আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৮- নামাযের ওয়াক্তের বিবরণ

হাদীস নং: ৫০৬
আন্তর্জতিক নং: ৫৩১

পরিচ্ছেদঃ ৩৫৮। মুসল্লী নামাযে তার মহান প্রতিপালকের সাথে গোপনে কথা বলে।

৫০৬। মুসলিম ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) .... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে গোপনে কথা বলে। কাজেই, সে যেন ডানদিকে থুথু না ফেলে, তবে (প্রয়োজনে) বাম পায়ের নীচে ফেলতে পারে।
তবে সাঈদ (রাহঃ) কাতাদা (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, সে যেন সামনের দিকে থুথু না ফেলে, কিন্তু বামদিকে অথবা পায়ের নীচে ফেলতে পারে। আর শু’বা (রাহঃ) বলেন, সে যেন কিবলার দিকে অথবা ডান দিকে থুথু না ফেলে, কিন্তু বামদিকে অথবা পায়ের তলায় ফেলতে পারে।
আর হুমাইদ (রাহঃ) আনাস (রাযিঃ) এর সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, সে যেন কিবলার দিকে বা ডানদিকে থুথু না ফেলে, কিন্ত বামদিকে অথবা পায়ের নীচে ফেলতে পারে।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মসজিদে) কিবলার দিকে কফ দেখতে পেলেন। এটা তাঁকে পীড়া দিল। এমনকি তাঁর চেহারায় তার ছাপ দেখা গেল। তারপর তিনি উঠে নিজ হাতে তা খুটে খুটে পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন, তোমাদের কেউ নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে কানাকানি করে। নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার ও কিবলার মাঝখানে থাকেন। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন কিবলার দিকে থুথু না ফেলে; বরং বামদিকে বা পায়ের নিচে ফেলে। তারপর তিনি নিজ চাদরের একপ্রান্ত ধরলেন এবং তাতে থুথু ফেললেন। তারপর তার একাংশ অন্য অংশের সঙ্গে রগড়ে দিলেন। তারপর বললেন, অথবা এরকম করবে। এ হাদীছটিতে বলা হয়েছে যে, মসজিদের কিবলার দিকে কেউ কফ ফেলেছিল। তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ পড়লে তিনি খুব ব্যথিত হন ও রাগ করেন। তারপর নিজ হাতে তা পরিষ্কার করেন। তারপর ইরশাদ করেন- إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ فِي صَلَاتِهِ فَإِنَّهُ يُنَاجِي رَبَّهُ (তোমাদের কেউ নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে কানাকানি করে)। কানাকানি হয় দু'দিক থেকে। নামাযে বান্দার দিক থেকে আল্লাহর সঙ্গে কানাকানি করার অর্থ হল আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করা, তাসবীহ ও তাকবীর উচ্চারণ করা ও বিভিন্ন দু'আ পাঠ করা। আর আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বান্দার সঙ্গে কানাকানি করার দ্বারা এর আক্ষরিক অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং রূপক অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তিনি বান্দার কানাকানি শোনেন এবং তা কবুল করেন ও তার উপযুক্ত প্রতিদান দেন। তারপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- وَإِنَّ رَبَّهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْقِبْلةِ (নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার ও কিবলার মাঝখানে থাকেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা মুসল্লীর নিকটবর্তী। তিনি যেন মুসল্লী ও কিবলার মাঝখানেই থাকেন। বস্তুত নামাযী ব্যক্তি যে কিবলার দিকে ফিরে থাকে, তা দ্বারা মূলত সে আল্লাহ তা'আলার অভিমুখী হয়। মূল উদ্দেশ্য যেহেতু আল্লাহ তা'আলা, পার্থিব কোনও বিষয় নয়, তাই কিবলার দিককে একটা পার্থিব বিষয়রূপে দেখা উচিত নয়। আল্লাহর অভিমুখী হওয়া একটি মহিমাপূর্ণ কাজ। সে হিসেবে কিবলারও বিশেষ মহিমা রয়েছে। আর এ কারণেই কিবলা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ইসলামের প্রতিটি নিদর্শন মর্যাদাপূর্ণ। সে মর্যাদা রক্ষা করার হুকুম রয়েছে। সে হুকুম অমান্য করা পাপ। কাজেই কিবলার মর্যাদা রক্ষা করা উচিত। থুথু বা কফ ফেলার দ্বারা সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। তাই এর থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- فَلَا يَبْزُقَنَّ أَحَدُكُمْ قِبَلَ الْقِبْلَةِ (সুতরাং তোমাদের কেউ যেন কিবলার দিকে থুথু না ফেলে)। বোঝা গেল কিবলার দিকে থুথু ফেলা গুনাহের কাজ। এটা যে কত বড় গুনাহের কাজ, বিভিন্ন হাদীছে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- مَنْ تَفَلَ تُجَاهَ الْقِبْلَةِ جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تَفْلُهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ যে ব্যক্তি কিবলার দিকে থুথু ফেলে, কিয়ামতের দিন সে এ অবস্থায় এসে হাজির হবে যে, তার সে থুথু থাকবে তার দুই চোখের মাঝখানে। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৮২৪; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৬৩৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫০৫৫) হযরত সাইব ইবন খাল্লাত রাযি. থেকে বর্ণিত- أَنَّ رَجُلاً أَمَّ قَوْمًا فَبَصَقَ فِي الْقِبْلَةِ وَرَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَنْظُرُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حِينَ فَرَغَ " لاَ يُصَلِّي لَكُمْ " . فَأَرَادَ بَعْدَ ذَلِكَ أَنْ يُصَلِّيَ لَهُمْ فَمَنَعُوهُ وَأَخْبَرُوهُ بِقَوْلِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرَ ذَلِكَ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ نَعَمْ " . وَحَسِبْتُ أَنَّهُ قَالَ إِنَّكَ آذَيْتَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ " জনৈক ব্যক্তি একদল লোকের ইমামত করছিল। এ অবস্থায় সে কিবলার দিকে থুথু ফেলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখছিলেন। সে নামায শেষ করলে তিনি (সেই লোকগুলোকে) বললেন, সে তোমাদের নামাযে ইমামত করবে না। পরে সে তাদের নামাযে ইমামত করতে চাইলে তারা তাকে বাধা দিল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা তাকে জানাল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা উল্লেখ করলে তিনি বললেন, হাঁ (অর্থাৎ আমি তাদেরকে এ কথা বলেছি)। সাইব রাযি. বলেন, আমার ধারণা তিনি তাকে বলেছিলেন, তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছ। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৮১; মুসনাদে আহমাদ: ১৬৫৬১; সহীহ ইবনে হিব্বান : ১৬৩৬) প্রশ্ন হল, কিবলার দিকে থুথু ফেলা যখন গুনাহ, তখন অন্য যে-কোনও দিকেই কি তা ফেলা যাবে? এ বিষয়ে নির্দেশনা কী? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- وَلَكِنْ عَنْ يَسَارِهِ أَوْ تَحْتَ قَدَمِهِ (বরং যেন বামদিকে বা পায়ের নিচে ফেলে)। অর্থাৎ ডানদিকে নয়। কোনও কোনও বর্ণনায় এর কারণ বলা হয়েছে যে, ডানদিকে ফিরিশতা থাকে। উল্লেখ্য, সেকালে মসজিদের মেঝেতে কংকর বিছানো থাকত। তাই বামদিকে বা পায়ের নিচে থুথু ফেলে তা কংকরের নিচে চাপা দেওয়া যেত। বর্তমানকালে সে সুযোগ নেই। তাই বর্তমানে মসজিদের ভেতর কোনওভাবেই থুথু ফেলার অবকাশ নেই। বর্তমানে হাদীছের এ নির্দেশনা মসজিদের বাইরের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ মসজিদের বাইরে থুথু ফেলার সময় লক্ষ রাখবে তা যেন কিবলার দিকে বা ডানদিকে না হয়। বরং বামদিকে ফেলবে অথবা পায়ের নিচে ফেলে পা দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। হাঁ, মসজিদের ভেতর থাকা অবস্থায় যদি থুথু আসে আর তা ফেলার প্রয়োজন দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে কী করণীয়, তা হাদীছটির পরবর্তী বাক্যে বলে দেওয়া হয়েছে- ثُمَّ أَخَذَ طَرَفَ رِدَائِهِ فَبَصَقَ فِيْهِ، ثُمَّ رَدَّ بَعْضَهُ عَلَى بَعْضٍ، فَقَالَ: أَوْ يَفْعَلُ هُكَذَا (তারপর তিনি নিজ চাদরের একপ্রান্ত ধরলেন এবং তাতে থুথু ফেললেন। তারপর তার একাংশ অন্য অংশের সঙ্গে রগড়ে দিলেন। তারপর বললেন, অথবা এরকম করবে)। অর্থাৎ মসজিদের ভেতরে কিছুতেই থুথু ফেলবে না। মসজিদ পবিত্র ও মহিমান্বিত স্থান। এর ভেতর থুথু ফেলা যায় না। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- الْبُزاقُ فِي الْمَسْجِدِ خَطِيئَةٌ، وَكَفَّارَتُهَا دَفْنهَا মসজিদে থুথু ফেলা পাপ। এর কাফফারা হল তা দাফন করা (বর্তমানকালে মুছে ফেলা)। (সহীহ মুসলিম: ৫৫২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৬৯৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৭৪৬৩; সুনানে নাসাঈ ৭২৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৬৩৭) অর্থাৎ মসজিদে থুথু ফেলার পর তা রেখে দেওয়ার যে পাপ, তার প্রায়শ্চিত্ত হবে দাফন করার দ্বারা। কিন্তু থুথু ফেলার যে পাপ, তার জন্য তাওবা করা জরুরি। তাওবার দ্বারাই তা মাফ হবে। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. মসজিদ অত্যন্ত পবিত্র স্থান। মসজিদের ভেতর কোনও নাপাক বস্তু তো নয়ই, থুথু কফ ইত্যাদি মলিন বস্তুও ফেলা উচিত নয়। তা ফেললে গুনাহ হয়। খ. মসজিদে যে ব্যক্তি কোনও ময়লা-আবর্জনা দেখতে পাবে, তার কর্তব্য তা পরিষ্কার করে ফেলা। গ. কিবলা ইসলামের একটি নিদর্শন। তাই যেদিকে কিবলা, সেদিকের আদব ও মর্যাদা রক্ষা করা উচিত। ঘ. মসজিদে তো নয়ই, মসজিদের বাইরেও কিবলার দিকে থুথু ফেলা উচিত নয়, এমনকি ডানদিকেও নয়। বরং বামদিকে বা পায়ের নিচে ফেলতে হবে। ঙ. নামাযের অবস্থা অত্যন্ত মহিমান্বিত অবস্থা। এ অবস্থায় বান্দা যেন আল্লাহর সঙ্গে কানাকানি করে। তাই নামাযী ব্যক্তির নিজের তো বটেই, অন্যদেরও উচিত তার এ অবস্থাকে বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা। চ. থুথু ফেলার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়ার সুযোগ না থাকলে কোনও কাপড় বা টিস্যুতে তা ফেলতে হবে।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন