আল মুওয়াত্তা - ইমাম মালিক রহঃ

৫৪. ঘরে প্রবেশের অনুমতি গ্রহণ বিষয়ক অধ্যায়

হাদীস নং: ১৭৯৬
১. ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি প্রসঙ্গ
রেওয়ায়ত ২. আবু মুসা আশ’আরী (রাযিঃ) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, তিনবার অনুমতি নিতে হয়। অতঃপর অনুমতি হইলে প্রবেশ করবে, অন্যথায় প্রত্যাবর্তন করিবে।
باب الْاسْتِئْذَانِ
وَحَدَّثَنِي مَالِك عَنْ الثِّقَةِ عِنْدَهُ عَنْ بُكَيْرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْأَشَجِّ عَنْ بُسْرِ بْنِ سَعِيدٍ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ عَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ أَنَّهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْاسْتِئْذَانُ ثَلَاثٌ فَإِنْ أُذِنَ لَكَ فَادْخُلْ وَإِلَّا فَارْجِعْ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটির বক্তব্য হল কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তার অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি চাওয়ার সর্বোচ্চ পরিমাণ তিনবার। অর্থাৎ সাক্ষাৎপ্রার্থী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সালামের মাধ্যমে অনুমতি চাইবে। যদি অনুমতি না পাওয়া যায়, দ্বিতীয়বার একইভাবে অনুমতি চাইবে। তারপরও অনুমতি না পাওয়া গেলে একইভাবে আরও একবার অনুমতি চাইবে। তাও যদি অনুমতি দেওয়া না হয়, তবে ফিরে যাবে। এ প্রসঙ্গে হযরত উমর ফারুক রাযি. ও হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি.-এর একটি সুন্দর ঘটনা বর্ণিত আছে। ঘটনাটি নিম্নরূপ-

একবার হযরত আবু মূসা আশ'আরী রাযি. হযরত উমর রাযি.-এর বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয়ে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিনি পরপর তিনবার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু অনুমতি দেওয়া হল না। তিনি পরের দিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং আগের দিনের বৃত্তান্ত তাঁকে জানালেন। বললেন, আমি গতকাল এসেছিলাম। এসে তিনবার সালাম দিই। কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাই ফিরে যাই। হযরত উমর রাযি. বললেন, আমরা তোমার সালাম শুনেছি। কিন্তু তখন আমরা একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তা তুমি আরও অনুমতি চাইলে না কেন? অনুমতি দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে? হযরত আবু মুসা রাযি. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি গ্রহণের যে নিয়ম শিখিয়েছেন সে অনুযায়ীই আমি অনুমতি চেয়েছি। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি অনুমতি চাওয়াটা তিনবার। তারপরও অনুমতি না পাওয়া গেলে ফিরে যাবে। হযরত উমর রাযি. বললেন, তুমি এ বিষয়ে সাক্ষী হাজির করো। অন্যথায় তোমাকে কঠিন শাস্তি দেব। এতে হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তখনই তিনি আনসারদের একটি মজলিসে গিয়ে উপস্থিত হলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি ক্ষুব্ধ ও বিচলিত। তিনি মজলিসের লোকদের লক্ষ্য করে বললেন, আপনাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আপনাদের মধ্যে কেউ কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন- اَلْاِسْتأذَانُ ثَلَاتٌ، فَإِنْ أُذِنَ لَكَ وَ إِلَّا فَارْجِعْ (অনুমতি চাওয়াটা তিনবার। তারপর তোমাকে অনুমতি দেওয়া হলে তো ভালো, অন্যথায় ফিরে যেয়ো)। সে মজলিসের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেন, কী হয়েছে? হযরত আবূ মূসা রাযি. তাদের সামনে ঘটনার বিবরণ দিলেন। হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. বললেন, এ বিষয়ে সাক্ষী দিতে যাবে আমাদের মধ্যকার সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি। সে মজলিসে হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি.-ও ছিলেন। তিনি ছিলেন বয়সে সবার ছোট। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনি গিয়ে সাক্ষ্য দিলেন এবং বললেন যে, আমাদেরকে অনুমতিগ্রহণ বিষয়ে এমনই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। হযরত উমর ফারূক রাযি. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষাটি আমার অজানা ছিল। বাজারে কেনাবেচায় ব্যস্ত থাকাটা আমাকে এ বিষয়ে অনবহিত রেখেছে। (সহীহ মুসলিম: ২১৫৩; সুনানে আবু দাউদ: ৫১৮২)

এক বর্ণনায় আছে, হযরত উমর রাযি. মসজিদেও এ বিষয়ে সাক্ষ্য চেয়েছিলেন। তখন হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. স্বয়ং সাক্ষ্যদান করেন এবং বলেন, হে উমর ইবনুল খাত্তাব! আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জন্য আযাবে পরিণত হবেন না। হযরত উমর রাযি. বললেন, সুবহানাল্লাহ! আমি তো একটি কথা শুনলাম আর সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইলাম। (সহীহ মুসলিম: ২১৫৪; সুনানে আবু দাউদ: ৫১৮১; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৫৮২)

বস্তুত এটা ছিল হযরত উমর ফারুক রাযি.-এর দূরদর্শীতা ও হাদীছ বিষয়ে তাঁর কঠোর সতর্কতা। হযরত আবূ মূসা রাযি.-এর বিশ্বস্ততায় তাঁর কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু হাদীছ যেহেতু শরী'আতের দলীল, তাই এর বর্ণনায় যাতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয় সেটাই ছিল তাঁর লক্ষ্যবস্তু। তাঁর আমলে তিনি ছিলেন সমগ্র উম্মতের অভিভাবক। তাই উম্মতের দীন ও দুনিয়া উভয় বিষয়ে তাঁর সতর্ক অবস্থান বাঞ্ছনীয় ছিল। বিশেষত এ শরী'আত যেহেতু সর্বশেষ শরী'আত, তাই কিয়ামত পর্যন্ত এর সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উম্মতের উলামা ও শাসকবর্গের অপরিহার্য কর্তব্য ছিল। সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে পরবর্তী শত শত বছর উম্মতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে এসেছে। ফলে আজ এ আখেরী শরী'আত ও এর উৎস কুরআন-সুন্নাহ যথাযথভাবে সংরক্ষিত আছে।

যাহোক অনুমতি চাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা হল তিনবার। তিনবারের পর আর অনুমতি চাওয়া সঙ্গত নয়। এটা পীড়াপীড়ির মধ্যে পড়ে। কাউকে পীড়াপীড়ি করে কষ্ট দেওয়া উচিত না। অনুমতি চাইলে যে অনুমতি দিতেই হবে এর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। মানুষের নানারকম ওজর থাকতে পারে। হয়তো এমন সময় অনুমতি চাওয়া হয়েছে, যখন অনুমতি দেওয়াটা সম্ভব নয়। তা দিতে গেলে বিশেষ কষ্ট বা পেরেশানি হবে। সাক্ষাৎপ্রার্থীর উচিত মানুষের কষ্ট-ক্লেশ বা ওজর-অজুহাতকে সম্মান দেওয়া এবং অনুমতি না পাওয়াকে সহজভাবে গ্রহণ করা। হাঁ, সাক্ষাৎপ্রার্থীর প্রয়োজনও বিশেষ জরুরি হতে পারে। তাই যথাসম্ভব অনুমতি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কঠিন ওজর না থাকলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া সঙ্গত নয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে আগে অনুমতি নেওয়া জরুরি।

খ. অনুমতি চাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা তিনবার। তৃতীয়বারেও অনুমতি পাওয়া না গেলে ফিরে যেতে হবে। চতুর্থ বার অনুমতি চাওয়া বিধিসম্মত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুওয়াত্তা মালিক - হাদীস নং ১৭৯৬ | মুসলিম বাংলা