মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

৪. নামায অধ্যায়

হাদীস নং: ৮৬
ইসফারের (পূবাকাশ পরিষ্কার হওয়ার) পর নামায আদায় করার ফযীলত
৮৬। হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ ভোরের (ফজরের) নামায ফর্সা হওয়ার পর আদায় কর। কারণ এতে অধিক সওয়াব রয়েছে।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «أَسْفِرُوا بِالصُّبْحِ، فَإِنَّهُ أَعْظَمُ لِلثَّوَابِ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীসের বিষয়বস্তু নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এখানে মাসয়ালাটি মূলত ভোরের (ফজরের) নামায সম্পর্কে। তিনজন ইমাম [(ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদ (র) ফজরের নামাযের ওয়াক্ত সম্পর্কে গালসের (غلس) কথা বলেছেন। ইমাম আযম আবূ হানীফা (র)-এর মতে ইসফার (اسفار) হল ফজর নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্ত। এখানে غلس অর্থ ভোরের এমনি একটি মুহূর্ত যখন চতুর্দিকে অন্ধকার বিরাজ করে। ফলে একজন তার পার্শ্বে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে চিনতে পারে না। উপরোক্ত হাদীসের اسفار শব্দটি ইমাম আবূ হানীফা (র) দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সিহাহ ছিত্তাহ কিতাবে একই অর্থে বিভিন্ন শব্দ প্রয়োগে এ হাদীসটি বর্ণিত আছে। হযরত রাফে ইবনে খাদীজা (রা) থেকে ইবনে মাজাহ শরীফে এক মরফূ' রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছেঃ أصبحوا بالصبح فإنه أعظم للأجر "পরিষ্কার হওয়ার পর (ভোরের অন্ধকার দূরীভূত হওয়ার পর) ফজরের নামায আদায় কর। কেননা এতে অধিক সওয়াব রয়েছে।”
আবূ দাউদ শরীফে একই হাদীস বর্ণিত আছে। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছেঃ اسفروا بالفجر فإنه أعظم للأجر “আলো স্পষ্ট ও পরিষ্কার হওয়ার পর ফজরের নামায আদায় কর। কেননা এতে অধিক সওয়াব রয়েছে।” ইমাম তিরমিযী (র) বলেন, রাফে' ইবনে খাদীজের এ হাদীস হাসান ও সহীহ (حسن و صحيح)। সাহাবা ও তাবিঈগণের মধ্যে অনেকেই এ মত পোষণ করেন। সুফিয়ান সওরী (র)-এর মাযহারও এটা। নাসাঈ, ইবনে হাব্বান এবং তিবরানী প্রায় এই বাক্য (الفاظ) দ্বারা এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। এছাড়া এ হাদীসের সমর্থনে কয়েকটি সহীহ হাদীসও রয়েছে। যেমন হযরত (সা) হযরত বিলাল (রা)-কে বললেন : ফজরের নামায ফর্সা হলে আদায় কর। যাতে আলোর কারণে মানুষ তাদের সিজদার স্থান দেখতে পায়। মুসান্নাফ নামক গ্রন্থে ইবনে আবী শায়বা এবং ইসহাক ও আবূ দাউদ (র) তাঁদের মুসনাদে এ হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন। এ বিতর্ক দূর করার জন্য বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হযরত ইবনে মাসউদ (রা)-এর হাদীস পেশ করা যায়। হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমি হুযুর (সা)-কে দু'টি নামায় ব্যতীত প্রত্যেক নামায ওয়াক্ত অনুযায়ী আদায় করতে দেখেছি। প্রথমত, মুযদালিফায় মাগরিব ও ইশা একত্রে আদায় করতেন আর দ্বিতীয়ত, মুযদালিফায় ফজরের নামায সাধারণ সময়ের পূর্বে অন্ধকারে (غلس) আদায় করতেন। কেননা মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে: قبل ميقاتها بغلس এটা হল এজন্য যে, অবস্থানের সময় অধিক মিলে থাকে।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) হুযূর (সা)-এর বিশেষ খাদিম ছিলেন। তিনি হুযূর (সা)-এর পারিবারিক, বাহ্যিক, সফর ও বাড়িতে দিবারাত্রি জীবনের অভ্যন্তরীণ খবর সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা) ফজর নামায ইসফারে (اسفار অর্থাৎ ফর্সা হলে) পড়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। সুতরাং এরপর এ বিষয়ে অন্য কারো সাক্ষীর প্রয়োজন আছে কি? এছাড়া শরহে মাআনিল আসার নামক গ্রন্থে হযরত ইবরাহীম নখঈ (র) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহাবাদের মধ্যে অন্য কোন বিষয়ে এরূপ ঐক্য সৃষ্টি হয়নি যেরূপ এ বিষয়ে সৃষ্টি হয়েছিল।
উপরে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মাযহাবের স্বপক্ষে দলীল পেশ করা হল। কিয়াসও এ মাযহাবের সমর্থন করে থাকে। কেননা যতদূর সম্ভব মুসল্লীদেরকে অধিক সংখ্যক জামাআতে অংশগ্রহণের সুযোগ দান করা উত্তম। জামাআতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না এরূপ সংক্ষিপ্ত সময় নির্ধারণ করা ঠিক নয়। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা) একবার নামাযে দীর্ঘ কিরআত পাঠ করেন। তখন হুযুর (সা) বলেনঃ أفتان يا معاذ হে মুআয! তুমি কি লোকদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি করছ? সুতরাং এই সমস্ত হাদীসের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, ফজরের নামায ফর্সা (اسفار) হলে পড়তে হবে, অন্ধকারে নয়।
এবার غلس শব্দের যে সমস্ত রিওয়ায়েত রয়েছে, তা বর্ণনা করা প্রয়োজন। যাঁরা ফজর غلس -এর সময় আদায় করার পক্ষে মত পোষণ করেন, তাঁরা সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। হাদীসে বর্ণিত আছে ।
اِنَّ رَسُولُ اللهِ صَلى الله عَلَيهِ وَسَلمَ لَيُصَلِّي الصُّبْحَ، فَيَنْصَرِفُ النِّسَاءُ مُتَلَفِّفَاتٍ بِمُرُوطِهِنَّ، مَا يُعْرَفْنَ مِنَ الْغَلَسِ
অর্থাৎ “হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) ফজর নামায আদায় করতেন তখন মহিলাগণ (জামাআত শেষে) তাদের চাদরে আবৃত হয়ে বাসায় ফিরে যেতেন। অন্ধকারের (غلس) কারণে তাদেরকে চেনা যেত না।" "চেনা যেত না'- এরদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তখন যথেষ্ট অন্ধকার থাকত। কিন্তু বাস্তবে চেনা না যাওয়ার দু'টি কারণ রয়েছে। প্রথমত, অন্ধকার হওয়া, দ্বিতীয়ত, চাদরে আবৃত হওয়া। যদি অন্ধকারের কারণেই চেনা না যেত, তাহলে বেশি অন্ধকারের প্রমাণ পাওয়া যেত। চাদরে আবৃত হলে সামান্য অন্ধকারেও চেনা না যাওয়ার কারণ হতে পারে এবং এটা সাধারণ ফর্সায় (اسفار)-ও হতে পারে। কেননা হানাফী মাযহাবমতে ফজর নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্ত হলো, এমন সময় নামায শুরু করতে হবে যাতে মুসল্লী ষাট থেকে একশ আয়াত নামাযে পড়তে পারে এবং এরপর যদি উযূ ভেঙ্গে যায়, তাহলে উক্ত পরিমাণ আয়াতের দ্বারা নামায পুনরায় আদায় করতে পারে।
অধিকন্তু এটা ঐ সময়ের ঘটনা যখন ইসলামের শুরুতে মহিলাদের জন্য মসজিদে জামাআতে নামায পড়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু যখন এটা রহিত হয়ে যায় এবং মহিলাদেরকে ঘরে নামায পড়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়, তখন সম্ভবত غلس-এর বিষয়টিও বাকী থাকেনি এবং সময়ের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত হয়। এ সমস্ত সন্দেহ দূরীভূত করার জন্য হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা)-এর রিওয়ায়েত সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। এছাড়া হযরত আয়েশা (রা)-এর হাদীস হলো আমলের সাথে জড়িত (فعلى) কিন্তু ইসফারের (اسفار) হাদীস বর্ণনাসূচক (قولى)। হানাফী মাযহাবমতে বর্ণনা (قول) -কে আমলের (فعل) উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে দু'টি হাদীসের মধ্যে এভাবে সমন্বয় করা যায় যে, غلس -এর অর্থ হলো হাল্কা অন্ধকার থাকা এবং اسفار -এর অর্থ হলো এরূপ ফর্সা হওয়া যাতে কিছু অন্ধকার বিদ্যমান থাকা যা غلس হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তবে যদি উভয়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়, তা হলে اسفار-কে প্রাধান্য দেওয়া হবে এবং ফজর নামায اسفار করে আদায় করা জায়েয হবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান