আশ-শামাঈলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ- ইমাম তিরমিযী রহঃ

শামাইলে নববীর পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ৩৯৬
রাসূলুল্লাহ্ -এর ওফাতের বিবরণ
৩৯৬। নসর ইবন আলী আল-জাহযামী (রাহঃ)... সালিম ইবন 'উবায়দ (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন, যিনি একজন সাহাবী ছিলেন- বলেন : পীড়িত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বারবার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছিলেন। সংজ্ঞা ফিরে এলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সালাতের সময় হয়েছে কি? সাহাবীরা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ বিলাল (রাযিঃ)-কে আযান দিতে বলো এবং আবু বাকর (রাযিঃ)-কে সালাতে ইমামতি করতে বলো। অতঃপর আবার সংজ্ঞা হারালেন এবং সংজ্ঞা ফিরে এলে আবার জিজ্ঞেস করলেন, সালাতের সময় হয়েছে কি? সাহাবীরা বললেন, হ্যাঁ। তারপর বললেনঃ বিলাল (রাযিঃ)-কে আযান দিতে বলো এবং আবু বাকর (রাযিঃ)-কে সালাতের ইমামতি করতে বলো। 'আয়িশা (রাযিঃ) বললেনঃ আমার পিতা কোমল হৃদয় ব্যক্তি। যখন আপনার স্থানে দাঁড়াবেন, তখন কেঁদে ফেলবেন। তিনি সালাত আদায় করতে পারবেন না । আপনি যদি অন্য কাউকে নির্দেশ দেন! বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আবার সংজ্ঞা হারান। সংজ্ঞা ফিরে পেলে বললেন, বিলাল (রাযিঃ)-কে আযান দিতে বল এবং আবু বাকর (রাযিঃ)-কে লোকের ইমামতি করতে বলে দাও। 'আয়িশা (রাযিঃ)-কে বলেন, তুমি কি ইউসুফ (আ)-এর সঙ্গী মহিলাদের মতো হতে চাও? বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর বিলালকে আযান দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। তিনি আযান দিলেন। আবু বাকর (রাযিঃ)-কে ইমামতির নির্দেশ দেয়া হলো। তিনি লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। এরপর একদিন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কিছুটা সুস্থ বোধ করলে বললেন, তোমরা কেউ আমার কাছে আস, যার উপর ভর করে আমি দাঁড়াতে পারব। এতে বারীরা (রাযিঃ) ও অপর এক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁদেরকে ভর করে দাঁড়ালেন। আবু বাকর (রাযিঃ) তাঁকে দেখে পেছনে ফিরে আসার মনস্থ করলেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁকে স্ব স্থানে স্থির থাকতে ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর আবু বাকর (রাযিঃ) সালাত আদায় সমাপ্ত করলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইনতিকাল করেন। 'উমার (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! যাকেই বলতে শুনবো যে রাসূলুল্লাহ্ ইনতিকাল করেছেন, তাকেই আমি এই তরবারী দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করব। বর্ণনাকারী বলেন, যেহেতু লোকেরা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল এবং যেহেতু তারা পূর্বে কোন নবী পায়নি, সেহেতু লোকেরা “উমার (রাযিঃ)-এর কথায় • নিশ্চুপ রইল। সাহাবীরা বললেন, হে সালিম! রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর প্রিয় সাহাবী আবু বাকর (রাযিঃ)-এর কাছে চল এবং তাঁকে ডেকে নিয়ে আস। অতঃপর আমি আবু বাকর (রাযিঃ)-এর কাছে আসলাম। তিনি তখন মসজিদে ছিলেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে এসেছিলাম। তিনি আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কি ইনতিকাল করেছেন? আমি বললাম, 'উমার (রাযিঃ) বলছেন, যাকেই বলতে শুনবো যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইনতিকাল করেছেন, তাকেই আমি এই তরবারী দ্বারা আঘাত করব। তিনি আমাকে বললেন, চল। আমি তাঁর সঙ্গে চললাম। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর কাছে আসলেন। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর কাছে অনেক লোক এসে জড়ো হয়েছে। আবু বাকর (রাযিঃ) বললেন, হে লোকেরা! আমাকে একটু রাস্তা দাও। আবু বাকর (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর কাছে পৌঁছলেন এবং তাঁর উপর ঝুঁকে পড়ে তাঁকে চুমু খেলেন। অতঃপর বললেন, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ হে মুহাম্মাদ ! আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তারাও (শত্রুরা) মৃত্যুবরণ করবে।

সাহাবীরা বললেন, হে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর বন্ধু! রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কি সত্যিই ইনতিকাল করেছেন? বললেন, হ্যাঁ। তখন সকলেই বুঝতে পারল যে, সত্য সত্যই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইনতিকাল করেছেন। সাহাবীরা বলল, হে আল্লাহর রাসূলের বন্ধু! আমরা কি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর সালাতে জানাযা আদায় করব? বললেন, হ্যাঁ। তারা জিজ্ঞেস করল, কিভাবে? বললেন, একেক জন গৃহে প্রবেশ করবে এবং একাকী তাকবীর, দু'আ ও দরূদ পাঠ করে বেরিয়ে আসবে। অতঃপর আরেকটি দল যাবে এবং তাকবীর, দু'আ ও দরূদ পাঠ করে বেরিয়ে আসবে। অতঃপর লোকেরা গৃহে প্রবেশ করে বলল, হে আল্লাহর রাসূলের বন্ধু! রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -কে কি দাফন করা হবে? বললেন, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করা হলো, কোথায়? বললেন, যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। কেননা যেখানে আল্লাহর পসন্দ, কেবল সেখানেই তিনি তাঁর বন্ধুর মৃত্যু দান করেন। লোকেরা বুঝতে পারল যে, আবু বাকর (রাযিঃ) সত্যি কথাই বলেছেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর নিকটাত্মীয়দেরকে তাঁর গোসল দেয়ার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন।

এরপর মুহাজিরগণ পরামর্শে মিলিত হলেন। তারা বলেন, চলুন। আমরা আনসারী ভাইদের কাছে যাই এবং এ বিষয়ে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করি। আনসাররা বললেন, আমাদের মধ্য থেকে একজনকে এবং মুহাজিরদের মধ্য থেকে একজনকে নেতা নির্বাচিত করা হোক। 'উমার (রাযিঃ) বললেন, এমন ব্যক্তি কে আছে, যার তিনটি মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে? যেমন, আল্লাহ্ তা'আলা ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর সাথী ও বন্ধুরূপে পরিচয় দিয়েছেন, তৃতীয়ত إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا বলে সহচরত্ব উল্লেখ করেছেন। এই দুই ব্যক্তি কে? অতঃপর তিনি আবু বাকর (রাযিঃ)-এর দিকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং আনুগত্যের বায়'আত গ্রহণ করলেন। অতঃপর অন্যান্য লোকেরাও সুন্দরভাবে আবু বাকর (রাযিঃ)-এর বায়'আত গ্রহণ করলেন।
حَدَّثَنَا نَصْرُ بْنُ عَلِيٍّ الْجَهْضَمِيُّ قَالَ : حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ دَاوُدَ قَالَ : حَدَّثَنَا سَلَمَةُ بْنُ نُبَيْطٍ ، عَنْ نُعَيْمِ بْنِ أَبِي هِنْدَ ، عَنْ نُبَيْطِ بْنِ شَرِيطٍ ، عَنْ سَالِمِ بْنِ عُبَيْدٍ ، وَكَانَتْ لَهُ صُحْبَةٌ قَالَ : أُغْمِيَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَرَضِهِ فَأَفَاقَ ، فَقَالَ : حَضَرَتِ الصَّلاَةُ ؟ فَقَالُوا : نَعَمْ . فَقَالَ : مُرُوا بِلاَلاً فَلْيُؤَذِّنْ ، وَمُرُوا أَبَا بَكْرٍ أَنْ يُصَلِّيَ للنَّاسِ - أَوْ قَالَ : بِالنَّاسِ - قَالَ : ثُمَّ أُغْمِيَ عَلَيْهِ ، فَأَفَاقَ ، فَقَالَ : حَضَرَتِ الصَّلاَةُ ؟ فَقَالُوا : نَعَمْ . فَقَالَ : مُرُوا بِلاَلاً فَلْيُؤَذِّنْ ، وَمُرُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ ، فَقَالَتْ عَائِشَةُ : إِنَّ أَبِي رَجُلٌ أَسِيفٌ ، إِذَا قَامَ ذَلِكَ الْمَقَامَ بَكَى فَلاَ يَسْتَطِيعُ ، فَلَوْ أَمَرْتَ غَيْرَهُ قَالَ : ثُمَّ أُغْمِيَ عَلَيْهِ فَأَفَاقَ فَقَالَ : مُرُوا بِلاَلاً فَلْيُؤَذِّنْ ، وَمُرُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ ، فَإِنَّكُنَّ صَوَاحِبُ أَوْ صَوَاحِبَاتُ يُوسُفَ قَالَ : فَأُمِرَ بِلاَلٌ فَأَذَّنَ ، وَأُمِرَ أَبُو بَكْرٍ فَصَلَّى بِالنَّاسِ ، ثُمَّ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَجَدَ خِفَّةً ، فَقَالَ : انْظُرُوا لِي مَنْ أَتَّكِئِ عَلَيْهِ ، فَجَاءَتْ بَرِيرَةُ وَرَجُلٌ آخَرُ ، فَاتَّكَأَ عَلَيْهِمَا فَلَمَّا رَآهُ أَبُو بَكْرٍ ذَهَبَ لِينْكُصَ فَأَوْمَأَ إِلَيْهِ أَنْ يَثْبُتَ مَكَانَهُ ، حَتَّى قَضَى أَبُو بَكْرٍ صَلاَتَهُ ، ثُمَّ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُبِضَ ، فَقَالَ عُمَرُ : وَاللَّهِ لاَ أَسْمَعُ أَحَدًا يَذْكُرُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُبِضَ إِلاَ ضَرَبْتُهُ بِسَيْفِي هَذَا قَالَ : وَكَانَ النَّاسُ أُمِّيِّينَ لَمْ يَكُنْ فِيهِمْ نَبِيٌّ قَبْلَهُ ، فَأَمْسَكَ النَّاسُ ، فَقَالُوا : يَا سَالِمُ ، انْطَلِقْ إِلَى صَاحِبِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَادْعُهُ ، فَأَتَيْتُ أَبَا بَكْرٍ وَهُوَ فِي الْمَسْجِدِ فَأَتَيْتُهُ أَبْكِي دَهِشًا ، فَلَمَّا رَآنِي قَالَ : أَقُبِضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ؟ قُلْتُ : إِنَّ عُمَرَ يَقُولُ : لاَ أَسْمَعُ أَحَدًا يَذْكُرُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُبِضَ إِلاَ ضَرَبْتُهُ بِسَيْفِي هَذَا ، فَقَالَ لِي : انْطَلِقْ ، فَانْطَلَقْتُ مَعَهُ ، فَجَاءَ هُوَ وَالنَّاسُ قَدْ دَخَلُوا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ ، أَفْرِجُوا لِي ، فَأَفْرَجُوا لَهُ فَجَاءَ حَتَّى أَكَبَّ عَلَيْهِ وَمَسَّهُ ، فَقَالَ : { إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ } [الزمر : ] ثُمَّ قَالُوا : يَا صَاحِبَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، أَقُبِضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ؟ قَالَ : نَعَمْ ، فَعَلِمُوا أَنْ قَدْ صَدَقَ ، قَالُوا : يَا صَاحِبَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، أَيُصَلَّى عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ؟ قَالَ : نَعَمْ ، قَالُوا : وَكَيْفَ ؟ قَالَ : يَدْخُلُ قَوْمٌ فَيُكَبِّرُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَدْعُونَ ، ثُمَّ يَخْرُجُونَ ، ثُمَّ يَدْخُلُ قَوْمٌ فَيُكَبِّرُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَدْعُونَ ، ثُمَّ يَخْرُجُونَ ، حَتَّى يَدْخُلَ النَّاسُ ، قَالُوا : يَا صَاحِبَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، أَيُدْفَنُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ؟ قَالَ : نَعَمْ ، قَالُوا : أَينَ ؟ قَالَ : فِي الْمكَانِ الَّذِي قَبَضَ اللَّهُ فِيهِ رُوحَهُ ، فَإِنَّ اللَّهَ لَمْ يَقْبِضْ رُوحَهُ إِلاَ فِي مَكَانٍ طَيِّبٍ . فَعَلِمُوا أَنْ قَدْ صَدَقَ ، ثُمَّ أَمَرَهُمْ أَنْ يَغْسِلَهُ بَنُو أَبِيهِ وَاجْتَمَعَ الْمُهَاجِرُونَ يَتَشَاوَرُونَ ، فَقَالُوا : انْطَلِقْ بِنَا إِلَى إِخْوانِنَا مِنَ الأَنْصَارِ نُدْخِلُهُمْ مَعَنَا فِي هَذَا الأَمْرِ ، فَقَالَتِ الأَنْصَارُ : مِنَّا أَمِيرٌ وَمِنْكُمْ أَمِيرٌ ، فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ : مَنْ لَهُ مِثْلُ هَذِهِ الثَّلاَثِ { ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا } [التوبة : ] مَنْ هُمَا ؟ قَالَ : ثُمَّ بَسَطَ يَدَهُ فَبَايَعَهُ وَبَايَعَهُ النَّاسُ بَيْعَةً حَسَنَةً جَمِيلَةً.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের আগের বৃহস্পতিবার ইশার সময় খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর পক্ষে মসজিদে গিয়ে ইমামত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তিনি ঘরের লোকদের হুকুম দিলেন, যেন তারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত করতে বলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মন ছিল অত্যন্ত নরম। কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতকালে তাঁর কান্না চলে আসত। কান্নার বেগ বেশি হলে স্বাভাবিক গতিতে তিলাওয়াত করা সম্ভব হয় না। ইমামত করার সময় এরূপ অবস্থা হলে সাবলীলভাবে কুরআন পাঠ করা কঠিন হয়ে যায়। আবার সময়টা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতাকালীন। এ কারণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, এমনিতেও উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থানে দাঁড়িয়ে ইমামত করতে তাঁর অনেক বেশি চাপবোধ হওয়ার কথা। সেদিকে ইঙ্গিত করে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বলেন যে, আপনার স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি নামায পড়লে কান্নার কারণে মানুষকে কিরাআত, তাকবীর ইত্যাদি শোনাতে পারবেন না। অর্থাৎ কান্না অবস্থায় তাঁর উচ্চারণ জড়িয়ে যাবে। আওয়াজও উঁচু হবে না। ফলে মুক্তাদীগণ তা শুনতে পাবে না।

কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব ওজর গ্রাহ্য করলেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর সবচে' বেশি প্রিয় মানুষ। বিভিন্ন আলামত-ইঙ্গিত দ্বারা বোঝা যায়, তাঁর একান্ত কামনা ছিল তাঁর ওফাতের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই যেন প্রথম খলীফা হিসেবে মনোনীত হন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নামাযের ইমামরূপে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটা এ কামনা পূরণে সহায়ক ছিল। অন্য কেউ এ দায়িত্ব পালন করলে তার দিকে কিছু লোকের ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা ছিল। হয়তো এটাকে তারা তার খলীফারূপে মনোনয়নের প্রতি ইঙ্গিত মনে করত। সে আশঙ্কার পথ বন্ধ করার জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে দিয়েই ইমামত করানোর প্রয়োজন ছিল। তাই সব ওজর প্রত্যাখ্যান করে তিনি বারবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কেই ইমামত করার হুকুম দিতে বললেন।

সেমতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্তরূপে নামাযের ইমামত করলেন। এটা ছিল বৃহস্পতিবার ইশার নামায। এরপর থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত টানা ১৭ ওয়াক্ত নামাযে তিনি ইমামত করেন। ওফাতের পর যখন খলীফা নিয়োগের পালা আসে, তখন হযরত উমর ফারূক রাযি, হযরত আলী রাযি. প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ নামাযের এই ইমামতকে তাঁর বৃহত্তর ইমামত অর্থাৎ খেলাফতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার পক্ষে একটি বড় শক্তিরূপে অবলম্বন করে নিয়েছিলেন।

যাহোক, এস্থলে এ হাদীছের মূল বিষয় হল কুরআন তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তিলাওয়াতকালে খুব কাঁদতেন। এটা প্রকৃত মুমিনদের শান। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ
"আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্য, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহমন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটা আল্লাহর হিদায়াত, যার মাধ্যমে তিনি যাকে চান সঠিক পথে নিয়ে আসেন আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, তাকে সঠিক পথে আনার কেউ নেই।

কুরআন পড়ে দেহমন বিগলিত হওয়া মহান লোকদের মধ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। মদীনা মুনাউওয়ারায় হিজরতের আগে তিনি মক্কা ছেড়ে পরিব্রাজকরূপে ভূপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ানো ও আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লে ইবনুদ্দাগিনাহ নামক মক্কার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় তিনি বাড়ির আঙিনায় একটি ইবাদতখানা বানিয়ে সেখানে ইবাদত-বন্দেগী ও যিকর-তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। তিনি যখন বিগলিত মনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকতেন, তখন আশপাশের নারী-পুরুষ সকলে ঘর থেকে বের হয়ে আসত এবং তাঁর নিকট জড়ো হয়ে কুরআন শ্রবণে মগ্ন হয়ে পড়ত। কুরায়শ নেতৃবর্গ এটাকে অনেক বড় ঝুঁকিরূপে দেখছিল। তারা ভাবছিল, এভাবে চলতে থাকলে মক্কার সকল নারী-পুরুষ নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম কবুল করে নেবে। সুতরাং তাদের চাপে পড়ে ইবনুদ্দাগিনাহ তার দেওয়া নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। পরিশেষে হিজরতের পালা আসে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ প্রমাণ করে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় সাহাবী।

খ. প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা পসন্দের ব্যক্তি।

গ. ‘ইলম ও আমলে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেই ইমামরূপে মনোনীত করা উচিত।

ঘ. কুরআন পাঠকালে সম্ভব হলে ক্রন্দন করা উচিত। অন্ততপক্ষে ক্রন্দনের ভাব তো অবলম্বন করা চাই-ই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
শামাঈলে তিরমিযী - হাদীস নং ৩৯৬ | মুসলিম বাংলা