আল মুওয়াত্তা - ইমাম মালিক রহঃ

৪৪. কাসামা (নিহতের ব্যাপারে বিশেষ হলফ করা)

হাদীস নং: ১৬২৮
১. প্রথমে ওয়ারিসদের কসম লওয়া হয়
রেওয়ায়ত ২. বুশাইর ইবনে ইয়াসার (রাহঃ) হইতে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ ইবনে সহল আনসারী ও মুহায়্যিসা খায়বর গিয়াছিল, তথায় যাইয়া তাহারা জিনজের কাজে ব্যস্ত হইয়া একে অপর হইতে পৃথক হইয়া গেল। আব্দুল্লাহকে কেহ হত্যা করিল। মুহায়্যিসা তাহার ভাই হুয়ায়্যিসা আব্দুর রহমানকে লইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে উপস্থিত হইল এবং আব্দুর রহমান স্বীয় ভ্রাতার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট কথা বলিতে চাহিল। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেনঃ যে বড় তাহার প্রতি লক্ষ্য কর। অতঃপর আব্দুল্লাহর ঘটনা মুহায়্যিসা ও হুয়ায়্যিসা বর্ণনা করিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলিলেনঃ যদি তোমরা পঞ্চাশবার কসম খাইতে পার তবে তোমরা দিয়াত প্রাপ্ত হইবে। তাহারা বলিলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা তো তখন তথায় ছিলাম না, আমরা দেখিও নাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলিলেনঃ তাহা হইলে ইহুদীরা পঞ্চাশ কসম করিয়া নির্দোষ হইয়া যাইবে। তাহারা বলিলঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাহারা তো কাফির! তাহদের কসম কি করিয়া গ্রহণ করা যাইবে? বুশাইর বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) নিজের পক্ষ হইতে দিয়াত আদায় করিলেন।

মালিক (রাহঃ) বলেনঃ আমাদের নিকট ইহা একটি সর্বস্বীকৃত বিষয়, এ ব্যাপারে অনেক আলিমের নিকটও শ্রবণ করিয়াছে এবং পূর্ব যুগের আর পরবর্তী যুগের ইমামগণও ইহাতে একমত হইয়াছেন যে, কসম লওয়ার ব্যাপারে প্রথমত বাদীপক্ষের নিকট হইতেই কসম লইতে হইবে। বাদিগণই প্রথমত কসম করিবে (যদি তাহারা কসম না করে তবে বিবাদী হইতে কসম লইতে হইবে। যদি তাহারা কসম করে, তবে তাহারা নির্দোষ সাব্যস্ত হইবে)।

নিম্নোক্ত দুইটি কারণের যে কোন একটির জন্যই কসম লওয়া অনিবার্য হয়। প্রথমত মৃত্যুর পূর্বে নিহত ব্যক্তি নিজেই বলিবে, যদি তাহার পক্ষে বলা সম্ভব হয় : আমাকে অমুক ব্যক্তি হত্যা করিয়াছে, ইহা তখনই যখন কোন সাক্ষী না থাকে। দ্বিতীয়ত, নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ যখন কাহারও উপর হত্যার সন্দেহ করে (অথচ কোন সাক্ষী পাওয়া না যায়)। আমাদের নিকট এই দুইটি কারণেই কসম লওয়া অনিবার্য হয়। এতদ্ব্যতীত অন্য কোন কারণে কসম লওয়া অনিবার্য হয় না।

মালিক (রাহঃ) বলেনঃ আমাদের নিকট এই সুন্নত সর্বসম্মত এবং ইহার উপর সর্বসাধারণের আমলও রহিয়াছে যে, প্রথমে বাদী পক্ষ হইতেই কসম লইতে হইবে। সেই হত্যা ইচ্ছাকৃত হত্যাই হউক অথবা অনিচ্ছাকৃত হত্যাই হউক।

মালিক (রাহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বনী হারিসের কোন আত্মীয় খায়বরে মারা যাওয়ার পর প্রথমত বনী হারিসকেই কসম করিতে বলিয়াছিলেন।

মালিক (রাহঃ) বলেন, যদি বাদীপক্ষ কসম করে, তবে তাহারা যাহাদের ব্যাপারে কসম করিয়াছে তাহাদিগকে হত্যা করিতে পারবে। কিন্তু এমতাবস্থায় প্রথমে বাদী পক্ষ হইতে পঞ্চাশ কসম লওয়া হইবে। যদি তাহারা পঞ্চাশজন হয় তবে প্রত্যেকে একটি কসম করিবে। আর যাদি তাহারা সংখ্যায় পঞ্চাশ জনের কম হয় অথবা তাহাদের কেহ কসম করিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে, তবে তাহাদের হইতে দুই দুইবার অথবা তিন তিনবার কসম লইয়া পঞ্চাশ পূর্ণ করিতে হইবে। কিন্তু যখন নিহত ব্যক্তির এমন ওয়ারিসগণ যাহাদের হত্যাকারীকে ক্ষমা করার অধিকার আছে, তাহাদের একজনও যদি কসম করিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে তবে এই একজনের কসম করিতে অনিচ্ছা প্রকাশের ফলে কিসাস আর অনিবার্য হইবে না।

মালিক (রাহঃ) বলেন, নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ যাহাদের ক্ষমা করিবার অধিকার নাই এমন ব্যক্তিদের কেহ কসম করিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেও অবশিষ্ট ব্যক্তিদের হইতে কসম লওয়া হইবে।

মালিক (রাহঃ) বলেন, যাহাদের ক্ষমা করিবার অধিকার রহিয়াছে এমন ওয়ারিসদের একজনও যদি কসম করিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তবে অবশিষ্ট ব্যক্তিদের হইতে আর কসম লওয়া হইবে না, বরং এমতাবস্থায় বিবাদীগণ হইতে কসম লইতে হইবে, বিবাদীদের পঞ্চাশজন পঞ্চাশ কসম করিবে। যদি তাহাদের সংখ্যা পঞ্চাশজন হইতে কম হয়, তবে দুই দুইবার, তিন তিন বার করিয়া হইলেও পঞ্চাশ পূর্ণ করিতে হইবে। যদি বিবাদী মাত্র একজন হয়, তবে এই একজন হইতেই পঞ্চাশ কসম লইতে হইবে। যদি এই এক ব্যক্তি পঞ্চাশ কসম করিয়া ফেলে, তবে সে নির্দোষ সাব্যস্ত হইবে।

মালিক (রাহঃ) বলেন, হত্যার বেলায় পঞ্চাশ কসম লওয়া হইয়া থাকে আর অন্যান্য দাবি আদায়ের জন্য শুধু এক কসমই লওয়া হয়। কেননা মানুষ কাহাকেও কাহারও সম্মুখে হত্যা করে না। যদি অন্যান্য দাবির মতো হত্যার বেলায়ও মাত্র একটি কসমই লওয়া হইত তাহা হইলে অনেক হত্যাই বৃথা যাইত এবং মানুষ হত্যার উৎসাহ পাইত। কিন্তু হত্যার কসমের বেলায় প্রথমত বাদী পক্ষ হইতেই কসম লওয়ার প্রথা নির্ধারিত হইয়াছে যেন মানুষ হত্যা করিতে সাহস না করে এবং এই ভাবিয়া ভীত থাকে যে, এ ব্যাপারে তো নিহত ব্যক্তির কথাই ধর্তব্য।

মালিক (রাহঃ) বলেন, যদি কোন একটি পূর্ণ সম্প্রদায়ের উপর হত্যার অভিযোগ আনা হয় যাহাতে অনেক লোক রহিয়াছে, আর নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ তাহাদের নিকট হইতে কসম লইতে ইচ্ছা করে, তাহা হইলে ঐ সমস্ত লোকের প্রত্যেক ব্যক্তি পঞ্চাশটি করিয়া কসম করিবে। সকলে মিলিয়া পঞ্চাশটি কসম করিলে চলিবে না। এ ব্যাপারে আমি ইহাই উত্তম শ্রবণ করিয়াছি।

মালিক (রাহঃ) বলেন, নিহত ব্যক্তির আসাবা যাহারা এই হত্যার হকদার তাহাদেরকেই কসম দেওয়া থাকে আর তাহাদের কসম করার পরই কিসাস লওয়া হয়।

(ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ)-এর মতে কসমের দ্বারা কিসাস সাব্যস্ত হয় না, শুধু দিয়াত (রক্তপণ) সাব্যস্ত হইয়া থাকে)।
باب تَبْدِئَةِ أَهْلِ الدَّمِ فِي الْقَسَامَةِ
قَالَ يَحْيَى عَنْ مَالِك عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ عَنْ بُشَيْرِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ سَهْلٍ الْأَنْصَارِيَّ وَمُحَيِّصَةَ بْنَ مَسْعُودٍ خَرَجَا إِلَى خَيْبَرَ فَتَفَرَّقَا فِي حَوَائِجِهِمَا فَقُتِلَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَهْلٍ فَقَدِمَ مُحَيِّصَةُ فَأَتَى هُوَ وَأَخُوهُ حُوَيِّصَةُ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ سَهْلٍ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَهَبَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ لِيَتَكَلَّمَ لِمَكَانِهِ مِنْ أَخِيهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَبِّرْ كَبِّرْ فَتَكَلَّمَ حُوَيِّصَةُ وَمُحَيِّصَةُ فَذَكَرَا شَأْنَ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَهْلٍ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَتَحْلِفُونَ خَمْسِينَ يَمِينًا وَتَسْتَحِقُّونَ دَمَ صَاحِبِكُمْ أَوْ قَاتِلِكُمْ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ نَشْهَدْ وَلَمْ نَحْضُرْ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتُبْرِئُكُمْ يَهُودُ بِخَمْسِينَ يَمِينًا فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ نَقْبَلُ أَيْمَانَ قَوْمٍ كُفَّارٍ قَالَ يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ فَزَعَمَ بُشَيْرُ بْنُ يَسَارٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدَاهُ مِنْ عِنْدِهِ
قَالَ مَالِك الْأَمْرُ الْمُجْتَمَعُ عَلَيْهِ عِنْدَنَا وَالَّذِي سَمِعْتُ مِمَّنْ أَرْضَى فِي الْقَسَامَةِ وَالَّذِي اجْتَمَعَتْ عَلَيْهِ الْأَئِمَّةُ فِي الْقَدِيمِ وَالْحَدِيثِ أَنْ يَبْدَأَ بِالْأَيْمَانِ الْمُدَّعُونَ فِي الْقَسَامَةِ فَيَحْلِفُونَ وَأَنَّ الْقَسَامَةَ لَا تَجِبُ إِلَّا بِأَحَدِ أَمْرَيْنِ إِمَّا أَنْ يَقُولَ الْمَقْتُولُ دَمِي عِنْدَ فُلَانٍ أَوْ يَأْتِيَ وُلَاةُ الدَّمِ بِلَوْثٍ مِنْ بَيِّنَةٍ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ قَاطِعَةً عَلَى الَّذِي يُدَّعَى عَلَيْهِ الدَّمُ فَهَذَا يُوجِبُ الْقَسَامَةَ لِلْمُدَّعِينَ الدَّمَ عَلَى مَنْ ادَّعَوْهُ عَلَيْهِ وَلَا تَجِبُ الْقَسَامَةُ عِنْدَنَا إِلَّا بِأَحَدِ هَذَيْنِ الْوَجْهَيْنِ قَالَ مَالِك وَتِلْكَ السُّنَّةُ الَّتِي لَا اخْتِلَافَ فِيهَا عِنْدَنَا وَالَّذِي لَمْ يَزَلْ عَلَيْهِ عَمَلُ النَّاسِ أَنَّ الْمُبَدَّئِينَ بِالْقَسَامَةِ أَهْلُ الدَّمِ وَالَّذِينَ يَدَّعُونَهُ فِي الْعَمْدِ وَالْخَطَإِ قَالَ مَالِك وَقَدْ بَدَّأَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْحَارِثِيِّينَ فِي قَتْلِ صَاحِبِهِمْ الَّذِي قُتِلَ بِخَيْبَرَ قَالَ مَالِك فَإِنْ حَلَفَ الْمُدَّعُونَ اسْتَحَقُّوا دَمَ صَاحِبِهِمْ وَقَتَلُوا مَنْ حَلَفُوا عَلَيْهِ وَلَا يُقْتَلُ فِي الْقَسَامَةِ إِلَّا وَاحِدٌ لَا يُقْتَلُ فِيهَا اثْنَانِ يَحْلِفُ مِنْ وُلَاةِ الدَّمِ خَمْسُونَ رَجُلًا خَمْسِينَ يَمِينًا فَإِنْ قَلَّ عَدَدُهُمْ أَوْ نَكَلَ بَعْضُهُمْ رُدَّتْ الْأَيْمَانُ عَلَيْهِمْ إِلَّا أَنْ يَنْكُلَ أَحَدٌ مِنْ وُلَاةِ الْمَقْتُولِ وُلَاةِ الدَّمِ الَّذِينَ يَجُوزُ لَهُمْ الْعَفْوُ عَنْهُ فَإِنْ نَكَلَ أَحَدٌ مِنْ أُولَئِكَ فَلَا سَبِيلَ إِلَى الدَّمِ إِذَا نَكَلَ أَحَدٌ مِنْهُمْ قَالَ يَحْيَى قَالَ مَالِك وَإِنَّمَا تُرَدُّ الْأَيْمَانُ عَلَى مَنْ بَقِيَ مِنْهُمْ إِذَا نَكَلَ أَحَدٌ مِمَّنْ لَا يَجُوزُ لَهُ عَفْوٌ فَإِنْ نَكَلَ أَحَدٌ مِنْ وُلَاةِ الدَّمِ الَّذِينَ يَجُوزُ لَهُمْ الْعَفْوُ عَنْ الدَّمِ وَإِنْ كَانَ وَاحِدًا فَإِنَّ الْأَيْمَانَ لَا تُرَدُّ عَلَى مَنْ بَقِيَ مِنْ وُلَاةِ الدَّمِ إِذَا نَكَلَ أَحَدٌ مِنْهُمْ عَنْ الْأَيْمَانِ وَلَكِنْ الْأَيْمَانُ إِذَا كَانَ ذَلِكَ تُرَدُّ عَلَى الْمُدَّعَى عَلَيْهِمْ فَيَحْلِفُ مِنْهُمْ خَمْسُونَ رَجُلًا خَمْسِينَ يَمِينًا فَإِنْ لَمْ يَبْلُغُوا خَمْسِينَ رَجُلًا رُدَّتْ الْأَيْمَانُ عَلَى مَنْ حَلَفَ مِنْهُمْ فَإِنْ لَمْ يُوجَدْ أَحَدٌ يَحْلِفُ إِلَّا الَّذِي ادُّعِيَ عَلَيْهِ حَلَفَ هُوَ خَمْسِينَ يَمِينًا وَبَرِئَ قَالَ يَحْيَى قَالَ مَالِك وَإِنَّمَا فُرِقَ بَيْنَ الْقَسَامَةِ فِي الدَّمِ وَالْأَيْمَانِ فِي الْحُقُوقِ أَنَّ الرَّجُلَ إِذَا دَايَنَ الرَّجُلَ اسْتَثْبَتَ عَلَيْهِ فِي حَقِّهِ وَأَنَّ الرَّجُلَ إِذَا أَرَادَ قَتْلَ الرَّجُلِ لَمْ يَقْتُلْهُ فِي جَمَاعَةٍ مِنْ النَّاسِ وَإِنَّمَا يَلْتَمِسُ الْخَلْوَةَ قَالَ فَلَوْ لَمْ تَكُنِ الْقَسَامَةُ إِلَّا فِيمَا تَثْبُتُ فِيهِ الْبَيِّنَةُ وَلَوْ عُمِلَ فِيهَا كَمَا يُعْمَلُ فِي الْحُقُوقِ هَلَكَتْ الدِّمَاءُ وَاجْتَرَأَ النَّاسُ عَلَيْهَا إِذَا عَرَفُوا الْقَضَاءَ فِيهَا وَلَكِنْ إِنَّمَا جُعِلَتْ الْقَسَامَةُ إِلَى وُلَاةِ الْمَقْتُولِ يُبَدَّءُونَ بِهَا فِيهَا لِيَكُفَّ النَّاسُ عَنْ الدَّمِ وَلِيَحْذَرَ الْقَاتِلُ أَنْ يُؤْخَذَ فِي مِثْلِ ذَلِكَ بِقَوْلِ الْمَقْتُولِ قَالَ يَحْيَى وَقَدْ قَالَ مَالِك فِي الْقَوْمِ يَكُونُ لَهُمْ الْعَدَدُ يُتَّهَمُونَ بِالدَّمِ فَيَرُدُّ وُلَاةُ الْمَقْتُولِ الْأَيْمَانَ عَلَيْهِمْ وَهُمْ نَفَرٌ لَهُمْ عَدَدٌ أَنَّهُ يَحْلِفُ كُلُّ إِنْسَانٍ مِنْهُمْ عَنْ نَفْسِهِ خَمْسِينَ يَمِينًا وَلَا تُقْطَعُ الْأَيْمَانُ عَلَيْهِمْ بِقَدْرِ عَدَدِهِمْ وَلَا يَبْرَءُونَ دُونَ أَنْ يَحْلِفَ كُلُّ إِنْسَانٍ عَنْ نَفْسِهِ خَمْسِينَ يَمِينًا قَالَ مَالِك وَهَذَا أَحْسَنُ مَا سَمِعْتُ فِي ذَلِكَ قَالَ وَالْقَسَامَةُ تَصِيرُ إِلَى عَصَبَةِ الْمَقْتُولِ وَهُمْ وُلَاةُ الدَّمِ الَّذِينَ يَقْسِمُونَ عَلَيْهِ وَالَّذِينَ يُقْتَلُ بِقَسَامَتِهِمْ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এটি খায়বার যুদ্ধপরবর্তী একটি ঘটনা। বিভিন্ন হাদীসে ঘটনাটি সংক্ষেপে/ বিস্তারিত বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় সামান্য গরমিলও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কিছুটা ব্যাখ্যা সহকারে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলো।

এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৭ম সালে। এখানকার অধিবাসীগণ ছিল ইহুদী। যুদ্ধে ইহুদীদের পরাজয় হয়। এখানকার সমস্ত দুর্গ ও জমি-জায়েদাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারে চলে আসে। তিনি চাইলে সমস্ত ইহুদীকে এখান থেকে বিতাড়িত করতে পারতেন। তা না করে তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। তাদেরকে এ শর্তে এখানে থাকার অনুমতি দেন যে, তারা মুসলিমদের পক্ষে চাষাবাদের কাজ করবে। তাতে যে ফল ও ফসল উৎপন্ন হবে তার অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে। এভাবে বর্গাচাষের চুক্তিতে তারা এখানে অবস্থানের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করাই যাদের স্বভাব, তাদের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষার আশা কিভাবে করা যায়? গোপনে তারা একের পর এক দুষ্কৃতি করে যেতে থাকে। ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে তাদের দুষ্কৃতির নানা ঘটনা বর্ণিত আছে। এ হাদীছেও সেরকম একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

ইহুদী এলাকায় একজন মুসলিম হত্যার ঘটনা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি. ও মুহায়্যিসা ইবন মাস'উদ রাযি. খেজুর কেনার উদ্দেশ্যে খায়বার গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তারা দু'জন খেজুরের সন্ধানে দুই দিকে চলে যান। পরে মুহায়্যিসা রাযি. সংবাদ পান যে, কে বা কারা আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি ছুটে আসেন। এসে দেখতে পান ঠিকই আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করা হয়েছে। তিনি রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছেন। সেখানকার ইহুদীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কেউ তাঁকে হত্যা করার কথা স্বীকার করল না। অগত্যা তিনি সেখানে তাঁর দাফন-কাফন সম্পন্ন করে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসলেন।

তারপর আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি.-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. এবং মাস'উদের পুত্রদ্বয় মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. — এ তিনজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তিনজনই একই গোত্রের লোক। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা অর্থাৎ মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. ছিলেন আব্দুর রহমান রাযি.-এর পিতা সাহলের চাচাতো ভাই।

এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. ছিলেন বয়সে সকলের ছোট। তিনি যেহেতু নিহতের ভাই, তাই বিচার প্রার্থনার জন্য সবার আগে তিনি কথা বলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাঁকে ক্ষান্ত করে দিলেন যে, বড়দের কথা বলতে দাও। সুতরাং তিনি ক্ষান্ত হয়ে গেলেন এবং অপর দু'জন কথা বললেন। বিভিন্ন বর্ণনা সামনে রাখলে বোঝা যায় মৌলিকভাবে কথা বলেছিলেন হুওয়ায়্যিসা রাযি। তিনি বয়সে সকলের বড় ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় যে দু'জনই কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ হিসেবে যে, সম্ভবত হুওয়ায়্যিসা রাযি. -এর কথা বলার মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মুহায়্যিসা রাযি.-ও দু’-একটি কথা বলেছিলেন।

প্রকাশ থাকে যে, এ ঘটনায় হুওয়ায়্যিসা রাযি. উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন মুহায়্যিসা রাযি.। তবে মামলার মূল বাদী ছিলেন নিহতের ভাই আব্দুর রহমান রাযি। একই খান্দানের হওয়ায় আব্দুর রহমান রাযি.-এর সহযোগী হিসেবে অপর দু'জন উপস্থিত হয়েছিলেন। তাছাড়া মুহায়্যিসা রাযি. তো আব্দুল্লাহ রাযি.-এর সফরসঙ্গীই ছিলেন এবং দাফন-কাফনের কাজও তিনিই সম্পন্ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়োজ্যেষ্ঠ হুওয়ায়্যিসা রাযি.-কে যে কথা বলতে বলেছিলেন তা মূলত বাদী হিসেবে নয়; বরং কেবলই তাঁর শোনা কথার বর্ণনাদাতা হিসেবে। অর্থাৎ তিনি মুহায়্যিসা রাযি.-এর নিকট যা-কিছু শুনেছেন হুবহু তা বর্ণনা করতে বলেছেন। যখন দাবির পর্যায় আসে, তখন আব্দুর রহমান রাযি.-কেই কথা বলতে বলা হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে, আব্দুর রহমান রাযি. তাঁদের দু'জনকে নিজের পক্ষ থেকে ওকিল বানিয়ে দিয়েছিলেন।

যাহোক মামলার পূর্ণ বিবরণ সামনে আসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কসম করবে এবং তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণের অধিকার লাভ করবে?

বিভিন্ন বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। সে অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদীপক্ষকে বলেছিলেন— তোমাদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণ গ্রহণের অধিকার পেতে পার। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কিভাবে হতে পারে? আমরা তো নিজ চোখে তা দেখিনি, সুতরাং কিভাবে কসম করব? তখন তিনি বললেন, তাহলে ইহুদীদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করুক। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা তো একটি কাফের সম্প্রদায়। অর্থাৎ তারা মিথ্যা কসম করতে দ্বিধাবোধ করবে না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করে দিলেন। তার পরিমাণ ছিল ১০০ উট। পরিভাষায় এ রক্তপণকে দিয়াত বলা হয়।

লক্ষণীয়, এ মামলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে ফয়সালা দান করেননি। নিহত ব্যক্তি একজন মুসলিম ও সাহাবী। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ইহুদীদের এলাকায়। স্পষ্ট কথা সন্দেহের তির তাদের দিকেই যায়। তাদেরকে চাপে ফেলার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। দিয়াতের ১০০টি উট সম্মিলিতভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দিলেন। তিনি দিয়াতের উট নিজের পক্ষ থেকে পরিশোধ করলেন। বাদীপক্ষও বঞ্চিত হলো না এবং বিবাদীরাও হয়রানির শিকার হলো না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

হাদীছটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা নিম্নরূপ :

ক. বয়সে যে বড় তাকে সম্মান দেখানো চাই। তার একটা দিক এইও যে, কথা বলার সময় বড়কে আগে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।

খ. চাচাতো ভাই বা চাচাতো ভাতিজা কোনও বিপদের সম্মুখীন হলে 'চাচাতো' বলে পাশ কাটাতে নেই; বরং তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া চাই।

গ. সফরসঙ্গীর একটা হক হলো তার মসিবতে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করা। সফরসঙ্গী মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঘ. বিচারকের উচিত বিচারকার্যে পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দেওয়া এবং উভয়পক্ষের উপর মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুওয়াত্তা মালিক - হাদীস নং ১৬২৮ | মুসলিম বাংলা