আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
১- ঈমানের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৫২
৩৯. দ্বীন রক্ষাকারীর ফযীলত
৫০। আবু নুআয়ম (রাহঃ) ......... নু’মান ইবনে বশীর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, হালালও স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এ দুয়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয়- যা অনেকেই জানেনা। যে ব্যক্তি সেই সন্দেহজনক বিষয়সমূহ থেকে বেঁচে থাকবে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়সমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তার উদাহরণ সে রাখালের ন্যায়, যে তার পশু বাদশাহর সংরক্ষিত চারণভুমির আশে পাশে চরায়, অচিরেই সেগুলোর সেখানে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জেনে রাখ যে, প্রত্যেক বাদশাহরই একটি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। আরো জেনে রাখ যে, আল্লাহর যমীনে তাঁর সংরক্ষিত এলাকা হল তাঁর নিষিদ্ধ কাজসমূহ। জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল কলব।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কয়েকটি হাদীছকে কেন্দ্র করে সমগ্র দীন ও শরী'আত আবর্তিত হয়, এটি তার অন্যতম। সেরকম হাদীছ তিনটি। আরেকটি হাদীছ হল-
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى (সমস্ত আমল নিয়তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করে)।(সহীহ বুখারী: ১: সহীহ মুসলিম: ১৯০৭; সুনানে আবু দাউদ: ২২০১; জামে তিরমিযী: ১৬৪৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২২৭ )
আর তৃতীয় হাদীছ হল- مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ (ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল যা-কিছু অনর্থক তা ছেড়ে দেওয়া)।(জামে' তিরমিযী: ২৩১৭: সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৭৬)
ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর মতে এরকম মৌলিক হাদীছ হল চারটি। এ তিনটি, আর চতুর্থটি হল- لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ (তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তা পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে)।(সহীহ বুখারী: ১৩; সহীহ মুসলিম: ৪৫; জামে তিরমিযী: ২৫১৫। সুনানে নাসাঈ হাদীছ: ৫০১৬)
সে হিসেবে উলামায়ে কেরাম বলেন, এ হাদীছটি ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা এক-চতুর্থাংশ।
এ হাদীছটির এতটা গুরুত্বের কারণ এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মুমিন ও মুসলিম হতে হলে খাদ্য, পানীয়, পোশাক, বিবাহ ইত্যাদি বৈধ ও হালাল পন্থায় হতে হবে আর সেজন্য কোনটা হালাল ও কোনটা হারাম তা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। আর যেসব বিষয় সন্দেহযুক্ত, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তা থেকে বিরত থাকার দ্বারা নিজ দীন ও সম্মান রক্ষা পায়। তিনি এ বিষয়টিকে একটা দৃষ্টান্ত দ্বারাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারপর কলব ও আত্মার সংশোধনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এসবের দিকে লক্ষ করে কোনও কোনও বিজ্ঞ আলেম বলেন, এই একটি হাদীছ থেকেই ইসলামের যাবতীয় বিধান নির্ণয় করা সম্ভব।
إِنَّ الْحَلَالَ بَينٌ (নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ শরী'আত যা হালাল করেছে তা এমনই স্পষ্ট, যার ভেতর কোনও সন্দেহ নেই। হয়তো তা কুরআন-হাদীছে সুনির্দিষ্টভাবে হালাল বলে দেওয়া হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা হালাল সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন খাদ্যশস্য ও ফল-ফলাদি, গবাদি পশু, পবিত্র পানীয়, তুলা, পশম ইত্যাদির তৈরি পোশাক, বেচাকেনা, মীরাছ, হিবা ও হাদিয়াসূত্রে অর্জিত মালামাল, গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ ইত্যাদি।
وَإِنَّ الْحَرَامَ بَينٌ (এবং হারামও সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ কুরআন-হাদীছে যেসব বিষয়কে হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা যা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে, তার মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই। সকলের কাছেই তা হারাম হিসেবে পরিষ্কার। যেমন মৃতজন্তু, রক্ত ও শূকরের গোশত খাওয়া, মদপান করা, মাহরাম নারীকে বিবাহ করা, ব্যভিচার করা, পুরুষের জন্য রেশমি পোশাক পরিধান করা, সুদ-ঘুষ ও চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে হস্তগত সম্পদ ভোগ করা ইত্যাদি।
وَبَيْنَهُمَا مُشتَبَهَاتٌ (উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়)। অর্থাৎ হালাল ও হারাম বিষয়াবলির মাঝখানে এমন কিছু বিষয় আছে, যা হালাল না হারাম সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। একদিক থেকে তা হালালের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সে হিসেবে তা হালাল বলে মনে হয়। আবার অন্যদিক থেকে হারামের সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে। সে কারণে তাকে হারাম বলেও মনে হয়। এমনিভাবে কোনও কোনও দলীল দ্বারা মনে হয় তা হালাল। আবার কোনও কোনও দলীল দ্বারা হারামও বোঝা যায়। এ অবস্থায় সেরকম বিষয়কে হালাল মনে করা হবে না হারাম, এ নিয়ে সন্দেহ জন্মায়। যেমন ঘোড়া ও গাধা খাওয়া, হিংস্র পশুর চামড়া দ্বারা তৈরি পোশাক পরিধান করা ইত্যাদি। কোনও বিষয়ে হালাল বা হারাম হওয়ার সন্দেহ দেখা দেয় বিভিন্ন কারণে। যেমন-
(ক) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য অতি অল্পসংখ্যক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছে। ফলে সমস্ত আলেমের কাছে তা পৌঁছায়নি।
(খ) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য দু'রকম আছে। এক হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হালাল, অন্য হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হারাম।
(গ) হয়তো সে বিষয়ে হাদীছের সুস্পষ্ট ভাষ্য নেই। ফলে হাদীছের কোনও সাধারণ ভাষ্য বা সুনির্দিষ্ট কোনও বিষয় সম্পর্কিত ভাষ্যের বিপরীত অর্থ কিংবা কিয়াস দ্বারা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর তা নিতে গিয়ে মুজতাহিদ আলেমদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়।
(ঘ) হয়তো সে সম্পর্কে কোনও আদেশ বা নিষেধসূচক বাণী আছে। এখন সে আদেশটিকে অবশ্যপালনীয় অর্থে ধরা হবে না অনুমোদন অর্থে, এটা অনেকের পক্ষেই সহজে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তা সম্ভব হয় অল্পসংখ্যক আলেমের পক্ষে, শরী'আতের পরিভাষায় যাদেরকে মুজতাহিদ বলা হয়।
যখন কোনও জিনিস নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় যে, সেটি হালাল না হারাম, আর সে সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর কোনও স্পষ্ট নির্দেশনা বা ইজমা' থাকে না, তখন মুজতাহিদ আলেম তা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি নিজ গবেষণার ভিত্তিতে সেটিকে হালালের কাতারে ফেলেন অথবা হারামের কাতারে। তখন সেটি হালাল বা হারাম সাব্যস্ত হয়। কখনও কখনও মুজতাহিদের পক্ষেও সে বিষয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয় না। ফলে সেটিকে হালাল ধরা হবে না হারাম, তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। এ অবস্থায় পরহেযগারীর দাবি তা থেকে বেঁচে থাকা। এরূপ বিষয়কে সাধারণত মাকরূহ বলা হয়।
لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ (বহু মানুষ তা জানে না)। অর্থাৎ সাধারণ স্তরের মানুষ বুঝতে পারে না তা হালাল না হারাম। কিন্তু যারা পরিপক্ক আলেম তারা ঠিকই বুঝতে পারে। তাদের কাছে সে বিষয়ে কোনও অস্পষ্টতা থাকে না। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের করণীয় নির্ভরযোগ্য আলেমের শরণাপন্ন হওয়া এবং তিনি যে ফয়সালা দেন সে অনুযায়ী আমল করা।
কেউ যদি সেরকম কোনও আলেমের সন্ধান না পায়, তবে তার কর্তব্য সে বিষয়টিকে সন্দেহের স্থানে রেখে দেওয়া, নিজের পক্ষ থেকে কোনও ফয়সালা গ্রহণ না করা। কেননা হতে পারে সে বিষয়টিকে হালাল মনে করছে অথচ বাস্তবিকপক্ষে সেটি হারাম। এ অবস্থায় সে তা ভোগ করলে হারাম বস্তু ভোগ করা হবে। তাই হাদীছটির পরের অংশে এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ (সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল)। অর্থাৎ লোকে তার দীনদারী নিয়ে কোনও অভিযোগ তুলতে পারবে না। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হলে যারা সেটিকে হারাম মনে করে তারা এই বলে সমালোচনা করবে যে, সে হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তার মান-সম্মানও ক্ষুণ্ণ হবে।
وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ (পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল)। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হতে থাকলে এক পর্যায়ে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর সে অভ্যাস পর্যায়ক্রমে মানুষকে হারামের দিকে টেনে নেয়। পরিশেষে এরূপ ব্যক্তি নির্দ্বিধায় হারামেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। বাক্যটির এরূপ ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে যে, কোনও ব্যক্তি যেই সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হয়েছে, সে বিষয়টি বাস্তবিকপক্ষে হারাম হতে পারে। এ অবস্থায় সে তো মনে করেছিল সন্দেহযুক্ত কাজ করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে করল হারাম কাজ।
উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজ বেশি বেশি করে, পরহেযগারী ত্যাগ করার কারণে তার অন্তর ক্রমান্বয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ফলে সে অজান্তেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাকওয়া-পরহেযগারীর নূর না থাকায় সে তা উপলব্ধি করতে পারে না।
বলা হয়ে থাকে, মাকরূহ হল হালাল ও হারামের মধ্যবর্তী একটি ঘাঁটি। যে ব্যক্তি বেশি বেশি মাকরূহ কাজে লিপ্ত হয়, সে মধ্যবর্তী ঘাঁটিটি পার হয়ে যায় আর এভাবে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অতএব হারাম থেকে বাঁচার জন্য মাকরূহ থেকেও বাঁচা জরুরি। সুতরাং হাদীছটির এক বর্ণনায় আছে-
فَمَنْ تَرَكَ مَا اشْتَبَهَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ، كَانَ لِمَا اسْتَبَانَ لَهُ أَتْرَكَ ، وَمَنِ اجْتَرَأَ عَلَى مَا شَكّ فِيهِ، أَوْشَكَ أَنْ يُوْقَعَ فِي الْحَرَامِ
‘যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহ আছে এমন বিষয় পরিত্যাগ করে, সে সুস্পষ্ট গুনাহ আরও বেশিই পরিত্যাগ করবে। অপরদিকে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজে ধৃষ্টতা দেখায়, সে অচিরেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে।(সহীহ বুখারী: ২০৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১০৪০১; শু'আবুল ঈমান: ৫৩৫৭)
كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوْشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ ‘ঠিক ওই রাখালের মতো, যে হিমা (সরকারি সংরক্ষিত ভূমি)-এর আশেপাশে পশু চড়ায়। তার অসতর্কতাবশত হিমায় ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। اَلْحِمَى -এর অর্থ সরকারি চারণভূমি, যে ভূমি সরকারি পশু চরানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। তাতে জনসাধারণের পশু চরানো নিষেধ থাকে। প্রাচীনকালে গোত্রপ্রধানেরাও নিজেদের জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করত। তারা ঘোষণা করে দিত, এ ভূমিতে অন্য কেউ পশু চরাতে পারবে না।
এটা একটা দৃষ্টান্ত। এর মাধ্যমে সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির অবস্থা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে যে, এ ব্যক্তির অবস্থা হল ওই রাখালের মতো, যে সংরক্ষিত ভূমির আশেপাশে পশু চরায়। ওই রাখালের ক্ষেত্রে যেমন আশঙ্কা রয়েছে তার পশু যে-কোনও সময় সংরক্ষিত ভূমির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে, তেমনি সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও যে-কোনও সময় হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে নিষিদ্ধ ভূমিতে পশু চরানোর দায়ে যেমন রাখাল দণ্ডপ্রাপ্ত হতে পারে, তেমনি হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার কারণে এ ব্যক্তিরও শাস্তিভোগের আশঙ্কা থাকে। সে শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় একটাই- সন্দেহযুক্ত কাজ পরিহার করা, যেমন রাখালেরও দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার উপায় হল নিষিদ্ধভূমির আশেপাশে পশু চরানো হতে বিরত থাকা।
أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِك حِمى ‘শোনো হে! প্রত্যেক বাদশারই হিমা (সংরক্ষিত ভূমি) থাকে'। অর্থাৎ প্রত্যেক বাদশাই রাষ্ট্রীয় পশু চরানোর জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করে থাকে। বাদশার পক্ষ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হয় কেউ যেন ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে না যায়। যে ব্যক্তি সরকারি শাস্তির ভয় রাখে এবং তা থেকে বাঁচতে চায়, সে কখনও ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে যায় না। ফলে সে শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। আর যার সেই ভয় নেই, সে ঠিকই ওই ভূমির পাশে পশু চরায়। তার পশু যে নিষিদ্ধ ভূমিতে ঢুকে পড়বে না, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর তা যদি ঢুকে পড়েই, তবে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللَّهِ مَحَارِمُهُ (শোনো হে! আল্লাহর হিমা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ)। অর্থাৎ আল্লাহ হলেন সমস্ত রাজার রাজা। রাজাদের যেমন হিমা বা সংরক্ষিত স্থান থাকে, তেমনি সকল রাজার রাজা আল্লাহরও সংরক্ষিত স্থান আছে। আর তা হচ্ছে ওইসমস্ত বিষয়, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের কোনও একটিতে লিপ্ত হবে, সে শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছাবে, তার যে-কোনও সময় তাতে লিপ্ত হয়ে পড়ারও আশঙ্কা আছে। কাজেই আল্লাহর শাস্তি থেকে যে ব্যক্তি বাঁচতে চায়, তার কর্তব্য হবে হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের ধারেকাছেও না যাওয়া। মনে রাখতে হবে, রাজা-বাদশার শাস্তির ভয়ে যখন তাদের হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকেও বিরত থাকা হয়, তখন মহান আল্লাহর হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকে তো আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে দূরে থাকা উচিত। কেননা তাঁর শাস্তি রাজা-বাদশাদের শাস্তি অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি কঠিন।
أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً (শোনো হে! শরীরের ভেতর একটি মাংসপিণ্ড আছে)। এই বলে কলব বা হৃদয়ের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কেননা তার সঙ্গে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিহার করা না করার গভীর সম্পর্ক আছে। হাদীছটির শেষে মাংসপিণ্ডটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে 'কলব'-এর দ্বারা। কলব অর্থ হৃৎপিণ্ড। এটা অন্তর বা আত্মার বাহন। এটি মানবদেহের একটি ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষুদ্র হলেও এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য এটি রাজার মতো। রাজার মতোই সে অন্যসব অঙ্গকে পরিচালনা করে। রাজা ভালো হলে তার পরিচালনা ভালো হয়। মন্দ হলে পরিচালনাও মন্দ হয়। কলবের বিষয়টাও সেরকমই। সুতরাং হাদীছটির পরের অংশে ইরশাদ হয়েছে-
إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ (সেটি ঠিক থাকলে সমস্ত শরীর ঠিক থাকে। আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত শরীর নষ্ট হয়ে যায়)। অর্থাৎ অন্তর যদি হিদায়াতের আলোয় আলোকিত থাকে, তাতে ঈমান থাকে পরিপক্ক, দীন সম্পর্কে থাকে পরিপূর্ণ ধারণা, থাকে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতমুখিতা, তবে সে অন্তর হয় সুস্থ ও পরিশুদ্ধ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর আনুগত্যে প্রস্তুত করে। ফলে তা দ্বারা সর্বাবস্থায় সৎকর্ম সম্পন্ন হয় ও উন্নত আখলাক-চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি থাকে হিদায়াতশূন্য এবং তাতে থাকে কুফর ও জাহিলিয়াতের অন্ধকার, তবে সে অন্তর হয় নষ্ট ও অসুস্থ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে নষ্ট কাজেই ব্যবহার করে। ফলে তা দ্বারা নানারকম পাপাচার হয় ও দুশ্চরিত্রের প্রকাশ ঘটে।
বোঝা গেল অন্তরের ইসলাহ ও সংশোধন করা অতীব জরুরি। অন্তরের ইসলাহ না হলে কেবল আইন-কানুন বা শাসন দ্বারা অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে না। অপরাধ ও পাপকর্ম তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাই হয়। যে হৃদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচালনা করে, তা যদি সুস্থ না হয়, তবে কেবল আইন দ্বারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থ ব্যবহার কীভাবে সম্ভব হতে পারে? এ কারণেই যারা আত্মিক চিকিৎসকের দ্বারা আপন অন্তরের আরোগ্যসাধনা করে, তাদের সুপথে পরিচালনার জন্য সরকারি আইনের প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে যারা এ চিকিৎসার ধার ধারে না, কোনও আইন ও শাসন তাদেরকে অন্যায়-অনাচার থেকে ফেরাতে পারে না। সুতরাং উন্নত, সুস্থ ও পরিশুদ্ধ জীবন প্রত্যাশীদের উচিত সবার আগে নিজ আত্মিক পরিশুদ্ধিতে মনোনিবেশ করা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যেসব বিষয় হালাল না হারাম তা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তা পরিহার করাই তাকওয়ার দাবি।
খ. সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করার দ্বারা নিজ দীনদারি ও সম্মান রক্ষা পায়।
গ. সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
ঘ. কলব বা অন্তরের ইসলাহ অতীব জরুরি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ হতে বাঁচানোর এটাই প্রধান উপায়।
ঙ. এ হাদীছটি দ্বারা উলামায়ে কেরাম বিশেষত মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা সম্পর্কেও ধারণা লাভ হয়।
চ. এর দ্বারা সুলুক ও তাসাউওফের চর্চা, যা দ্বারা কিনা অন্তরের ইসলাহ করাই মূল উদ্দেশ্য, এর গুরুত্বও বুঝে আসে।
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى (সমস্ত আমল নিয়তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করে)।(সহীহ বুখারী: ১: সহীহ মুসলিম: ১৯০৭; সুনানে আবু দাউদ: ২২০১; জামে তিরমিযী: ১৬৪৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২২৭ )
আর তৃতীয় হাদীছ হল- مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ (ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল যা-কিছু অনর্থক তা ছেড়ে দেওয়া)।(জামে' তিরমিযী: ২৩১৭: সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৭৬)
ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর মতে এরকম মৌলিক হাদীছ হল চারটি। এ তিনটি, আর চতুর্থটি হল- لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ (তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তা পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে)।(সহীহ বুখারী: ১৩; সহীহ মুসলিম: ৪৫; জামে তিরমিযী: ২৫১৫। সুনানে নাসাঈ হাদীছ: ৫০১৬)
সে হিসেবে উলামায়ে কেরাম বলেন, এ হাদীছটি ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা এক-চতুর্থাংশ।
এ হাদীছটির এতটা গুরুত্বের কারণ এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মুমিন ও মুসলিম হতে হলে খাদ্য, পানীয়, পোশাক, বিবাহ ইত্যাদি বৈধ ও হালাল পন্থায় হতে হবে আর সেজন্য কোনটা হালাল ও কোনটা হারাম তা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। আর যেসব বিষয় সন্দেহযুক্ত, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তা থেকে বিরত থাকার দ্বারা নিজ দীন ও সম্মান রক্ষা পায়। তিনি এ বিষয়টিকে একটা দৃষ্টান্ত দ্বারাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারপর কলব ও আত্মার সংশোধনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এসবের দিকে লক্ষ করে কোনও কোনও বিজ্ঞ আলেম বলেন, এই একটি হাদীছ থেকেই ইসলামের যাবতীয় বিধান নির্ণয় করা সম্ভব।
إِنَّ الْحَلَالَ بَينٌ (নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ শরী'আত যা হালাল করেছে তা এমনই স্পষ্ট, যার ভেতর কোনও সন্দেহ নেই। হয়তো তা কুরআন-হাদীছে সুনির্দিষ্টভাবে হালাল বলে দেওয়া হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা হালাল সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন খাদ্যশস্য ও ফল-ফলাদি, গবাদি পশু, পবিত্র পানীয়, তুলা, পশম ইত্যাদির তৈরি পোশাক, বেচাকেনা, মীরাছ, হিবা ও হাদিয়াসূত্রে অর্জিত মালামাল, গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ ইত্যাদি।
وَإِنَّ الْحَرَامَ بَينٌ (এবং হারামও সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ কুরআন-হাদীছে যেসব বিষয়কে হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা যা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে, তার মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই। সকলের কাছেই তা হারাম হিসেবে পরিষ্কার। যেমন মৃতজন্তু, রক্ত ও শূকরের গোশত খাওয়া, মদপান করা, মাহরাম নারীকে বিবাহ করা, ব্যভিচার করা, পুরুষের জন্য রেশমি পোশাক পরিধান করা, সুদ-ঘুষ ও চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে হস্তগত সম্পদ ভোগ করা ইত্যাদি।
وَبَيْنَهُمَا مُشتَبَهَاتٌ (উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়)। অর্থাৎ হালাল ও হারাম বিষয়াবলির মাঝখানে এমন কিছু বিষয় আছে, যা হালাল না হারাম সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। একদিক থেকে তা হালালের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সে হিসেবে তা হালাল বলে মনে হয়। আবার অন্যদিক থেকে হারামের সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে। সে কারণে তাকে হারাম বলেও মনে হয়। এমনিভাবে কোনও কোনও দলীল দ্বারা মনে হয় তা হালাল। আবার কোনও কোনও দলীল দ্বারা হারামও বোঝা যায়। এ অবস্থায় সেরকম বিষয়কে হালাল মনে করা হবে না হারাম, এ নিয়ে সন্দেহ জন্মায়। যেমন ঘোড়া ও গাধা খাওয়া, হিংস্র পশুর চামড়া দ্বারা তৈরি পোশাক পরিধান করা ইত্যাদি। কোনও বিষয়ে হালাল বা হারাম হওয়ার সন্দেহ দেখা দেয় বিভিন্ন কারণে। যেমন-
(ক) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য অতি অল্পসংখ্যক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছে। ফলে সমস্ত আলেমের কাছে তা পৌঁছায়নি।
(খ) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য দু'রকম আছে। এক হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হালাল, অন্য হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হারাম।
(গ) হয়তো সে বিষয়ে হাদীছের সুস্পষ্ট ভাষ্য নেই। ফলে হাদীছের কোনও সাধারণ ভাষ্য বা সুনির্দিষ্ট কোনও বিষয় সম্পর্কিত ভাষ্যের বিপরীত অর্থ কিংবা কিয়াস দ্বারা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর তা নিতে গিয়ে মুজতাহিদ আলেমদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়।
(ঘ) হয়তো সে সম্পর্কে কোনও আদেশ বা নিষেধসূচক বাণী আছে। এখন সে আদেশটিকে অবশ্যপালনীয় অর্থে ধরা হবে না অনুমোদন অর্থে, এটা অনেকের পক্ষেই সহজে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তা সম্ভব হয় অল্পসংখ্যক আলেমের পক্ষে, শরী'আতের পরিভাষায় যাদেরকে মুজতাহিদ বলা হয়।
যখন কোনও জিনিস নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় যে, সেটি হালাল না হারাম, আর সে সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর কোনও স্পষ্ট নির্দেশনা বা ইজমা' থাকে না, তখন মুজতাহিদ আলেম তা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি নিজ গবেষণার ভিত্তিতে সেটিকে হালালের কাতারে ফেলেন অথবা হারামের কাতারে। তখন সেটি হালাল বা হারাম সাব্যস্ত হয়। কখনও কখনও মুজতাহিদের পক্ষেও সে বিষয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয় না। ফলে সেটিকে হালাল ধরা হবে না হারাম, তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। এ অবস্থায় পরহেযগারীর দাবি তা থেকে বেঁচে থাকা। এরূপ বিষয়কে সাধারণত মাকরূহ বলা হয়।
لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ (বহু মানুষ তা জানে না)। অর্থাৎ সাধারণ স্তরের মানুষ বুঝতে পারে না তা হালাল না হারাম। কিন্তু যারা পরিপক্ক আলেম তারা ঠিকই বুঝতে পারে। তাদের কাছে সে বিষয়ে কোনও অস্পষ্টতা থাকে না। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের করণীয় নির্ভরযোগ্য আলেমের শরণাপন্ন হওয়া এবং তিনি যে ফয়সালা দেন সে অনুযায়ী আমল করা।
কেউ যদি সেরকম কোনও আলেমের সন্ধান না পায়, তবে তার কর্তব্য সে বিষয়টিকে সন্দেহের স্থানে রেখে দেওয়া, নিজের পক্ষ থেকে কোনও ফয়সালা গ্রহণ না করা। কেননা হতে পারে সে বিষয়টিকে হালাল মনে করছে অথচ বাস্তবিকপক্ষে সেটি হারাম। এ অবস্থায় সে তা ভোগ করলে হারাম বস্তু ভোগ করা হবে। তাই হাদীছটির পরের অংশে এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ (সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল)। অর্থাৎ লোকে তার দীনদারী নিয়ে কোনও অভিযোগ তুলতে পারবে না। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হলে যারা সেটিকে হারাম মনে করে তারা এই বলে সমালোচনা করবে যে, সে হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তার মান-সম্মানও ক্ষুণ্ণ হবে।
وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ (পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল)। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হতে থাকলে এক পর্যায়ে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর সে অভ্যাস পর্যায়ক্রমে মানুষকে হারামের দিকে টেনে নেয়। পরিশেষে এরূপ ব্যক্তি নির্দ্বিধায় হারামেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। বাক্যটির এরূপ ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে যে, কোনও ব্যক্তি যেই সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হয়েছে, সে বিষয়টি বাস্তবিকপক্ষে হারাম হতে পারে। এ অবস্থায় সে তো মনে করেছিল সন্দেহযুক্ত কাজ করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে করল হারাম কাজ।
উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজ বেশি বেশি করে, পরহেযগারী ত্যাগ করার কারণে তার অন্তর ক্রমান্বয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ফলে সে অজান্তেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাকওয়া-পরহেযগারীর নূর না থাকায় সে তা উপলব্ধি করতে পারে না।
বলা হয়ে থাকে, মাকরূহ হল হালাল ও হারামের মধ্যবর্তী একটি ঘাঁটি। যে ব্যক্তি বেশি বেশি মাকরূহ কাজে লিপ্ত হয়, সে মধ্যবর্তী ঘাঁটিটি পার হয়ে যায় আর এভাবে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অতএব হারাম থেকে বাঁচার জন্য মাকরূহ থেকেও বাঁচা জরুরি। সুতরাং হাদীছটির এক বর্ণনায় আছে-
فَمَنْ تَرَكَ مَا اشْتَبَهَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ، كَانَ لِمَا اسْتَبَانَ لَهُ أَتْرَكَ ، وَمَنِ اجْتَرَأَ عَلَى مَا شَكّ فِيهِ، أَوْشَكَ أَنْ يُوْقَعَ فِي الْحَرَامِ
‘যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহ আছে এমন বিষয় পরিত্যাগ করে, সে সুস্পষ্ট গুনাহ আরও বেশিই পরিত্যাগ করবে। অপরদিকে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজে ধৃষ্টতা দেখায়, সে অচিরেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে।(সহীহ বুখারী: ২০৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১০৪০১; শু'আবুল ঈমান: ৫৩৫৭)
كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوْشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ ‘ঠিক ওই রাখালের মতো, যে হিমা (সরকারি সংরক্ষিত ভূমি)-এর আশেপাশে পশু চড়ায়। তার অসতর্কতাবশত হিমায় ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। اَلْحِمَى -এর অর্থ সরকারি চারণভূমি, যে ভূমি সরকারি পশু চরানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। তাতে জনসাধারণের পশু চরানো নিষেধ থাকে। প্রাচীনকালে গোত্রপ্রধানেরাও নিজেদের জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করত। তারা ঘোষণা করে দিত, এ ভূমিতে অন্য কেউ পশু চরাতে পারবে না।
এটা একটা দৃষ্টান্ত। এর মাধ্যমে সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির অবস্থা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে যে, এ ব্যক্তির অবস্থা হল ওই রাখালের মতো, যে সংরক্ষিত ভূমির আশেপাশে পশু চরায়। ওই রাখালের ক্ষেত্রে যেমন আশঙ্কা রয়েছে তার পশু যে-কোনও সময় সংরক্ষিত ভূমির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে, তেমনি সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও যে-কোনও সময় হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে নিষিদ্ধ ভূমিতে পশু চরানোর দায়ে যেমন রাখাল দণ্ডপ্রাপ্ত হতে পারে, তেমনি হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার কারণে এ ব্যক্তিরও শাস্তিভোগের আশঙ্কা থাকে। সে শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় একটাই- সন্দেহযুক্ত কাজ পরিহার করা, যেমন রাখালেরও দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার উপায় হল নিষিদ্ধভূমির আশেপাশে পশু চরানো হতে বিরত থাকা।
أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِك حِمى ‘শোনো হে! প্রত্যেক বাদশারই হিমা (সংরক্ষিত ভূমি) থাকে'। অর্থাৎ প্রত্যেক বাদশাই রাষ্ট্রীয় পশু চরানোর জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করে থাকে। বাদশার পক্ষ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হয় কেউ যেন ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে না যায়। যে ব্যক্তি সরকারি শাস্তির ভয় রাখে এবং তা থেকে বাঁচতে চায়, সে কখনও ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে যায় না। ফলে সে শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। আর যার সেই ভয় নেই, সে ঠিকই ওই ভূমির পাশে পশু চরায়। তার পশু যে নিষিদ্ধ ভূমিতে ঢুকে পড়বে না, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর তা যদি ঢুকে পড়েই, তবে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللَّهِ مَحَارِمُهُ (শোনো হে! আল্লাহর হিমা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ)। অর্থাৎ আল্লাহ হলেন সমস্ত রাজার রাজা। রাজাদের যেমন হিমা বা সংরক্ষিত স্থান থাকে, তেমনি সকল রাজার রাজা আল্লাহরও সংরক্ষিত স্থান আছে। আর তা হচ্ছে ওইসমস্ত বিষয়, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের কোনও একটিতে লিপ্ত হবে, সে শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছাবে, তার যে-কোনও সময় তাতে লিপ্ত হয়ে পড়ারও আশঙ্কা আছে। কাজেই আল্লাহর শাস্তি থেকে যে ব্যক্তি বাঁচতে চায়, তার কর্তব্য হবে হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের ধারেকাছেও না যাওয়া। মনে রাখতে হবে, রাজা-বাদশার শাস্তির ভয়ে যখন তাদের হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকেও বিরত থাকা হয়, তখন মহান আল্লাহর হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকে তো আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে দূরে থাকা উচিত। কেননা তাঁর শাস্তি রাজা-বাদশাদের শাস্তি অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি কঠিন।
أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً (শোনো হে! শরীরের ভেতর একটি মাংসপিণ্ড আছে)। এই বলে কলব বা হৃদয়ের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কেননা তার সঙ্গে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিহার করা না করার গভীর সম্পর্ক আছে। হাদীছটির শেষে মাংসপিণ্ডটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে 'কলব'-এর দ্বারা। কলব অর্থ হৃৎপিণ্ড। এটা অন্তর বা আত্মার বাহন। এটি মানবদেহের একটি ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষুদ্র হলেও এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য এটি রাজার মতো। রাজার মতোই সে অন্যসব অঙ্গকে পরিচালনা করে। রাজা ভালো হলে তার পরিচালনা ভালো হয়। মন্দ হলে পরিচালনাও মন্দ হয়। কলবের বিষয়টাও সেরকমই। সুতরাং হাদীছটির পরের অংশে ইরশাদ হয়েছে-
إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ (সেটি ঠিক থাকলে সমস্ত শরীর ঠিক থাকে। আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত শরীর নষ্ট হয়ে যায়)। অর্থাৎ অন্তর যদি হিদায়াতের আলোয় আলোকিত থাকে, তাতে ঈমান থাকে পরিপক্ক, দীন সম্পর্কে থাকে পরিপূর্ণ ধারণা, থাকে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতমুখিতা, তবে সে অন্তর হয় সুস্থ ও পরিশুদ্ধ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর আনুগত্যে প্রস্তুত করে। ফলে তা দ্বারা সর্বাবস্থায় সৎকর্ম সম্পন্ন হয় ও উন্নত আখলাক-চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি থাকে হিদায়াতশূন্য এবং তাতে থাকে কুফর ও জাহিলিয়াতের অন্ধকার, তবে সে অন্তর হয় নষ্ট ও অসুস্থ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে নষ্ট কাজেই ব্যবহার করে। ফলে তা দ্বারা নানারকম পাপাচার হয় ও দুশ্চরিত্রের প্রকাশ ঘটে।
বোঝা গেল অন্তরের ইসলাহ ও সংশোধন করা অতীব জরুরি। অন্তরের ইসলাহ না হলে কেবল আইন-কানুন বা শাসন দ্বারা অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে না। অপরাধ ও পাপকর্ম তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাই হয়। যে হৃদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচালনা করে, তা যদি সুস্থ না হয়, তবে কেবল আইন দ্বারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থ ব্যবহার কীভাবে সম্ভব হতে পারে? এ কারণেই যারা আত্মিক চিকিৎসকের দ্বারা আপন অন্তরের আরোগ্যসাধনা করে, তাদের সুপথে পরিচালনার জন্য সরকারি আইনের প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে যারা এ চিকিৎসার ধার ধারে না, কোনও আইন ও শাসন তাদেরকে অন্যায়-অনাচার থেকে ফেরাতে পারে না। সুতরাং উন্নত, সুস্থ ও পরিশুদ্ধ জীবন প্রত্যাশীদের উচিত সবার আগে নিজ আত্মিক পরিশুদ্ধিতে মনোনিবেশ করা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যেসব বিষয় হালাল না হারাম তা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তা পরিহার করাই তাকওয়ার দাবি।
খ. সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করার দ্বারা নিজ দীনদারি ও সম্মান রক্ষা পায়।
গ. সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
ঘ. কলব বা অন্তরের ইসলাহ অতীব জরুরি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ হতে বাঁচানোর এটাই প্রধান উপায়।
ঙ. এ হাদীছটি দ্বারা উলামায়ে কেরাম বিশেষত মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা সম্পর্কেও ধারণা লাভ হয়।
চ. এর দ্বারা সুলুক ও তাসাউওফের চর্চা, যা দ্বারা কিনা অন্তরের ইসলাহ করাই মূল উদ্দেশ্য, এর গুরুত্বও বুঝে আসে।
