আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৫৫- ভরণ পোষণ বাসস্থান অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৫৩৫৫
২৮২২. পরিবার-পরিজনের উপর ব্যয় করা ওয়াজিব
৪৯৬৪। ‘উমর ইবনে হাফস (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ উত্তম সাদাকা হল যা দান করার পরেও মানুষ অমুখাপেক্ষী থাকে। উপরের হাত নীচের হাতের চাইতে শ্রেষ্ঠ। যাদের ভরন-পোষণ তোমার যিম্মায় তাদের আগে দাও। (কেননা) স্ত্রী বলবে, হয় আমাকে খাবার দাও, নতুবা তালাক দাও। গোলাম বলবে, খাবার দাও এবং কাজ করাও। ছেলে বলবে, আমাকে খাবার দাও, আমাকে তুমি কার কাছে রেখে যাচ্ছ? লোকেরা জিজ্ঞাসা করলঃ হে আবু হুরায়রা আপনি কি এ হাদীস রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে শুনেছেন? তিনি উত্তরে বললেনঃ এটি আবু হুরায়রার জামবিলের নয় (বরং নবী (ﷺ) থেকে)।[১]
[১] কারো কারো মতে لاَ-এর সম্পর্ক পূর্বের উক্তির সাথে। পূর্ণ হাদীস রাসূল (সা) থেকে শ্রুত নয়, বরং শেষ অংশ আবূ হুরায়রা (রা)- এর নিজস্ব ব্যাখ্যা।
[১] কারো কারো মতে لاَ-এর সম্পর্ক পূর্বের উক্তির সাথে। পূর্ণ হাদীস রাসূল (সা) থেকে শ্রুত নয়, বরং শেষ অংশ আবূ হুরায়রা (রা)- এর নিজস্ব ব্যাখ্যা।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
দান-খয়রাতে কী নীতি অবলম্বন করা চাই
দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, প্রথমে নিজের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যা প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া। তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা থেকেই দান-খয়রাত করা হবে। এ হাদীছে বলা হয়েছে- وخير الصدقة ما كان عن ظهر غنى (উৎকৃষ্ট দান সেটাই, যা অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে করা হয়)।- (এখানে ظهر শব্দটি অতিরিক্ত। আরবী ভাষায় বাক্যের সৌন্দর্য বা অন্য কোনও উদ্দেশ্য এরকম অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনুবাদে এর অর্থ আসে না।) অর্থাৎ যা দান করা হয় তার প্রতি যদি দাতার মুখাপেক্ষিতা না থাকে এবং তা ছাড়াও তার পক্ষে চলা সম্ভব হয়, তবে সেই দানই উত্তম। এভাবেও বলা যায় যে, ওই দান উত্তম, যা দেওয়ার পর দাতার হাতে এতটুকু সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, যা দ্বারা সে নিজ প্রয়োজন সমাধা করতে পারে। অপর এক হাদীছে কথাটি আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে خير الصدقة ما أبقت غنى “শ্রেষ্ঠ দান তাই, যা প্রয়োজন সমাধা করার মত সম্পদ অবশিষ্ট রাখে।- (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৫৭৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২৭২৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১৪৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১০৬৯৩)
মূলত এ হাদীছটি কুরআন মাজীদের আয়াত থেকেই গৃহীত। ইরশাদ হয়েছে وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ "লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে) তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত।- (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২১৯)
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন হতে পারে যে, এক হাদীছ দ্বারা তো এর বিপরীত কথাই জানা যায়, তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ সদাকা উত্তম, এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন- جهد المقل (দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান),- (الجهد এর অর্থ শক্তি, শ্রম ও কষ্ট। কেউ বলেন, শব্দটির ج হরফে যবর দেওয়া হলে তখন অর্থ হয়, কষ্ট-ক্লেশ। আর পেশ দেওয়া হলে অর্থ হয়, সামর্থ্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- وَالَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ 'তাদেরকেও (মুনাফিকগণ দোষারোপ করে) যারা নিজ শ্রম (লব্ধ অর্থ) ছাড়া কিছুই পায় না (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৭৯)'। ইবনুল আছীর রহ. বলেন, কেউ যখন কষ্টক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বলা হয় جهد الرجل فهو مجهود। এমনিভাবে লোকে খরাপীড়িত হয়ে পড়লে বলা হয় جهد الناس فهم مجهودون । কেউ সফরকালে নিজ বাহনের পিঠে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপালে বলা হয় أجهد دابته । সফরে কারও পশু ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে তাকে বলা হয় رجل مجهد । এরই সঙ্গে উপমিত করে অর্থসংকটে জর্জরিত ব্যক্তিকেও رجل مجهد বলে। তো এই হাদীছে جهد المقل দ্বারা দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থসংকটের কারণে যে ব্যক্তি কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে দিনাতিপাত করে, তার দান শ্রেষ্ঠ দান, যেহেতু সে নিজ কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে আল্লাহর পথে খরচকে প্রধান্য দেয়।) এ উভয় হাদীছ কি পরস্পরবিরোধী নয়?- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৪৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫২৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭০২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৪৮৪৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬১; তবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৬৭৫)
উত্তর এই যে, মূলত হাদীছদু'টি দুই স্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে দান করা যে শ্রেষ্ঠ, এর সম্পর্ক সাধারণ স্তরের লোকদের সঙ্গে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে দান করা সমীচীন নয়। কেননা খালিহাত হয়ে গেলে পরে যখন কষ্টের সম্মুখীন হবে, তখন সবটা দিয়ে ফেলার কারণে তাদের মনে অনুশোচনা দেখা দিতে পারে। ফলে দানের ছাওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে দিও না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দিত ও অনুতপ্ত হয়ে বসে পড়তে হবে।- (সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৯)
এ কারণেই সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য ভালো হল চলার মত টাকা-পয়সা হাতে রেখে দেওয়া, তারপর অতিরিক্ত থাকলে তা থেকে দান-খয়রাত করা।
পক্ষান্তরে আল্লাহর প্রতি যাদের তাওয়াক্কুল যথেষ্ট পরিপক্ক, সেইসঙ্গে কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যও হারায় না, এ শ্রেণীর গরীবগণ যদি তাদের হাতের সবটা সম্পদও দান করে দেয় তাতে ক্ষতি নেই। পরবর্তীতে তাদের অনুশোচনায় ভোগার আশঙ্কা নেই। পরের হাদীছটির সম্পর্ক এই স্তরের লোকদের সঙ্গে। এদের দান অতি উত্তম তাতে সন্দেহ কী? নিজেদের কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তাদের দানের ছাওয়াব অনেক বেশি।
বস্তুত সব কাজ সবার জন্য নয়। যুদ্ধের জন্য যেমন সৎসাহসের প্রয়োজন হয়, দান-খয়রাতের জন্যও তেমনি হিম্মতের প্রয়োজন। উচ্চমাত্রার তাওয়াক্কুল ও সবর দ্বারা সে হিম্মত গঠিত হয়। এ গুণ যাদের আছে কেবল তাদের জন্যই আল্লাহর পথে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া সাজে। তাদেরই জন্য এটা উৎকৃষ্টতর দান। যারা এ পর্যায়ের নয় তাদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জন্য উত্তম বাড়তি সম্পদ থেকে দান করা। সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত উঁচু হিম্মতের অধিকারী ছিলেন, যদিও তাদের পরস্পরের মধ্যেও এ ক্ষেত্রে পার্থক্য ছিল। তাই দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থায়ও আল্লাহর পথে শেষ কড়িটুকুও বিলিয়ে দিতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর স্থান ছিল এ ক্ষেত্রে সর্বশীর্ষে। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান-সদাকা করার হুকুম দিলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ঘরে যা-কিছু ছিল সবটা এনে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৭৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৬৭৫; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৭০১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭৪; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৭৫)
নিচের হাত অপেক্ষা উপরের হাত শ্রেষ্ঠ হওয়া
হাদীছটিতে বলা হচ্ছে- اليد العليا خير من اليد السفلى (উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম)। নিচের হাত দ্বারা গ্রহণকারীর হাত এবং উপরের হাত দ্বারা দাতার হাত বোঝানো উদ্দেশ্য। দান করা না করা এবং গ্রহণ করা না করা হিসেবে মানুষের হাত চার প্রকার। দাতার হাত, সওয়ালকারীর হাত, দান গ্রহণ করা হতে বিরত ব্যক্তির হাত এবং বিনা সওয়ালে গ্রহণকারীর হাত।
এই চার প্রকারের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হল দাতার হাত। উপরের হাত বলতে এ হাতই বোঝানো হয়েছে। কেননা বাহ্যত দাতার হাত গ্রহীতার হাতের উপরেই থাকে। আর যেহেতু সে দেয়, তাই মর্যাদায়ও তা শ্রেষ্ঠ বৈকি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, উপরের হাত কোন হাত? তিনি বলেন, যে হাত দান করে, গ্রহণ করে না।
দাতার হাত শ্রেষ্ঠ এ কারণে যে, দান করাটা আল্লাহ তাআলার গুণ। সৃষ্টির সূচনা থেকে এ যাবতকাল তিনি শুধু দিয়েই যাচ্ছেন। কারও কাছ থেকে কিছু নেন না। বলাবাহুল্য আল্লাহর গুণই সর্বশ্রেষ্ঠ। বান্দাকে তাঁর গুণে গুণান্বিত হতে বলা হয়েছে। কাজেই যে হাত কারও কাছ থেকে কিছু নেয় না; বরং দেয়, অন্যসব হাত থেকে তা শ্রেষ্ঠ হবে তাতে সন্দেহ কী?
দ্বিতীয় স্তরের হল ওই ব্যক্তির হাত, যে কারও কাছে কিছু চাওয়া হতে বিরত থাকে। এমনকি বিনা চাওয়াতে দেওয়া হলেও গ্রহণ করে না। একে ইস্তিগনা বলে। হাদীছে এর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও যে কোনও মাখলূকের কাছে কিছু চায় না এবং মাখলূকের কাছ থেকে কিছু নেয়ও না, সে উচ্চস্তরের যাহিদ। সাহাবায়ে কেরামের শ্রেষ্ঠত্বের একটা কারণ তাঁরা শ্রেষ্ঠতম যাহিদ ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক সাহাবীকে এই বলে উপদেশ দেন যে ازهد في الدنيا يحبك الله، وازهد فيما في أيدي الناس يحبك الناس "দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত থাক, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের হাতে যা আছে তা থেকে বিমুখ থাক, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বলেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের তুলনায় অনেক বেশি সাধনা-মুজাহাদা করে থাক এবং তাদের তুলনায় নামাযও অনেক দীর্ঘ ও বেশি পড়। তা সত্ত্বেও তোমাদের তুলনায় তারা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, তার কারণ? তিনি বললেন, তোমাদের তুলনায় তারা বেশি দুনিয়াবিমুখ ও বেশি আখেরাতমুখী ছিলেন।
সাহাবায়ে কেরামের পরও এ উম্মতের আকাবির-আসলাফের মধ্যে অনেকেই এমন ছিলেন, যারা নিজ উপার্জনেই সন্তুষ্ট থাকতেন। যত কষ্ট-ক্লেশই হোক না কেন, তারা মানুষের কাছে হাত তো পাততেনই না; বিনা চাওয়াতে দিলেও কিছু গ্রহণ করতেন না। একবার দাউদ তাঈ রহ.-এর অনাহারক্লিষ্ট অবস্থায় ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর পুত্র হাম্মাদ রহ. তাঁর কাছে দু'শ দিরহাম পেশ করে বললেন, এটা এমন এক ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে আনা হয়েছে, তাকওয়া-পরহেযগারী ও দুনিয়াবিমুখতায় আমি যারচে' উত্তম কাউকে পাইনি, এমনকি হালাল উপার্জনেও নয়। আপনি এটা গ্রহণ করুন। তিনি বললেন, আমি কোনও মানুষের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করলে এটা অবশ্যই গ্রহণ করতাম। এক তো মহান মৃত ব্যক্তি (ইমাম আবূ হানীফা) এর মর্যাদায়, দ্বিতীয়ত তাঁর জীবিত এ উত্তরাধিকারীর সম্মানে। কিন্তু আমি নিজের যা আছে তাতে পরিতুষ্টির মর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
আমাদের মহান আকাবিরে দেওবন্দের প্রাণপুরুষ ইমাম কাসিম নানুতবী রহ. তো বটেই, তাঁর পরবর্তী অনুসারীদের মধ্যেও অনেকেই এ পর্যায়ের যাহিদ ছিলেন।
তৃতীয় স্তরের হাত সেই ব্যক্তির হাত, যে কারও কাছে চায় না বটে, তবে তাকে দেওয়া হলে সে তা গ্রহণ করে। বিনা চাওয়ায় কিছু দেওয়া হলে তা গ্রহণ করতে দোষ নেই। বরং এরূপ দান গ্রহণের জন্য উৎসাহই দেওয়া হয়েছে। যেমন হযরত উমর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعطيني العطاء، فأقول: أعطه من هو أفقر إليه مني، فقال: خذه إذا جاءك من هذا المال شيء وأنت غير مشرف ولا سائل، فخذه ومالا فلا تتبعه نفسك 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে কিছু দান করতে চাইলে আমি বলতাম, এটা আমার চেয়ে যার বেশি প্রয়োজন তাকে দিন। এর উত্তরে তিনি বলেন, তুমি এটা নাও। তোমার কাছে যদি কোনও সম্পদ আসে আর তুমি তার প্রতি আগ্রহী না থাক এবং যাচনাকারীও না হও, তবে তা গ্রহণ কর। এরকম না হলে তুমি নিজেকে তার অনুগামী করো না।
চতুর্থ ও সর্বনিম্ন হল ওই ব্যক্তির হাত, যে মানুষের কাছে চায়ও এবং নিজে কিছু দেয়ও না। বিনা প্রয়োজনে মানুষের কাছে হাত পাতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এরচে' বরং যে-কোনও হালাল কাজ করা ভালো, তা মানুষের চোখে যতই নিম্নস্তরের কাজ হোক। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন والذي نفسي بيده لأن يأخذ أحدكم حبله، فيحتطب على ظهره خير له من أن يأتي رجلا، فيسأله أعطاه أو منعه 'যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম! তোমাদের কেউ রশি নিয়ে বের হয়ে যাবে, তারপর (তা দ্বারা) লাকড়ির বোঝা (বেঁধে) নিজ পিঠে করে নিয়ে আসবে, সেটাই এরচেয়ে ভালো যে, কারও কাছে গিয়ে সওয়াল করবে, যে তাকে দিতেও পারে, নাও দিতে পারে।
অন্যের কাছে সওয়াল করা চরম অমর্যাদাকর কাজ। এর দ্বারা নিজের আত্মসম্মান ধূলিসাৎ করা হয় । এরূপ ব্যক্তিকে হাশরের ময়দানেও চরম লাঞ্ছনাকর অবস্থায় উঠানো হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক হাদীছে আছে ما يزال الرجل يسأل الناس حتى يأتي يوم القيامة ليس في وجهه مزعة لحم কোনও ব্যক্তি মানুষের কাছে সওয়াল করতে থাকে। পরিশেষে কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তার চেহারায় গোশত বলতে কিছু থাকবে না।
চেহারা গোশতশূন্য হওয়াটা হীনতা ও লাঞ্ছনার নিদর্শন। কাজেই চরম ঠ্যাকা অবস্থা না হলে কারও কাছে হাত পাতা উচিত নয়। এর দ্বারা আত্মসম্মান নষ্ট হয় ও আখলাক-চরিত্র ধ্বংস হয়। প্রত্যেক ঈমানদারের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
খরচের খাতসমূহের মধ্যে অগ্রগণ্য কোনটি
খরচে কাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচ্য হাদীছে ইরশাদ করেন- وابدا بمن تعول (তুমি যাদের লালন পালন কর তাদের থেকে খরচ শুরু কর)। অর্থাৎ নিজ সত্তা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, পিতামাতা এবং আরও যারা নিজ লালন-পালনাধীন থাকে, প্রথম খরচটা তাদের পেছনেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও যদি সকলের পেছনে খরচ করা সম্ভব হয় তবে তো সেটাই করবে, অন্যথায় প্রথমে খরচ করবে নিজের জন্য, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে শিশুসন্তানের জন্য, তারপর স্ত্রীর জন্য, তারপর পিতা, তারপর মাতা, তারপর দাদা, তারপর বালেগ সন্তান- এ ধারাবাহিকতা অনুসরণ করবে। তারপরও বেঁচে থাকলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্যদের মধ্যে খরচ করা হবে। পরিবারের লোককে বঞ্চিত করে অন্যত্র খরচ করা জায়েয নয়। নিজ পোষ্য হওয়ার কারণে তাদের জরুরত পূরণ করা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। অন্যসব খরচা হয়তো নফল পর্যায়ের অথবা ওয়াজিব হলেও তা এর পরবর্তী স্তরের। কাজেই এদেরকে পেছনে রাখার কোনও সুযোগ নেই।। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জনৈক সাহাবীর হাতে কিছু দিরহাম দিয়ে তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে ابدأ بنفسك فتصدق عليها، فإن فضل شيء، فلأهلك، فإن فضل عن أهلك شيء فلذي قرابتك، فإن فضل عن ذي قرابتك شيء فهكذا وهكذا يقول فبين يديك وعن يمينك وعن شمالك 'তুমি এটা সর্বপ্রথম খরচ করবে তোমার নিজের উপর। তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার পরিবার-পরিজনের উপর, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার নিকটাত্মীয়দের উপর। তাদের উপর খরচ করার পরও যদি কিছু বেঁচে থাকে, তবে তা এভাবে এভাবে অর্থাৎ তোমার সামনে, ডানে ও বামে বিতরণ করবে।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (যদি এমন হয় যে,) আমার কাছে একটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার নিজের উপর খরচ কর। সে বলল, আমার কাছে আরেকটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার সন্তানের উপর খরচ কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার স্ত্রীর উপর খরচ কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার খাদেমের (অর্থাৎ গোলামের) উপর খরচ কর। সে বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। তিনি বললেন, এটি কী করবে সে ব্যাপারে তুমিই ভালো জান। এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলতেন, এমন না হলে তোমার সন্তান বলবে আমাকে খাওয়াও, তুমি আমাকে কার হাতে ছাড়ছ? স্ত্রী বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে তালাক দাও। খাদেম বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে বিক্রি করে দাও।
অবশ্য নিজেকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যেকের সবর ও তাওয়াক্কুলের মাত্রার উপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে যার দুর্বলতা আছে, সে নিজের উপরই প্রথম খরচ করবে। যার সবর ও তাওয়াক্কুল অনেক শক্তিশালী, সে নিজেকে পেছনে রেখে অন্যকে অগ্রাধিকার দিলে তা প্রশংসনীয় বৈকি। সাহাবায়ে কেরাম তো এ চরিত্রেরই ছিলেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে পিতামাতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এমনকি নিজেকে অভুক্ত রেখে অতিথিকে খাওয়ানোর নজিরও আছে অনেক। নিজ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে এ মাত্রার সবর ও তাওয়াক্কুলের উপর গড়ে তোলা গেলে তাদের উপরও অতিথি বা অন্য কোনও ক্ষুধার্তকে খাওয়ানোর অবকাশ আছে। এ নীতিকে ‘ঈছার’ বলে। কুরআন ও হাদীছে এর প্রশংসা করা হয়েছে। ইসলাম তার অনুসারীদের এরকম উচ্চতর আদর্শে উপনীত হওয়ার উৎসাহ যোগায়।
ইমাম সামহূদী রহ. বলেন, এ হাদীছটির সম্পর্ক যদিও আর্থিক ব্যয়ের সঙ্গে, তবে মুহাক্কিকগণ একে পরকালীন বিষয়েও ব্যবহার করেছেন। যেমন আলেম ব্যক্তি অন্যদের আগে নিজ পরিবারবর্গকে দীনের শিক্ষাদান করবে। কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا “তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় শরীআতের অনুসরণ। শরীআতের অনুসরণ করার জন্য প্রথমে শরীআতের ইলম অর্জন করা চাই। সর্বপ্রথম কর্তব্য যখন নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো, তখন ইলমে দীনের শিক্ষায়ও নিজেকে প্রথম স্থানে রাখা জরুরি। তারপর পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো জরুরি হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে দীনী ইলম শেখানো কর্তব্য। তারপর সক্ষমতা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে অন্যদের দিকে নজর দেওয়ার পালা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা দান করার শ্রেষ্ঠত্ব ও দান গ্রহণের হেয়ত্ব জানা যাচ্ছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য দানশীলতার গুণ অর্জন করা।
খ. পরিবার-পরিজন থেকেই খরচ আরম্ভ করা উচিত। তাদেরকে কষ্টে রেখে অন্যত্র দান-খয়রাত করা শরীআতসম্মত কাজ নয়।
গ. সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য এটাই শ্রেয় যে, পারিবারিক জরুরত মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকেই দান-খয়রাত করবে।
দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, প্রথমে নিজের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যা প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া। তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা থেকেই দান-খয়রাত করা হবে। এ হাদীছে বলা হয়েছে- وخير الصدقة ما كان عن ظهر غنى (উৎকৃষ্ট দান সেটাই, যা অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে করা হয়)।- (এখানে ظهر শব্দটি অতিরিক্ত। আরবী ভাষায় বাক্যের সৌন্দর্য বা অন্য কোনও উদ্দেশ্য এরকম অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনুবাদে এর অর্থ আসে না।) অর্থাৎ যা দান করা হয় তার প্রতি যদি দাতার মুখাপেক্ষিতা না থাকে এবং তা ছাড়াও তার পক্ষে চলা সম্ভব হয়, তবে সেই দানই উত্তম। এভাবেও বলা যায় যে, ওই দান উত্তম, যা দেওয়ার পর দাতার হাতে এতটুকু সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, যা দ্বারা সে নিজ প্রয়োজন সমাধা করতে পারে। অপর এক হাদীছে কথাটি আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে خير الصدقة ما أبقت غنى “শ্রেষ্ঠ দান তাই, যা প্রয়োজন সমাধা করার মত সম্পদ অবশিষ্ট রাখে।- (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৫৭৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২৭২৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১৪৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১০৬৯৩)
মূলত এ হাদীছটি কুরআন মাজীদের আয়াত থেকেই গৃহীত। ইরশাদ হয়েছে وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ "লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে) তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত।- (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২১৯)
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন হতে পারে যে, এক হাদীছ দ্বারা তো এর বিপরীত কথাই জানা যায়, তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ সদাকা উত্তম, এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন- جهد المقل (দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান),- (الجهد এর অর্থ শক্তি, শ্রম ও কষ্ট। কেউ বলেন, শব্দটির ج হরফে যবর দেওয়া হলে তখন অর্থ হয়, কষ্ট-ক্লেশ। আর পেশ দেওয়া হলে অর্থ হয়, সামর্থ্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- وَالَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ 'তাদেরকেও (মুনাফিকগণ দোষারোপ করে) যারা নিজ শ্রম (লব্ধ অর্থ) ছাড়া কিছুই পায় না (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৭৯)'। ইবনুল আছীর রহ. বলেন, কেউ যখন কষ্টক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বলা হয় جهد الرجل فهو مجهود। এমনিভাবে লোকে খরাপীড়িত হয়ে পড়লে বলা হয় جهد الناس فهم مجهودون । কেউ সফরকালে নিজ বাহনের পিঠে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপালে বলা হয় أجهد دابته । সফরে কারও পশু ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে তাকে বলা হয় رجل مجهد । এরই সঙ্গে উপমিত করে অর্থসংকটে জর্জরিত ব্যক্তিকেও رجل مجهد বলে। তো এই হাদীছে جهد المقل দ্বারা দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থসংকটের কারণে যে ব্যক্তি কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে দিনাতিপাত করে, তার দান শ্রেষ্ঠ দান, যেহেতু সে নিজ কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে আল্লাহর পথে খরচকে প্রধান্য দেয়।) এ উভয় হাদীছ কি পরস্পরবিরোধী নয়?- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৪৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫২৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭০২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৪৮৪৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬১; তবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৬৭৫)
উত্তর এই যে, মূলত হাদীছদু'টি দুই স্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে দান করা যে শ্রেষ্ঠ, এর সম্পর্ক সাধারণ স্তরের লোকদের সঙ্গে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে দান করা সমীচীন নয়। কেননা খালিহাত হয়ে গেলে পরে যখন কষ্টের সম্মুখীন হবে, তখন সবটা দিয়ে ফেলার কারণে তাদের মনে অনুশোচনা দেখা দিতে পারে। ফলে দানের ছাওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে দিও না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দিত ও অনুতপ্ত হয়ে বসে পড়তে হবে।- (সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৯)
এ কারণেই সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য ভালো হল চলার মত টাকা-পয়সা হাতে রেখে দেওয়া, তারপর অতিরিক্ত থাকলে তা থেকে দান-খয়রাত করা।
পক্ষান্তরে আল্লাহর প্রতি যাদের তাওয়াক্কুল যথেষ্ট পরিপক্ক, সেইসঙ্গে কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যও হারায় না, এ শ্রেণীর গরীবগণ যদি তাদের হাতের সবটা সম্পদও দান করে দেয় তাতে ক্ষতি নেই। পরবর্তীতে তাদের অনুশোচনায় ভোগার আশঙ্কা নেই। পরের হাদীছটির সম্পর্ক এই স্তরের লোকদের সঙ্গে। এদের দান অতি উত্তম তাতে সন্দেহ কী? নিজেদের কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তাদের দানের ছাওয়াব অনেক বেশি।
বস্তুত সব কাজ সবার জন্য নয়। যুদ্ধের জন্য যেমন সৎসাহসের প্রয়োজন হয়, দান-খয়রাতের জন্যও তেমনি হিম্মতের প্রয়োজন। উচ্চমাত্রার তাওয়াক্কুল ও সবর দ্বারা সে হিম্মত গঠিত হয়। এ গুণ যাদের আছে কেবল তাদের জন্যই আল্লাহর পথে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া সাজে। তাদেরই জন্য এটা উৎকৃষ্টতর দান। যারা এ পর্যায়ের নয় তাদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জন্য উত্তম বাড়তি সম্পদ থেকে দান করা। সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত উঁচু হিম্মতের অধিকারী ছিলেন, যদিও তাদের পরস্পরের মধ্যেও এ ক্ষেত্রে পার্থক্য ছিল। তাই দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থায়ও আল্লাহর পথে শেষ কড়িটুকুও বিলিয়ে দিতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর স্থান ছিল এ ক্ষেত্রে সর্বশীর্ষে। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান-সদাকা করার হুকুম দিলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ঘরে যা-কিছু ছিল সবটা এনে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।- (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৭৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৬৭৫; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৭০১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৭৪; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৭৫)
নিচের হাত অপেক্ষা উপরের হাত শ্রেষ্ঠ হওয়া
হাদীছটিতে বলা হচ্ছে- اليد العليا خير من اليد السفلى (উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম)। নিচের হাত দ্বারা গ্রহণকারীর হাত এবং উপরের হাত দ্বারা দাতার হাত বোঝানো উদ্দেশ্য। দান করা না করা এবং গ্রহণ করা না করা হিসেবে মানুষের হাত চার প্রকার। দাতার হাত, সওয়ালকারীর হাত, দান গ্রহণ করা হতে বিরত ব্যক্তির হাত এবং বিনা সওয়ালে গ্রহণকারীর হাত।
এই চার প্রকারের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হল দাতার হাত। উপরের হাত বলতে এ হাতই বোঝানো হয়েছে। কেননা বাহ্যত দাতার হাত গ্রহীতার হাতের উপরেই থাকে। আর যেহেতু সে দেয়, তাই মর্যাদায়ও তা শ্রেষ্ঠ বৈকি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, উপরের হাত কোন হাত? তিনি বলেন, যে হাত দান করে, গ্রহণ করে না।
দাতার হাত শ্রেষ্ঠ এ কারণে যে, দান করাটা আল্লাহ তাআলার গুণ। সৃষ্টির সূচনা থেকে এ যাবতকাল তিনি শুধু দিয়েই যাচ্ছেন। কারও কাছ থেকে কিছু নেন না। বলাবাহুল্য আল্লাহর গুণই সর্বশ্রেষ্ঠ। বান্দাকে তাঁর গুণে গুণান্বিত হতে বলা হয়েছে। কাজেই যে হাত কারও কাছ থেকে কিছু নেয় না; বরং দেয়, অন্যসব হাত থেকে তা শ্রেষ্ঠ হবে তাতে সন্দেহ কী?
দ্বিতীয় স্তরের হল ওই ব্যক্তির হাত, যে কারও কাছে কিছু চাওয়া হতে বিরত থাকে। এমনকি বিনা চাওয়াতে দেওয়া হলেও গ্রহণ করে না। একে ইস্তিগনা বলে। হাদীছে এর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও যে কোনও মাখলূকের কাছে কিছু চায় না এবং মাখলূকের কাছ থেকে কিছু নেয়ও না, সে উচ্চস্তরের যাহিদ। সাহাবায়ে কেরামের শ্রেষ্ঠত্বের একটা কারণ তাঁরা শ্রেষ্ঠতম যাহিদ ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক সাহাবীকে এই বলে উপদেশ দেন যে ازهد في الدنيا يحبك الله، وازهد فيما في أيدي الناس يحبك الناس "দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত থাক, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের হাতে যা আছে তা থেকে বিমুখ থাক, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বলেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের তুলনায় অনেক বেশি সাধনা-মুজাহাদা করে থাক এবং তাদের তুলনায় নামাযও অনেক দীর্ঘ ও বেশি পড়। তা সত্ত্বেও তোমাদের তুলনায় তারা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, তার কারণ? তিনি বললেন, তোমাদের তুলনায় তারা বেশি দুনিয়াবিমুখ ও বেশি আখেরাতমুখী ছিলেন।
সাহাবায়ে কেরামের পরও এ উম্মতের আকাবির-আসলাফের মধ্যে অনেকেই এমন ছিলেন, যারা নিজ উপার্জনেই সন্তুষ্ট থাকতেন। যত কষ্ট-ক্লেশই হোক না কেন, তারা মানুষের কাছে হাত তো পাততেনই না; বিনা চাওয়াতে দিলেও কিছু গ্রহণ করতেন না। একবার দাউদ তাঈ রহ.-এর অনাহারক্লিষ্ট অবস্থায় ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর পুত্র হাম্মাদ রহ. তাঁর কাছে দু'শ দিরহাম পেশ করে বললেন, এটা এমন এক ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে আনা হয়েছে, তাকওয়া-পরহেযগারী ও দুনিয়াবিমুখতায় আমি যারচে' উত্তম কাউকে পাইনি, এমনকি হালাল উপার্জনেও নয়। আপনি এটা গ্রহণ করুন। তিনি বললেন, আমি কোনও মানুষের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করলে এটা অবশ্যই গ্রহণ করতাম। এক তো মহান মৃত ব্যক্তি (ইমাম আবূ হানীফা) এর মর্যাদায়, দ্বিতীয়ত তাঁর জীবিত এ উত্তরাধিকারীর সম্মানে। কিন্তু আমি নিজের যা আছে তাতে পরিতুষ্টির মর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
আমাদের মহান আকাবিরে দেওবন্দের প্রাণপুরুষ ইমাম কাসিম নানুতবী রহ. তো বটেই, তাঁর পরবর্তী অনুসারীদের মধ্যেও অনেকেই এ পর্যায়ের যাহিদ ছিলেন।
তৃতীয় স্তরের হাত সেই ব্যক্তির হাত, যে কারও কাছে চায় না বটে, তবে তাকে দেওয়া হলে সে তা গ্রহণ করে। বিনা চাওয়ায় কিছু দেওয়া হলে তা গ্রহণ করতে দোষ নেই। বরং এরূপ দান গ্রহণের জন্য উৎসাহই দেওয়া হয়েছে। যেমন হযরত উমর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعطيني العطاء، فأقول: أعطه من هو أفقر إليه مني، فقال: خذه إذا جاءك من هذا المال شيء وأنت غير مشرف ولا سائل، فخذه ومالا فلا تتبعه نفسك 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে কিছু দান করতে চাইলে আমি বলতাম, এটা আমার চেয়ে যার বেশি প্রয়োজন তাকে দিন। এর উত্তরে তিনি বলেন, তুমি এটা নাও। তোমার কাছে যদি কোনও সম্পদ আসে আর তুমি তার প্রতি আগ্রহী না থাক এবং যাচনাকারীও না হও, তবে তা গ্রহণ কর। এরকম না হলে তুমি নিজেকে তার অনুগামী করো না।
চতুর্থ ও সর্বনিম্ন হল ওই ব্যক্তির হাত, যে মানুষের কাছে চায়ও এবং নিজে কিছু দেয়ও না। বিনা প্রয়োজনে মানুষের কাছে হাত পাতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এরচে' বরং যে-কোনও হালাল কাজ করা ভালো, তা মানুষের চোখে যতই নিম্নস্তরের কাজ হোক। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন والذي نفسي بيده لأن يأخذ أحدكم حبله، فيحتطب على ظهره خير له من أن يأتي رجلا، فيسأله أعطاه أو منعه 'যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম! তোমাদের কেউ রশি নিয়ে বের হয়ে যাবে, তারপর (তা দ্বারা) লাকড়ির বোঝা (বেঁধে) নিজ পিঠে করে নিয়ে আসবে, সেটাই এরচেয়ে ভালো যে, কারও কাছে গিয়ে সওয়াল করবে, যে তাকে দিতেও পারে, নাও দিতে পারে।
অন্যের কাছে সওয়াল করা চরম অমর্যাদাকর কাজ। এর দ্বারা নিজের আত্মসম্মান ধূলিসাৎ করা হয় । এরূপ ব্যক্তিকে হাশরের ময়দানেও চরম লাঞ্ছনাকর অবস্থায় উঠানো হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক হাদীছে আছে ما يزال الرجل يسأل الناس حتى يأتي يوم القيامة ليس في وجهه مزعة لحم কোনও ব্যক্তি মানুষের কাছে সওয়াল করতে থাকে। পরিশেষে কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তার চেহারায় গোশত বলতে কিছু থাকবে না।
চেহারা গোশতশূন্য হওয়াটা হীনতা ও লাঞ্ছনার নিদর্শন। কাজেই চরম ঠ্যাকা অবস্থা না হলে কারও কাছে হাত পাতা উচিত নয়। এর দ্বারা আত্মসম্মান নষ্ট হয় ও আখলাক-চরিত্র ধ্বংস হয়। প্রত্যেক ঈমানদারের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
খরচের খাতসমূহের মধ্যে অগ্রগণ্য কোনটি
খরচে কাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচ্য হাদীছে ইরশাদ করেন- وابدا بمن تعول (তুমি যাদের লালন পালন কর তাদের থেকে খরচ শুরু কর)। অর্থাৎ নিজ সত্তা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, পিতামাতা এবং আরও যারা নিজ লালন-পালনাধীন থাকে, প্রথম খরচটা তাদের পেছনেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও যদি সকলের পেছনে খরচ করা সম্ভব হয় তবে তো সেটাই করবে, অন্যথায় প্রথমে খরচ করবে নিজের জন্য, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে শিশুসন্তানের জন্য, তারপর স্ত্রীর জন্য, তারপর পিতা, তারপর মাতা, তারপর দাদা, তারপর বালেগ সন্তান- এ ধারাবাহিকতা অনুসরণ করবে। তারপরও বেঁচে থাকলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্যদের মধ্যে খরচ করা হবে। পরিবারের লোককে বঞ্চিত করে অন্যত্র খরচ করা জায়েয নয়। নিজ পোষ্য হওয়ার কারণে তাদের জরুরত পূরণ করা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। অন্যসব খরচা হয়তো নফল পর্যায়ের অথবা ওয়াজিব হলেও তা এর পরবর্তী স্তরের। কাজেই এদেরকে পেছনে রাখার কোনও সুযোগ নেই।। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জনৈক সাহাবীর হাতে কিছু দিরহাম দিয়ে তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে ابدأ بنفسك فتصدق عليها، فإن فضل شيء، فلأهلك، فإن فضل عن أهلك شيء فلذي قرابتك، فإن فضل عن ذي قرابتك شيء فهكذا وهكذا يقول فبين يديك وعن يمينك وعن شمالك 'তুমি এটা সর্বপ্রথম খরচ করবে তোমার নিজের উপর। তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার পরিবার-পরিজনের উপর, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার নিকটাত্মীয়দের উপর। তাদের উপর খরচ করার পরও যদি কিছু বেঁচে থাকে, তবে তা এভাবে এভাবে অর্থাৎ তোমার সামনে, ডানে ও বামে বিতরণ করবে।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (যদি এমন হয় যে,) আমার কাছে একটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার নিজের উপর খরচ কর। সে বলল, আমার কাছে আরেকটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার সন্তানের উপর খরচ কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার স্ত্রীর উপর খরচ কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার খাদেমের (অর্থাৎ গোলামের) উপর খরচ কর। সে বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। তিনি বললেন, এটি কী করবে সে ব্যাপারে তুমিই ভালো জান। এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলতেন, এমন না হলে তোমার সন্তান বলবে আমাকে খাওয়াও, তুমি আমাকে কার হাতে ছাড়ছ? স্ত্রী বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে তালাক দাও। খাদেম বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে বিক্রি করে দাও।
অবশ্য নিজেকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যেকের সবর ও তাওয়াক্কুলের মাত্রার উপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে যার দুর্বলতা আছে, সে নিজের উপরই প্রথম খরচ করবে। যার সবর ও তাওয়াক্কুল অনেক শক্তিশালী, সে নিজেকে পেছনে রেখে অন্যকে অগ্রাধিকার দিলে তা প্রশংসনীয় বৈকি। সাহাবায়ে কেরাম তো এ চরিত্রেরই ছিলেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে পিতামাতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এমনকি নিজেকে অভুক্ত রেখে অতিথিকে খাওয়ানোর নজিরও আছে অনেক। নিজ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে এ মাত্রার সবর ও তাওয়াক্কুলের উপর গড়ে তোলা গেলে তাদের উপরও অতিথি বা অন্য কোনও ক্ষুধার্তকে খাওয়ানোর অবকাশ আছে। এ নীতিকে ‘ঈছার’ বলে। কুরআন ও হাদীছে এর প্রশংসা করা হয়েছে। ইসলাম তার অনুসারীদের এরকম উচ্চতর আদর্শে উপনীত হওয়ার উৎসাহ যোগায়।
ইমাম সামহূদী রহ. বলেন, এ হাদীছটির সম্পর্ক যদিও আর্থিক ব্যয়ের সঙ্গে, তবে মুহাক্কিকগণ একে পরকালীন বিষয়েও ব্যবহার করেছেন। যেমন আলেম ব্যক্তি অন্যদের আগে নিজ পরিবারবর্গকে দীনের শিক্ষাদান করবে। কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا “তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় শরীআতের অনুসরণ। শরীআতের অনুসরণ করার জন্য প্রথমে শরীআতের ইলম অর্জন করা চাই। সর্বপ্রথম কর্তব্য যখন নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো, তখন ইলমে দীনের শিক্ষায়ও নিজেকে প্রথম স্থানে রাখা জরুরি। তারপর পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো জরুরি হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে দীনী ইলম শেখানো কর্তব্য। তারপর সক্ষমতা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে অন্যদের দিকে নজর দেওয়ার পালা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা দান করার শ্রেষ্ঠত্ব ও দান গ্রহণের হেয়ত্ব জানা যাচ্ছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য দানশীলতার গুণ অর্জন করা।
খ. পরিবার-পরিজন থেকেই খরচ আরম্ভ করা উচিত। তাদেরকে কষ্টে রেখে অন্যত্র দান-খয়রাত করা শরীআতসম্মত কাজ নয়।
গ. সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য এটাই শ্রেয় যে, পারিবারিক জরুরত মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকেই দান-খয়রাত করবে।
