মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১. ঈমান-আকাঈদ অধ্যায়

হাদীস নং: ২৮
শাফাআতের বর্ণনা
২৮। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি হুযূর (ﷺ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! তাওহীদে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি কি জাহান্নামে বাকী থাকবে (অর্থাৎ মুসলমানদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করার পর)? হযরত (ﷺ) বললেনঃ হ্যা, এক ব্যক্তি বাকী থাকবে। জাহান্নামের অতল গহ্বরে একটি লোক ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান বলে চিৎকার করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে হযরত জিবরাঈল (আ) তার আওয়াজ শুনে হতবাক হয়ে বলবেন, আশ্চর্য! আশ্চর্য!! অতঃপর তিনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না এবং আরশের সামনে গিয়ে সিজদাবনত হয়ে পড়বেন। তখন আল্লাহ্ বলবেন, হে জিবরাঈল! মাথা উঠাও। তিনি মাথা উঠাবেন। আল্লাহ বলবেন, তুমি আশ্চর্যের কি প্রত্যক্ষ করলে ? অথচ আল্লাহ খুব ভালভাবে অবগত আছেন যা কিছু হযরত জিবরাঈল (আ) দেখেছেন।

তিনি বলবেন, হে প্রভু! আমি জাহান্নামের অতল গহ্বর থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কে যেন চিৎকার দিয়ে বলছে, ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান। এই আওয়াজ শুনে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। তখন আল্লাহ্ বলবেন, হে জিবরাঈল! তুমি জাহান্নামের দারোগার নিকট যাও এবং তাকে বল, যেন ঐ লোকটিকে বের করে দেয়, যে ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান বলে চিৎকার করছে। অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আ) জাহান্নামের কোন একটি দরওয়াজার নিকট গিয়ে খট্‌খট্ আওয়াজ দিবেন। তখন জাহান্নামের দারোগা তাঁর নিকট আগমণ করবেন এবং হযরত জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশ হয়েছে, ঐ বান্দা যে ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান' বলে চিৎকার করছে, তাকে বের করে দাও। তখন দারোগা ভিতরে প্রবেশ করবেন এবং তাকে খুঁজতে থাকবেন, কিন্তু তাকে পাবেন না। অথচ মা তার সন্তানকে ততটুকু চিনতে পারে না যতটুকু দারোগা জাহান্নামবাসীদেরকে চিনতে পারবেন।

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বাইরে এসে হযরত জিবরাঈল (আ)-এর নিকট বলবেন, জাহান্নাম এ মুহূর্তে এমন এক নিশ্বাস গ্রহণ করেছে যে, পাথর ও লোহা এবং লোহা ও মানুষের মধ্যে আমি পার্থক্য করতে পারছি না। হযরত জিবরাঈল (আ) ফিরে গিয়ে পুনরায় আরশের সামনে সিজদাবনত হবেন। তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেন, হে জিবরাঈল মাথা উঠাও। তুমি কি আমার বান্দাকে নিয়ে আসনি? তিনি বলবেন, প্রতিপালক জাহান্নামের দারোগা বলল যে, “জাহান্নাম এরূপ একটি নিশ্বাস গ্রহণ করেছে যায় ফলে আমি পাথর ও লোহা এবং লোহা ও মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারিনি।" তখন আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামের দারোগার নিকট গিয়ে বল, আমার বান্দা অমুক গর্ভের এরূপ কোটরে অবস্থান করছে।

হযরত জিবরাঈল গিয়ে দারোগাকে এ সংবাদ দিলে দারোগা ভিতরে প্রবেশ করে তাকে পায়ের সাথে কপাল, গলার সাথে হাত বাঁধা এবং সাপ-বিচ্ছু দ্বারা আক্রান্ত অবস্থায় দেখতে পাবেন। তখন দারোগা এমন জোরে হেঁচকা টান মারবেন যার ফলে সাপ-বিচ্ছু তার উপর থেকে পড়ে যাবে। দ্বিতীয়বার হেঁচকা টান মারবেন যার ফলে হাত-পা ও গলার সমস্ত বাঁধন ও বেড়ী খুলে যাবে। অতঃপর তাকে আগুন থেকে বের করে হায়াওয়ান নামক নহরে নিক্ষেপ করা হবে। সেখান থেকে বের করার পর হযরত জিবরাঈল (আ)-এর নিকট তাকে সোপর্দ করা হবে। তিনি তাকে কপালে ধরে নিয়ে যেতে থাকবেন এবং ফিরিশতাদের যে জামাআতের নিকট দিয়ে অতিক্রম করবেন। তারাই বলবেন, এ বান্দার জন্য আফসোস!

অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আ) আরশের সামনে গিয়ে সিজদাবনত হয়ে পড়বেন। তখন আল্লাহ্ বলবেন, হে জিবরাঈল! মাথা উঠাও। তিনি মাথা উঠাবেন। আল্লাহ বলবেন, হে আমার বান্দা! আমি কি তোমাকে সুন্দর আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করিনি? আমি কি তোমাদের নিকট পয়গম্বর প্রেরণ করিনি? তিনি কি তোমাকে আমার কিতাব তিলাওয়াত করে শোনান নি? সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে বাধা প্রদান করেন নি? ঐ ব্যক্তি তখন সবকিছুই স্বীকার করবে। আল্লাহ বলবেন, তাহলে তুমি এভাবে চিৎকার করছ কেন? তখন সে বলবে, হে প্রভু! আমি আমার জীবনের উপর যুলুম করেছি। যার শাস্তি হিসেবে আমি দীর্ঘদিন জাহান্নামে পড়ে আছি। কিন্তু আমি তোমার করুণা ও দয়ার আশা পরিত্যাগ করিনি। তাই তোমাকে ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান বলে ডাকছি। তুমি তোমার করুণা দ্বারা আমাকে জাহান্নাম থেকে বের করে এনেছ। সুতরাং আজ তুমি আমার উপর তোমার রহমতের বারিধারা বর্ষণ কর। তখন আল্লাহ্ তা'আলা ফিরিশতাদেরকে বলবেন, তোমরা সাক্ষী থাক, আমি এ বান্দার উপর রহমত ও অনুগ্রহ করলাম।
عَنْ حَمَّادٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَلْ يَبْقَى أَحَدٌ مِنَ الْمُوَحِّدِينَ فِي النَّارِ؟ قَالَ: " نَعَمْ، رَجُلٌ فِي قَعْرِ جَهَنَّمَ يُنَادِي بِالْحَنَّانِ الْمَنَّانِ، حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتَهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ، فَيَعْجَبُ مِنْ ذَلِكَ الصَّوْتِ، فَقَالَ: الْعَجَبَ الْعَجَبَ، ثُمَّ لَمْ يَصْبِرْ حَتَّي يَصِيرَ بَيْنَ يَدَيْ عَرْشِ الرَّحْمَنِ سَاجِدًا، فَيَقُولُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: ارْفَعْ رَأْسَكَ يَا جِبْرِيلُ، فَيَرْفَعُ رَأْسَهُ، فَيَقُولُ: مَا رَأَيْتُ مِنَ الْعَجَايِبِ؟ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا رَآهُ، فَيَقُولُ: يَا رَبُّ، سَمِعْتُ صَوْتًا مِنْ قَعْرِ جَهَنَّمَ يُنَادِي بِالْحَنَّانِ الْمَنَّانِ، فَتَعَجَّبْتُ مِنْ ذَلِكَ الصَّوْتُ، فَيَقُولُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: يَا جِبْرِيلُ، اذْهَبْ إِلَى مَالِكٍ، قُلْ لَهُ: أَخْرِجِ الْعَبْدَ الَّذِي يُنَادِي بِالْحَنَّانِ الْمَنَّانِ، فَيَذْهَبُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ إِلَى بَابٍ مِنْ أَبْوَابِ جَهَنَّمَ، فَيَضْرِبُهُ، فَيَخْرُجُ إِلَيْهِ مَالِكٌ، فَيَقُولُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ: إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى، يَقُولُ: أَخْرِجِ الْعَبْدَ الَّذِي يُنَادِي بِالْحَنَّانِ الْمَنَّانِ، فَيَدْخُلُ فَيَطْلُبُهُ، فَلَا يُوجَدُ، وَإِنَّ مَالِكًا أَعْرَفُ بِأَهْلِ النَّارِ مِنَ الْأُمِّ بِأَوْلَادِهَا، فَيَخْرُجُ، فَيَقُولُ لِجِبْرِيلَ: إِنَّ جَهَنَّمَ زَفَرَتْ زَفْرَةً لَا أَعْرِفُ الْحِجَارَةَ مِنَ الْحَدِيدِ، وَلَا الْحَدِيدَ مِنَ الرِّجَالِ، فَيَرْجِعُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ حَتَّى يَصِيرَ بَيْنَ يَدَيْ عَرْشِ الرَّحْمَنِ سَاجِدًا، فَيَقُولُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: ارْفَعْ رَأْسَكَ يَا جِبْرِيلُ، لِمَ لَمْ تَجِيءْ بِعَبْدِي؟ فَيَقُولُ: يَا رَبُّ، إِنَّ مَالِكًا يَقُولُ: إِنَّ جَهَنَّمَ قَدْ زَفَرَتْ زَفْرَةً لَا أَعْرِفُ الْحِجَارَةَ مِنَ الْحَدِيدِ، وَلَا الْحَدِيدَ مِنَ الرِّجَالِ، فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: قُلْ لِمَالِكٍ: إنَّ عَبْدِي فِي قَعْرِ كَذَا وَكَذَا، فِي سِرِّ كَذَا وَكَذَا.
وَفِي رِوَايَةٍ: كَذَا وَكَذَا، فَيَدْخُلُ جِبْرِيلُ فَيُخْبِرُهُ بِذَلِكَ، فَيَدْخُلُ مَالِكٌ، فَيَجِدُهُ مَطْرُوحًا مَنْكُوسًا مَشْدُودًا نَاصِيَتُهُ إِلَى قَدَمَيْهِ، وَيَداهُ إِلَى عُنُقِهِ، وَاجْتَمَعَتْ عَلَيْهِ الْحَيَّاتُ وَالْعَقَارِبُ، فَيَجْذِبُهُ حَتَّى تَسْقُطَ عَنْهُ الْحَيَّاتُ وَالْعَقَارِبُ، ثُمَّ يَجْذِبُهُ جَذْبَةً أُخْرَى حَتَّى تَنْقَطِعَ مِنْهُ السَّلَاسِلُ وَالْأَغْلَالُ، ثُمَّ يُخْرِجُهُ مِنَ النَّارِ، فَيُصَيِّرُهُ فِي مَاءِ الْحَيَاةِ وَيَدْفَعُهُ إِلَى جِبْرِيلَ، فَيَأْخُذُ بِنَاصِيَتِهِ وَيَمُدَّهُ مَدًّا، فَمَا يَمُرُّ بِهِ جِبْرِيلُ عَلَى مَلَأٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ إِلَّا وَهُمْ يَقُولُونَ: أُفٍّ لِهَذَا الْعَبْدِ، حَتَّى يَصِيرَ بَيْنَ يَدَيْ عَرْشِ الرَّحْمَنِ سَاجِدًا، فَيَقُولُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: ارْفَعْ رَأْسَكَ يَا جِبْرِيلُ، وَيَقُولُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: عَبْدِي أَلَمْ أَخْلُقْكَ بِخَلْقٍ حَسَنٍ؟ أَلَمْ أُرْسِلْ إِلَيْكَ رَسُولًا؟ أَلَمْ يُقْرَأْ عَلَيْكَ كِتَابِي؟ أَلَمْ يَأْمُرْكَ وَيَنْهَكَ؟ حَتَّى يُقِرَّ الْعَبْدُ.
فَيَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: لِمَ فَعَلْتَ كَذَا وَكَذَا؟ فَيَقُولُ الْعَبْدُ: يَا رَبُّ، ظَلَمْتُ نَفْسِي حَتَّى بَقِيتُ فِي النَّارِ كَذَا وَكَذَا خَرِيفًا لَمْ أَقْطَعْ رَجَائِي مِنْكَ، يَا رَبُّ، دَعَوْتُكَ بِالْحَنَّانِ الْمَنَّانِ وأَخْرَجْتَنِي بِفَضْلِكَ، فَارْحَمْنِي بِرَحْمَتِكَ، فَيَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: اشْهَدُوا يَا مَلَائِكَتِي بِأَنِّي رَحِمْتُهُ "

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মু'তাযিলাদের মাযহাব মতে কবীরা গুনাহ থেকে তওবাকারী ও গুনাহে সগীরাকারী উভয়ে জাহান্নামে যাবে এবং কাফির ও কবীরা গুনাহকারী চিরদিনের জন্য জাহান্নামে যাবে, কখনো সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় থাকবে না। উপরোক্ত হাদীসের দ্বারা তাদের মতবাদকে খন্ডন ও বাতিল করা হয়েছে। হযরত (সা) অন্যান্য আম্বিয়া কিরাম (আ), আওলিয়া, শহীদগণ, উলামা এবং মুকাররাবীনের শাফা'আতের দ্বারা তাওহীদে বিশ্বাসী গুনাহগার মুমিনদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। এমনিভাবে যদি কোন হকদার তার দাবি তুলে নেয়, তবে ঐ ব্যক্তিকেও জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। এরদ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ বলবেন, হে ফিরিশতাগণ! তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তার (গুনাহগার বান্দার) উপর রহমত ও দয়া করলাম।

রহমত কেন হবে না? আল্লাহ বলেছেনঃ (আমার রহমত প্রত্যেক বস্তুর উপর বিদ্যমান রয়েছে)। হতে পারে, তাঁর করুণা দয়ার কারণে পাপীদের সাজা হ্রাস পাবে। অথবা শাস্তি পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ স্বীয় ইনসাফের কারণে তাদেরকে বের করবেন।

বর্ণিত আছে, হযরত হাসান বসরী (র)-এর মাহফিলে উল্লেখ করা হয় যে, হান্নাদ নামক এক ব্যক্তি এক হাজার বছর শাস্তি ভোগ করার পর ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান' বলে চিৎকার করতে থাকবে এবং তাকে জাহান্নাম থেকে সর্বশেষ বের করা হবে। এ সময় হাসান বসরী (রাহঃ) কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, হায় । আমি যদি হান্নাদ হতাম! লোকজন আশ্চর্য হয়ে বলল, এটা কি ধরনের আশা? তিনি বললেন, এতে আশ্চর্য বা আফসোসের কি আছে ? তার জন্য কি এমন একটি দিন হবে না যে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং সে অনন্তকালের জন্য সেখানে থাকবে না। হযরত ইমাম গাযালী (র) মিনহাজুল আবেদীন' নামক গ্রন্থে এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।

আল্লামা সুয়ূতী (র) 'কানযুল মাদফুন' নামক গ্রন্থে লিখেছেন, হযরত ইয়াহইয়া (আ)-এর হত্যাকারিণী 'যবা' অথবা 'আযমীল' নামক মহিলা সর্বপ্রথম জাহান্নামে প্রবেশ করবে। সে এর পূর্বে সত্তরজন নবীকে হত্যা করেছে। বাইবেলে তার নাম 'সলোমী’ তাওরাতে ‘মাকতালাতুল আম্বিয়া' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে জাহান্নামের একটি উঁচু স্থান থেকে এমন জোরে চিৎকার করতে থাকবে যে, তার আওয়াজ জাহান্নামের অপর কিনারা থেকে শোনা যাবে।