بَكْرٍ، وَعُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، لَا يَزِيدُونَ عَلَيْهِ»
হাদীসের ব্যাখ্যা:
উপরোক্ত হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী মাসয়ালা হলো এই যে, মুসাফির (ভ্রমণকারী) সফরের সময় চার রাকাআত বিশিষ্ট নামায কসর অর্থাৎ দু'রাকাআত পড়বে। এই মাসয়ালা নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য হলো এই যে, সফরের সময় চার রাকাআত পড়ার অধিকার আছে কি না? যদি চার রাকাআত আদায় করে, তবে এই আমল কি হিসেবে গণ্য হবে? ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে এটা ঐ ব্যক্তির ইচ্ছা, তিনি চার রাকাআত পড়তে পারেন, আবার দু'রাকাআতও পড়তে পারেন। এক রিওয়ায়েত ইমাম মালিক (র) ও ইমাম আহমদ (র) এই মত পোষণ করেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেনঃ মুসাফিরের চার রাকাআত আদায় করার কোন অধিকার নেই। কসর ব্যতীত তার জন্য অন্য কোন উপায় জায়েয নয়। যদি চার রাকাআত আদায় করে, তা হলে গুনাহগার হবে এবং তা মাকরূহ তাহরীমি বলে গণ্য হবে।
ইমাম শাফিঈ (র) দলীল হিসেবে পবিত্র কুরআনের এই আয়াত পেশ করেন فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ “তোমাদের উপর কোন গুনাহ নেই যদি তোমরা নামাযে কসর কর।" এ আয়াতে অনুমতি ও ব্যক্তিগত ইচ্ছার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ কসর পড়ুক অথবা চার রাকাআত পড়ুক এতে মুসাফিরের উপর কোন বাধ্য-বাধকতা নেই। তিনি হযরত আলী ইবনে রবীআ (রা)-এর হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করে বলেন তিনি হযরত উমর (রা)-এর নিকট বলেনঃ এখন তো শত্রুর ভয় নেই, সুতরাং আমরা এখন কেন কসর পড়ব? কেননা আয়াত বলা হয়েছে إِنْ خِفْتُمْ (যদি তোমাদের ভয় হয়)। হযরত উমর (রা) বলেন : আমার মনেও এই প্রশ্ন জেগেছিল। তাই আমি এ ব্যাপারে হুযুর (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন: এটা এক প্রকার অনুগ্রহ যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে দান করা হয়েছে। তোমরা এটা গ্রহণ কর। এছাড়া তিনি এটা রোযার উপর কিয়াস করেছেন। রোযা রাখা ও না রাখার ব্যাপারে মুসাফিরকে অনুমতি ও সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সুতরাং নামাযের ব্যাপারেও তাই হবে। এ পর্যায়ে তিনি স্বীয় মতামতের স্বপক্ষে হযরত উসমান (রা)-এর একটি হাদীস পেশ করেন। তিনি মুসাফির অবস্থায় মিনায় চার রাকাআত নামায আদায় করেন। দ্বিতীয় হাদীস হযরত আয়েশা (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি সফরে কসর না পড়ে চার রাকাআত আদায় করেন।
ইমাম আবূ হানীফা (র) স্বীয় মাযহাবের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে কয়েকটি সহীহ হাদীস পেশ করেছেন। প্রথমতঃ মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির (র)-এর সূত্রে হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি হুযূর (সা)-এর সাথে যুল- হুলায়ফাতে নামায কসর করে পড়েছেন। ইমাম তিরমিযী এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দ্বিতীয়তঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর হাদীস এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা পেশ করেছে। এই হাদীস অন্যান্য সহীহ হাদীস গ্রন্থেও বিদ্যমান রয়েছে। যখন তাঁর নিকট বলা হলো যে, হযরত উসমান (রা) মিনাতে চার রাকাআত নামায আদায় করেছেন। তিনি তখন انا لله পাঠ করেন এবং বলেন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে দু'রাকাআত পড়েছি। হযরত আবূ বকর (রা) এবং হযরত উমর (রা)-এর সাথেও দু'রাকাআত পড়েছি। মোট কথা তিনি খুব হতবাক হলেন। শরীয়তের আহকাম সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) যে জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, এতে তিনি যদি কোন ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করেন, তা হলে এটা স্বাভাবিকভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর অবস্থা কি? অতঃপর তিনি আঁ হযরত (সা) এবং হযরত আবূ বকর (র) ও হযরত উমর (রা)-এর আমদের কথাও উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় দলীল হিসেবে বুখারী শরীফে উদ্ধৃত, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন। এই হাদীসে হুজুর (সা)-এর সাথে হযরত আবু বকর (রা) এবং এবং হযরত উমর (রা)-এর আমলের কথা উল্লেখ করে বলেন আমি তাঁদের সাথে মিনায় নামায পড়েছি। তাঁরা দু-দু'রাকাজাত করে (কসর) পড়েছেন। তিনি আরো বর্ণনা করেন, হযরত উসমান (রা) খিলাফতের প্রথম যুগে কসর পড়েছেন, এরপর চার রাকাআত পড়েছেন। চতুর্থ দলীল হিসেবে তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন। এই হাদীসকে তিনি সহীহ বলেছেন। হাদীসের বিষয়বস্তু হলো এই যে, তাঁকে মুসাফিরের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হজ্জ করেছি। তিনি এ সময় দু'রাকাআত নামায পড়েছেন (কসর পড়েছেন)। হযরত আবূ বকর (রা)-এর সাথে হজ্জ আদায় করেছি, তিনিও দু'রাকাআত আদায় করেছেন। পঞ্চম দলীল হিসেবে ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত মরফূ' (مرفوع) হাদীস পেশ করেছেন। উক্ত হাদীসে বর্ণিত আছে, হুযুর (সা) যখন মদীনা থেকে বাইরে গমন করতেন, তখন ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি চার রাকাআত বিশিষ্ট নামায দু'রাকাআত আদায় করতেন। সুতরাং সহীহ হাদীসসমূহে আঁ হযরত (সা), হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর পক্ষ থেকে অব্যাহত আমলের প্রমাণ বহন করে। এটা অস্বীকারের কোন অবকাশ নেই। এর প্রমাণ হিসেবে আরো বলা যায় যে, সফরে দু'রাকাআত সুন্নত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। সুতরাং শরীয়ত যখন এটাকে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহর মর্যাদা দান করেছে, তাই এর অতিরিক্ত কিছু করা জায়েয হবে না। বস্তুত এর উপর অতিরিক্ত বা বেশি নামায এরূপ হবে যেমন কেউ জুমুআ' এবং ঈদের নামায দু'রাকাআতের পরিবর্তে চার রাকাআত আদায় করে। নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে আবী লায়লা হযরত ইবনে উমর (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, সফরের নামায, ঈদুল আযহার নামায, ঈদুল ফিতরের নামায এবং জুমুআর নামায দু'রাকাআত দু'রাকাআত । হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে সহীহ রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, من صلى في السفر اربعا كمن صلى فى الحضر ركعتين "যে ব্যক্তি সফরে চার রাকাআত নামায পড়ে, সে যেন বাড়িতে অবস্থানের সময় (চার রাকাআতের পরিবর্তে) দু'রাকাআত আদায় করল।" মোট কথা সে উভয় ক্ষেত্রেই শরীয়তের বিধান লংঘন করল।
এবার শাফিঈ মাযহাবের উপর একটু আলোচনা প্রয়োজন। তাঁদের মাযহাবের ভিত্তি হলো এই যে, ফরয মূলত চার রাকাআত কিন্তু সফরে তা একটু সহজ করে দু'রাকাআত করে দেওয়া হয়েছে এবং মুসাফিরকে এই সুযোগ গ্রহণ করা বা না করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা সহীহ রিওয়ায়েত ও বাস্তবতা বিরোধী। কেননা নামায প্রথমত দু'রাকাআত হিসেবে ফরয ছিল। অতঃপর স্থায়ী বাসস্থানে (حضر) দু'রাকাআতের সাথে আরো দু'রাকাআত যুক্ত করে পূর্ণ চার রাকাআত করে দেওয়া হয়েছে এবং সফরে পূর্ববর্তী দু'রাকাআত ফরয বাকী রয়েছে। এই মতের স্বপক্ষে বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস পেশ করা হয়েছে الصلوة أول ما فرصت ركعتان فاقرت صلوة السفر ركعتان واتممت صلوة الحضر "প্রথমত দু'রাকাআত নামায ফরয় হয়েছিল। অতঃপর সফরে দু'রাকাআত স্থায়ী থাকে এবং স্থায়ী বাসস্থান (حضر) নামায় চার রাকাআত হয়ে যায়। নাসাঈ শরীফে সহীহ সনদের সাথে হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে صلوة السفر ركعتان تمام غير قصر على لسان نبيكم - ص “তোমাদের নবী (সা)-এর বাণী অনুযায়ী কসর ব্যতীত সফরের নামায দু'রাকাআত”। মুসলিম শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তোমাদের নবী (সা)-এর বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের উপর বাসস্থানে চার রাকাআত, সফরে দু'রাকাআত এবং ভয় ও আশংকার (خوف) অবস্থায় এক রাকাআত ফরয করেছেন। সুতরাং উপরোক্ত দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শাফিঈ মাযহাবের দলীল সঠিক নয়।
এবার প্রশ্ন হতে পারে যে, হযরত উসমান (রা) মিনায় কেন চার রাকাআত পড়লেন এবং হযরত আয়েশা (রা) সফরে কেন পূর্ণ চার রাকাআত আদায় করেন? এর জওয়াব হলো এই যে, হজ্জ সমাপনের পর হযরত উসমান (রা) সেখানে অবস্থানের নিয়্যত করেন এবং এই অবস্থানকে তিনি বাসস্থান (وطن) হিসেবে গণ্য করেছেন। বাসস্থানে অবস্থান করলে কসর পরিত্যাগ করে পূর্ণ চার রাকাআত পড়তে হয়। যেমন আবদুর রায্যাক (র) এরূপ বর্ণনা করেছেন। এছাড়া ইমাম আহমদ (র) এই ঘটনা বর্ণনা করে বলেন যে, যখন তাঁর এই আমলের উপর লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেন, তখন তিনি ওজর পেশ করে বলেনঃ আমি হুযূর (সা)-কে এটা বলতে শুনেছিঃ من تأهل في بلد فليصل صلوة المقيم"যখন কেউ কোন শহরে অবস্থান করে এবং পরিবারবর্গ নিয়ে বসবাস শুরু করে, তখন সে যেন মুকীম (مقيم) বা স্থায়ী বাসিন্দার মত নামায আদায় করবে।" অথবা হযরত উসমান (রা) হয়ত পূর্ণ ও কসর (اتمام و قصر) উভয় মত পোষণ করতেন। যেমন প্রায় এই ধারণা হযরত আয়েশা (রা) পোষণ করতেন। ইমাম যুহরী বলেনঃ হযরত উরওয়া (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত আয়েশা (রা) সফরে কেন চার রাকাআত পড়তেন? হযরত উরওয়াহ্ (রা) বলেনঃ তিনি এই বিষয়ে ঐ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা হযরত উসমান (রা) পোষণ করতেন। আমরা বলব, রাসূলুল্লাহ (সা) এবং হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) থেকে যখন কসরের উপর স্থায়ী ও অব্যাহত আমল প্রমাণিত হয়েছে, তাই এটাই মাযহাবের ভিত্তি হওয়া উচিত। যদি এ পর্যায়ে কোন সহীহ, হাসান, যঈফ হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণ করা হতো যে, হুযূর (সা) সফরে পূর্ণ চার রাকাআত পড়েছেন, তা হলে এটা মেনে নেওয়া যেত যে, বিরোধী পক্ষের মাযহাবের একটি ভিত্তি রয়েছে। সুতরাং সফর ব্যতীত যেহেতু এর অন্য কোন প্রমাণ নেই, তাই বাধ্য হয়ে এটাই মানতে হবে যে, সফরে পূর্ণ চার রাকাআত পড়া মাকরূহ।
বুদ্ধি ও বিবেকের দৃষ্টিতেও ইমাম শাফিঈ (র)-এর মাযহার সঠিক নয়। কেননা তিনি সফরে যে অতিরিক্ত দু'রাকাআতের কথা বলেছেন তা কি ফরয? তাঁদের মতানুযায়ী যদি তা ফরয হয় তা হলে তা আদায় করা কেন ওয়াজিব করা হয়নি ? ইচ্ছার উপর কেন এর ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে?
এমনিভাবে প্রত্যেক ফরযের কাযা রয়েছে, কিন্তু এই অতিরিক্ত দু'রাকাআতের কাযা নেই কেন? প্রত্যেক ফরয ত্যাগ করা গুনাহের কাজ, কিন্তু এ দু'রাকাত ত্যাগ করলে কেন গুনাহ হয় না? কিরূপ ফরয যার মধ্যে ফরযের কোন চিহ্ন নেই। বরং এই সমস্ত নীতি বা নিদর্শন নফলের মধ্যে বিদ্যমান। এরদ্বারা নামাযকে রোযার উপর অনুমান করার বিষয়টি বাতিল হয়ে যায়। কেননা রোযা যদিও অধিকার বা ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এতে কাযা রয়েছে, অথচ নামাযে তা নেই। সুতরাং এই অতিরিক্ত দু'রাকাআতকে কিভাবে ফরয মেনে নেওয়া যায়?
এবার পবিত্র কুরআনের আয়াত فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ -এর মধ্যে কিছু সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, কসর করা অথবা না করার মধ্যে তাকে অধিকার দেওয়া হয়েছে; বরং প্রকৃতপক্ষে এই বাক্য এইজন্য বৃদ্ধি করা হয়েছে যাতে এই সন্দেহ সৃষ্টি না হয় যে, বাসস্থানের নামাযে কিছু হ্রাস পেয়েছে এবং চার রাকাআতের স্থলে দু'রাকাআত অবশিষ্ট রয়েছে; বরং এটা পৃথক ফরয এবং বাসস্থানের (حضر) এই পূর্ণ নামায অর্ধেক নয় যে, এটাতে গুনাহের আশংকা করবে।
ইমাম শাফিঈ (র) দলীল হিসেবে পবিত্র কুরআনের এই আয়াত পেশ করেন فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ “তোমাদের উপর কোন গুনাহ নেই যদি তোমরা নামাযে কসর কর।" এ আয়াতে অনুমতি ও ব্যক্তিগত ইচ্ছার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ কসর পড়ুক অথবা চার রাকাআত পড়ুক এতে মুসাফিরের উপর কোন বাধ্য-বাধকতা নেই। তিনি হযরত আলী ইবনে রবীআ (রা)-এর হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করে বলেন তিনি হযরত উমর (রা)-এর নিকট বলেনঃ এখন তো শত্রুর ভয় নেই, সুতরাং আমরা এখন কেন কসর পড়ব? কেননা আয়াত বলা হয়েছে إِنْ خِفْتُمْ (যদি তোমাদের ভয় হয়)। হযরত উমর (রা) বলেন : আমার মনেও এই প্রশ্ন জেগেছিল। তাই আমি এ ব্যাপারে হুযুর (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন: এটা এক প্রকার অনুগ্রহ যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে দান করা হয়েছে। তোমরা এটা গ্রহণ কর। এছাড়া তিনি এটা রোযার উপর কিয়াস করেছেন। রোযা রাখা ও না রাখার ব্যাপারে মুসাফিরকে অনুমতি ও সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সুতরাং নামাযের ব্যাপারেও তাই হবে। এ পর্যায়ে তিনি স্বীয় মতামতের স্বপক্ষে হযরত উসমান (রা)-এর একটি হাদীস পেশ করেন। তিনি মুসাফির অবস্থায় মিনায় চার রাকাআত নামায আদায় করেন। দ্বিতীয় হাদীস হযরত আয়েশা (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি সফরে কসর না পড়ে চার রাকাআত আদায় করেন।
ইমাম আবূ হানীফা (র) স্বীয় মাযহাবের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে কয়েকটি সহীহ হাদীস পেশ করেছেন। প্রথমতঃ মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির (র)-এর সূত্রে হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি হুযূর (সা)-এর সাথে যুল- হুলায়ফাতে নামায কসর করে পড়েছেন। ইমাম তিরমিযী এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দ্বিতীয়তঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর হাদীস এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা পেশ করেছে। এই হাদীস অন্যান্য সহীহ হাদীস গ্রন্থেও বিদ্যমান রয়েছে। যখন তাঁর নিকট বলা হলো যে, হযরত উসমান (রা) মিনাতে চার রাকাআত নামায আদায় করেছেন। তিনি তখন انا لله পাঠ করেন এবং বলেন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে দু'রাকাআত পড়েছি। হযরত আবূ বকর (রা) এবং হযরত উমর (রা)-এর সাথেও দু'রাকাআত পড়েছি। মোট কথা তিনি খুব হতবাক হলেন। শরীয়তের আহকাম সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) যে জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, এতে তিনি যদি কোন ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করেন, তা হলে এটা স্বাভাবিকভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর অবস্থা কি? অতঃপর তিনি আঁ হযরত (সা) এবং হযরত আবূ বকর (র) ও হযরত উমর (রা)-এর আমদের কথাও উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় দলীল হিসেবে বুখারী শরীফে উদ্ধৃত, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন। এই হাদীসে হুজুর (সা)-এর সাথে হযরত আবু বকর (রা) এবং এবং হযরত উমর (রা)-এর আমলের কথা উল্লেখ করে বলেন আমি তাঁদের সাথে মিনায় নামায পড়েছি। তাঁরা দু-দু'রাকাজাত করে (কসর) পড়েছেন। তিনি আরো বর্ণনা করেন, হযরত উসমান (রা) খিলাফতের প্রথম যুগে কসর পড়েছেন, এরপর চার রাকাআত পড়েছেন। চতুর্থ দলীল হিসেবে তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন। এই হাদীসকে তিনি সহীহ বলেছেন। হাদীসের বিষয়বস্তু হলো এই যে, তাঁকে মুসাফিরের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হজ্জ করেছি। তিনি এ সময় দু'রাকাআত নামায পড়েছেন (কসর পড়েছেন)। হযরত আবূ বকর (রা)-এর সাথে হজ্জ আদায় করেছি, তিনিও দু'রাকাআত আদায় করেছেন। পঞ্চম দলীল হিসেবে ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত মরফূ' (مرفوع) হাদীস পেশ করেছেন। উক্ত হাদীসে বর্ণিত আছে, হুযুর (সা) যখন মদীনা থেকে বাইরে গমন করতেন, তখন ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি চার রাকাআত বিশিষ্ট নামায দু'রাকাআত আদায় করতেন। সুতরাং সহীহ হাদীসসমূহে আঁ হযরত (সা), হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর পক্ষ থেকে অব্যাহত আমলের প্রমাণ বহন করে। এটা অস্বীকারের কোন অবকাশ নেই। এর প্রমাণ হিসেবে আরো বলা যায় যে, সফরে দু'রাকাআত সুন্নত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। সুতরাং শরীয়ত যখন এটাকে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহর মর্যাদা দান করেছে, তাই এর অতিরিক্ত কিছু করা জায়েয হবে না। বস্তুত এর উপর অতিরিক্ত বা বেশি নামায এরূপ হবে যেমন কেউ জুমুআ' এবং ঈদের নামায দু'রাকাআতের পরিবর্তে চার রাকাআত আদায় করে। নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে আবী লায়লা হযরত ইবনে উমর (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, সফরের নামায, ঈদুল আযহার নামায, ঈদুল ফিতরের নামায এবং জুমুআর নামায দু'রাকাআত দু'রাকাআত । হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে সহীহ রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, من صلى في السفر اربعا كمن صلى فى الحضر ركعتين "যে ব্যক্তি সফরে চার রাকাআত নামায পড়ে, সে যেন বাড়িতে অবস্থানের সময় (চার রাকাআতের পরিবর্তে) দু'রাকাআত আদায় করল।" মোট কথা সে উভয় ক্ষেত্রেই শরীয়তের বিধান লংঘন করল।
এবার শাফিঈ মাযহাবের উপর একটু আলোচনা প্রয়োজন। তাঁদের মাযহাবের ভিত্তি হলো এই যে, ফরয মূলত চার রাকাআত কিন্তু সফরে তা একটু সহজ করে দু'রাকাআত করে দেওয়া হয়েছে এবং মুসাফিরকে এই সুযোগ গ্রহণ করা বা না করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা সহীহ রিওয়ায়েত ও বাস্তবতা বিরোধী। কেননা নামায প্রথমত দু'রাকাআত হিসেবে ফরয ছিল। অতঃপর স্থায়ী বাসস্থানে (حضر) দু'রাকাআতের সাথে আরো দু'রাকাআত যুক্ত করে পূর্ণ চার রাকাআত করে দেওয়া হয়েছে এবং সফরে পূর্ববর্তী দু'রাকাআত ফরয বাকী রয়েছে। এই মতের স্বপক্ষে বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস পেশ করা হয়েছে الصلوة أول ما فرصت ركعتان فاقرت صلوة السفر ركعتان واتممت صلوة الحضر "প্রথমত দু'রাকাআত নামায ফরয় হয়েছিল। অতঃপর সফরে দু'রাকাআত স্থায়ী থাকে এবং স্থায়ী বাসস্থান (حضر) নামায় চার রাকাআত হয়ে যায়। নাসাঈ শরীফে সহীহ সনদের সাথে হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে صلوة السفر ركعتان تمام غير قصر على لسان نبيكم - ص “তোমাদের নবী (সা)-এর বাণী অনুযায়ী কসর ব্যতীত সফরের নামায দু'রাকাআত”। মুসলিম শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তোমাদের নবী (সা)-এর বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের উপর বাসস্থানে চার রাকাআত, সফরে দু'রাকাআত এবং ভয় ও আশংকার (خوف) অবস্থায় এক রাকাআত ফরয করেছেন। সুতরাং উপরোক্ত দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শাফিঈ মাযহাবের দলীল সঠিক নয়।
এবার প্রশ্ন হতে পারে যে, হযরত উসমান (রা) মিনায় কেন চার রাকাআত পড়লেন এবং হযরত আয়েশা (রা) সফরে কেন পূর্ণ চার রাকাআত আদায় করেন? এর জওয়াব হলো এই যে, হজ্জ সমাপনের পর হযরত উসমান (রা) সেখানে অবস্থানের নিয়্যত করেন এবং এই অবস্থানকে তিনি বাসস্থান (وطن) হিসেবে গণ্য করেছেন। বাসস্থানে অবস্থান করলে কসর পরিত্যাগ করে পূর্ণ চার রাকাআত পড়তে হয়। যেমন আবদুর রায্যাক (র) এরূপ বর্ণনা করেছেন। এছাড়া ইমাম আহমদ (র) এই ঘটনা বর্ণনা করে বলেন যে, যখন তাঁর এই আমলের উপর লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেন, তখন তিনি ওজর পেশ করে বলেনঃ আমি হুযূর (সা)-কে এটা বলতে শুনেছিঃ من تأهل في بلد فليصل صلوة المقيم"যখন কেউ কোন শহরে অবস্থান করে এবং পরিবারবর্গ নিয়ে বসবাস শুরু করে, তখন সে যেন মুকীম (مقيم) বা স্থায়ী বাসিন্দার মত নামায আদায় করবে।" অথবা হযরত উসমান (রা) হয়ত পূর্ণ ও কসর (اتمام و قصر) উভয় মত পোষণ করতেন। যেমন প্রায় এই ধারণা হযরত আয়েশা (রা) পোষণ করতেন। ইমাম যুহরী বলেনঃ হযরত উরওয়া (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত আয়েশা (রা) সফরে কেন চার রাকাআত পড়তেন? হযরত উরওয়াহ্ (রা) বলেনঃ তিনি এই বিষয়ে ঐ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা হযরত উসমান (রা) পোষণ করতেন। আমরা বলব, রাসূলুল্লাহ (সা) এবং হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) থেকে যখন কসরের উপর স্থায়ী ও অব্যাহত আমল প্রমাণিত হয়েছে, তাই এটাই মাযহাবের ভিত্তি হওয়া উচিত। যদি এ পর্যায়ে কোন সহীহ, হাসান, যঈফ হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণ করা হতো যে, হুযূর (সা) সফরে পূর্ণ চার রাকাআত পড়েছেন, তা হলে এটা মেনে নেওয়া যেত যে, বিরোধী পক্ষের মাযহাবের একটি ভিত্তি রয়েছে। সুতরাং সফর ব্যতীত যেহেতু এর অন্য কোন প্রমাণ নেই, তাই বাধ্য হয়ে এটাই মানতে হবে যে, সফরে পূর্ণ চার রাকাআত পড়া মাকরূহ।
বুদ্ধি ও বিবেকের দৃষ্টিতেও ইমাম শাফিঈ (র)-এর মাযহার সঠিক নয়। কেননা তিনি সফরে যে অতিরিক্ত দু'রাকাআতের কথা বলেছেন তা কি ফরয? তাঁদের মতানুযায়ী যদি তা ফরয হয় তা হলে তা আদায় করা কেন ওয়াজিব করা হয়নি ? ইচ্ছার উপর কেন এর ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে?
এমনিভাবে প্রত্যেক ফরযের কাযা রয়েছে, কিন্তু এই অতিরিক্ত দু'রাকাআতের কাযা নেই কেন? প্রত্যেক ফরয ত্যাগ করা গুনাহের কাজ, কিন্তু এ দু'রাকাত ত্যাগ করলে কেন গুনাহ হয় না? কিরূপ ফরয যার মধ্যে ফরযের কোন চিহ্ন নেই। বরং এই সমস্ত নীতি বা নিদর্শন নফলের মধ্যে বিদ্যমান। এরদ্বারা নামাযকে রোযার উপর অনুমান করার বিষয়টি বাতিল হয়ে যায়। কেননা রোযা যদিও অধিকার বা ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এতে কাযা রয়েছে, অথচ নামাযে তা নেই। সুতরাং এই অতিরিক্ত দু'রাকাআতকে কিভাবে ফরয মেনে নেওয়া যায়?
এবার পবিত্র কুরআনের আয়াত فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ -এর মধ্যে কিছু সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, কসর করা অথবা না করার মধ্যে তাকে অধিকার দেওয়া হয়েছে; বরং প্রকৃতপক্ষে এই বাক্য এইজন্য বৃদ্ধি করা হয়েছে যাতে এই সন্দেহ সৃষ্টি না হয় যে, বাসস্থানের নামাযে কিছু হ্রাস পেয়েছে এবং চার রাকাআতের স্থলে দু'রাকাআত অবশিষ্ট রয়েছে; বরং এটা পৃথক ফরয এবং বাসস্থানের (حضر) এই পূর্ণ নামায অর্ধেক নয় যে, এটাতে গুনাহের আশংকা করবে।
