আল মুওয়াত্তা - ইমাম মালিক রহঃ

৫১. চুল বিষয়ক অধ্যায়

হাদীস নং: ১৭৭৮
৫. আল্লাহর জন্য ভালবাসা
রেওয়ায়ত ১৬. আবু ইদরীস খাওলানী (রাহঃ) বলেন, আমি দামিশকের মসজিদে প্রবেশ করিলাম। সেখানে জনৈক যুবককে দেখিলাম, তাহার দাঁতগুলি অতি উজ্জ্বল সাদা (মুক্তার মতো)। তাহার সঙ্গে অনেক মানুষ ছিল। যখনই কোন ব্যাপারে মতবিরোধ হইত, উক্ত যুবকের কথাকেই সনদ (নির্ভরযোগ্য) বলিয়া গণ্য করা হইত এবং তাহার কথার উপরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হইত। আমি (আবু ইদরীস) লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই যুবকটি কে? তাহারা বলিল, ইনি হইলেন মুআয ইবনে জাবাল (রাযিঃ)। পরদিন প্রাতঃকালে আমি (মসজিদে) যাইয়া দেখি যে, তিনি (মু’আয ইবনে জাবাল) আমার আগেই সেখানে পৌছিয়াছেন এবং নামায পড়িতেছেন। আমি অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। তিনি নামায পড়িয়া শেষ করিলে পর আমি তাহার সম্মুখে গিয়া পৌছিলাম। অতঃপর তাহাকে সালাম করিয়া বলিলাম, আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসি। তিনি বলিলেন, আল্লাহরই জন্য? আমি বলিলাম, হ্যাঁ, আল্লাহর জন্যই। তিনি (পুনরায়) বললেন, আল্লাহরই জন্য? আমি বলিলাম, হ্যাঁ, আল্লাহরই জন্য। অতঃপর তিনি আমার চাদরের এক কোণা ধরিয়া (আমাকে) নিজের দিকে টানিলেন এবং বলিলেন, আনন্দিত হও! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে শুনিয়াছি, তিনি বলিতেছিলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার ভালবাসা সেই সমস্ত লোকের জন্য ওয়াজিব হইয়াছে যাহারা আমার (সন্তুষ্টির) জন্য পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসে, আমারই জন্য একত্রে বসে, আমারই জন্য একে অন্যকে দেয় এবং আমারই জন্য একে অন্যের জন্য খরচ করে।
بَاب مَا جَاءَ فِي الْمُتَحَابِّينَ فِي اللَّهِ
وَحَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ أَبِي حَازِمِ بْنِ دِينَارٍ عَنْ أَبِي إِدْرِيسَ الْخَوْلَانِيِّ أَنَّهُ قَالَ دَخَلْتُ مَسْجِدَ دِمَشْقَ فَإِذَا فَتًى شَابٌّ بَرَّاقُ الثَّنَايَا وَإِذَا النَّاسُ مَعَهُ إِذَا اخْتَلَفُوا فِي شَيْءٍ أَسْنَدُوا إِلَيْهِ وَصَدَرُوا عَنْ قَوْلِهِ فَسَأَلْتُ عَنْهُ فَقِيلَ هَذَا مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ فَلَمَّا كَانَ الْغَدُ هَجَّرْتُ فَوَجَدْتُهُ قَدْ سَبَقَنِي بِالتَّهْجِيرِ وَوَجَدْتُهُ يُصَلِّي قَالَ فَانْتَظَرْتُهُ حَتَّى قَضَى صَلَاتَهُ ثُمَّ جِئْتُهُ مِنْ قِبَلِ وَجْهِهِ فَسَلَّمْتُ عَلَيْهِ ثُمَّ قُلْتُ وَاللَّهِ إِنِّي لَأُحِبُّكَ لِلَّهِ فَقَالَ أَللَّهِ فَقُلْتُ أَللَّهِ فَقَالَ أَللَّهِ فَقُلْتُ أَللَّهِ فَقَالَ أَللَّهِ فَقُلْتُ أَللَّهِ قَالَ فَأَخَذَ بِحُبْوَةِ رِدَائِي فَجَبَذَنِي إِلَيْهِ وَقَالَ أَبْشِرْ فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى وَجَبَتْ مَحَبَّتِي لِلْمُتَحَابِّينَ فِيَّ وَالْمُتَجَالِسِينَ فِيَّ وَالْمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ وَالْمُتَبَاذِلِينَ فِيَّ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আবু ইদরীস খাওলানী রহ. শামের খাওলান গোত্রীয় একজন প্রবীণ ও বিখ্যাত তাবি‘ঈ। তিনি দামেশকের মসজিদে হযরত মুআয ইবন জাবাল রাযি-এর সঙ্গে সাক্ষাত করে বলেছিলেন 'আমি আপনাকে ভালোবাসি', যেমনটা এ হাদীছের বর্ণনায় আছে। হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি, ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিশিষ্ট আলেম সাহাবী। তাঁর সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমার উম্মতের মধ্যে হালাল-হারাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশি জানে মু'আয। অতি বড় জ্ঞানীজন হওয়ায় তাঁর কাছে লোকজনের ভিড় লেগে থাকত। কারও কিছু জানার থাকলে তাঁর কাছেই জিজ্ঞেস করত। কোনও বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তাঁর কাছেই সমাধান চাইত। খুব ইবাদতগুযারও ছিলেন। এসব গুণ ও বিশেষত্ব দেখে আবূ ইদরীস খাওলানী রহ.-এর অন্তরে তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাতে আপ্লুত হয়েই তিনি এ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন যে, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
ইনি তো হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.। উচ্চস্তরের আলেম সাহাবী। পারস্পরিক ভালোবাসার কী মর্যাদা, ভালোভাবেই জানেন। এ উক্তির গভীরতাও যথেষ্ট বোঝেন। তাই তিনি আবূ ইদরীস খাওলানী রহ.-কে কসম দিয়ে তার উক্তির সত্যতা পরিষ্কার করে নেন। তারপর তাকে এ সম্পর্কে সুসংবাদ দান করেন। প্রথমে সুসংবাদটির মূল্য ও মাহাত্ম্যের প্রতি সচেতন করে তোলার জন্য তার চাদর ধরে নিজের দিকে টেনে নেন। অথবা তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন ভালোবাসার কারণে তাকে সম্বর্ধিত করার জন্য। তিনি তাকে বললেন, তুমি সুসংবাদ নাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَجَبَتْ مَحَبَّتِي لِلْمُتَحَابِّينَ فِيَّ، وَالْمُتَجَالِسِينَ فِيَّ، وَالْمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ، وَالْمُتَبَاذِلِينَ فِيَّ.

(ওই সকল লোকের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত, যারা আমারই জন্য একে অন্যকে ভালোবাসে; আমারই জন্য পরস্পরে ওঠাবসা করে; আমারই জন্য পরস্পরে দেখা-সাক্ষাত করে এবং আমারই জন্য খরচ করে)। অর্থাৎ যাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, যাদের পারস্পরিক ওঠাবসা, যাদের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাত এবং যাদের পারস্পরিক অর্থব্যয় হয় কেবল আমারই জন্য, আমারই সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, দুনিয়ার নশ্বর কোনও সম্পদের জন্যও নয় এবং নয় অন্য কোনও পার্থিব স্বার্থে, তারা নিশ্চিত থাকুক যে, আমি অবশ্যই তাদের মহব্বত করি, তাদের ভালোবাসি। আল্লাহু আকবার! কী বিশাল পুরস্কার! এটা আল্লাহ তাআলারই মহত্ত্ব ও মহানুভবতা যে, বান্দার তুচ্ছ কাজের বিনিময়েও তিনি নিজের পক্ষ থেকে অনেক বড় পুরস্কার দিয়ে থাকেন। বান্দাই বা কী আর তার ভালোবাসাই বা কী! এক বান্দা আরেক বান্দাকে ভালোবাসলে কতটুকুই বা বাসতে পারে? একজন আরেকজনের জন্য কী পরিমাণই বা খরচ করতে পারে? অথচ এর বিপরীতে তিনি বান্দাকে নিজ ভালোবাসার নিশ্চয়তা দান করেছেন। এ মহা নি'আমতের কারণে আমরা তাঁর কী শোকর আদায় করব?
প্রকাশ থাকে যে, পারস্পরিক মহব্বত, ওঠাবসা, দেখা-সাক্ষাত ও অর্থব্যয় যদি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে হয়, তবে তাতে কোনওরকম সীমালঙ্ঘন হতে পারে না। তা হয় শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেক। কাজেই এ বিষয়গুলো যাতে নিখুঁতভাবে কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই নিবেদিত থাকে, সে লক্ষ্যে শরীআতের সীমারেখা রক্ষা করে চলা অবশ্যকর্তব্য। খুব সাবধান থাকতে হবে যাতে এর কোনওটিতেই শরীআতের বরখেলাফ না হয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কাছাকাছি কোথাও কোনও বুযুর্গ ব্যক্তি ও আল্লাহওয়ালার উপস্থিতি জানতে পারলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া উচিত। এটা নিজ ঈমান-আমলে উন্নতি লাভের পক্ষে সহায়ক।

খ. নিজেদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতভিন্নতা সৃষ্টি হলে সে ব্যাপারে কর্তব্য বিজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে সমাধান নেওয়া।

গ. আল্লাহপ্রেমের এক দাবি হলো আল্লাহওয়ালা ও আল্লাহর প্রেমিক বান্দাদের মহব্বত করা।

ঘ. কারও প্রতি অন্তরে মহব্বত ও ভালোবাসা থাকলে তাকে তা জানানো উচিত।

ঙ. যাকে মহব্বত করা হয় তার উচিত সে মহব্বতের কদর করা এবং যারা মহব্বত করে তাদের মূল্যায়ন করা।

চ. মহব্বত ও ভালোবাসা এবং দেখা-সাক্ষাত করা, ওঠাবসা করা ও টাকাপয়সা খরচ করার কাজগুলো কেবলই আল্লাহ তাআলার জন্য হওয়া উচিত, পার্থিব কোনও স্বার্থে নয়।

ছ. এসব কাজ আল্লাহর জন্য হলে পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তাআলার মহব্বত লাভ করা যায়। এরচে' বড় কোনও পুরস্কার হতে পারে না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান