আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬১- রোগীদের বর্ণনা

হাদীস নং: ৫২৬৬
আন্তর্জাতিক নং: ৫৬৬৮
২৯৯৫. রোগীর উক্তি “আমি যাতনা গ্রস্থ" কিংবা আমার মাথা গেল, কিংবা আমার যন্ত্রণা প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে এর বর্ণনা।
৫২৬৬। মুসা ইবনে ইসমা‘ঈল (রাহঃ) ......... ‘আমির ইবনে সা‘দ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিদায় হজ্জের সময় আমার রোগ কঠিন আকার ধারণ করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের দেখতে আসলেন। আমি বললামঃ (মৃত্যু) আমার সন্নিকটে এসে গেছে যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন অথচ আমি একজন বিত্তবান ব্যক্তি। একটি মাত্র কন্যা ছাড়া আমার কোন ওয়ারিস নেই। এখন আমি আমার সম্পদের দু-তৃতীয়াংশ সাদাকা করতে পারি কি? তিনি উত্তর দিলেনঃ না। আমি বললামঃ তাহলে অর্ধেক? তিনি বললেনঃ না। আমি বললাম এক-তৃতীয়াংশ। তিনি বললেনঃ এও অনেক বেশী। নিশ্চয়ই তোমার ওয়ারিসদের সাবলম্বী রেখে যাওয়াই উত্তম তাদের নিঃস্ব ও মানুষের দারগ্রস্ত বানিয়ে যাওয়ার চাইতে। আর তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে যে ব্যয়ই কর না কেন, তার বিনিময়ে তোমাকে সাওয়াব দেওয়া হবে। এমন কি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে আহার তুলে দাও, তাতেও।
باب قَوْلِ الْمَرِيضِ إِنِّي وَجِعٌ أَوْ وَارَأْسَاهْ، أَوِ اشْتَدَّ بِي الْوَجَعُ
5668 - حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ العَزِيزِ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي سَلَمَةَ، أَخْبَرَنَا الزُّهْرِيُّ، عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: جَاءَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُودُنِي مِنْ وَجَعٍ اشْتَدَّ بِي، زَمَنَ حَجَّةِ الوَدَاعِ، فَقُلْتُ: بَلَغَ بِي مَا تَرَى، وَأَنَا ذُو مَالٍ، وَلاَ يَرِثُنِي إِلَّا ابْنَةٌ لِي، أَفَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثَيْ مَالِي؟ قَالَ: «لاَ» قُلْتُ: بِالشَّطْرِ؟ قَالَ: «لاَ» قُلْتُ: الثُّلُثُ؟ قَالَ: «الثُّلُثُ كَثِيرٌ، أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ، وَلَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে হযরত সা'দ রাযি. নিজ ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তিনি বিদায় হজ্জের বছর মক্কা মুকার্রামায় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখতে আসেন। কোনও সাহাবী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে আসা তাঁর সাধারণ অভ্যাস ছিল। তিনি অন্যদেরকেও রোগী দেখতে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এটা তাঁর সুন্নত এবং এর অনেক ফযীলত।

হযরত সা'দ রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখতে আসলেন। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমার ওয়ারিশ তো মাত্র আমার এক কন্যা। অন্যদিকে আমার সম্পদ প্রচুর। এ অবস্থায় আমি কি আমার সম্পদের তিন ভাগের দুইভাগ সদকা করে দিতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করলেন। তারপর তিনি অর্ধেকের কথা বললেন। তাও নিষেধ করলেন। শেষে যখন তিন ভাগের একভাগের কথা বললেন, তখন পরিমাণ হিসেবে এটাকেও বেশিই সাব্যস্ত করলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুমতি দিয়ে দিলেন। সেইসংগে উপদেশ দিলেন যে, ধন–সম্পদ থাকলে তার একটা বড় অংশ সন্তানদের জন্য রেখে যাওয়া চাই। কেননা তা না হলে এ আশংকা আছে যে, তারা মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়াবে। আর প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এটা অমর্যাদাকর।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে অপরের কাছে হাত পেতে বেড়ানোর নিন্দা করেছেন। তিনি ভিক্ষাবৃত্তিকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তাঁর শিক্ষায় অপরের কাছে হাত পাতা অপেক্ষা খেটে খাওয়াই শ্রেয়। সেই শিক্ষা হিসেবেই তিনি হযরত সা'দ রাযি.–কে তার সম্পদের বড় অংশ ওয়ারিশদের জন্য রেখে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। স্ত্রী ও সন্তানদের হক আদায়ার্থে যে অর্থ ব্যয় করা হয়, তাতেও ছওয়াব পাওয়া যায়। এ হাদীছে বলা হয়েছে যে, এমনকি স্ত্রীর মুখে যদি কোনও লোকমা তুলে দেওয়া হয়, তবে তাও ছওয়াবের কাজরূপে গণ্য হয়। এমন নয় যে, স্ত্রীর প্রতি খরচে স্বভাবগত মহব্বত ও আসক্তি কার্যকর থাকে বলে তা ছাওয়াবের পক্ষে বাধা হবে।বিবাহের পর স্ত্রীর খোরপোশ দেওয়া স্বামীর কর্তব্য। সে কর্তব্য পালন শরীআতেরই হুকুম। শরীআতের হুকুম পালন তো ছাওয়াবেরই কাজ। এমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর মহব্বতও আল্লাহ তাআলার কুদরতের নিদর্শন। সে হিসেবে এ মহব্বত তার প্রতি অর্থব্যয়ে অনুপ্রেরণা যোগায়ও বৈকি। সে অনুপ্রেরণায় যদি অর্থব্যয় করা হয়, তবে তা পারস্পরিক মহব্বত বৃদ্ধিতেও সহায়ক হয়, যা শরীআতে কাম্য। এদিক থেকেও তা ছাওয়াবের কাজই বটে।
উল্লেখ্য, স্ত্রীর পেছনে হোক বা অন্য কারও পেছনে, সর্বাবস্থায়ই অর্থব্যয় হওয়া চাই শরীআতের সীমারেখার মধ্যে। স্ত্রীর খেয়াল-খুশি পূরণের জন্য কিংবা নিজের বাড়তি আহ্লাদ মেটানোর উদ্দেশ্যে যদি ব্যয় করা হয় আর তা শরীআত অনুমোদিত কাজে না হয়, তবে তা নিছক অপব্যয় ও অপচয়। এতে ছাওয়াবের পরিবর্তে উল্টো গুনাহ হয়। এ ব্যাপারে সকলেরই সতর্ক থাকা জরুরি।
মোটকথা যে অর্থব্যয় আল্লাহর সন্তুষ্টিতে হয়, যা হয় দীন ও ঈমানের তাকাযায় এবং হয় শরীআতের সীমারেখার ভেতর, তাতে অবশ্যই ছাওয়াব আছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কেউ অসুস্থ হয়েছে জানলে তাকে দেখতে যাওয়া উচিত। এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।

খ. উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করতে চাইলে সে ব্যাপারে বিজ্ঞজনের সংগে পরামর্শ করা উচিত, যেমন হযরত সা'দ ইবন আবূ ওয়াক্কাস রাযি. তার সম্পদ দান করে দেওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে পরামর্শ করেছেন।

গ. মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি তার সম্পদ দান করতে চায় বা সে সম্পর্কে অসিয়ত করতে চায়, তবে তা সর্বোচ্চ এক–তৃতীয়াংশের ভেতর করতে পারে, এর বেশি করা জায়েয নয়। উত্তম হল এক–তৃতীয়াংশেরও নিচে রাখা

ঘ. সম্পদ যদি অল্প হয়, তবে মুমূর্ষুকালে তা দান–খয়রাত না করে ওয়ারিশদের জন্য রেখে দেওয়াই ভালো।

ঙ. অন্যের কাছে কিছু চাওয়া ও হাত পেতে বেড়ানো অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। যথাসম্ভব খেটে খাওয়াই ইসলামের শিক্ষা।

চ. দান–খয়রাতে সুনাম–সুখ্যাতি নয়, বরং একমাত্র আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি কামনাই লক্ষ হওয়া উচিত।

ছ. আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় সন্তান–সন্ততি ও আত্মীয়–স্বজনের পেছনে খরচ করলেও ছওয়াব পাওয়া যায়। এমনকি স্ত্রীর মুখে লোকমা তুলে দেওয়াটাও একটি ছওয়াবের কাজ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
সহীহ বুখারী - হাদীস নং ৫২৬৬ | মুসলিম বাংলা