আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫১- কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৭৪১
সূরা হজ্জ

ইবনে উয়াইনা (রাহঃ) বলেন, الْمُخْبِتِيْنَ বিনয়ী, শাস্তিপ্রাপ্ত। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, فِيْٓ أُمْنِيَّتِهٰ অর্থাৎ যখন তিনি কোন কথা বলেন, তখন শয়তান তাঁর কথার সঙ্গে নিজের কথা মিলিয়ে দেয়। এরপর আল্লাহ্ তাআলা শয়তানের সে মিলানো কথা মিটিয়ে দিয়ে তাঁর আয়াতকে সুদৃঢ় করেন। কেউ কেউ বলেন, أُمْنِيَّتِهٰ অর্থাৎ তার কিরাআত (পাঠ) إِلَّآ أَمَانِيَّ তাঁরা পড়তে জানতেন লিখতে জানতেন না। মুজাহিদ (রাহঃ) বলেন, مَشِيْدٌ অর্থাৎ চুন-সুরকি দ্বারা দৃঢ় নির্মিত। অন্যরা বলেন, يَسْطُوْنَ অর্থাৎ বাড়াবাড়ি করে। এটি سَطْوَةً থেকে উদ্ভূত। বলা হয় يَسْطُوْنَ অর্থাৎ মজবুত করে ধরে। وَهُدُوْآ إِلَى الطَّيِّبِ مِنَ الْقَوْلِ অর্থাৎ তাদের অন্তরে পবিত্র বাক্য[১] ঢেলে দেয়া হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, بِسَبَبٍ রজ্জু দ্বারা যা ঘরের ছাদের দিকে। تَذْهَلُ তুমি বিস্মৃত হবে।

[১] পবিত্র বাক্য দ্বারা 'কালিমায়ে তাওহীদ' অথবা 'কুরআন'কে বুঝানো হয়েছে। কেউ বলেন, এর দ্বারা “ইসলাম’কে বুঝানো হয়েছে।
৪৩৮৬। উমর ইবনে হাফস (রাহঃ) ......... আবু সাইদ খুদরি (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে আদম! তিনি বলবেন, হে রব! আমার সৌভাগ্য, আমি হাজির। তারপর তাকে উচ্চস্বরে ডেকে বলা হবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমার বংশধর থেকে একদলকে বের করে জাহান্নামের দিকে নিয়ে আস। আদম (আলাইহিস সালাম) বলবেন, হে রব! জাহান্নামের দলের পরিমাণ কি? বলবে, প্রতি হাজার থেকে আমার ধারণা যে, বললেন, নয়শত নিরানব্বই, এ সময় গর্ভবতী মহিলা গর্ভপাত করবে, শিশুরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে এবং তুমি মানুষকে দেখেবে মাতাল; অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি কঠিন। (পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ আয়াতটি পাঠ করলেন), এ কথা লোকদের কাছে ভয়াবহ মনে হল। এমনকি তাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল।
এরপর নবী (ﷺ) বললেন, প্রতি হাজারে নয়শত নিরানব্বই জন তো ইয়াজুজ-মাজুজ থেকে নেয়া হবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে একজন। আবার মানবকূলের মধ্যে তোমাদের তুলনা হবে যেমন, সাদা গরুর পার্শ্ব মধ্যে যেন একটি কালো পশম অথবা কালো গরুর পার্শ্ব মধ্যে যেন একটি সাদা পশম। আমি অবশ্য আশা রাখি যে জান্নাতবাসীদের মধ্যে তোমরাই হবে এক চতুর্থাংশ। (রাবি বলেন) আমরা সবাই খুশিতে বলে উঠলাম, আল্লাহু আকবার। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা হবে জান্নাতবাসীদের এক তৃতীয়াংশ। আমরা বলে উঠলাম, আল্লাহু আকবার। তারপর তিনি বললেন, তোমরা হবে জান্নাতবাসীদের অর্ধেক। আমরা বলে উঠলাম, আল্লাহু আকবার। আ’মাশ থেকে উসামার বর্ণনায় রয়েছে تَرَى النَّاسَ سُكَارٰى وَمَا هُمْ بِسُكَارٰى এবং তিনি (সন্দেহাতীতভাবে) বলেন, প্রতি হাজারে নয়শত নিরানব্বই জন। জারীর, ঈসা ইবনে ইউনুস ও আবু মুআবিয়ার বর্ণনায় سُكَرٰى এবং وَمَا هُمْ بِسُكَارٰى রয়েছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতবাসীদের মধ্যে অন্যান্য উম্মতের তুলনায় এ উম্মতের হার বর্ণনা করলেন। তাতে অন্যান্য উম্মতের তুলনায় এ উম্মতের হার পর্যায়ক্রমে এক-চতুর্থাংশ, এক-তৃতীয়াংশ ও অর্ধাংশ বর্ণনা করে সাহাবায়ে কেরামের কাছ থেকে জানতে চাচ্ছিলেন এতে তারা খুশি কি না। প্রতিবারই তারা নিজেদের খুশি হওয়ার কথা ব্যক্ত করছিলেন। তা খুশি হওয়ারই কথা। কেননা পৃথিবীতে কত হাজার হাজার নবী এসেছেন, তাতে কত হাজার হাজার উম্মত তৈরি হয়েছে। সেই অসংখ্য হাজার উম্মতের মধ্যে আমরাও একটি উম্মত। এ অবস্থায় আমরা যদি সর্বমোট জান্নাতবাসীর এক-চতুর্থাংশ হই, তাও তো বড় আশার কথা। সেখানে এক-তৃতীয়াংশ হলে খুশির কোনও সীমা থাকে না। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের জন্য আরও বড় আশার বাণী অপেক্ষা করছিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবশেষে জানালেন যে, জান্নাতবাসীদের অর্ধেকই হবে তাঁর উম্মত।

জান্নাতবাসীদের মধ্যে কোনও কোনও নবীর অনুসারী সংখ্যা হবে দু'-চারজন। কারও শ' খানেক, কারও হাজার খানেক, কারও বা লাখ খানেক। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
عرضت علي الأمم، فجعل النبي والنبيان يمرون معهم الرهط، والنبي ليس معه أحد، حتى رفع لي سواد عظيم، قلت: ما هذا؟ أمتي هذه؟ قيل: بل هذا موسى وقومه، قيل : انظر إلى الأفق، فإذا سواد يملأ الأفق، ثم قيل لي : انظر هاهنا وهاهنا في آفاق السماء، فإذا سواد قد ملأ الأفق، قيل : هذه أمتك
“আমার সামনে উম্মতসমূহকে পেশ করা হল। দেখা গেল দু'-একজন নবী তাঁদের সঙ্গে ছোট ছোট দল নিয়ে যাচ্ছেন। কোনও নবী যাচ্ছেন একা। তাঁর সঙ্গে কেউ নেই। একপর্যায়ে আমার সামনে একটি বড় দল তুলে ধরা হল। জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? এরা কি আমার উম্মত? বলা হল, বরং এরা মূসা ও তাঁর কওম। তারপর আমাকে বলা হল, আকাশপ্রান্তে তাকান। দেখি কি এমন বিশাল এক দল, যারা আকাশপ্রান্ত ছেয়ে ফেলেছে। বলা হল, ওই দিকে তাকান,ওই দিকে তাকান। এভাবে আকাশের সকল প্রান্তে। দেখা গেল বিশাল বিশাল দল আকাশের সকল প্রান্ত ছেয়ে ফেলেছে। বলা হল, এরা আপনার উম্মত।

হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
أهل الجنة عشرون ومائة صف، أمتي منهم ثمانون صفا
'জান্নাতবাসীগণ হবে একশ' বিশ কাতার। তার মধ্যে আশি কাতার আমার উম্মত।
এর দ্বারা বোঝা যায়, জান্নাতবাসীদের মধ্যে এ উম্মতের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি হবে। সম্ভবত আল্লাহ তা'আলার রহমতের দিকে তাকিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশা প্রকাশ করেন যে, তাঁর উম্মত জান্নাতবাসীদের অর্ধেক হবে, তখন আল্লাহ তা'আলা তাঁর সে আশা পূর্ণ করে দেন, সঙ্গে বেশিও দেন। খুবসম্ভব এদিকে ইঙ্গিত করেই কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে
وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى
“অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে এত দেবেন যে, তুমি খুশি হয়ে যাবে।

প্রশ্ন হয়, তিনি এ কথাটি তো প্রথমেই জানাতে পারতেন, তার পরিবর্তে প্রথমে এক-চতুর্থাংশ ও তারপর এক-তৃতীয়াংশের কথা বললেন কেন? উত্তর হল, পর্যায়ক্রমে বললে তা অন্তরে বেশি রেখাপাত করে। তাছাড়া কাউকে কোনওকিছুর সবটা একসঙ্গে না দিয়ে কিছু কিছু করে দিলে দেওয়াটা হয় অনেকবার। তা গ্রহীতার প্রতি দাতার খাস দৃষ্টি ও বিশেষ মনোযোগের পরিচয় বহন করে। এর আরও বাড়তি ফায়দা হল, প্রতিবার সুসংবাদদান একটি স্বতন্ত্র নি'আমত। ফলে যতবার সুসংবাদ দেওয়া হবে, ততবার বান্দার পক্ষে পৃথক পৃথক কৃতজ্ঞতা আদায়ের সুযোগ হবে। কৃতজ্ঞতা আদায়ের সুযোগদানও একটি আলাদা নি'আমত বটে।

এক হাদীছে জান্নাতবাসীদের মধ্যে মুসলিম উম্মাহ'র সংখ্যা সর্বাপেক্ষা বেশি হওয়ার কথা জানানোর পর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে
إن الجنة لا يدخلها إلا نفس مسلمة
(জান্নাতে প্রবেশ করবে কেবলই মুসলিম ব্যক্তি)।
অর্থাৎ কোনও কাফের ও মুশরিক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। জান্নাতে প্রবেশ করতে চাইলে অবশ্যই শিরক ও কুফর পরিহার করে আল্লাহর প্রতি, আখিরাতের প্রতি, নবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবের প্রতি এবং এমন সবকিছুর প্রতি ঈমান আনতে হবে, যার প্রতি ঈমান আনার জন্য আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হুকুম রয়েছে। কিন্তু দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এ শর্ত পাওয়া যায় না।

সব কালেই কাফের-মুশরিকের সংখ্যা বেশি ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের সামনে এ কথা বলেছিলেন, সেই সাহাবায়ে কেরামের যমানায় জাযীরাতুল আরবের বাইরে সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষই ঈমান ও ইসলামের বাইরে ছিল। আজও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই অমুসলিম। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, জাহান্নামীদের তুলনায় জান্নাতবাসীর সংখ্যা হবে অতি নগণ্য। তা যে কতটা নগণ্য তা স্পষ্ট করার জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টান্ত দেন যে
وما أنتم في أهل الشرك إلا كالشعرة البيضاء في جلد الثور الأسود، أو كالشعرة السوداء في جلد الثور الأحمر
‘আর অংশীবাদীদের (মুশরিকদের) মধ্যে তোমরা হলে কালো বলদের চামড়ায় সাদা পশমতুল্য অথবা (বললেন,) লাল বলদের চামড়ায় কালো পশমতুল্য। ‘অংশীবাদী' বলে সমস্ত অমুসলিমকে বোঝানো হয়েছে। অমুসলিমগণ কোনও না কোনওভাবে আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করেই ফেলে। এমনকি যারা নাস্তিক, আল্লাহ তা'আলার অস্তিত্ব স্বীকার করে না, প্রকারান্তরে তারা প্রকৃতিকে ঈশ্বর বানাচ্ছে। এটা তো শিরকই হল। যাহোক, এ দৃষ্টান্ত দ্বারা অমুসলিমদের তুলনায় মুসলিমদের সংখ্যা কত অল্প তা সহজেই অনুমান করা যায়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জান্নাত লাভের জন্য ঈমান ও ইসলাম শর্ত। কোনও অমুসলিম জান্নাতে যাবে না।

খ. আল্লাহ তা'আলা যখন আমাদেরকে মুসলিম বানিয়েছেন, তখন আমরা জান্নাত পাওয়ার জন্য আশাবাদী থাকতেই পারি।

গ. জান্নাতবাসীদের মধ্যে মুসলিম উম্মাহ'র সংখ্যা হবে সর্বাপেক্ষা বেশি। এ সুসংবাদ আমাদেরকে জান্নাতলাভের জন্য আশাবাদী করে তোলে।

ঘ. জান্নাতলাভের জন্য যেহেতু ঈমান ও ইসলাম শর্ত, তাই আমাদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হবে যাতে মৃত্যু পর্যন্ত ঈমান ও ইসলাম আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন