আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫১- কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং: ৪২০৭
আন্তর্জাতিক নং: ৪৫৬৩
২৩১৯. আল্লাহর বাণীঃ যখম হওয়ার পরও যারা আল্লাহ ও রাসুলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সৎকার্য করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে (৩ঃ ১৭২) القرح যখম।استجابوا ডাকে সাড়া দিল। يستجيب সাড়া দেয়।

পরিচ্ছেদঃ ২৩২০. আল্লাহর বাণীঃ তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে (৩ঃ ১৭৩)
৪২০৭। আহমদ ইবনে ইউনুস (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ বাক্যটি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) বলেছিলেন, যখন তিনি অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। আর মুহাম্মাদ (সা:) বলেছিলেন যখন লোকেরা বলল, ‘‘তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে, সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় কর কিন্তু এটি তাদের ঈমান দৃঢ়তর করেছিল এবং তারা বলেছিল ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক’’ (৩: ১৭৩)
باب قوله: {الذين استجابوا لله والرسول من بعد ما أصابهم القرح للذين أحسنوا منهم واتقوا أجر عظيم} [آل عمران: 172] {القرح} [آل عمران: 172] : «الجراح» ، {استجابوا} [آل عمران: 172] : «أجابوا» ، {يستجيب} [الأنعام: 36] : «يجيب»

باب إن الناس قد جمعوا لكم فاخشوهم الآية
4563 - حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ، أُرَاهُ قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرٍ، عَنْ أَبِي حَصِينٍ، عَنْ أَبِي الضُّحَى، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الوَكِيلُ، «قَالَهَا إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ حِينَ أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَقَالَهَا مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» حِينَ قَالُوا: {إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا، وَقَالُوا: حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الوَكِيلُ} [آل عمران: 173]

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলার একজন শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। তাঁর কওম মূর্তিপূজা করত। তাঁর নিজের পরিবারবর্গও মূর্তিপূজারী ছিল। মূর্তিপূজায় তাঁর পিতা আযরের বিশ্বাস ছিল অতি গভীর। সেকালের রাজাও মূর্তিপূজার পৃষ্ঠপোষক ছিল। রাজাকে বলা হত নমরূদ । হযরত ইবরাহীম আ. নবুওয়াত লাভের পর নিজ ঘর থেকেই দা'ওয়াতী কাজের সূচনা করেন। তিনি পিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, মূর্তিপূজা এক অসার কাজ। আল্লাহ এক। তাঁর কোনও শরীক নেই। তিনি এ বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সকলের জীবিকাদাতা ও সকলের রক্ষক। তিনি ছাড়া আর কারও কোনও শক্তি নেই উপকার বা ক্ষতি করার। কাজেই ইবাদত-উপসনার উপযুক্ত কেবল তিনিই। এতে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা কঠিন পাপ। আপনি এ পাপকাজ পরিত্যাগ করুন। নয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু তাঁর পিতা তাঁর দাওয়াতে কর্ণপাত করেনি। উল্টো তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا (41) إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَاأَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا (42) يَاأَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا (43) يَاأَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيًّا (44) يَاأَبَتِ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيًّا (45) قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِي يَاإِبْرَاهِيمُ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا (46)

অর্থ : এ কিতাবে ইবরাহীমের বৃত্তান্তও বিবৃত কর। নিশ্চয়ই সে ছিল সত্যনিষ্ঠ নবী। স্মরণ কর, যখন সে নিজ পিতাকে বলেছিল, আব্বাজী ! আপনি এমন জিনিসের ইবাদত কেন করেন, যা কিছু শোনে না, দেখে না এবং আপনার কোনও কাজও করতে পারে না? আব্বাজী। আমার নিকট এমন এক জ্ঞান এসেছে যা আপনার কাছে আসেনি। কাজেই আপনি আমার কথা শুনুন, আমি আপনাকে সরল পথ বাতলে দেব। আব্বাজী! শয়তানের ইবাদত করবেন না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য। আব্বাজী! আমার আশঙ্কা- দয়াময়ের পক্ষ হতে কোনও শাস্তি আপনাকে স্পর্শ করবে। ফলে আপনি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবেন। তার পিতা বলল, ইবরাহীম। তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? তুমি যদি এর থেকে নিবৃত্ত না হও, তবে আমি অবশ্যই তোমার উপর পাথর নিক্ষেপ করব। আর এখন তুমি চিরদিনের জন্য আমার থেকে দূর হয়ে যাও।' সূরা মারয়াম, আয়াত ৪১-৪৬
তারপর তিনি নিজ কওমকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন। তাদের সামনে দেব ও দেবীর অক্ষমতা তুলে ধরলেন এবং আল্লাহ তা'আলাই যে সর্বশক্তিমান ও ইবাদতের একমাত্র উপযুক্ত সত্তা, তার ব্যাখ্যা দিলেন। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে তাঁর সে দাওয়াতের কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا تَعْبُدُونَ (70) قَالُوا نَعْبُدُ أَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِينَ (71) قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُونَ (72) أَوْ يَنْفَعُونَكُمْ أَوْ يَضُرُّونَ (73) قَالُوا بَلْ وَجَدْنَا آبَاءَنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُونَ (74) قَالَ أَفَرَأَيْتُمْ مَا كُنْتُمْ تَعْبُدُونَ (75) أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُونَ (76) فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِي إِلَّا رَبَّ الْعَالَمِينَ (77) الَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهْدِينِ (78) وَالَّذِي هُوَ يُطْعِمُنِي وَيَسْقِينِ (79) وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ (80) وَالَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحْيِينِ (81)

অর্থ : যখন সে তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কিসের ইবাদত কর? তারা বলল, আমরা প্রতিমাদের ইবাদত করি এবং তাদেরই সামনে ধরনা দিয়ে থাকি । ইবরাহীম বলল, তোমরা যখন তাদেরকে ডাক, তখন তারা কি তোমাদের কথা শোনে? কিংবা তারা কি তোমাদের কোনও উপকার বা ক্ষতি করতে পারে? তারা বলল, আসল কথা হল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এমনই করতে দেখেছি। ইবরাহীম বলল, তোমরা কি কখনও গভীরভাবে লক্ষ করে দেখছ তোমরা কিসের ইবাদত করছ? তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী বাপ-দাদাগণ? এরা সব আমার শত্রু; এক রাব্বুল আলামীন। ছাড়া। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনিই আমার পথপ্রদর্শন করেন। এবং আমাকে খাওয়ান ও পান করান। এবং আমি যখন পীড়িত হই, তিনিই আমাকে শিফা দান করেন। এবং যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, ফের আমাকে জীবিত করবেন। সূরা শু'আরা, আয়াত ৭০-৮১
কিন্তু তারাও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল। তাঁর কোনও কথাই শুনতে রাজি হল না। তারা যেন তাদের মিথ্যা উপাস্যদের মত অন্ধ, বধির ও বোবা হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি তাদের চোখ খুলে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি আঘাত করলেন তাদের উপাস্যদের উপর। কুঠারের আঘাতে তাদেরকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলেন। কুরআন মাজীদে তা নিম্নরূপ বর্ণিত হয়েছে-

فَجَعَلَهُمْ جُذَاذًا إِلَّا كَبِيرًا لَهُمْ لَعَلَّهُمْ إِلَيْهِ يَرْجِعُونَ (58) قَالُوا مَنْ فَعَلَ هَذَا بِآلِهَتِنَا إِنَّهُ لَمِنَ الظَّالِمِينَ (59) قَالُوا سَمِعْنَا فَتًى يَذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهُ إِبْرَاهِيمُ (60) قَالُوا فَأْتُوا بِهِ عَلَى أَعْيُنِ النَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَشْهَدُونَ (61) قَالُوا أَأَنْتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآلِهَتِنَا يَاإِبْرَاهِيمُ (62) قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ (63) فَرَجَعُوا إِلَى أَنْفُسِهِمْ فَقَالُوا إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّالِمُونَ (64) ثُمَّ نُكِسُوا عَلَى رُءُوسِهِمْ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلَاءِ يَنْطِقُونَ (65) قَالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَلَا يَضُرُّكُمْ (66) أُفٍّ لَكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (67)

অর্থ : সুতরাং (ইবরাহীম) সবগুলো মূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলল তাদের প্রধানটি ছাড়া, যাতে তারা তার কাছে রুজু করতে পারে। তারা বলল, আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ আচরণ কে করল? নিশ্চয়ই সে ঘোর জালেম। কিছু লোক বলল, আমরা এক যুবককে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি। তাকে ‘ইবরাহীম' বলা হয়। তারা বলল, তবে তাকে জনসমক্ষে হাজির কর, যাতে সকলে সাক্ষী হয়ে যায়। (তারপর যখন ইবরাহীমকে নিয়ে আসা হল, তখন) তারা বলল হে ইবরাহীম! আমাদের উপাস্যদের সাথে এটা কি তুমিই করেছ? ইবরাহীম বলল, বরং এটা করেছে তাদের এই বড়টি। এই প্রতিমাদেরকেই জিজ্ঞেস কর না, যদি তারা কথা বলতে পারে। এ কথায় তারা আপন মনে চিন্তা করতে লাগল এবং (স্বগতভাবে) বলতে লাগল, প্রকৃতপক্ষে তোমরা নিজেরাই জালেম। অতঃপর তারা তাদের মাথা নুইয়ে দিল এবং বলল, তুমি তো জানই তারা কথা বলতে পারে না। সে বলল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসনা করছ, যা তোমাদের কিছু উপকারও করতে পারে না এবং তোমাদের ক্ষতিও করতে পারে না? আফসোস তোমাদের প্রতি এবং আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ইবাদত করছ তাদেরও প্রতি! তোমাদের কি এতটুকু বোধও নেই? সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৫৮-৬৭
দএরূপ চাক্ষুষ ও অকাট্য প্রমাণেও তাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলল না; উল্টো মূর্তিপূজার প্রতি অন্যায় পক্ষপাতে তারা জেদী হয়ে উঠল। সারাদেশ তাঁর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে গেল। তারা তাঁকে কঠিন শাস্তি দিতে চাইল। সে লক্ষ্যে তারা ব্যাপারটা রাজার কানে পৌঁছাল। রাজা ছিল ঘোর কাফের। আল্লাহর 'ইবাদত করবে কি, সে নিজেকেই মা'বূদ মনে করত। প্রজাদেরকে নিজের পূজারী বানিয়ে রেখেছিল। কাজেই যখন শুনল ইবরাহীম তাকে মা'বূদ মানে না, দেব ও দেবীকেও না, সকলকে ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষকে ডাকছে, তখন সেও ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সত্বর ইবরাহীম আ.- কে দরবারে ডেকে পাঠাল। আল্লাহর নির্ভীক পয়গম্বর তাকেও তাওহীদের দাওয়াত দিলেন। নমরূদ তাঁর সাথে তর্কে অবতীর্ণ হল। কিন্তু তাঁর অকাট্য দলীল-প্রমাণের সামনে নমরূদের সব যুক্তিতর্ক অসার সাব্যস্ত হল। কুরআন মাজীদে তার কিছুটা বিবরণ দেওয়া হয়েছে এরকম-

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (258)

অর্থ : তুমি কি লক্ষ করনি তার প্রতি, যে ইবরাহীমের সাথে তাঁর প্রতিপালক সম্পর্কে এ কারণে তর্কে লিপ্ত হয়েছিল যে, আল্লাহ তাকে রাজত্ব দান করেছিলেন। যখন ইবরাহীম বলেছিল আমার প্রতিপালক তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান! তখন সে বলতে লাগল, আমিও জীবন দেই এবং মৃত্যু ঘটাই! ইবরাহীম বলল, আচ্ছা! তাহলে আল্লাহ তো সূর্যকে পূর্ব থেকে উদিত করেন, তুমি তা পশ্চিম থেকে উদিত কর তো! এ কথায় সে কাফির নিরুত্তর হয়ে গেল। আর আল্লাহ (এরূপ) জালিমদেরকে হিদায়াত করেন না। সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৮
উদ্যত হঠকারী রাজা যখন এক নিঃসঙ্গ পয়গম্বরের সাথে তর্কে হেরে গেল, তখন ক্রোধে অপমানবোধে দিশাহারা হয়ে পড়ল। যুক্তিতে হেরে গিয়ে সে পাশবশক্তিতে জয়ী হতে চাইল। পারিষদবর্গের কাছে পরামর্শ চাইল তাঁকে কী শাস্তি দেওয়া যায়। তারা রায় জানাল তাঁকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হোক। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قَالُوا حَرِّقُوهُ وَانْصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ (68)

অর্থ : তারা (একে অন্যকে) বলতে লাগল, তোমরা তাকে আগুনে জ্বালিয়ে দাও এবং নিজেদের দেবতাদেরকে সাহায্য কর, যদি তোমাদের কিছু করার থাকে। সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৬৮
সেমতে একটি অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হল। একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত তাতে আগুন জ্বলতে থাকল। যখন সে আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করল, তার জ্বলন্ত শিখায় চারদিক উত্তপ্ত হয়ে উঠল, তখন হযরত ইবরাহীম আ. কে তাতে নিক্ষেপ করা হল।
কার ধারণা ছিল এই ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডের ভেতর তিনি প্রাণে বেঁচে যাবেন এবং সম্পূর্ণ অক্ষত থাকবেন? কিন্তু সকল ভাবনা-ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হল। তিনি জ্বলন্ত আগুনের ভেতর সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকলেন। তা কিভাবে সম্ভব হল? সম্ভব হয়েছে এভাবে যে, হায়াত ও মওতের মালিক হিসেবে যে আল্লাহর একত্ব সম্পর্কে তিনি নমরূদ ও তার জাতির সামনে প্রমাণ পেশ করেছিলেন, নিজেকে সেই সর্বশক্তিমানের হাতে সমর্পণ করলেন। তাঁর নিজের ও আগুনের স্রষ্টার কাছে নিজেকে ছেড়ে দিলেন। কোনও সৃষ্টির উপর ভরসা করলেন না। কোনও মাখলুকের সাহায্য চাইলেন না। কোনও গায়রুল্লাহ'র সহযোগিতা গ্রহণ করলেন না। যখন তারা তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করছিল, তিনি সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে কেবল বললেন- حسبنا الله ونعم الوكيل (আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। এবং তিনি উত্তম কর্মসম্পাদক)। হাঁ অতি উত্তমভাবেই আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পাদন করলেন। তিনি আগুনকে হুকুম করলেন-

يَانَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ (69)

অর্থ : হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে যাও।” সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৬৯
حسبنا الله তার কীর্তি দেখিয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ আগুন তাঁর জন্য ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হয়ে গেল শান্তিদায়ক। এটাই আল্লাহর নীতি। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য ক্ষতিকর বস্তুকেও উপকারী বানিয়ে দেন। আগুন যেমন আল্লাহর সৃষ্টি, তেমনি তার তাপও তাঁরই সৃষ্টি। তিনি যদি তাপ কেড়ে নেন, তবে আগুনের কী সাধ্য কাউকে জ্বালাবে? তিনি যদি আগুনের ভেতর তাপের স্থলে শীতলতা সৃষ্টি করেন, তা তিনি করতেই পারেন। যে বস্তুতে তিনি দাহনশক্তি দান করেন, তাকে নাতিশীতোষ্ণও তিনি করতে পারেন বৈ কি। স্রষ্টার উপর ইবরাহীমী ঈমানের সাথে তাওয়াক্কুল করতে পারলে আজও অগ্নিকুণ্ড পুষ্পোদ্যানে পরিণত হতে পারে। ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে এমন বহু ঘটনা বর্ণিত আছে।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ছিলেন খলীলুল্লাহ। আল্লাহর খাস বন্ধু। তদ্রূপ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামও আল্লাহর খলীল ছিলেন। যেমন এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

فَإِنَّ اللهِ تَعَالَى قَدِ اتَّخَذَنِي خَلِيلًا، كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا

"আল্লাহ তা'আলা আমাকে তাঁর খলীল বানিয়েছেন, যেমন ইবরাহীমকে খলীল বানিয়েছিলেন।” সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫২২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৪২; মুসনাদে আহমাদ,হাদীছ নং ৪৪১৩
উভয়ে যেমন আল্লাহ তা'আলার খলীল ছিলেন, তেমনি উভয়ের নবুওয়াতী জীবনেও বহু মিল আছে। একটি মিল আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ঘোর বিপদকালে সর্বাস্তকরণে আল্লাহ অভিমুখী হয়ে এবং তাঁর প্রতি চূড়ান্ত পর্যায়ে সমর্পিত হয়ে বলেছিলেন حسبنا الله ونعم الوكيل (আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মসম্পাদক)। তদ্রূপ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঘোর বিপদকালে এ দু'আ পাঠ করেছিলেন। উহুদ যুদ্ধ থেকে ফেরার পর যখন জানানো হল- إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ (লোকে তোমাদের জন্য একাট্টা হয়েছে, সুতরাং তোমরা তাদের ভয় কর), অর্থাৎ আবূ সুফয়ানের বাহিনী মদীনার দিকে ফিরে আসছে, তারা তোমাদের ক্ষতবিক্ষত অবস্থার সুযোগ নিতে চাচ্ছে, তারা তোমাদের উপর পুনরায় হামলা চালাবে এবং তোমাদের নির্মূল করে ছাড়বে, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম একটুও দমলেন না। তাঁরা ঈমানী তেজে উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে বলে উঠলেন حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ সুতরাং আল্লাহ তা'আলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে যেমন রক্ষা করেছিলেন, তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামকেও এ চরম দুরবস্থাকালে শত্রুবাহিনীর হাত থেকে হেফাজত করলেন। কাফের বাহিনী ভীত প্রকম্পিত হয়ে ফিরে গেল এবং তাঁরা সম্পূর্ণরূপে অক্ষত অবস্থায় আল্লাহর নি'আমত ও অনুগ্রহ এবং তাঁর সন্তুষ্টি ও ছওয়াবের অধিকারী হয়ে ফিরে আসলেন।
সুতরাং প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য, যে-কোনও সংকটকালে সকল মাখলুক থেকে বিমুখ হয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা এবং কেবল তাঁরই সাহায্য কামনা করা। তাহলে তিনি যেমন তাঁর এ মহান দুই খলীলকে সাহায্য করেছিলেন এবং চরম বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন, তেমনি আমাদেরও সাহায্য করবেন ও মসিবত থেকে রক্ষা করবেন।
বিপদ-আপদে আল্লাহ তা'আলার সাহায্য লাভের জন্য حَسْبِىَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মসম্পাদনকারী) - এ দু'আটি খুবই কার্যকর। তবে এর জন্য কেবল মুখে উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হওয়া উচিত নয়; বরং এর অর্থের প্রতি ধ্যান করে আল্লাহর দিকে রুজু করাও অবশ্যকর্তব্য।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যত কঠিন বিপদই হোক, যথার্থভাবে আল্লাহর অভিমুখী হতে পারলে আল্লাহ

অবশ্যই তা থেকে মুক্তিদান করেন। এর জন্য উল্লিখিত দু'আটি অত্যন্ত উপকারী।

খ. মাখলুকের মধ্যে উপকার বা ক্ষতি করার যে শক্তি তা তার নিজস্ব নয়, বরং আল্লাহর দান। আল্লাহ চাইলে যে কোনও সময় সে শক্তি কেড়েও নিতে পারেন। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কোনও মাখলুকের পক্ষে কারও উপকার বা ক্ষতি করা সম্ভব নয়। কাজেই কোনও মাখলুকের দ্বারা উপকার পেতে হলে বা তার ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে চাইলে সে ব্যাপারে আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন