আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫১- কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৭৫০
২৪৭০ আল্লাহ তাআলার বাণীঃ إن الذين جاءوا بالإفك عصبة منكم لا تحسبوه شرا لكم بل هو خير لكم لكل امرئ منهم ما اكتسب من الإثم والذي تولى كبره منهم له عذاب عظيم “যারা এ অপবাদ রচনা করেছে , তারা তো তোমাদেরই একটি দল; একে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করোনা; বরং এ তো তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি”।
৪৩৯৫। ইয়াহয়া ইবনে বুকায়র (রাহঃ) ......... ইবনে শিহাব (রাহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন উরওয়া ইবনে যুবাইর, সাইদ ইবনে মুসায়্যিব, আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস, উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাস‘ঊদ (রা) নবী (ﷺ) এর সহধর্মিণী আয়েশা (রাযিঃ) এর ঘটনা সম্পর্কে বলেন, যখন অপবাদকারীরা তার প্রতি অপবাদ এনেছিল এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাদের অভিযোগ থেকে নির্দোষ থাকার বর্ণনা দেন। তাদের প্রত্যেকেই ঘটনার অংশবিশেষ আমাকে অবহিত করেন। অবশ্য তাদের পরস্পর পরস্পরের বর্ণনা সমর্থন করে, যদিও তাদের মধ্যে কেউ অন্যের তুলনায় এ ঘটনাটি বেশী সংরক্ষণ করেছে। তবে উরওয়া আয়িশা (রাযিঃ) থেকে আমাকে এরূপ বলেছিলেন যে, নবী (ﷺ) এর সহধর্মিণী আয়িশা (রাযিঃ) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কোথাও সফরে বের হতেন, তখন তিনি তার স্ত্রী গণের মধ্যে লটারি দিতেন। এতে যার নাম উঠত, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বের হতেন।
আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, অতএব, কোন এক যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমাদের মধ্যে লটারি দিলেন। তাতে আমার নাম উঠল। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে বের হলাম, পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরে। আমাকে হাওদায় করে উঠান হত এবং তাতে করে নামান হত। এ ভাবেই আমরা চললাম। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ শেষ করে ফিরলেন এবং ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলাম। একদা (মনযিল থেকে) রওয়ানা দেওার জন্য রাত থাকতেই ঘোষণা দিলেন। এ ঘোষণা দিলে আমি উট ছেড়ে সৈন্যদের অবস্থানস্থল থেকে কিছু দূরে চলে গেলাম। আমার প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে যখন সওয়ারীর কাছে এলাম, তখন দেখতে পেলাম যে, জাফারের দানা খচিত আমার হারটি ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে। আমি তা খোঁজ করতে লাগলাম। খোঁজ করতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে এ সকল লোক যারা আমাকে সওয়ার করাতো তারা, আমি আমার হাওদার ভিতরে আছি মনে করে, আমার হাওদা উটের পিঠে রেখে দিল। কেননা এ সময় শরীরের গোশত আমাকে (হালকা পাতলা ছিলাম) ভারী করেনি। আমরা তো খুব অল্প-খাদ্য গ্রহণ করতাম। আমি ছিলাম অল্পবয়স্কা এক বালিকা। সুতরাং হাওদা উঠাবার সময় তা যে খুব হালকা, তা তারা বুঝতে পারেনি এবং তারা উট হাঁকিয়ে রওয়ানা দিল।
সেনাদল চলে যাওয়ার পর আমি আমার হার পেয়ে গেলাম এবং যেখানে তারা ছিল সেখানে ফিরে এলাম। তখন সেখানে এমন কেউ ছিলনা যে ডাকবে বা ডাকে সাড়া দিবে। আমি যেখানে ছিলাম সে স্থানেই থেকে গেলাম। এ ধারণায় বসে থাকলাম যে যখন কিছুদূর গিয়ে আমাকে দেখতে পাবেনা, তখন এ স্থানে অবশ্যই খুঁজতে আসবে। সেখানে বসা অবস্থায় আমার চোখে ঘুম এসে গেল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। আর সৈন্যবেহিনীর পিছনে সাফওান ইবনে মুয়াত্তাল সুলামি যাকওয়ানি ছিলেন। তিনি শেষ রাতে রওয়ানা দিয়ে ভোর বেলা আমার এ স্থানে এসে পৌঁছলেন। তিনি একজন মানুষের আকৃতি নিদ্রাবস্থায় দেখতে পেলেন। তিনি আমার কাছে এসে আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। কেননা, পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার আগে আমাকে দেখেছিলেন। কাজেই আমাকে চেনার পর উচ্চকণ্ঠে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়লেন। পড়ার আওয়াজে আমি উঠে গেলাম এবং আমি আমার চাঁদর দিয়ে চেহারা ঢেকে নিলাম। আল্লাহর কসম তিনি আমার সঙ্গে কোন কথাই বলেননি এবং তার মুখ হতে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” ছাড়া আর কোন কথা আমি শুনিনি।
এরপর তিনি তার উট বসালেন এবং সামনের দুই পা নিজ পায়ে দাবিয়ে রাখলেন। আর আমি তাতে আরোহণ করলাম। তখন সাফওয়ান উটের লাগাম ধরে চললেন। শেষ পর্যন্ত আমরা সৈন্যবেহিনীর নিকট এ সময় গিয়ে পৌঁছলাম, যখন তারা দুপুরের প্রচণ্ড উত্তাপের সময় অবতরণ করে। (এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে) যারা ধ্বংস হওয়ার তারা ধ্বংস হল। আর যে ব্যক্তি এ অপবাদের নেতৃত্ব দেয়, সে ছিল (মুনাফিক সর্দার) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল। তারপর আমি মদীনায় এসে পৌঁছলাম এবং পৌঁছার পর আমি দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত অসুস্থ ছিলাম। আর অপবাদকারীদের কথা নিয়ে লোকেরা রটনা করছিল। আমি এসব কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে এতে আমাকে সন্দেহে ফেলেছিল যে, আমার অসুস্থ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে রকম স্নেহ-ভালবাসা দেখাতেন, এবারে তেমনি ভালবাসা দেখাচ্ছেন না। শুধু এতটুকুই ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার কাছে আসতেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার অবস্থা কি? তারপর তিনি ফিরে যেতেন। এই আচরণই আমাকে সন্দেহে ফেলেছিল। অথচ আমি এই অপপ্রচার সম্বন্ধে জানতেই পারিনি।
অবশেষে একটু সুস্থ হওয়ার পর মিসতাহের মায়ের সঙ্গে মানাসের (ময়দান বা জঙ্গলের) দিকে বের হলাম। সে জায়গাটিই ছিল আমাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার স্থান। আর আমরা কেবল রাতের পর রাতেই বাইরে যেতাম। এ ছিল সে সময়ের কথা যখন আমাদের ঘর সংলগ্ন পায়খানা নির্মিত হয়নি। আমাদের অবস্থা ছিল অনেকটা প্রাচীন আরবদের মত নিচু ময়দানের দিকে বের হয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারা। কেননা, ঘর সংলগ্ন পায়খানা নির্মাণ আমরা কষ্টকর মনে করতাম। কাজেই আমি ও মিসতাহের মা বাইরে গেলাম। তিনি ছিলেন আবু রুহম ইবনে আবদে মানাফের কন্যা এবং মিসতাহের মায়ের মা ছিলেন সাখর ইবনে আমিরের কন্যা, যিনি আবু বকর (রাযিঃ) এর খালা ছিলেন। আর তার পুত্র ছিলেন মিসতাহ ইবনে উসাসাহ।
আমি ও উম্মে মিসতাহ আমাদের প্রয়োজন সেরে ঘরের দিকে ফিরলাম। তখন মিসতাহের মা তার চাঁদরে হোঁচট খেয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাঁকে বললাম, তুমি খুব খারাপ কথা বলছ, তুমি কি এমন এক ব্যক্তিকে মন্দ বলছ, যে বদরের যুদ্ধে হাজির ছিল। তিনি বললেন, হে আত্মভোলা! তুমি কি শোননি সে কি বলেছে? আমি বললাম, সে কি বলেছে? তিনি বললেন, এমন এমন। এ বলে তিনি অপবাদকারীদের অপবাদ সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত খবর দিলেন। এতে আমার অসুখের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। যখন আমি ঘরে ফিরে আসলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার ঘরে প্রবেশ করে বললেন, তুমি কেমন আছ? তখন আমি বললাম, আপনি কি আমাকে আমার আব্বা আম্মার নিকট যেতে অনুমতি দিবেন? তিনি বললেন, তখন আমার উদ্দেশ্য ছিল যে, আমি তাদের কাছে গিয়ে তাদের থেকে আমার এ ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে জেনে নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে (যাওয়ার জন্য) অনুমতি দিলেন। আমি আব্বা আম্মার কাছে চলে গেলাম এবং আমার আম্মাকে বললাম, ও গো আম্মা! লোকেরা কি বলাবলি করছে? তিনি বললেন, বৎস! তুমি তোমার মন হালকা রাখ। আল্লাহর কসম! এমন কমই দেখা যায় যে, কোন পুরুষের কাছে এমন সুন্দরী রূপবতী স্ত্রী আছে, যাকে সে ভালবাসে এবং তার সতীনও আছে, অথচ তার ত্রুটি বের করা হয়না। রাবি বলেন, আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ। সত্যি কি লোকেরা এ ব্যপারে বলাবলি করছে? তিনি বললেন, আমি সে রাত কেঁদে কাটালাম। এমনকি ভোর হয়ে গেল তথাপি আমার কান্না থামল না। এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। আমি কাঁদতে কাঁদতেই ভোর করলাম।
যখন ওহী আসতে দেরি হল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী ইবনে আবু তালিব (রাযিঃ) ও উসামা ইবনে যায়দ (রাযিঃ) কে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদের ব্যপারে তাদের পরামর্শের জন্য ডাকলেন। তিনি বলেন, উসামা ইবনে যায়দ তার সহধর্মিণী (আয়েশা (রাযিঃ) এর পবিত্রতা এবং তার অন্তরে তাদের প্রতি তার ভালবাসা সম্পর্কে যা জানেন তার আলোকে তাঁকে পরামর্শ দিতে গিয়ে) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার পরিবার সম্পর্কে আমরা ভাল ধারণাই পোষণ করি। আর আলী ইবনে আবু তালিব (রাযিঃ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ আপনার উপর কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেন নি এবং তিনি ছাড়া বহু মহিলা রয়েছেন। আর আপনি যদি দাসীকে জিজ্ঞাসা করেন, সে আপনার কাছে সত্য ঘটনা বলবে। তিনি [আয়িশা (রাযিঃ)] বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বারিরাকে ডাকলেন এবং বললেন, হে বারিরা! তুমি কি তার কাছ থেকে সন্দেহজনক কিছু দেখেছ? বারিরা বলল, যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম! আমি এমন কোন কিছু তাঁর মধ্যে দেখতে পাইনি, যা আমি গোপন করতে পারি। তবে তাঁর মধ্যে সবচাইতে বেশী যা দেখেছি, তা হল তিনি একজন অল্প বয়স্কা বালিকা। তিনি কখনও তাঁর পরিবাবের আটার খামির রেখে ঘুমিয়ে পড়তেন। আর বকরীর বাচ্চা এসে তা খেয়ে ফেলত।
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (মিম্বরে) দাঁড়ালেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের বিরুদ্ধে তিনি সমর্থন চাইলেন। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বরের উপর থেকে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, ঐ ব্যক্তির মিথ্যা অপবাদ থেকে আমাকে সাহায্য করতে পারে, যে আমার স্ত্রীর ব্যপারে আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভালই জানতে পেরেছি। এবং তারা এমন এক পুরুষ সম্পর্কে অভিযোগ এনেছে, যার সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া কিছুই জানিনা। সে কখনও আমাকে ছাড়া আমার ঘরে আসেনি।
এ কথা শুনে সা’দ ইবনে মু’য়াজ আনসারি (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাঁর বিরুদ্ধে আমি আপনাকে সাহায্য করব, যদি সে আউস গোত্রের হয় তবে আমি তাঁর গর্দান মেরে দিব। আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের লোক হয়, তবে আপনি নির্দেশ দিলে আমি আপনার নির্দেশ কার্যকর করব। আয়েশা (রাযিঃ) বললেন, এরপর সা’দ ইবনে উবাদা দাঁড়ালেন। তিনি খাযরাজ গোত্রের সর্দার। তিনি পূর্বে একজন নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু এ সময় স্বগোত্রের পক্ষপাতিত্ব তাকে উত্তেজিত করে তোলে। কাজেই তিনি সা’দ কে বললেন, চিরঞ্জীব আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না। এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতা তুমি রাখ না। তারপর উসায়দ ইবনে হুযায়র দাঁড়ালেন, যিনি সা’দের চাচাতো ভাই। তিনি সা’দ ইবনে উবাদা কে বললেন, চিরঞ্জীব আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলেছ। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি নিজেও মুনাফিক এবং মুনাফিকের পক্ষে প্রতিবাদ করছ। এতে আউস এবং খাযরাজ উভয় গোত্রের লোকেরা উত্তেজিত হয়ে উঠল। এমনকি তারা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বরে দাঁড়ানো ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের থামাতে লাগলেন। অবশেষে তারা থামল।
নবী (ﷺ)ও নিরব হলেন। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, আমি সেদিন এমনভাবে কাটালাম যে, আমার চোখের অশ্রুও থামেনি এবং চোখে ঘুমও আসেনি। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, সকাল বেলা আমার আব্বা-আম্মা আমার কাছে আসলেন, আর আমি দু’ রাত এবং একদিন (একাধারে) কাঁদছিলাম। এর মধ্যে না আমার ঘুম হয়েছে না আমার চোখের পানি বন্ধ হয়েছে। তারা ধারণা করছিলেন যে এ ক্রন্দনে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, এর পূর্বে তারা যখন আমার কাছে বসা ছিলেন এবং আমি কাঁদছিলাম, ইত্যবসরে জনৈকা আনসারি মহিলা আমার কাছে আসার জন্য অনুমতি চাইলেন। আমি তাকে অনুমতি দিলাম। সে বসে আমার সাথে কাঁদতে লাগল। আমাদের এ অবস্থার মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের কাছে প্রবেশ করলেন এবং সালাম দিয়ে বসলেন।
আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, এর পূর্বে যখন থেকে এ কথা রটনা চলেছে, তিনি আমার কাছে বসেন নি। এ অবস্থায় তিনি এক মাস অপেক্ষা করেছেন। আমার সম্পর্কে ওহী আসেনি। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাশাহ্‌হুদ পাঠ করলেন। তারপর বললেন, হে আয়িশা! তোমার সম্পর্কে এরূপ এরূপ কথা আমার কাছে পৌঁছেছে। তুমি যদি নির্দোষ হয়ে থাক, তবে অচিরেই আল্লাহ তাআলা তোমার পবিত্রতা ব্যক্ত করে দিবেন। আর যদি তুমি কোন পাপে লিপ্ত হয়ে থাক, তবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর কাছে তওবা কর। কেননা, বান্দা যখন তার পাপ স্বীকার করে নেয় এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে তখন আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করেন।
আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর কথা শেষ করলেন, তখন আমার চোখের পানি এমনভাবে শুকিয়ে গেল যে, এক ফোঁটা পানিও অনুভব করছিলাম না। আমি আমার পিতাকে বললাম, আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে (তিনি যা কিছু বলেছেন তার) জবাব দিন। তিনি বললেন। আল্লাহর কসম! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে কি জবাব দিব তা আমার বুঝে আসছেনা। তারপর আমার আম্মাকে বললাম, আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জবাব দিন। তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারছিনা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে কি জবাব দিব। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, তখন আমি নিজেই জবাব দিলাম। অথচ আমি একজন অল্প বয়স্কা বালিকা। কুরআন খুব বেশী পড়িনি। আল্লাহর কসম! আমি জানি আপনারা এ ঘটনা শুনেছেন, এমনকি তা আপনাদের অন্তরে বসে গেছে এবং সত্য বলে বিশ্বাস করে নিয়েছেন। এখন যদি আমি বলি যে আমি নির্দোষ এবং আল্লাহ ভালভাবেই জানেন যে, আমি নির্দোষ; তবে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর আমি যদি আপনাদের কাছে এ বিষয় স্বীকার করে নেই, অথচ আল্লাহ জানেন , আমি তা থেকে নির্দোষ; তবে আপনারা আমার এই উক্তি বিশ্বাস করে নিবেন। আল্লাহর কসম! এ ক্ষেত্রে আমি আপনাদের জন্য ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর পিতার উক্তি ব্যতীত আর কোন দৃষ্টান্ত পাচ্ছিনা। তিনি বলেছিলেন,فَصَبْرٌ جَمِيلٌ وَاللَّهُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُونَ “পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয় তোমরা যা বলছ; সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যায়”।তিনি বলেন, এরপর আমি আমার চেহারা ঘুরিয়ে নিলাম এবং কাত হয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তিনি বলেন, এ সময় আমার বিশ্বাস ছিল যে আমি নির্দোষ এবং আল্লাহ তাআলা আমার নির্দোষিতা প্রকাশ করে দিবেন। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি তখন এ ধারণা করতে পারিনি যে, আল্লাহ আমার সম্পর্কে এমন ওহী অবতীর্ণ করবেন যা তিলাওয়াত করা হবে। আমার দৃষ্টিতে আমার মর্যাদা এর চাইতে অনেক নীচে ছিল। বরং আমি আশা করেছিলাম যে, হয়ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিদ্রায় কোন স্বপ্ন দেখবেন যাতে আল্লাহ তাআলা আমার নির্দোষিতা জানিয়ে দিবেন। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাঁড়ান নি এবং ঘরের কেউ বের হন নি। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি ওহী নাযিল হতে লাগল এবং তাঁর শরীর ঘামতে লাগল। এমনকি যদিও শীতের দিন ছিল তবুও তাঁর উপর যে ওহী অবতীর্ণ হচ্ছিল এর বোঝার ফলে মুক্তার মত তাঁর ঘাম ঝরছিল। যখন ওহী শেষ হল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাসছিলেন। তখন তিনি প্রথম যে বাক্যটি বলেছিলেন তা হলঃ হে আয়িশা! আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা প্রকাশ করেছেন।
এ সময় আমার মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব না, আল্লাহ ছাড়া আর কারও প্রশংসা করবনা। আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করলেন পূর্ণ দশ আয়াত পর্যন্ত। إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالإِفْكِ عُصْبَةٌ যারা এ অপবাদ রচনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল.....। যখন আল্লাহ তাআলা আমার নির্দোষিতার আয়াত অবতীর্ণ করলেন, তখন আবু বকর সিদ্দিক (রাযিঃ) যিনি মিসতাহ ইবনে উসাসাকে নিকটবর্তী আত্মীয়তা এবং দারিদ্র্যের কারণে আর্থিক সাহায্য করতেন, তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! মিসতাহ আয়িশা সম্পর্কে যা বলেছে, এরপর আমি তাকে কখনওই কিছুই দান করবনা।
তারপর আল্লাহ তাআলা আয়াত অবতীর্ণ করেলন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে তার আত্মীয় স্বজন ও অভাবগ্রস্থ কে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদের কিছুই দেবে না। তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাওনা যে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
আবু বকর (রাযিঃ) এ সময় বললেন, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করেন। তারপর তিনি মিসতাহের সাহায্য আগের মত দিতে লাগলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম! আমি এ সাহায্য কখনও বন্ধ করবনা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জয়নাব বিনতে জাহশকেও আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে জয়নাব! (আয়িশা সম্পর্কে) কি জানো আর কি দেখেছ? তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার কান ও চোখকে বাচিয়ে রাখতে চাই। আমি তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া অন্য কিছু জানি না। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সহধর্মিণীদের মধ্যে তিনি আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার পরহেযগারির কারণে রক্ষা করেন। আর তার বোন হামনা তার পক্ষ অবলম্বন করে মুকাবিলা করে এবং অপবাদ আনয়নকারী যারা ধ্বংস হয়েছিল তাদের মধ্যে সেও ধ্বংস হল।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন