আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫১- কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৯৫৯
সূরা কাদর
الْمَطْلَعُ বলা হয় উদয় হওয়া, পক্ষান্তরে, الْمَطْلِعُ মানে উদয়স্থল। أَنْزَلْنَاهُ এর ه সর্বনামটি দ্বারা আল-কুরআনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও অর্থ একবচনের গ্রহণ করা হয়েছে। কেননা, কুরআন নাযিলকারী হলেন আল্লাহ্ তাআলা। বস্তুত কোন বস্তুর গুরুত্ব প্রকাশ বা জোরালো ভাব প্রকাশের জন্য আরবরা একবচনের ক্রিয়াপদকে বহুবচনে ব্যবহার করে থাকে।
৪৫৯৯। মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) উবাই ইবনে কা’ব (রাযিঃ) কে বলেছিলেন, তোমাকে لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوا (সূরা) পড়ে শোনানোর জন্য আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। উবাই ইবনে কা’ব (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহ কি আমার নাম নিয়ে বলেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। একথা শুনে উবাই ইবনে কা’ব (রাযিঃ) কাঁদতে লাগলেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.-কে বলা হয় সায়্যিদুল কুররা শ্রেষ্ঠতম কারী। তাঁর কুরআনপাঠ ছিল সর্বাপেক্ষা সুন্দর। তাঁর সে বিশেষত্বের সঙ্গে এ হাদীছে একটি বাড়তি বিশেষত্ব বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন মাজীদের সূরা বায়্যিনাহ পড়ে শুনিয়েছিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁকে জানালেন যে, আল্লাহ তা'আলা আমাকে হুকুম করেছেন যেন তোমার সামনে এ সূরাটি পাঠ করি। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহ তা'আলা কি আপনার কাছে আমার নাম বলেছেন? তাঁর এ জিজ্ঞাসার কারণ ছিল হয়তো এই যে, তিনি মনে করেছিলেন যে, আল্লাহ তা'আলা উম্মতের কোনও এক ব্যক্তির সামনে এ সূরাটি পাঠ করতে বলেছেন। তিনি বিশেষ কারও নাম উল্লেখ করে এ হুকুম দেননি। হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নির্দিষ্ট করেছেন নিজের পক্ষ থেকে। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারাও এরকম বোঝা যায়। যেমন তাবারানীর বর্ণনায় আছে-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «يا أبا المنذر، إني أمرت أن أعرض عليك القرآن»، فقال: بالله آمنت، وعلى يدك أسلمت، ومنك تعلمت، قال: فرد النبي صلى الله عليه وسلم القول، فقال: يا رسول الله، وذكرت هناك؟ قال: «نعم باسمك ونسبك في الملأ الأعلى، قال : فاقرأ إذا يا رسول الله
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবুল মুনযির! (আবুল মুনযির হযরত উবাঈ রাযি.-এর উপনাম) আমাকে আদেশ করা হয়েছে যেন তোমার সামনে কুরআন পাঠ করি। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। আপনার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছি। আপনার নিকট থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথাটি পুনরাবৃত্তি করলেন। হযরত উবাঈ রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওখানে কি আমার কথা উল্লেখ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ, ঊর্ধ্বজগতে তোমার ও তোমার পিতার নামসহই বলা হয়েছে। হযরত উবাঈ রাযি. বললেন, তাহলে ইয়া রাসূলাল্লাহ, পাঠ করুন।

হযরত উবাঈ রাযি. যখন জানলেন আল্লাহ তা'আলাই নির্দিষ্টভাবে তাঁর নাম নিয়েই এ আদেশ করেছেন, তখন তিনি কেঁদে দিলেন। তাঁর সে কান্না খুশিতেও হতে পারে, ভয়েও হতে পারে। খুশির বিষয়টি তো স্পষ্ট। কুরআন মাজীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারা অতি বড় নি'আমত। এ নি'আমত লাভ করতে পারা এমনিই খুশির বিষয় বটে। সে শিক্ষাগ্রহণ যদি হয় সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে, তবে তা কত বড়ই না সৌভাগ্য। তদুপরি তা যদি হয় মহান আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে! আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং যদি তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশেষ কোনও বান্দার নাম নিয়ে হুকুম দেন যে, তার সামনে কুরআন পাঠ করো, তবে সে সৌভাগ্যের কোনও তুলনা হয় কি?

ভয়ের কারণ হল- শোকর আদায়ের ব্যাপারে নিজ ত্রুটি ও অক্ষমতার অনুভূতি। হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. হয়তো ভাবছিলেন, এত বড় নি'আমত আল্লাহ তা'আলা আমাকে দান করেছেন, এর যথাযথ শোকর আমি আদায় করতে পারব কি? এ নি'আমতের মর্যাদা রক্ষা করা আমার দ্বারা সম্ভব হবে কি?

হযরত উবাঈ রাযি.-এর কান্নার কারণ একইসঙ্গে আনন্দ ও ভীতির মিশ্র অনুভূতিও হতে পারে। একদিকে মহা নি'আমত লাভের পরমানন্দ, অন্যদিকে সে নি'আমতের মর্যাদা রক্ষায় ত্রুটি হয়ে যায় কি না সে ভয়। এ উভয়বিধ অনুভূতি তাঁর অন্তর নাড়া দিয়েছিল। আর সে কারণেই তিনি কেঁদে দিয়েছিলেন। প্রকৃত আল্লাহওয়ালাদের এটাই শান। আল্লাহ তা'আলার কোনও নি'আমত লাভ করতে পারলে তারা যেমন আনন্দিত হয়ে থাকেন, তেমনি সে নি'আমতের শোকর আদায়ে কোনও ত্রুটি হয়ে যায় কি না, সে ব্যাপারে তারা ভীতও থাকেন।

প্রকাশ থাকে যে, হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.-এর সামনে কুরআন পড়ে শোনানোর উদ্দেশ্য ছিল হযরত উবাঈ রাযি.-কে কুরআন শেখানো। শিক্ষাদানের এটাও একটা পদ্ধতি। উস্তায পাঠ করবে, আর ছাত্র তার পাঠ শুনে শিক্ষাগ্রহণ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে নিজ 'ইলমের হেফাজত ও তার বিশুদ্ধতা রক্ষার এটাও একটা তরিকা যে, জ্ঞানীজন তার জ্ঞান অন্যের সামনে পেশ করবে। আলেম যদি তার 'ইলম অন্য আলেমের সামনে তুলে ধরে, হাফেয যদি অন্য হাফেযের সামনে কুরআন তিলাওয়াত করে, কারী যদি অন্য কারীর সামনে পাঠ করে, তবে এর দ্বারা তাদের প্রত্যেকেরই অর্জিত বিদ্যা পরিপক্কও হয় এবং সেইসঙ্গে ভুলত্রুটি থাকলে তার সংশোধনও হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.-এর সামনে যে কুরআন পাঠ করেছিলেন, তা তাঁর নিজের জন্য প্রয়োজন না থাকলেও আমাদের জন্য তিনি এর মাধ্যমে অনেক বড় নির্দেশনা রেখে গেছেন। এ নির্দেশনা মোতাবেক আমাদের অবশ্যই আমল করা উচিত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জ্ঞানীজনের নিজ জ্ঞান-বিদ্যার উপর অতি আস্থাশীল না হয়ে অন্য জ্ঞানীর সঙ্গে মতবিনিময় করা এবং অন্যের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা অব্যাহত রাখা উচিত

খ. এক হাফেযের সামনে অন্য হাফেষের মুখস্থ কুরআন পেশ করা (দাওর করা) সুন্নত।

গ. ছাত্রের সঙ্গে শিক্ষকের নিজ জ্ঞান-বিদ্যার পর্যালোচনায় লজ্জার কিছু নেই। বরং এটা প্রকৃত শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য।

ঘ. আল্লাহ তা'আলার কোনও নি'আমত হাসিল হলে সেজন্য আনন্দ প্রকাশ করা চাই। এটা কৃতজ্ঞতার অংশ।

ঙ. নি'আমতের কৃতজ্ঞতা আদায়ে ত্রুটি হয়ে যায় কি না, সে ভয়ে ভীত থাকা চাই। এটা কৃতজ্ঞতা আদায়ে সহায়ক।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন