আল মুওয়াত্তা-ইমাম মুহাম্মাদ রহঃ

১৮- বিবিধ প্রসঙ্গ।

হাদীস নং: ৮৮৭
নিজে পান করার পর ডান দিকের ব্যক্তিকে পান করতে দেয়া।
৮৮৭। সাহল ইবনে সাদ আস-সাইদী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ -এর সামনে পানীয় দ্রব্য আনা হলো। তিনি তা থেকে পান করলেন। তাঁর ডানপাশে ছিলো একটি যুবক ছেলে এবং বাঁপাশে ছিলো কয়েকজন প্রবীণ লোক। তিনি যুবককে বলেন, “তুমি কি এই পানীয় (তোমার আগে) এদের দেয়ার জন্য আমাকে অনুমতি দিবে?" সে বললো, আল্লাহর শপথ! আমি আপনার মুখ লাগানো জিনিসে (আমার আগে) অন্য কাউকে শরীক হতে দিবো না। রাবী বলেন, অতএব রাসূলুল্লাহ ﷺ পানপাত্রটি যুবকের হাতে দিলেন।**
أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، أَخْبَرَنَا أَبُو حَازِمٍ، عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ السَّاعِدِيِّ، أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ " أُتِيَ بِشَرَابٍ فَشَرِبَ مِنْهُ، وَعَنْ يَمِينِهِ غُلامٌ، وَعَنْ يَسَارِهِ أَشْيَاخٌ، فَقَالَ لِلْغُلامِ: أَتَأْذَنُ لِي فِي أَنْ أُعْطِيَهُ هَؤُلاءِ؟ فَقَالَ: لا وَاللَّهِ، لا أُوثِرُ بِنَصِيبِي مِنْكَ أَحَدًا، قَالَ: فَتَلَّهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي يَدِهِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে বর্ণিত ঘটনাটি ঘটেছিল উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা রাযি.-এর ঘরে। আল্লামা ইবন হাজার রহ. এরূপ বলেছেন। যে পানীয়ের কথা বলা হয়েছে, তা আসলে কী ছিল, এ বর্ণনায় তার উল্লেখ নেই। তবে এর কাছাকাছি একটি বর্ণনা তিরমিযী শরীফে আছে। তাতে এক পেয়ালা দুধের কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডানদিকে যে বালকটির থাকার কথা বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি.। কেউ কেউ তাঁর ভাই হযরত ফাযল রাযি.-এর কথাও বলেছেন। বামদিকে যে বৃদ্ধগণ ছিলেন, কারও কারও বর্ণনামতে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-ও তাদের একজন। তিরমিযী শরীফের একটি বর্ণনায় হযরত খালিদ রাযি.-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাত্র থেকে প্রথমে পানীয়ের কিছুটা নিয়ে পান করলেন। তারপর ডানদিকের বালকটিকে বললেন-
أتَأْذَنُ لي أنْ أُعْطِيَ هَؤُلَاءِ؟ (তুমি কি এদেরকে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবে)? তিরমিযী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন- فَقَالَ لِي : الشَّرْبَةُ لَكَ ، فَإِنْ شِئْتَ آثَرْتَ بِهَا خَالِدًا (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, এ পানীয় তোমার। তুমি চাইলে এতে খালিদকে অগ্রাধিকার দিতে পার)(জামে' তিরমিযী: ৩৪৫৫)। নিয়ম হচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য বা পানীয় বিতরণকালে শুরুটা মজলিসের সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তির মাধ্যমে করা হবে। তা তিনি মজলিসের যেখানেই অবস্থান করুন। তাকে পরিবেশনের পর এবার তারই ডানদিকে যে হবে তাকে অগ্রাধিকার দেবে। আর সে তার ডানের জনকে। এভাবে শেষ পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে বামদিকের লোকদের তুলনায় ডানদিকের লোকদের অধিকার বেশি, যদিও গুরুত্ব ও মর্যাদায় বামদিকের লোকদের তুলনায় ডানদিকের লোকেরা সাধারণ পর্যায়ের হয়। উক্ত ঘটনায় সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি তো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি গ্রহণের পর তাঁর ডানে অবস্থান করা ব্যক্তির অধিকারই অগ্রগণ্য। তো তাঁর ডানদিকে ছিলেন একজন বালক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. হয়ে থাকলে তিনিও তখন বালকই ছিলেন। বয়সে ছোট হলেও নবীজির ডানদিকে থাকায় তাঁর অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে বামদিকে ছিলেন হযরত খালিদ রাযি.-এর মতো একজন বয়স্ক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি। ইসলামগ্রহণের আগেও নিজ গোত্রে তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল। ইসলাম সম্মানী লোককে সম্মান জানানোর শিক্ষা দেয়। আবার হযরত খালিদ রাযি. ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন দেরিতে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর একটু মনোরঞ্জনও করতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি পাত্রের অবশিষ্ট পানি হযরত খালিদ রাযি.-কে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তা দিতে হলে ডানদিকের বালকের অনুমতি প্রয়োজন। তাই তিনি এ কথা বললেন। অর্থাৎ তুমি যেহেতু ডানদিকে, তাই এতে তোমারই অধিকার বেশি। তবে তুমি চাইলে খালিদের অনুকূলে এ অধিকার ত্যাগও করতে পার।

হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকেও এ জাতীয় এক ঘটনা বর্ণিত আছে। তাতে বলা হয়েছে-
‏أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ‏ ‏صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‏ ‏أُتِيَ بِلَبَنٍ قَدْ شِيبَ بِمَاءٍ وَعَنْ يَمِينِهِ أَعْرَابِيٌّ وَعَنْ شِمَالِهِ ‏ ‏أَبُو بَكْرٍ ‏ ‏فَشَرِبَ ثُمَّ أَعْطَى الْأَعْرَابِيَّ وَقَالَ ‏ ‏الْأَيْمَنَ فَالْأَيْمَنَ
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কিছু দুধ আনা হল। তাতে পানি মেশানো ছিল। তাঁর ডানদিকে ছিল এক বেদুঈন। বামদিকে হযরত আবু বকর সিদ্দীক। তিনি প্রথমে সে দুধ নিজে পান করলেন। তারপর বেদুঈনকে দিলেন এবং বললেন, ডানদিকের জনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তারপর যে ব্যক্তি তার ডানে।(সহীহ বুখারী: ৫২১৯; সহীহ মুসলিম: ২০২৯; জামে তিরমিযী: ১৮৯৩)

এ ঘটনায়ও দেখা যাচ্ছে মজলিসের সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে গ্রহণ করার পর তাঁর ডানের জনকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যদিও সে একজন বেদুঈনই। সুতরাং প্রথমে সর্বাপেক্ষা সম্মানীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তারপর তার ডানকে। যদিও তার ডানে বামের জনের চেয়ে মর্যাদায় অগ্রগামী ব্যক্তি বিদ্যমান থাকে।

যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার উত্তরে সেই বালক সাহাবী বললেন-
لا واللَّهِ يا رَسولَ اللَّهِ، لا أُوثِرُ بنَصِيبِي مِنْكَ أحَدًا (না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আপনার কাছ থেকে পাওয়া আমার অংশে আমি কাউকে অগ্রাধিকার দেব না)। অর্থাৎ আপনি আল্লাহ তা'আলার মহান রাসূল। আপনার কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তাতে বরকতই বরকত। আমি ডানদিকে থাকায় যখন এ বরকতপূর্ণ পানীয়ে আমার অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন এ পানীয়তে আমি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেব না। তা এ কারণে নয় যে, এটা খুব মজাদার পানীয়। বরং এ কারণে যে, এর থেকে আপনি পান করায় এটা বরকতপূর্ণ হয়ে গেছে। তাই এতে ছাড় দেওয়া তো বরকতে ছাড় দেওয়ার নামান্তর। তা আমি করতে পারব না।

তিনি বলেছেন, কাউকে অগ্রাধিকার দেব না। অর্থাৎ তিনি যেই হোন। আপন হোক বা পর, কাছের হোক বা দূরের, বয়স্ক হোক বা অল্পবয়স্ক, সম্মানী ব্যক্তি হোন বা সাধারণ ব্যক্তি।

বলাবাহুল্য এটা সেই বালক, আর যদি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. নিজেই হয়ে থাকেন, তবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। ওই বালকবয়সেই তিনি বস্তুর মর্যাদা নিরূপণ করতে জানতেন। কোন জিনিসে ছাড় দেওয়া যায় আর কোন জিনিসে দেওয়া যায় না, তা ভালোভাবে বুঝতেন। কেন ছাড় দেওয়া যায় না তা ব্যাখ্যা করতে পারতেন। ছাড় না দেওয়ার কারণও যৌক্তিকভাবে বোঝানোর ক্ষমতা তিনি রাখতেন। বিভিন্ন কাজকর্মে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি.-এর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। এ কারণেই একজন তরুণ হওয়া সত্ত্বেও হযরত উমর রাযি.-এর পরামর্শসভায় তিনি স্থান লাভ করেছিলেন। যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বালকের আবেগ-অনুভূতি ও তাঁর অধিকারের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন।

فَتَلَّهُ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ فِي يَدِهِ (ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতে সজোরে তা রাখলেন)। تَلَّ অর্থ রাখা, সজোরে রাখা। মূলত শব্দটির উৎপত্তি التل থেকে। এর অর্থ টিলা বা উঁচু স্থান। উঁচু স্থান থেকে কোনওকিছু নিক্ষেপ করা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হতো। পরে এর মধ্যে ব্যাপকতা আসে এবং যে-কোনওভাবে নিক্ষেপ করা বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালকটির হাতে এমনভাবে পাত্রটি রেখেছিলেন, যেন কিছুটা নিক্ষেপ করার মতো হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত আদরমিশ্রিত কৃত্রিম রাগের অবস্থায় এরূপ করা হয়ে থাকে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অবশিষ্ট খাবার, পানীয় বা অন্য যে-কোনও বস্তু বিতরণকালে সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। তারপর তার ডানদিক থেকে বিতরণ করা। এটিই সঠিক আদব।

খ. এ ক্ষেত্রে বামদিকের কাউকে দিতে চাইলে ডানদিকে যারা থাকে তাদের অনুমতি নিতে হবে।

গ. অনেক পরিবেশনকারী মনে করে, তার ডানে যেই হবে তার থেকেই আরম্ভ করা হবে। এটা ভুল কর্মপন্থা। সঠিক পদ্ধতি হলো মজলিসে সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তি যিনি হবেন, প্রথমে তার নিকট যাওয়া এবং তার থেকেই বিতরণ আরম্ভ করা। তারপর তারই ডানদিক থেকে। বিতরণকারীর ডানদিক থেকে নয়।

ঘ. বিতরণের বস্তুটি বরকতপূর্ণ হলে তাতে নিজ অধিকার ত্যাগ না করা দূষণীয় নয়।

ঙ. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির স্পর্শ দ্বারা বরকত ও কল্যাণ লাভ হয়।

চ. বরকতপূর্ণ বস্তুতে স্বার্থত্যাগের জন্য গণ্যমান্য ব্যক্তির অনুরোধ রক্ষা না করাটা বেয়াদবি নয়।

ছ. বরকতপূর্ণ বিষয়ে নিজ অধিকার লাভে আগ্রহ প্রকাশ দীনী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশংসনীয়।

জ. নিজের অধীন কারও উপর এমন কোনও ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়, যা দ্বারা তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন