আল মুওয়াত্তা - ইমাম মালিক রহঃ

১৬. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৪৭
১৪. মুসিবতের ধৈর্যধারণ সম্পর্কে বিবিধ বর্ণনা
রেওয়ায়ত ৪২. নবী করীম (ﷺ) এর পত্নী উম্মে সালামা (রাযিঃ) হইতে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ যাহার (উপর) কোন মুসিবত পৌছে, অতঃপর আল্লাহ্ তাহাকে যেরূপ নির্দেশ দিয়াছেন সেইরূপ বলে-

إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
اللَّهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي وَأَعْقِبْنِي خَيْرًا مِنْهَا

অর্থাৎ,আমরা তো আল্লাহরই এবং আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। হে আল্লাহ আমার মুসিবতে (উহার বিনিময়ে) আমাকে সওয়াব দান করুন এবং উহার পশ্চাতে আমাকে উহা অপেক্ষা উত্তম বস্তু দান করুন।

তবে আল্লাহ্ তাহার সহিত সেইরূপ করিবেন। উম্মে সালামা (রাযিঃ) বলেনঃ আবু সালামা (রাযিঃ)-এর ওফাতের পর আমি উক্ত দুআ পাঠ করিলাম, আর বলিলামঃ আবু সালামা (রাযিঃ) হইতে ভাল কে হইবেন? ফলে তাহার পরিবর্তে আল্লাহ আমাকে তাহার রাসূল (ﷺ)-কে প্রদান করিলেন, অতঃপর তিনি আমাকে বিবাহ করেন।
بَاب جَامِعِ الْحِسْبَةِ فِي الْمُصِيبَةِ
وَحَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ رَبِيعَةَ بْنِ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ أَصَابَتْهُ مُصِيبَةٌ فَقَالَ كَمَا أَمَرَ اللَّهُ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ اللَّهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي وَأَعْقِبْنِي خَيْرًا مِنْهَا إِلَّا فَعَلَ اللَّهُ ذَلِكَ بِهِ قَالَتْ أُمُّ سَلَمَةَ فَلَمَّا تُوُفِّيَ أَبُو سَلَمَةَ قُلْتُ ذَلِكَ ثُمَّ قُلْتُ وَمَنْ خَيْرٌ مِنْ أَبِي سَلَمَةَ فَأَعْقَبَهَا اللَّهُ رَسُولَهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَزَوَّجَهَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত উম্মু সালামা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে বান্দার উপরই কোনও মসিবত আসে, সে যদি বলে–
{إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ} اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي, وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا, إِلاَّ أَخْلَفَ اللهُ لَهُ خَيْرًا مِنْهَا
‘আমরা আল্লাহর এবং আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। হে আল্লাহ! আমার মসিবতে আমারে প্রতিদান দিন এবং আমাকে তার চেয়ে উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করুন), তবে আল্লাহ অবশ্যই তার মসিবতে তাকে প্রতিদান দেবেন এবং তার চেয়ে উত্তম স্থলাভিষিক্ত তারে দান করবেন। হযরত উম্মু সালামা রাযি. বলেন, আবূ সালামা মারা গেলে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন হুকুম করেছিলেন তেমনি বললাম। ফলে আল্লাহ তা'আলা আমাকে তার চেয়ে উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করলেন। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে।

ব্যাখ্যাঃ

হাদীছটিতে বর্ণিত দু'আ সম্পর্কে ওয়াদা দেওয়া হয়েছে যে, কোনও বিপদ-আপদে পতিত ব্যক্তি এটি পড়লে আল্লাহ তা'আলা তাকে অবশ্যই প্রতিদান দেবেন এবং সে যা হারাল তার বদলে উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করবেন। বলাবাহুল্য এ ওয়াদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেই দিয়েছেন। কাজেই এ ওয়াদার সত্যতায় কোনও সন্দেহ নেই।

হাদীছটির বর্ণনাকারী হযরত উম্মু সালামা রাযি. বলেন, আবূ সালামার ইন্তিকালের পর এ দু'আটি আমার স্মরণ হল। আমি দু'আটি পড়লাম। কিন্তু এর শেষাংশ বলতে আমার মন প্রস্তুত হচ্ছিল না। মনে মনে ভাবছিলাম, আবূ সালামার চেয়ে ভালো আর কে হতে পারে! তিনি এমন ছিলেন, এমন ছিলেন- এই বলে তাঁর গুণাবলি কল্পনা করছিলাম। তারপরও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু এ দু'আটি পড়তে বলেছেন, তাই তাঁর প্রতি উৎসর্গিতপ্রাণ ও তাঁর কথার উপর গভীর আস্থাবতী সাহাবিয়া উম্মু সালামা রাযি. দু’আটি শেষপর্যন্ত পড়লেন। আল্লাহ তা’আলা সে দু’আ কবুল করলেন। আবূ সালামার স্থানে তিনি (স্বামী হিসেবে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেলেন।

উল্লেখ্য, কারও জীবনে এ জাতীয় ওয়াদার সুফল পাওয়ার বিষয়টি তার ঈমান ও বিশ্বাসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখে। একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে-
أَنَا عِنْدَ ظَنّ عَبْدِي بِي
'আমি আমার সম্পর্কে আমার বান্দার ধারণার কাছে থাকি (অর্থাৎ আমার সম্পর্কে আমার বান্দা যেমন ধারণা করে, আমি তার প্রতি সেরকম আচরণই করে থাকি)’।
(সহীহ বুখারী: ৭৫০৫; সহীহ মুসলিম: ২৬৭৫; জামে' তিরমিযী: ২৩৮৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭৬৮৩; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৮২৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৬৩; সুনানে দারিমী: ২৭৭৩; মুনাদুল বাযযার: ৮৯০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৬৩৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৭৪)

সুতরাং এ দু'আটি পড়ার সময় মনোযোগ যত গভীর ও বিশ্বাস যত দৃঢ় থাকবে, সুফল পাওয়ার সম্ভাবনাও ততো বেশি থাকবে।

হাদীছটিতে যে-কোনও মসিবতের বেলায়ই এ দু'আটি পড়তে বলা হয়েছে। সে মসিবত শারীরিক হোক, আর্থিক হোক কিংবা হোক মান-সম্মান সম্পর্কিত। এরূপ যে-কোনও বিপদে এ দু'আটি পড়া উচিত। এমনিভাবে সে মসিবত যদি হয় কারও প্রাণবিয়োগ, যেমন পিতা-মাতা, সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, ভাইবোন বা যে-কোনও প্রিয়জনের মৃত্যু, তবে মুমিন ব্যক্তিকে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে অবশ্যই এ দু'আটি পড়তে হবে। হযরত উম্মু সালামা রাযি. এ দু'আটি পড়ে দুনিয়াতেই তার সুফল পেয়েছিলেন। আমরাও যদি তাঁর মতো করে বিপদ-আপদে এ দু'আটি পড়ি, তবে অবশ্যই আমরাও এর সুফল পাব।

এ দু'আটি পড়ার দাবি বিপদে নিজেকে স্থির রাখা ও ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া। কেউ মুখে দু'আটি পড়ল কিন্তু মনে সবর নেই, আচার-আচরণে স্থিরতা নেই এবং নেই আল্লাহর ফয়সালায় আত্মসমর্পণ ও আদব-কায়দার লেহাজ, তবে সে দু'আপাঠ অসার কথামাত্র হয়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি দু'আর কী সুফল পেতে পারে? মনে রাখতে হবে, কুরআন-সুন্নাহর দু'আ গভীর অর্থ ও ভাব বহন করে। তার সম্পর্ক বিশ্বাস ও কর্মের সঙ্গে। দু'আর সঙ্গে জীবনপগঠনেরও সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃত অর্থে ইসলামী দু’আসমূহ জীবনগঠনেরই মূলমন্ত্র। তাই দু'আপাঠ দ্বারা জীবনগঠনে অনুপ্রাণিত হওয়া ও আচার-আচরণ পরিশীলিত করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখা অতীব জরুরি। সুন্দর সুফল পাওয়ার বিষয়টা এরই মধ্যে নিহিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যে-কোনও মসিবত প্রকৃত অর্থে বান্দার জন্য আল্লাহ তা'আলার নি'আমত, যেহেতু তা দ্বারা আল্লাহ অভিমুখী হওয়া ও দু'আয় রত হওয়ার সুযোগ মেলে এবং লাভ হয় অশেষ নেকী।

খ. প্রিয়জনকে হারানো ছাড়াও যে-কোনও মসিবতে হাদীছে বর্ণিত দু'আটি পড়তে হবে।

গ. যে-কোনও দু'আ পড়ার সময় সে দু'আ সম্পর্কে হাদীছে যে ওয়াদা আছে তার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা অতীব জরুরি। সে বিশ্বাসের বদৌলতেই হযরত উম্মু সালামা রাযি. দু'আটির সুফল লাভ করেছিলেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)