শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ
১৮. আদালত-বিচার-সাক্ষ্য-শুনানির বিধান
হাদীস নং: ৬১৫২
আন্তর্জাতিক নং: ৬১৫৪
হাকিম কোন জিনিসের ফয়সালা করেন অতঃপর বাস্তবে তা যাহিরের খেলাফ হয়
৬১৫২-৫৪। রাবী আল-মুয়াযযিন..... হযরত উম্মে সালমা (রাযিঃ)-এর অযাদ করা গােলাম আব্দুল্লাহ ইবন রাফে হযরত উম্মে সালামা (রাযিঃ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একবার দু'জন আনসারী তাদের পাস্পরিক মত সম্পর্কে ঝগড়া করতে করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর দরবারে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তাদের কারো কোন দলীল-প্রমাণ ছিল না। তখন রাসূল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমি তো কেবল একজন মানুষ, আমার নিকট বিরোধকারী, আগমন ঘটে। আর সম্ভবত তোমাদের একজন অন্যের চেয়ে অধিক বাগ্মিতার অধিকারী হয়। অতঃপর আমি তার মধ্যে ফয়সালা করি। কারণ আমার ধারণা হয়, সে সত্যবাণী। সুতরাং যার জন্য আমি কোন মুসলমানের হকের ফয়সালা করি। বস্তুত তা আগুনের টুকরা। এখন ইচ্ছে হলে তা গ্রহণ করুক কিংবা ত্যাগ করুক। রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর এ কথাগুলো শুনে দু'জনেই কাঁদতে শুরু করলেন। তারা প্রত্যেকেই বললেন, আমার হক আমার ভাইয়ের জন্য। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, তােমরা যখন এ কাজই করেছ, তখন তােমরা যাও, বন্টন করে নাও। তােমরা সত্যকে সন্ধান কর ও লটার কর এবং তােমাদের প্রত্যেকে যেন তার সাথীকে হালাল করে দেয়।
ইবন মারযূক ......... উসামা ইবুন যায়দ (রাযিঃ) তার সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইউনুস ..... উসামা ইবন যায়দ (রাযিঃ) তাঁর সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
আবু জাফর (রাহঃ) বলেন, একদল আলিম এমত পােষণ করেন। হাকিম যে কোন ফয়সালা করবেন, কাউকে কোন মালের মালিক বানিয়ে দেয়া, কিংবা মালিকানা অধিকারের অবসান ঘটানাে, কিংবা বিবাহ প্রতিষ্ঠা করা অথবা তালাক কিংবা অনুরূপ কিছুর মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন হতে মুক্ত করা, এসব কিছুর ফয়সালা বাতিনের হুকুমের ওপর প্রযােজ্য হবে। বাতিনের হুকুম যদি যাহির মুতাবিক হয়, তবে হাকিম যে হুকুম করেছেন তা-ই ওয়াজিব হবে। যদি বাতিনের হুকুম দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের বিপরীত হয় এবং তাদের সাক্ষ্যের মাধ্যেমে হাকিম যে ফয়সালা প্রদান করেছেন সে ফয়সালার বিপরীত হয়, তবে সে ক্ষেত্রে কাযীর যে কোন ফয়সালা, চাই কাউকে কোন মালের মালিক করা হােক, হারাম করা হােক ও হালাল করা হােক, এর কোন কিছুই ওয়াজিব করবে না। আর তারা এ হাদীসকেই দলীল হিসেবে পেশ করেন। যারা এ মত পােষণ করেন, তাদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ (রাহঃ) রয়েছেন । অপরপক্ষে অন্য এক দল উলামা-ই কিরাম এর বিপরীত মত পােষণ করেন।
আল্লামা আইনী (রাযিঃ) বলেন, এরা হলেন, সাওরী, আওযাঈ, মালিক শাফিঈ, আহমদ, আবু সাওর, ওসমস্ত আহলে যাহির । ইমাম আবু দাউদ (রাযিঃ)-ও এ মত পােষণ করেন।
অন্য একটি জামাআত এর বিপরীত মত পােষণ করেন। তারা বলেন, যাহিরী সাক্ষ্যের মাধ্যমে কাউকে মালের মালিক করা হলে তা বাতিলের হুকুম মুতাবিক হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, তিনি বলেন, যে ব্যাক্তির জন্য আমি তার ভাইয়ের হকের ফয়সালা করি, সে যেন তা গ্রহণ না করে। কারণ আমি তার জন্য দোযখের আগুনের এক টুকরা কর্তন করে দেই। আর এমন সাক্ষী যারা যাহিরীভাবে আদিল, কিন্তু বাতিনভাবে অভিযুক্ত তাদের দ্বারা তালঅক ও নিকাহের যে ফয়সালা হয়েছে এবং হাকিম তাদের যাহিরের উপর ভিত্তি করে যে ফয়সালা প্রদান করেছেন এবং এ ধরনের সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা ফয়সালা করার নির্দেশও প্রদান করেছেন, তবে তা বাতিনেও ঠিক তদ্রপ হারাম হবে, যেমন যাহিরে তা হারাম। আর এর জন্য তাদের দলীল হলো ঐ হাদীস যা লিআনকারী দু'ব্যাক্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) : হতে বর্ণিত। আল্লামা আইনী (রাযিঃ) বলেন, এ উলামা-ই কিরাম হলেন আমের, শা'বী, আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান।
ইবন মারযূক ......... উসামা ইবুন যায়দ (রাযিঃ) তার সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইউনুস ..... উসামা ইবন যায়দ (রাযিঃ) তাঁর সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
আবু জাফর (রাহঃ) বলেন, একদল আলিম এমত পােষণ করেন। হাকিম যে কোন ফয়সালা করবেন, কাউকে কোন মালের মালিক বানিয়ে দেয়া, কিংবা মালিকানা অধিকারের অবসান ঘটানাে, কিংবা বিবাহ প্রতিষ্ঠা করা অথবা তালাক কিংবা অনুরূপ কিছুর মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন হতে মুক্ত করা, এসব কিছুর ফয়সালা বাতিনের হুকুমের ওপর প্রযােজ্য হবে। বাতিনের হুকুম যদি যাহির মুতাবিক হয়, তবে হাকিম যে হুকুম করেছেন তা-ই ওয়াজিব হবে। যদি বাতিনের হুকুম দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের বিপরীত হয় এবং তাদের সাক্ষ্যের মাধ্যেমে হাকিম যে ফয়সালা প্রদান করেছেন সে ফয়সালার বিপরীত হয়, তবে সে ক্ষেত্রে কাযীর যে কোন ফয়সালা, চাই কাউকে কোন মালের মালিক করা হােক, হারাম করা হােক ও হালাল করা হােক, এর কোন কিছুই ওয়াজিব করবে না। আর তারা এ হাদীসকেই দলীল হিসেবে পেশ করেন। যারা এ মত পােষণ করেন, তাদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ (রাহঃ) রয়েছেন । অপরপক্ষে অন্য এক দল উলামা-ই কিরাম এর বিপরীত মত পােষণ করেন।
আল্লামা আইনী (রাযিঃ) বলেন, এরা হলেন, সাওরী, আওযাঈ, মালিক শাফিঈ, আহমদ, আবু সাওর, ওসমস্ত আহলে যাহির । ইমাম আবু দাউদ (রাযিঃ)-ও এ মত পােষণ করেন।
অন্য একটি জামাআত এর বিপরীত মত পােষণ করেন। তারা বলেন, যাহিরী সাক্ষ্যের মাধ্যমে কাউকে মালের মালিক করা হলে তা বাতিলের হুকুম মুতাবিক হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, তিনি বলেন, যে ব্যাক্তির জন্য আমি তার ভাইয়ের হকের ফয়সালা করি, সে যেন তা গ্রহণ না করে। কারণ আমি তার জন্য দোযখের আগুনের এক টুকরা কর্তন করে দেই। আর এমন সাক্ষী যারা যাহিরীভাবে আদিল, কিন্তু বাতিনভাবে অভিযুক্ত তাদের দ্বারা তালঅক ও নিকাহের যে ফয়সালা হয়েছে এবং হাকিম তাদের যাহিরের উপর ভিত্তি করে যে ফয়সালা প্রদান করেছেন এবং এ ধরনের সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা ফয়সালা করার নির্দেশও প্রদান করেছেন, তবে তা বাতিনেও ঠিক তদ্রপ হারাম হবে, যেমন যাহিরে তা হারাম। আর এর জন্য তাদের দলীল হলো ঐ হাদীস যা লিআনকারী দু'ব্যাক্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) : হতে বর্ণিত। আল্লামা আইনী (রাযিঃ) বলেন, এ উলামা-ই কিরাম হলেন আমের, শা'বী, আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান।
6152 - حَدَّثَنَا رَبِيعٌ الْمُؤَذِّنُ، قَالَ: ثنا أَسَدٌ، قَالَ: ثنا وَكِيعٌ، عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، سَمِعَهُ مِنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ نَافِعٍ، مَوْلَى أُمِّ سَلَمَةَ عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: جَاءَ رَجُلَانِ مِنَ الْأَنْصَارِ يَخْتَصِمَانِ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَوَارِيثَ بَيْنَهُمَا قَدْ دُرِسَتْ لَيْسَتْ بَيْنَهُمَا بَيِّنَةٌ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ وَإِنَّهُ يَأْتِي الْخَصْمُ وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَبْلَغَ مِنْ بَعْضٍ فَأَقْضِيَ لَهُ بِذَلِكَ وَأَحْسِبُ أَنَّهُ صَادِقٌ فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِحَقِّ مُسْلِمٍ فَإِنَّمَا هِيَ قِطْعَةٌ مِنَ النَّارِ فَلْيَأْخُذْهَا أَوْ لِيَدَعْهَا» . فَبَكَى الرَّجُلَانِ وَقَالَ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا حَقِّي لِأَخِي. [ص:155] فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَمَّا إِذْ فَعَلْتُمَا هَذَا فَاذْهَبَا فَاقْتَسِمَا وَتَوَخَّيَا الْحَقَّ ثُمَّ اسْتَهِمَا ثُمَّ لِيُحْلِلْ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْكُمَا صَاحِبَهُ»
6153 - حَدَّثَنَا ابْنُ مَرْزُوقٍ، قَالَ: ثنا عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ، قَالَ: أنا أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ، فَذَكَرَ بِإِسْنَادِهِ مِثْلَهُ
6154 - حَدَّثَنَا يُونُسُ، قَالَ: ثنا عَبْدُ اللهِ بْنُ نَافِعٍ الصَّائِغُ، قَالَ: حَدَّثَنِي أُسَامَةُ، فَذَكَرَ بِإِسْنَادِهِ مِثْلَهُ قَالَ أَبُو جَعْفَرٍ: فَذَهَبَ قَوْمٌ إِلَى أَنَّ كُلَّ قَضَاءٍ قَضَى بِهِ حَاكِمٌ مِنْ تَمْلِيكِ مَالٍ أَوْ إِنَالَةِ مِلْكٍ عَنْ مَالٍ أَوْ مِنْ إِثْبَاتِ نِكَاحٍ أَوْ مِنْ حِلِّهِ بِطَلَاقٍ أَوْ بِمَا أَشْبَهَهُ أَنَّ ذَلِكَ كُلَّهُ عَلَى حُكْمِ الْبَاطِنِ وَأَنَّ ذَلِكَ فِي الْبَاطِنِ كَهُوَ فِي الظَّاهِرِ وَجَبَ ذَلِكَ عَلَى مَا حَكَمَ بِهِ الْحَاكِمُ. وَإِنْ كَانَ ذَلِكَ فِي الْبَاطِنِ عَلَى خِلَافِ مَا شَهِدَ بِهِ الشَّاهِدَانِ وَعَلَى خِلَافِ مَا حَكَمَ بِهِ بِشَهَادَتِهِمَا عَلَى الْحُكْمِ الظَّاهِرِ لَمْ يَكُنْ قَضَاءُ الْقَاضِي مُوجِبًا شَيْئًا مِنْ تَمْلِيكٍ وَلَا تَحْرِيمٍ وَلَا تَحْلِيلٍ وَاحْتَجُّوا فِي ذَلِكَ بِهَذَا الْحَدِيثِ. وَمِمَّنْ قَالَ بِذَلِكَ أَبُو يُوسُفَ. وَخَالَفَهُمْ فِي ذَلِكَ آخَرُونَ فَقَالُوا: مَا كَانَ مِنْ ذَلِكَ مِنْ تَمْلِيكِ مَالٍ فَهُوَ عَلَى حُكْمِ الْبَاطِنِ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِشَيْءٍ مِنْ حَقِّ أَخِيهِ فَلَا يَأْخُذْهُ فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّارِ» . وَمَا كَانَ مِنْ ذَلِكَ مِنْ قَضَاءٍ بِطَلَاقٍ أَوْ نِكَاحٍ بِشُهُودٍ ظَاهِرُهُمُ الْعَدَالَةُ وَبَاطِنُهُمُ الْجُرْحَةُ فَحَكَمَ الْحَاكِمُ بِشَهَادَتِهِمْ عَلَى ظَاهِرِهِمِ الَّذِي تَعَبَّدَ اللهَ أَنْ يَحْكُمَ بِشَهَادَةِ مِثْلِهِمْ مَعَهُ فَذَلِكَ يَحْرُمُ فِي الْبَاطِنِ كَحُرْمَتِهِ فِي الظَّاهِرِ. وَالدَّلِيلُ عَلَى هَذَا مَا قَدْ رُوِيَ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمُتَلَاعِنَيْنِ
6153 - حَدَّثَنَا ابْنُ مَرْزُوقٍ، قَالَ: ثنا عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ، قَالَ: أنا أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ، فَذَكَرَ بِإِسْنَادِهِ مِثْلَهُ
6154 - حَدَّثَنَا يُونُسُ، قَالَ: ثنا عَبْدُ اللهِ بْنُ نَافِعٍ الصَّائِغُ، قَالَ: حَدَّثَنِي أُسَامَةُ، فَذَكَرَ بِإِسْنَادِهِ مِثْلَهُ قَالَ أَبُو جَعْفَرٍ: فَذَهَبَ قَوْمٌ إِلَى أَنَّ كُلَّ قَضَاءٍ قَضَى بِهِ حَاكِمٌ مِنْ تَمْلِيكِ مَالٍ أَوْ إِنَالَةِ مِلْكٍ عَنْ مَالٍ أَوْ مِنْ إِثْبَاتِ نِكَاحٍ أَوْ مِنْ حِلِّهِ بِطَلَاقٍ أَوْ بِمَا أَشْبَهَهُ أَنَّ ذَلِكَ كُلَّهُ عَلَى حُكْمِ الْبَاطِنِ وَأَنَّ ذَلِكَ فِي الْبَاطِنِ كَهُوَ فِي الظَّاهِرِ وَجَبَ ذَلِكَ عَلَى مَا حَكَمَ بِهِ الْحَاكِمُ. وَإِنْ كَانَ ذَلِكَ فِي الْبَاطِنِ عَلَى خِلَافِ مَا شَهِدَ بِهِ الشَّاهِدَانِ وَعَلَى خِلَافِ مَا حَكَمَ بِهِ بِشَهَادَتِهِمَا عَلَى الْحُكْمِ الظَّاهِرِ لَمْ يَكُنْ قَضَاءُ الْقَاضِي مُوجِبًا شَيْئًا مِنْ تَمْلِيكٍ وَلَا تَحْرِيمٍ وَلَا تَحْلِيلٍ وَاحْتَجُّوا فِي ذَلِكَ بِهَذَا الْحَدِيثِ. وَمِمَّنْ قَالَ بِذَلِكَ أَبُو يُوسُفَ. وَخَالَفَهُمْ فِي ذَلِكَ آخَرُونَ فَقَالُوا: مَا كَانَ مِنْ ذَلِكَ مِنْ تَمْلِيكِ مَالٍ فَهُوَ عَلَى حُكْمِ الْبَاطِنِ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِشَيْءٍ مِنْ حَقِّ أَخِيهِ فَلَا يَأْخُذْهُ فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّارِ» . وَمَا كَانَ مِنْ ذَلِكَ مِنْ قَضَاءٍ بِطَلَاقٍ أَوْ نِكَاحٍ بِشُهُودٍ ظَاهِرُهُمُ الْعَدَالَةُ وَبَاطِنُهُمُ الْجُرْحَةُ فَحَكَمَ الْحَاكِمُ بِشَهَادَتِهِمْ عَلَى ظَاهِرِهِمِ الَّذِي تَعَبَّدَ اللهَ أَنْ يَحْكُمَ بِشَهَادَةِ مِثْلِهِمْ مَعَهُ فَذَلِكَ يَحْرُمُ فِي الْبَاطِنِ كَحُرْمَتِهِ فِي الظَّاهِرِ. وَالدَّلِيلُ عَلَى هَذَا مَا قَدْ رُوِيَ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمُتَلَاعِنَيْنِ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন- إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ (আমি একজন মানুষই)। এটা যেন আল্লাহর কালামেরই প্রতিধ্বনি। কুরআন মাজীদেও আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেনঃ-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
'বলে দাও, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ। (সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১১০) অর্থাৎ আমি একজন মানুষ, মাবুদ নই যে, সমস্ত জ্ঞান আপনা-আপনিই আমার আয়ত্তাধীন থাকবে। হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা আমাকে যেহেতু নবী বানিয়েছেন তাই ওহী মারফত তিনি মানুষের হিদায়াতের জন্য যা কিছু জ্ঞান দরকার তা আমাকে সরবরাহ করেন এবং ওহীর সে জ্ঞান ধারণ, সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য যে যোগ্যতা ও গুণাবলী দরকার তাও তিনি আমাকে দান করেছেন।
এ আয়াত এবং আলোচ্য হাদীছ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আমাদের বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের শিক্ষা দেয়। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি অবশ্যই রাসূল ছিলেন তবে 'মানুষ রাসূল'। তাঁর প্রতি আল্লাহ তাআলার খাস গুণ আরোপ করা যাবে না। অন্যান্য মানুষের মত তাঁকেও আদমসন্তান বলে বিশ্বাস করতে হবে। তাঁকে নূরের তৈরি সাব্যস্ত করে মানুষের কাতার থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
তিনি গায়েব জানতেন না। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে যতটুকু জানাতেন, অতটুকুই জানতেন। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে এ আকীদা পোষণ করা জায়েয হবে না যে, তিনি অতীত ও ভবিষ্যতের যাবতীয় বিষয়, যা ঘটেছে এবং যা-কিছু ঘটবে সবকিছুই নিজে নিজেই পরিপূর্ণরূপে জানতেন বা সবকিছুই তাঁকে পরিপূর্ণরূপে জানানো হয়েছে, তাঁর জানার বাইরে কোনও কিছুই নেই। গায়েবের এমন পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। কোনও নবী-রাসূল বা ফিরিশতা এরকম জ্ঞানের অধিকারী নয়। কুরআন মাজীদে ঘোষণা হয়েছেঃ-
قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ
বলে দাও, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব জানে না। (সূরা নামল (২৭), আয়াত ৬৫)
এ আয়াত স্পষ্টভাবেই জানাচ্ছে যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব জানে না। এই নাজানার মধ্যে নবী, রাসূল, ফিরিশতা সকলেই আছেন। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবী-রাসূলের মধ্যে সবচে' বড় জ্ঞানী ছিলেন। তাই বলে তিনি আলিমুল-গায়ব ছিলেন না। কুরআন মাজীদে তাঁকে ঘোষণা দিতে বলা হয়েছেঃ-
وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ
আমার যদি গায়েব সম্পর্কে জানা থাকত, তবে ভালো ভালো জিনিস প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করে নিতাম এবং কোনওরকম কষ্ট আমাকে স্পর্শ করত না। (সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৮৮)
মোটকথা, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কিত আকীদায় আমাদেরকে সবরকম বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করে কুরআন-সুন্নাহ যে আকীদা পেশ করেছে তার মধ্যেই থাকতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবধান করেনঃ-
لا تطروني كما أطرت النصارى ابن مريم، فإنما أنا عبده، فقولوا عبد الله ورسوله
তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন নাসারা সম্প্রদায় ঈসা ইবনে মারয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে (অর্থাৎ তারা তাঁর ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করেছে)। আমি আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বল (আমার ওপর আল্লাহর খাস গুণাবলী আরোপ করো না)। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৪৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৩; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ২৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৭৫৮; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪১৩: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৪১১; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৬৮১)
এর মধ্যে নূরের সত্তা হওয়া ও আলিমুল গায়েব হওয়ার বিষয়টিও রয়েছে। তাঁর প্রতি এ জাতীয় গুণ আরোপ করা বাড়াবাড়িরই শামিল, যা করতে আমাদের তিনি নিষেধ করেছেন। তিনি যখন মানুষ ছিলেন এবং এটাও জানা গেল যে, তিনি গায়েব জানতেন না, তখন কোনও ঘটনার কেবল প্রকাশ্য দিক জানা এবং তার ভেতরগত বাস্তব অবস্থা অজানা থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। যেমন খায়বারের এক ইয়াহুদী মহিলা তাঁকে বিষ মেশানো খাবার দিয়েছিল। তিনি তার খানিকটা খেয়েও ফেলেছিলেন। খেয়ে ফেলেছিলেন এ কারণে যে, তিনি প্রকাশ্য খাবারটাই দেখেছিলেন। ভেতরে মেশানো বিষ ছিল তাঁর অজানা।
যেহেতু গুপ্ত অবস্থা সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞাত থাকা সম্ভব ছিল, তাই তাঁর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করার প্রয়োজন ছিল, বিশেষত বিচারপ্রার্থীদের। তিনি যেমন নবী ছিলেন, তেমনি ছিলেন ইমাম (শাসক) ও বিচারকও। কোনও দাবি-দাওয়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তাঁর কাছে মামলা পেশ করা হত এবং তিনি তার ফয়সালা করে দিতেন। দাবি-দাওয়া কোনও হক সংক্রান্ত হলে এটাই স্বাভাবিক যে, একপক্ষের দাবি ন্যায্য হবে এবং অন্যপক্ষের দাবি অন্যায্য। বিচারকের কর্তব্য বাহ্যিক দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে ফয়সালা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে এ অবকাশ থাকে যে, একপক্ষ দাবি-দাওয়া উত্থাপনে চতুর ও সুদক্ষ, যুক্তি-প্রমাণ প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট কৌশলী, অপরপক্ষ সরল-সোজা, যুক্তি-তর্কের চাতুর্য জানে না। এ অবস্থায় যার দাবি ন্যায্য সে কৌশলী না হলে মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদি সে হেরে যায় এবং তার প্রতিপক্ষের অনুকূলে রায় হয়ে যায়, তবে রায়ের ভিত্তিতে তার জন্য কি সংশ্লিষ্ট সম্পদ হালাল হয়ে যাবে এবং সে তা ভোগ করতে পারবে? এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সম্পর্কেই ইরশাদ করছেন যে-
ولعل بعضكم أن يكون ألحن بحجته من بعض، فأقضي له بنحو ما أسمع، فمن قضيت له يحن أخيه فإنما أقطع له قطعة من النار
'হয়তো তোমাদের একজন দলীল-প্রমাণ উত্থাপনে অপরজন অপেক্ষা বেশি পারদর্শী। ফলে আমি তার কাছ থেকে যেভাবে শুনি, সে অনুযায়ী ফয়সালা দিয়ে দিই। সুতরাং এভাবে আমি তার ভাইয়ের হক তাকে দিয়ে দেওয়ার ফয়সালা করলে প্রকৃতপক্ষে আমি তাকে জাহান্নামের একটা টুকরাই দিয়ে দিই।'
অর্থাৎ সে প্রমাণ উপস্থাপনে বেশি পারদর্শী ও সুদক্ষ হওয়ায় সে নিজ প্রমাণ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে আর তাতে বোঝা গেছে যে, তার দাবিই সঠিক। ফলে তার এ বাহ্যিক প্রমাণ ও বিবরণের ভিত্তিতে আমি রায় দিয়ে দিই যে, যে সম্পদ নিয়ে বিবাদ হয়েছে তা তারই। কিন্তু সে তো জানে যে, বাস্তবিকপক্ষে তার দাবি ভ্রান্ত এবং ওই সম্পদ তার নয়। সুতরাং আমি যতই তার অনুকূলে রায় দিই না কেন, সে যেন কিছুতেই ওই সম্পদ গ্রহণ না করে। কেননা তার জন্য তা হালাল নয়। রায় তার পক্ষে গেলেও প্রকৃতপক্ষে তা তার জন্য জাহান্নামের আগুনস্বরূপ। সে তা ভোগ করলে জাহান্নামের আগুনই ভোগ করা হবে। হারাম মাল ভোগ করা জাহান্নামের আগুন খাওয়ারই নামান্তর। যেমন ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
নিশ্চয়ই যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে, তারা নিজেদের পেটে কেবল আগুন ভরতি করে। তারা অচিরেই এক জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১০)
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
প্রশ্ন হতে পারে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো মা'সূম ও নিষ্পাপ ছিলেন, এমতাবস্থায় কোনও সম্পত্তির মিথ্যা দাবিদারের আকর্ষণীয় ও চাতুর্যপূর্ণ কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়ে তার অনুকূলে রায় দেওয়া তাঁর পক্ষে কী করে সম্ভব?
এর জবাব হচ্ছে, তাঁর মা'সূম হওয়ার বিষয়টি এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত, যা করলে গুনাহ হয়। মামলা-মুকাদ্দামায় দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেওয়ার বিষয়টি সেরকম নয়। কেননা এরূপ রায় দেওয়া হয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ দলীল প্রমাণের মধ্যে চিন্তাভাবনা করে যার দলীল সঠিক মনে হয় তার পক্ষে রায় দেওয়াই শরী'আতের হুকুম। এটাই বিচারকার্যের নীতি। তা যেমন অন্যান্য বিচারকদের জন্য, তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যও। এ নীতি অনুযায়ী যে রায় দেওয়া হয়, বাস্তবিকপক্ষে তা ভুল হলেও তাতে কোনও গুনাহ হয় না। গুনাহ তো হয়ই না; বরং বাহ্যিকভাবে সে ভুলকেই সঠিক ধরে নেওয়া হয়। যার পক্ষে রায় দেওয়া হয় তার জন্য হালাল না হওয়ার ব্যাপারটা আল্লাহ ও তার মধ্যকার বিষয়, আদালতের বিষয় নয়। এ কারণেই দুনিয়ায় তাকে ধরা হয় না, সে ধরা পড়বে আখিরাতে। আখিরাতে যাতে ধরা না পড়ে, সেজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রায় তার অনুকূলে যাওয়া সত্ত্বেও তাকে তা ভোগ করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লামা ‘আকূলী রহ. বলেন, এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল বিচার-আচারের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিচারকদের মতই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যও একই নিয়ম কার্যকর ছিল। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে বিচার করা হবে বাহ্যিক দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে। এটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অনেক বড় মেহেরবানী। কেননা মানুষ যদি গায়েবের বিষয় জানতে পারত, তবে তো মামলা মুকাদ্দামায় সাক্ষীর প্রয়োজন হত না। সে ক্ষেত্রে মানুষের মনের চিন্তাভাবনা প্রকাশ হয়ে যেত আর তা কতই না লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন মানুষ ছিলেন। সুতরাং তাঁর প্রতি আল্লাহ তা'আলার বিশেষ গুণাবলী আরোপ করা যাবে না।
খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েব জানতেন না। তিনি বিচারকার্য সম্পাদন করতেন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে, গায়েবী জ্ঞান দ্বারা নয়।
গ. বিচারকার্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সম্পাদন করাই নিয়ম।
ঘ. মিথ্যা মামলায় জেতার দ্বারা অন্যের মাল প্রকৃতপক্ষে হালাল হয়ে যায় না। তা ভোগ করা আগুন খাওয়ার নামান্তর। এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য।
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
'বলে দাও, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ। (সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১১০) অর্থাৎ আমি একজন মানুষ, মাবুদ নই যে, সমস্ত জ্ঞান আপনা-আপনিই আমার আয়ত্তাধীন থাকবে। হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা আমাকে যেহেতু নবী বানিয়েছেন তাই ওহী মারফত তিনি মানুষের হিদায়াতের জন্য যা কিছু জ্ঞান দরকার তা আমাকে সরবরাহ করেন এবং ওহীর সে জ্ঞান ধারণ, সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য যে যোগ্যতা ও গুণাবলী দরকার তাও তিনি আমাকে দান করেছেন।
এ আয়াত এবং আলোচ্য হাদীছ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আমাদের বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের শিক্ষা দেয়। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি অবশ্যই রাসূল ছিলেন তবে 'মানুষ রাসূল'। তাঁর প্রতি আল্লাহ তাআলার খাস গুণ আরোপ করা যাবে না। অন্যান্য মানুষের মত তাঁকেও আদমসন্তান বলে বিশ্বাস করতে হবে। তাঁকে নূরের তৈরি সাব্যস্ত করে মানুষের কাতার থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
তিনি গায়েব জানতেন না। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে যতটুকু জানাতেন, অতটুকুই জানতেন। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে এ আকীদা পোষণ করা জায়েয হবে না যে, তিনি অতীত ও ভবিষ্যতের যাবতীয় বিষয়, যা ঘটেছে এবং যা-কিছু ঘটবে সবকিছুই নিজে নিজেই পরিপূর্ণরূপে জানতেন বা সবকিছুই তাঁকে পরিপূর্ণরূপে জানানো হয়েছে, তাঁর জানার বাইরে কোনও কিছুই নেই। গায়েবের এমন পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। কোনও নবী-রাসূল বা ফিরিশতা এরকম জ্ঞানের অধিকারী নয়। কুরআন মাজীদে ঘোষণা হয়েছেঃ-
قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ
বলে দাও, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব জানে না। (সূরা নামল (২৭), আয়াত ৬৫)
এ আয়াত স্পষ্টভাবেই জানাচ্ছে যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব জানে না। এই নাজানার মধ্যে নবী, রাসূল, ফিরিশতা সকলেই আছেন। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবী-রাসূলের মধ্যে সবচে' বড় জ্ঞানী ছিলেন। তাই বলে তিনি আলিমুল-গায়ব ছিলেন না। কুরআন মাজীদে তাঁকে ঘোষণা দিতে বলা হয়েছেঃ-
وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ
আমার যদি গায়েব সম্পর্কে জানা থাকত, তবে ভালো ভালো জিনিস প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করে নিতাম এবং কোনওরকম কষ্ট আমাকে স্পর্শ করত না। (সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৮৮)
মোটকথা, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কিত আকীদায় আমাদেরকে সবরকম বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করে কুরআন-সুন্নাহ যে আকীদা পেশ করেছে তার মধ্যেই থাকতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবধান করেনঃ-
لا تطروني كما أطرت النصارى ابن مريم، فإنما أنا عبده، فقولوا عبد الله ورسوله
তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন নাসারা সম্প্রদায় ঈসা ইবনে মারয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে (অর্থাৎ তারা তাঁর ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করেছে)। আমি আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বল (আমার ওপর আল্লাহর খাস গুণাবলী আরোপ করো না)। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৪৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৩; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ২৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৭৫৮; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪১৩: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৪১১; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৬৮১)
এর মধ্যে নূরের সত্তা হওয়া ও আলিমুল গায়েব হওয়ার বিষয়টিও রয়েছে। তাঁর প্রতি এ জাতীয় গুণ আরোপ করা বাড়াবাড়িরই শামিল, যা করতে আমাদের তিনি নিষেধ করেছেন। তিনি যখন মানুষ ছিলেন এবং এটাও জানা গেল যে, তিনি গায়েব জানতেন না, তখন কোনও ঘটনার কেবল প্রকাশ্য দিক জানা এবং তার ভেতরগত বাস্তব অবস্থা অজানা থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। যেমন খায়বারের এক ইয়াহুদী মহিলা তাঁকে বিষ মেশানো খাবার দিয়েছিল। তিনি তার খানিকটা খেয়েও ফেলেছিলেন। খেয়ে ফেলেছিলেন এ কারণে যে, তিনি প্রকাশ্য খাবারটাই দেখেছিলেন। ভেতরে মেশানো বিষ ছিল তাঁর অজানা।
যেহেতু গুপ্ত অবস্থা সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞাত থাকা সম্ভব ছিল, তাই তাঁর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করার প্রয়োজন ছিল, বিশেষত বিচারপ্রার্থীদের। তিনি যেমন নবী ছিলেন, তেমনি ছিলেন ইমাম (শাসক) ও বিচারকও। কোনও দাবি-দাওয়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তাঁর কাছে মামলা পেশ করা হত এবং তিনি তার ফয়সালা করে দিতেন। দাবি-দাওয়া কোনও হক সংক্রান্ত হলে এটাই স্বাভাবিক যে, একপক্ষের দাবি ন্যায্য হবে এবং অন্যপক্ষের দাবি অন্যায্য। বিচারকের কর্তব্য বাহ্যিক দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে ফয়সালা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে এ অবকাশ থাকে যে, একপক্ষ দাবি-দাওয়া উত্থাপনে চতুর ও সুদক্ষ, যুক্তি-প্রমাণ প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট কৌশলী, অপরপক্ষ সরল-সোজা, যুক্তি-তর্কের চাতুর্য জানে না। এ অবস্থায় যার দাবি ন্যায্য সে কৌশলী না হলে মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদি সে হেরে যায় এবং তার প্রতিপক্ষের অনুকূলে রায় হয়ে যায়, তবে রায়ের ভিত্তিতে তার জন্য কি সংশ্লিষ্ট সম্পদ হালাল হয়ে যাবে এবং সে তা ভোগ করতে পারবে? এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সম্পর্কেই ইরশাদ করছেন যে-
ولعل بعضكم أن يكون ألحن بحجته من بعض، فأقضي له بنحو ما أسمع، فمن قضيت له يحن أخيه فإنما أقطع له قطعة من النار
'হয়তো তোমাদের একজন দলীল-প্রমাণ উত্থাপনে অপরজন অপেক্ষা বেশি পারদর্শী। ফলে আমি তার কাছ থেকে যেভাবে শুনি, সে অনুযায়ী ফয়সালা দিয়ে দিই। সুতরাং এভাবে আমি তার ভাইয়ের হক তাকে দিয়ে দেওয়ার ফয়সালা করলে প্রকৃতপক্ষে আমি তাকে জাহান্নামের একটা টুকরাই দিয়ে দিই।'
অর্থাৎ সে প্রমাণ উপস্থাপনে বেশি পারদর্শী ও সুদক্ষ হওয়ায় সে নিজ প্রমাণ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে আর তাতে বোঝা গেছে যে, তার দাবিই সঠিক। ফলে তার এ বাহ্যিক প্রমাণ ও বিবরণের ভিত্তিতে আমি রায় দিয়ে দিই যে, যে সম্পদ নিয়ে বিবাদ হয়েছে তা তারই। কিন্তু সে তো জানে যে, বাস্তবিকপক্ষে তার দাবি ভ্রান্ত এবং ওই সম্পদ তার নয়। সুতরাং আমি যতই তার অনুকূলে রায় দিই না কেন, সে যেন কিছুতেই ওই সম্পদ গ্রহণ না করে। কেননা তার জন্য তা হালাল নয়। রায় তার পক্ষে গেলেও প্রকৃতপক্ষে তা তার জন্য জাহান্নামের আগুনস্বরূপ। সে তা ভোগ করলে জাহান্নামের আগুনই ভোগ করা হবে। হারাম মাল ভোগ করা জাহান্নামের আগুন খাওয়ারই নামান্তর। যেমন ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
নিশ্চয়ই যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে, তারা নিজেদের পেটে কেবল আগুন ভরতি করে। তারা অচিরেই এক জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১০)
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
প্রশ্ন হতে পারে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো মা'সূম ও নিষ্পাপ ছিলেন, এমতাবস্থায় কোনও সম্পত্তির মিথ্যা দাবিদারের আকর্ষণীয় ও চাতুর্যপূর্ণ কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়ে তার অনুকূলে রায় দেওয়া তাঁর পক্ষে কী করে সম্ভব?
এর জবাব হচ্ছে, তাঁর মা'সূম হওয়ার বিষয়টি এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত, যা করলে গুনাহ হয়। মামলা-মুকাদ্দামায় দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেওয়ার বিষয়টি সেরকম নয়। কেননা এরূপ রায় দেওয়া হয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ দলীল প্রমাণের মধ্যে চিন্তাভাবনা করে যার দলীল সঠিক মনে হয় তার পক্ষে রায় দেওয়াই শরী'আতের হুকুম। এটাই বিচারকার্যের নীতি। তা যেমন অন্যান্য বিচারকদের জন্য, তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যও। এ নীতি অনুযায়ী যে রায় দেওয়া হয়, বাস্তবিকপক্ষে তা ভুল হলেও তাতে কোনও গুনাহ হয় না। গুনাহ তো হয়ই না; বরং বাহ্যিকভাবে সে ভুলকেই সঠিক ধরে নেওয়া হয়। যার পক্ষে রায় দেওয়া হয় তার জন্য হালাল না হওয়ার ব্যাপারটা আল্লাহ ও তার মধ্যকার বিষয়, আদালতের বিষয় নয়। এ কারণেই দুনিয়ায় তাকে ধরা হয় না, সে ধরা পড়বে আখিরাতে। আখিরাতে যাতে ধরা না পড়ে, সেজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রায় তার অনুকূলে যাওয়া সত্ত্বেও তাকে তা ভোগ করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লামা ‘আকূলী রহ. বলেন, এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল বিচার-আচারের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিচারকদের মতই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যও একই নিয়ম কার্যকর ছিল। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে বিচার করা হবে বাহ্যিক দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে। এটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অনেক বড় মেহেরবানী। কেননা মানুষ যদি গায়েবের বিষয় জানতে পারত, তবে তো মামলা মুকাদ্দামায় সাক্ষীর প্রয়োজন হত না। সে ক্ষেত্রে মানুষের মনের চিন্তাভাবনা প্রকাশ হয়ে যেত আর তা কতই না লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন মানুষ ছিলেন। সুতরাং তাঁর প্রতি আল্লাহ তা'আলার বিশেষ গুণাবলী আরোপ করা যাবে না।
খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েব জানতেন না। তিনি বিচারকার্য সম্পাদন করতেন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে, গায়েবী জ্ঞান দ্বারা নয়।
গ. বিচারকার্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সম্পাদন করাই নিয়ম।
ঘ. মিথ্যা মামলায় জেতার দ্বারা অন্যের মাল প্রকৃতপক্ষে হালাল হয়ে যায় না। তা ভোগ করা আগুন খাওয়ার নামান্তর। এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
