আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬১- রোগীদের বর্ণনা

হাদীস নং: ৫২৪৭
আন্তর্জাতিক নং: ৫৬৫০
২৯৮৩. রোগীর সেবা করা ওয়াজিব
৫২৪৭। হাফস ইবনে ‘উমর (রাহঃ) ......... বারা ইবনে ‘আযিব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের সাতটি জিনিসের আদেশ দিয়েছেন এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। তিনি আামাদের নিষেধ করেছেনঃ সোনার আংটি, মোটা ও পাতলা এবং কারুকার্য খচিত রেশমী কাপড় ব্যবহার করতে এবং কাসসী ও মিয়সারা কাপড় ব্যবহার করতে। আর তিনি আমাদের আদেশ করেছেনঃ আমরা যেন জানাযার অনুসরণ করি, রোগীর সেবা করি এবং বেশী বেশী করে সালাম করি।
باب وُجُوبِ عِيَادَةِ الْمَرِيضِ
5650 - حَدَّثَنَا حَفْصُ بْنُ عُمَرَ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، قَالَ: أَخْبَرَنِي أَشْعَثُ بْنُ سُلَيْمٍ، قَالَ: سَمِعْتُ مُعَاوِيَةَ بْنَ سُوَيْدِ بْنِ مُقَرِّنٍ، عَنِ البَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: " أَمَرَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِسَبْعٍ، وَنَهَانَا عَنْ سَبْعٍ: نَهَانَا عَنْ خَاتَمِ الذَّهَبِ، وَلُبْسِ الحَرِيرِ، وَالدِّيبَاجِ، وَالإِسْتَبْرَقِ، وَعَنِ القَسِّيِّ، وَالمِيثَرَةِ، وَأَمَرَنَا أَنْ نَتْبَعَ الجَنَائِزَ، وَنَعُودَ المَرِيضَ، وَنُفْشِيَ السَّلاَمَ "

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি শিক্ষাদান করেছেন। এ শিক্ষাগুলো সমাজনীতি সম্পর্কিত। এগুলো অনুসরণ করার দ্বারা একদিকে বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়, অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনও সুদৃঢ় হয়। পারস্পরিক শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ দূর করা এবং ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে এ শিক্ষাসমূহের অনুসরণ অত্যন্ত কার্যকর এক ব্যবস্থা।
আমরা নিচে এক একটি করে এর ব্যাখ্যা প্রদান করছি।

রোগী দেখতে যাওয়া
عِيَادَةُ الْمَرِيضِ (রোগীর 'ইয়াদাত করা)। অর্থাৎ রোগী দেখতে যাওয়া ও তার খোঁজখবর নেওয়া। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কোনও কোনও হাদীছে একে মুসলিম ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। এটা যখন মুসলিম ব্যক্তির হক, তখন অবশ্যপালনীয়ও বটে। কারও অসুস্থতার সংবাদ পেলে তার খোঁজখবর নিতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাকে দেখতেও যেতে হবে। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বেরও দাবি। এর দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من مسلم يعود مسلما غدوة, إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يمسي, وإن عاده عشية إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يصبح, وكان له خريف في الجنة
'যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি সকালবেলা কোনও অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলে عَادَهُ সত্তর হাজার ফিরিশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে। যদি সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে যায় তবে সত্তর হাজার ফিরিশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান করা হয়’।
(জামে তিরমিযী: ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ: ৩০৯৮; মুসনাদে আহমাদ: ৯৭৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৭৪২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৪১০)
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَيُّمَا رَجُلٍ يَعُودُ مَرِيضًا، فَإِنَّمَا يَخُوضُ فِي الرَّحْمَةِ، فَإِذَا قَعَدَ عِنْدَ الْمَرِيضِ غَمَرَتْهُ الرَّحْمَةُ، قَالَ : فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللهِ ، هَذَا لِلصَّحِيحِ الَّذِي يَعُودُ الْمَرِيضِ، فَالْمَرِيض مَا لَهُ؟ قَالَ: تُحَطَّ عَنْهُ ذُنُوبُهُ.
'যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় সে রহমতের ভেতর ডুব দিতে থাকে। যখন সে রোগীর কাছে গিয়ে বসে তখন রহমত তাকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বর্ণনাকারী (হযরত আনাস রাযি.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা তো ওই সুস্থ ব্যক্তির জন্য, যে রোগী দেখতে যায়। তা অসুস্থ ব্যক্তি কী পাবে? তিনি বললেন, তার পাপরাশি মিটিয়ে দেওয়া হয়’।
(মুসনাদে আহমাদ: ১২৭৮২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ১০৮৩৯; মুসান্নাফ আব্দুর রায্ যাক : ৬৭৬৪; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা: ৬৫৮৩; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত: ২২০৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৪৫২)
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
.مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلاً
‘যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, তার উদ্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করে, তুমি শুভ হও, তোমার যাত্রা শুভ হোক এবং জান্নাতে তোমার ঠিকানা হোক’।
(জামে তিরমিযী: ২০০৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; আল-আদাবুল মুফরাদ : ৩৪৫; শারহুস্ সুন্নাহ: ২৪৭৪)
হযরত ছাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَائِدُ الْمَرِيضِ فِي مَخْرَفَةِ الْجَنَّةِ
'যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায় সে জান্নাতের ফলের বাগানে (অথবা এর অর্থ সে জান্নাতের পথে) থাকে’।
(সহীহ মুসলিম : ২৫৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪২; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩৭৫০; মুসনাদে আহমাদ: ২২৪০৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫৮০; শুআবুল ঈমান : ৮৭৩৮)

জানাযায় অংশগ্রহণ
إِتَّبَاعُ الْجَنائِز (জানাযায় অংশগ্রহণ করা)। কোনও মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার জানাযা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা জীবিতদের উপর ফরয। এটা ফরযে কিফায়াহ। একদল লোক এটা সমাধা করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। অন্যথায় সকলেই গুনাহগার হয়। এ কাজ মৃতব্যক্তির হক, তার প্রাপ্য। এর দ্বারা মৃতব্যক্তিও উপকৃত হয় এবং যারা এ কাজে অংশগ্রহণ করে তারাও উপকৃত হয়। সেইসঙ্গে এটা মৃতব্যক্তির পরিবার ও তার আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সহমর্মিতার প্রকাশও বটে। এতে তারা সান্ত্বনা পায়, তাদের কষ্ট লাঘব হয়। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যেকেরই এতে অংশগ্রহণ করা উচিত। এতে মৃতব্যক্তির উপকার তো এই যে, জানাযার নামায মূলত তার জন্য দু'আ। মৃতব্যক্তির জন্য জীবিতদের দু'আ আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হয়ে থাকে। এটা তার মাগফিরাতের জন্য সুপারিশ। জীবিতদের সুপারিশ মৃতব্যক্তির উপকারে আসে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ مَيِّتِ تُصَلِّي عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَبْلُغُوْنَ مِائَةً، كُلُّهُمْ يَشْفَعُوْنَ لَهُ، إِلَّا شُفّعُوا فِيهِ
'একশ সংখ্যক মুসলিমের একটি দল যে মায়িয়তের জানাযার নামায আদায় করে এবং তারা তার জন্য সুপারিশ করে, তার জন্য তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল হয়’।
(সহীহ মুসলিম: ৯৩২; জামে তিরমিযী: ১০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৩৮০৪; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ১১৬২২; সুনানে নাসাঈ ১৯৯১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৮১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৯০৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من رجل مسلم يموت، فيقوم على جنازته أربعون رجلاً، لا يشركون بالله شيئاً إلا شَفَعهم الله فيه
'কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তারপর আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না এমন চল্লিশ জন লোক তার জানাযা পড়ে, তবে আল্লাহ তার পক্ষে তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল করেন। (সহীহ মুসলিম: ৯৪৮; সুনানে আবু দাউদ: ৩১৭০; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩০৮২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৫৬২১; শুআবুল ঈমান: ৮৮১২)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ দ্বারা অংশগ্রহণকারীদের নিজেদেরও অনেক ফায়দা হয়। একটা বড় ফায়দা তো নসীহত ও উপদেশলাভ। জানাযায় অংশগ্রহণ দ্বারা এই উপদেশ লাভ হয় যে, একদিন আমারও মরতে হবে। আমারও জানাযা পড়া হবে। হয়তো যে-কোনওদিনই মালাকুল-মাওত আমার কাছে এসে পড়বে। আমি সেজন্য কতটুকু প্রস্তুত? এভাবে এ চিন্তা জানাযায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে আখিরাতমুখী করে তোলে। এ চিন্তা তার আত্মসংশোধনে সহায়ক হয়। সে সৎকর্মশীল হলে সৎকর্মের প্রতি আরও অগ্রগামী হবে। পাপী হলে তাওবা করে সৎকর্মে মনোযোগী হবে। তাই হাদীছে জানাযায় অংশগ্রহণ করতে বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عُودُوا الْمَرْضَى، وَاتَّبِعُوا الْجَنَائِزَ يُذَكِّرْكُمُ الْآخِرَةَ
'রোগীদের ইয়াদাত করো এবং জানাযায় অংশগ্রহণ করো। তা তোমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেবে’।
(মুসনাদে আহমাদ:১২৩৬; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৩৫৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১০৮৪১; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৫১৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ১১১৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৫৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৭৫০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫০৩)
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলতেন-
كَفَى بِالْمَوْتِ وَاعِظًا
'উপদেশদাতা হিসেবে মৃত্যুই যথেষ্ট।'
অর্থাৎ মৃতব্যক্তিকে দেখলে তার দ্বারা উপদেশ লাভ হয়। আর নিজেকে সংশোধন করা ও আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য সে উপদেশই যথেষ্ট। এ বাক্যটি হাদীছরূপেও বর্ণিত আছে।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৭২; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ১৯২৫)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণকারীর আরেকটা বড় ফায়দা হল বিপুল ছাওয়াব অর্জন। এর অনেক ছাওয়াব। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من شهد الجنازة حتى يصلي، فله قيراط، ومن شهد حتى تدفن كان له قيراطان»، قيل: وما القيراطان؟ قال: مثل الجبلين العظيمين
'যে ব্যক্তি মায়্যিতের সাথে তার জানাযার নামায আদায় করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে এক কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তাকে দাফন করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে দুই কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। জিজ্ঞেস করা হল, দুই কীরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বড় বড় পাহাড়ের সমান।
(সহীহ বুখারী: ১৩২৫ সহীহ মুসলিম : ৯৪৫; মুসনাদে আহমাদ: ৯২০৮; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৭৮; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৭৪৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ২১৩৩)

সালামের রেওয়াজদান
إفشاء السلام (সালামের প্রসার ঘটানো)। সালামের প্রসার ঘটানোর অর্থ বেশি বেশি সালাম দেওয়া। এমনভাবে এর প্রচার ও চর্চা করা, যাতে সালাম দেওয়া-নেওয়া সামাজিক রেওয়াজে পরিণত হয়ে যায়। তা সম্ভব হবে এভাবে যে, সালামের যতগুলো ক্ষেত্র আছে তার প্রত্যেকটিতেই আমরা সালাম বিনিময় করব। ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেব। একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সালাম দেব। পরস্পর বিদায় গ্রহণকালে সালাম দেব। কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সালাম দেব। মজলিসে উপস্থিত হওয়ার সময় মজলিসের লোকদেরকে সালাম দেব। এমনিভাবে সালাম দেব বড় ছোটকে ও ছোট বড়কে। সালাম দেব পিতা-মাতাকে, ছেলেমেয়েকে, স্বামী তার স্ত্রীকে এবং স্ত্রী তার স্বামীকে। নিজে আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করব। কাউকে সালাম দিতে লজ্জিত হব না, কুণ্ঠাবোধ করব না। যারা সালাম দেয় না তাদেরকে সালাম শেখাব। শিশুদেরকে সালামের তা'লীম দেব। ফোনালাপকালেও কথার সূচনা করব সালাম দ্বারা। আবার কথা শেষে সালাম দিয়েই ফোন রাখব। এভাবে নিজে সালামের চর্চা করার সাথে সাথে অন্যদেরকে সালাম দেওয়ার প্রতি উৎসাহ দিতে থাকলে এক পর্যায়ে ইসলামের এ সুন্নত সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, আমাদেরকে কেবল সালাম দিতে বা নিতেই বলা হয়নি; বরং সালামের প্রসার ঘটাতে, একে রেওয়াজে পরিণত করতে আদেশ করা হয়েছে। সর্বত্র সালামকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখার দ্বারাই এ আদেশ যথাযথভাবে পালন হতে পারে। আমরা জান্নাতকে আমাদের আসল ঠিকানা মনে করি। সে ঠিকানায় পৌঁছার জন্য এ প্রচেষ্টা এক শক্তিশালী অবলম্বন।

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি বিষয় নিষেধ করেছেন। নিচে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাদান করা যাচ্ছে।

পুরুষের জন্য স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
হযরত বারা ইব্ন আযিব রাযি. বলেন- (নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সোনার আংটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন)। এ নিষেধাজ্ঞা পুরুষের জন্য, নারীর জন্য নয়। পুরুষের জন্য কোনওরূপ স্বর্ণালংকার ব্যবহার করা জায়েয নয়, তার পরিমাণ যত অল্পই হোক না কেন। স্বর্ণালংকার ব্যবহার করা জায়েয কেবল নারীর জন্য, তাও যদি অহংকার ও প্রদর্শনের জন্য না হয়। অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, পুরুষের জন্য জান্নাতে স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কাজেই যেসকল পুরুষ দুনিয়ায় স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার করবে, জান্নাতে তারা তা পাবে না। এটা তাদের জন্য জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার সতর্কবাণী। কাজেই জান্নাতকামী পুরুষদের কর্তব্য দুনিয়ায় স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। তা থাকতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ জান্নাতে তাদেরকে নানারকম স্বর্ণালঙ্কার ও সাজসজ্জায় ভূষিত করা হবে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদঃ- يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا “তাদেরকে সেখানে স্বর্ণকঙ্কনে অলংকৃত করা হবে। আর তারা উচ্চ আসনে হেলান দেওয়া অবস্থায় মিহি ও পুরু রেশমী কাপড় পরিহিত থাকবে। কতইনা উৎকৃষ্ট প্রতিদান এবং কত সুন্দর বিশ্রামস্থল। সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৩১
অপর এক আয়াতে ইরশাদঃ- يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌ ‘সেখানে তাদেরকে সজ্জিত করা হবে সোনার কাঁকন ও মণি-মুক্তা দ্বারা। আর সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের। সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ২৩

সোনা-রুপার পাত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
وعن شرب بآنية الفضة এবং (নিষেধ করেছেন) রুপার পাত্রে পান করতে'। রুপার পাত্রে পানি পান করা পুরুষ ও নারী কারও জন্যই জায়েয নয়। সোনারুপার অন্যকোনও পাত্রও ব্যবহারের অনুমতি নেই। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- لا تشربوا في إناء الذهب والفضة، ولا تلبسوا الديباج والحرير، فإنه لهم في الدنيا وهو لكم في الآخرة يوم القيامة 'তোমরা সোনা-রুপার পাত্রে পান করো না এবং রেশম ও দীবাজ (এক ধরনের রেশমী কাপড়) পরিধান করো না। কেননা এটা দুনিয়ায় তাদের (কাফেরদের) জন্য এবং তোমাদের জন্য আখেরাতে।[৮]
এক বর্ণনায় অতিরিক্ত আছেঃ- ولا تأكلوا في صحافها এবং তোমরা সোনা-রুপার পাত্রে আহার করো না'।[৯]
এক হাদীছে এ নিষেধাজ্ঞার কারণ বলা হয়েছে যে, জান্নাতে পানাহারের পাত্র হবে সোনারুপার। কাজেই এটা নারী-পুরুষ সকলের জন্যই নিষেধ। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে- من شرب في إناء من ذهب، أو فضة، فإنما يجرجر في بطنه نارا من جهنم “যে ব্যক্তি সোনা-রূপার পাত্রে পান করে, সে তার পেটে কেবল জাহান্নামের আগুনই ঢোকায়।[১০]
মোটকথা, সোনা-রুপার পাত্র ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম ও কঠিন পাপ। কাজেই ঈমানদারদেরকে অবশ্যই এর থেকে বিরত থাকতে হবে। এ জাতীয় বিলাসিতা ঈমানদারদের জন্য শোভা পায় না।
এ নিষেধাজ্ঞা পানাহারের পাত্র ছাড়া অন্য আসবাবপত্রেও প্রযোজ্য, যেমন সুরমাদানি, কলম, চশমার ফ্রেম, আতরদানি ইত্যাদি।
বিভিন্ন রেশমী পোশাকের নিষেধাজ্ঞা
وعن المياثر এবং (তিনি নিষেধ করেছেন) মায়াছির ব্যবহার করতে”। ইমাম নববী রহ. "المياثر -এর ব্যাখ্যা করেছেন যে, এ শব্দটি ميثرة এর বহুবচন। এটা একরকম গদি। রেশম দ্বারা তৈরি করা হয়। ভেতরে তুলা বা অন্যকিছুর পুর দেওয়া হয়। এটা উট, গাধা ইত্যাদি বাহনের পিঠে রেখে আরোহী তার উপর বসে। রেশমের তৈরি সব মায়াছিরই হারাম, তা যে রঙেরই হোক।

রেশম ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ, রেশমি পোশাক ব্যবহার করতে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে - من لبس الحرير في الدنيا لم يلبسه في الآخرة 'যে ব্যক্তি দুনিয়ায় রেশমী পোশাক পরে, সে আখেরাতে তা পরতে পারবে না।[১১]
তবে এ নিষেধাজ্ঞা কেবল পুরুষের জন্য। নারীর জন্য রেশমী পোশাক পরা জায়েয, যেমন তাদের জন্য স্বর্ণালঙ্কারও জায়েয। হযরত উকবা ইবন আমির রাযি থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- الذهب والحرير حل لإناث أمتي وحرام على ذكورها সোনা ও রেশম আমার উম্মতের মহিলাদের জন্য হালাল এবং পুরুষদের জন্য হারাম।[১২]
হযরত আলী রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাম হাতে রেশম এবং ডান হাতে স্বর্ণ ধরলেন। তারপর দু'হাত তুলে বললেনঃ- إن هذين حرام على ذكور أمتي، حل لإناثهم ‘এ দুটি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম, মহিলাদের জন্য হালাল।[১৩]
শায়খ আবূ মুহাম্মাদ রহ. এ নিষেধাজ্ঞার হিকমত বর্ণনা করেন যে, সাজসজ্জার ব্যাপারে নারীদের সংযম কম। তাই এটা তাদের জন্য হালাল করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষত এ কারণেও যে, তাদের সাজসজ্জা হবে কেবল স্বামীদের জন্য। এর দ্বারা বোঝা যায় পুরুষদের জন্য বেশি সাজসজ্জা ও উপভোগের বস্তু ব্যবহার করা ভালো নয়। কেননা এটা নারীর বৈশিষ্ট্য।
والإستبرق والديباج ‘এবং (তিনি নিষেধ করেছেন) ইসতাবরাক ও দীবাজ ব্যবহার করতে। ইসতাবরাক বলা হয় মোটা রেশমী কাপড়কে। আর দীবাজ হচ্ছে চিকন রেশমী কাপড়।

হারানো প্রাপ্তির ঘোষণাদানের আদেশ
وإنشاد الضالة 'হারানো প্রাপ্তির ঘোষণা'। এটি একটি আদিষ্ট বিষয়। অর্থাৎ হাদীছটির প্রথম অংশে যে সাতটি বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে, কোনও কোনও বর্ণনায় তাতে কসমের পরিবর্তে এটির উল্লেখ আছে। কেউ যদি কোনও হারানো বস্তু পায়, তবে তার কর্তব্য জনসম্মুখে তা ঘোষণা করা। এটা মুসলিম ব্যক্তির হক। যে ব্যক্তি তার কোনও বস্তু হারায়, সে পেরেশান হয়ে পড়ে। বস্তুটি যত দামী বা যতবেশি প্রয়োজনীয় হয়, পেরেশানিও ততবেশি হয়। মুসলিম ভাইয়ের পেরেশানি দূর করা অপর মুসলিম ভাইয়ের কর্তব্য। পেছনে মুসলিম ব্যক্তির হকসমূহের বর্ণনায় এটিরও উল্লেখ আছে। কাজেই এ ব্যাপারে কোনওরকম অবহেলা করা উচিত নয়।
কারও কোনও হারানো বস্তু দেখতে পেলে যদি আশঙ্কা হয় সেটি পড়ে থাকলে কোনও দুষ্ট লোকের হাতে পড়বে বা অন্য কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, ফলে প্রকৃত মালিক সেটি আর ফিরে পাবে না, তবে তার উচিত হবে মালিকের হাতে পৌঁছানোর নিয়তে সেটি তুলে নেওয়া, তারপর যতদিন মালিককে না পাওয়া যায় ততদিন সেটি সংরক্ষণ করা এবং ঘোষণা দিতে থাকা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিন তা এভাবে সংরক্ষণ করতে হবে? এটা একেক মালের জন্য একেকরকম। কোনওটির জন্য হয়তো তিনদিনই যথেষ্ট, আবার কোনওটির জন্য মাস কি বছরকালও হেফাজতের প্রয়োজন হতে পারে। একবার জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে পড়ে পাওয়া টাকার থলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল । তিনি বলেন- إعرف عفاصها ووكاءها، ثم عرفها سنة، فإن جاء صاحبها وإلا فشأنك بها 'তুমি থলি ও তার বাঁধন-রশিটি চিনে রাখ। তারপর এক বছর সেটি প্রচার কর। এর মধ্যে তার মালিক আসলে তো ভালো, অন্যথায় তোমার যা ভালো মনে হয় করো।[১৪]
এক বছর সংরক্ষণ ও প্রচার করতে হবে অর্থের পরিমাণ বেশি হলে বা খুব দামী মাল হলে। অন্যথায় মালিককে পাওয়ার সম্ভাব্য সময় চিন্তাভাবনা করে দেখবে। যখন মনে করবে তাকে আর পাওয়া যাবে না, তখন তার উদ্দেশ্যে সেটি সদাকা করে দেবে। নেহাত গরীব হলে নিজেও ভোগ করতে পারে। পরে যদি মালিককে পাওয়া যায়, তখন হয় সেটি তাকে ফেরত দেবে, নয়তো তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেবে।
কারও হারানো মাল পেয়ে গেলে তা লুকানো ও নিজে নিয়ে নেওয়া কঠিন পাপ। এটা আত্মসাতের মধ্যে পড়ে। বেশি দামী বস্তু হলে অনেকে লোভে পড়ে যায়। এরকম লোভ অবশ্যই সামলাতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- لا يأوي الضالة إلا ضال হারিয়ে যাওয়া বস্তু (নিজে ভোগের জন্য) তুলে নেয় কেবল পথভ্রষ্ট লোক।[১৫]
কারও হারানো বস্তু পেলে তার মালিক সন্ধান করা কর্তব্য বটে, তবে এ কাজে মসজিদ ব্যবহার করা উচিত নয়। ইদানীং মসজিদে হারানো বস্তু ও হারানো প্রাপ্তির ঘোষণা দেওয়াটা ব্যাপক হয়ে গেছে। অথচ মসজিদে এটা করা নিষেধ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من سمع رجلا ينشد ضالة في المسجد، فليقل: لا أداها الله إليك فإن المساجد لم تبن لهذا “যে ব্যক্তি কাউকে মসজিদে তার হারিয়ে যাওয়া বস্তুর ঘোষণা দিতে শুনে সে যেন তাকে বলে দেয়, আল্লাহ করুন তুমি যেন এটা না-ই পাও। মসজিদ তো এজন্য বানানো হয়নি।[১৬]
অবশ্য মসজিদের ভেতরে ঘোষণা না করে যদি মসজিদের দরজার সামনে ঘোষণা করে, তবে অসুবিধা নেই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. রোগী দেখতে যাওয়া ও রোগীর খোঁজখবর নেওয়া মুসলিম ব্যক্তির এক বিশেষ দায়িত্ব।

খ. জানাযার নামায ও দাফনে অংশগ্রহণ করা মৃতব্যক্তির হক। এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

গ. কেবল সালাম দিয়েই ক্ষান্ত হওয়া উচিত নয়; মুসলিম সমাজে যাতে সালামের ব্যাপক চর্চা হয়, সে চেষ্টা করাও জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ বুখারী - হাদীস নং ৫২৪৭ | মুসলিম বাংলা