আল মুওয়াত্তা - ইমাম মালিক রহঃ

২০. হজ্ব - উমরার অধ্যায়

হাদীস নং: ৯০৩
৬৮. আইয়্যামে তাশরীকের তাকবীর
রেওয়ায়ত ২০৮. ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (রাহঃ) জ্ঞাত হইয়াছেন- উমর ইবনে খাত্তাব (রাযিঃ) ১০ তারিখ একটু বেলা হইয়া আসিলে তাকবীর পড়া শুরু করেন। তাহার সঙ্গিগণও তাকবীর বলিতে শুরু করেন। পরের দিন তিনি একটু বেলা হইয়া আসিলে তাকবীর পড়া শুরু করেন এবং সঙ্গিগণও তখন পড়া শুরু করেন। তৃতীয় দিন সূর্য হেলিয়া যাওয়ার পর তিনি তাকবীর বলিলেন। সঙ্গিগণও তখন তাকবীর বলিলেন। সমস্বরে তাকবীর বলার এই আওয়ায মক্কা পর্যন্ত গিয়া পৌছায়। অন্যান্য মানুষ তখন বুঝিতে পারে যে, উমর (রাযিঃ) প্রস্তর নিক্ষেপের (রমীয়ে জামর) জন্য রওয়ানা হইয়া গিয়াছে।

মালিক (রাহঃ) বলেনঃ আমাদের নিকট হুকুম হইল, আইয়্যামে তাশরীকের সময় প্রত্যেক নামাযের পর তাকবীর পড়িতে হইবে। ইমাম প্রথমে তাকবীর বলিবেন, মুক্তাদীগণ তাহার অনুসরণ করবেন। বিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখের যোহর হইতে তাকবীর বলা শুরু করিবে এবং ১৩ তারিখ ফজরের সময় তাহা শেষ করবে। ইমাম-মুক্তাদী সকলেই এই তাকবীর পাঠ করিবে। নারী-পুরুষ সকলের উপরই পাঠ করা ওয়াজিব। জামাতে নামায পড়ুক বা একাকী, মিনায় অবস্থানরত থাকুক বা অন্য কোনখানে, সকল অবস্থায়ই উহা পাঠ করিতে হইবে। ইমামুল-হজ্জ এবং মিনার ময়দানে অবস্থিত হাজীগণের অনুসরণ করিবে অন্যান্য লোক। তাকবীরের বেলায় তাহারা যখন মিনা হইতে প্রত্যাবর্তন করিবে ও ইহরাম ভঙ্গ করিবে, তখন মুহিলদের (ইহরাম অবস্থায় যাহারা নাই) অনুসরণ করিবে যাহাতে তাহাদেরই মত হয় অর্থাৎ মুহরিম ও মুহিল দুই দলের মধ্যে তাকবীর বলার ব্যাপারে পার্থক্য নাই। আর যাহারা হজ্জ সম্পাদনকারী নহে, তাহারা কেবল আইয়্যামে তাশরীকের বেলায় হাজীদের অনুসরণ করবে। মালিক (রাহঃ) বলেনঃ কুরআনে উল্লিখিত আইয়্যামে মা’দুদাত’ হইল আইয়্যামে তাশরীক।*

* মহান আল্লাহ্‌র বাণীঃ (وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ) তোমরা নির্দিষ্টসংখ্যক দিনগুলিতে আল্লাহকে স্মরণ করবে। (বাকারাঃ ২০৩)। মালিক (রহঃ) উক্ত আয়াতে উল্লিখিত আইয়্যামিম মা'দুদাত’-এর তাফসীর করিয়াছেন।
بَاب تَكْبِيرِ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ
922 حَدَّثَنِي يَحْيَى عَنْ مَالِك عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ أَنَّهُ بَلَغَهُ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ خَرَجَ الْغَدَ مِنْ يَوْمِ النَّحْرِ حِينَ ارْتَفَعَ النَّهَارُ شَيْئًا فَكَبَّرَ فَكَبَّرَ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِ ثُمَّ خَرَجَ الثَّانِيَةَ مِنْ يَوْمِهِ ذَلِكَ بَعْدَ ارْتِفَاعِ النَّهَارِ فَكَبَّرَ فَكَبَّرَ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِ ثُمَّ خَرَجَ الثَّالِثَةَ حِينَ زَاغَتْ الشَّمْسُ فَكَبَّرَ فَكَبَّرَ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِ حَتَّى يَتَّصِلَ التَّكْبِيرُ وَيَبْلُغَ الْبَيْتَ فَيُعْلَمَ أَنَّ عُمَرَ قَدْ خَرَجَ يَرْمِي
قَالَ مَالِك الْأَمْرُ عِنْدَنَا أَنَّ التَّكْبِيرَ فِي أَيَّامِ التَّشْرِيقِ دُبُرَ الصَّلَوَاتِ وَأَوَّلُ ذَلِكَ تَكْبِيرُ الْإِمَامِ وَالنَّاسُ مَعَهُ دُبُرَ صَلَاةِ الظُّهْرِ مِنْ يَوْمِ النَّحْرِ وَآخِرُ ذَلِكَ تَكْبِيرُ الْإِمَامِ وَالنَّاسُ مَعَهُ دُبُرَ صَلَاةِ الصُّبْحِ مِنْ آخِرِ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ ثُمَّ يَقْطَعُ التَّكْبِيرَ قَالَ مَالِك وَالتَّكْبِيرُ فِي أَيَّامِ التَّشْرِيقِ عَلَى الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ مَنْ كَانَ فِي جَمَاعَةٍ أَوْ وَحْدَهُ بِمِنًى أَوْ بِالْآفَاقِ كُلُّهَا وَاجِبٌ وَإِنَّمَا يَأْتَمُّ النَّاسُ فِي ذَلِكَ بِإِمَامِ الْحَاجِّ وَبِالنَّاسِ بِمِنًى لِأَنَّهُمْ إِذَا رَجَعُوا وَانْقَضَى الْإِحْرَامُ ائْتَمُّوا بِهِمْ حَتَّى يَكُونُوا مِثْلَهُمْ فِي الْحِلِّ فَأَمَّا مَنْ لَمْ يَكُنْ حَاجًّا فَإِنَّهُ لَا يَأْتَمُّ بِهِمْ إِلَّا فِي تَكْبِيرِ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ قَالَ مَالِك الْأَيَّامُ الْمَعْدُودَاتُ أَيَّامُ التَّشْرِيقِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আইয়ামুত তাশরীকঃ

যিলহজ্ব মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখকে পরিভাষায় আইয়ামে তাশরীক বলে। আইয়ামে তাশরীক-এর অন্যতম প্রধান আমল হল, আল্লাহর যিকির-তাকবীর উচ্চারণ করা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَيّامُ التّشْرِيقِ أَيّامُ أَكْلٍ، وَشُرْبٍ، وَذِكْرِ اللهِ.

আইয়ামে তাশরীক পানাহার ও আল্লাহর যিকিরের দিন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৭২২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৪১

সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে তাকবীর ধ্বনি তুলতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও হযরত আবু হুরাইরা রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের ধ্বনি তুলত।

নয় যিলহজ্ব ফজর থেকে নিয়ে তের যিলহজ্ব আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্তে প্রতি ফরয নামাযের পর সারা বিশ্বের সকল মুসলিম নারী-পুরুষ তাকবীরে তাশরীক বলে থাকে। সকলের জন্য একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব।

কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ اذْكُرُوا اللهَ فِیْۤ اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ.

তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর। -সূরা বাকারা (২) : ২০৩

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এখানে اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ দ্বারা উদ্দেশ্য- আইয়ামে তাশরীক। (দ্র. সহীহ বুখারী, বাবু ফাদলিল আমাল ফী আইয়ামিত তাশরীক; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, হাদীস ১০৮৭২)


তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত কয়েকটি মাসআলাঃ

১। প্রত্যেক মুসল্লীর জন্য যিলহজ্বের নয় তারিখের ফজর হতে তের তারিখের আসর পর্যন- প্রত্যেক ফরয নামায আদায় করে সালাম ফিরানোর সাথে সাথে উচ্চস্বরে একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব।-সূরা বাকারা : ২০৩; মুসতাদরাকে হাকেম ১/২৯৯হাদীস : ১১৫২-১১৫৭; ইবনে আবী শায়বা ৪/১৯৫ হাদীস : ৫৬৭৭, ৫৬৭৮, ৫৬৯২; সুনানে দারাকুতনী ২/৪৯-৫০ হাদীস : ২৫-২৯; ইলাউস সুনান ৮/১৪৮-১৬২, আদ্দুররুল মুখতার ৩/১৭৭-১৭৮

২। তাকবীরে তাশরীক হল-

اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلهِ الْحَمْدُ.

-‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’

অর্থাৎ আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আল্লাহই সবচেয়ে বড় এবং আল্লাহরই জন্য সকল প্রশংসা।

-তাবারানী মুজামে কাবীর হাদীস : ৯৫৩৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ৫৬৭৯, ৫৬৯৬, ৫৬৯৭, ৫৬৯৯; ইলাউস সুনান ৮/১৫৬; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৫৮

৩। ইমাম আবু হানীফার রাহ-এর মতে একাকী নামায আদায়কারী ও মুসাফির ব্যক্তি এবং মহিলাদের উপর তাকবীরে তাশরীক যদিও ওয়াজিব নয়, কিন' সাহেবাইনের মতে তাদের উপরও তাকবীর বলা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে সাহেবাইনের কথার উপরই ফতওয়া।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/২৪০-২৪১, ২৫১; ইলাউস সুনান ৮/১৫৯; রদ্দুল মুহতার ২/১৮০; ইমদাদুল আহকাম ১/৭৬৩-৭৬৫, ৭৭৯-৭৮০

৪। সুন্নত, নফল, বিতর নামাযের পর তাকবীর ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬২; মাবসূত সারাখসী ২/৪৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২

৫। উচ্চস্বরে একবারই তাকবীর বলা ওয়াজিব।-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; রদ্দুর মুহতার ২/১৭৮

৬। কোনো সময় সকলেই বা কেউ কেউ তাকবীর বলতে ভুলে গিয়ে মসজিদ থেকে বের না হয়ে গেলে তাকবীর আদায় করে নিবে। আর যদি মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় তাহলে এই ওয়াজিব ছুটে যাবে। এই ওয়াজিবের কোনো কাযা নেই এবং ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়ার কারণে ঐ ব্যক্তি গুনাহগার হবে।-মাবসূত সারাখসী ২/৪৫; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫০৯-৫১১; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬০-৪৬১; রদ্দুল মুহতার ২/১৮১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২১৬

৭। আইয়ামে তাশরীকের কোনো নামায কাযা হয়ে গেলে ঐ দিনগুলোর মধ্যে তার কাযা আদায় করলে তাকবীর বলা ওয়াজিব। কিন' এই কাযা পরবর্তী অন্য সময় আদায় করলে বা আইয়ামে তাশরীকের আগের কাযা নামায ঐ দিনগুলোতে আদায় করলে তাকবীর বলা ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫১১-৫১৩

৮। ঈদুল আযহায় ঈদগাহে পৌঁছার আগ পর্যন্ত পথে পথে উচ্চস্বরে তাকবীর বলে বলে যাবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/১৯২-১৯৪; দারাকুতনী ২/৪৪-৪৫; ইলাউস সুনান ৮/১১৪-১১৯; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬২৫; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫১৩; ফাতাওয়া খানিয়া ১/১৮৩

৯। কোনো ব্যক্তি নামাযে মাসবুক হলে ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর পর দাঁড়িয়ে স্বীয় নামায আদায় করার পর তাকবীরে তাশরীক বলবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/২৩৯-২৪০; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬২; রদ্দুল মুহতার ২/১৮০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২

১০। মহিলারা এই তাকবীরে তাশরীকটি নিচু স্বরে আদায় করবে। উচ্চ স্বরে নয়।-রদ্দুল মুহতার ২/১৭৯; হাশিয়া তাহতাবী ১/৩৫৭; হিন্দিয়া ১/১৫২
মুওয়াত্তা মালিক - হাদীস নং ৯০৩ | মুসলিম বাংলা