আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ

হাদীস নং: ৪১০২
আন্তর্জাতিক নং: ৪৪৪৯
২২৪৭. নবী কারীম (ﷺ)- এর রোগ ও তাঁর ওফাত।
৪১০২। মুহাম্মাদ ইবনে উবাইদা (রাহঃ) .... আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি প্রায়ই বলতেন, আমার প্রতি আল্লাহর বিশেষ নিআমত যে, নবী কারীম (ﷺ) আমার ঘরে, আমার পালার দিনে এবং আমার হলকুম ও সিনার মধ্যস্থলে থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর ইন্‌তিকাল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর ইন্‌তিকালের সময় আমার থুথু তাঁর থুথুর সাথে মিশ্রিত করে দিয়েছেন। এ সময় আব্দুর রহমান (রাযিঃ) আমার নিকট প্রবেশ করে এবং তার হাতে মিসওয়াক ছিল। আর আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে (আমার বুকে) হেলান লাগান অবস্থায় রেখেছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম যে, তিনি আব্দুর রহমানের দিকে তাকাচ্ছেন। আমি অনুভব করতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিসওয়াক চাচ্ছেন। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি আপনার জন্য মিসওয়াক আনব? তিনি তখন মাথার ইশারায় জানালেন যে, হ্যাঁ, আন।
তখন আমি মিসওয়াক আনলাম। কিন্তু মিসওয়াক শক্ত ছিল, তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি এটি আপনার জন্য নরম করে দিব? তখন তিনি মাথার ইশারায় হ্যাঁ বললেন। তখন আমি মিসওয়াকটি চিবিয়ে নরম করে দিলাম। এরপর তিনি মিসওয়াক করলেন। তাঁর সম্মুখে পাত্র অথবা পেয়ালা ছিল (রাবী উমরের সন্দেহ) তাতে পানি ছিল। নবী কারীম (ﷺ) বারবার স্বীয় হস্তদ্বয় উক্ত পানির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে তার দ্বারা তাঁর চেহারা মাসাহ (ঠাণ্ডা) করালেন। এবং বলছিলেনঃ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ আল্লাহ ব্যতিত কোন মা‘বুদ নেই, সত্যিই মৃত্যুযন্ত্রণা কঠিন। তারপর উভয় হাত উপর দিকে উত্তোলন করে বলছিলেন, আমি উর্ধ্বলোকের মহান বন্ধুর সাথে মিলিত হতে চাই। এ অবস্থায় তাঁর ইন্‌তিকাল হল আর হাত শিথিল হয়ে গেল।
بَابُ مَرَضِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَوَفَاتِهِ
4449 - حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ عُبَيْدٍ، حَدَّثَنَا عِيسَى بْنُ يُونُسَ، عَنْ عُمَرَ بْنِ سَعِيدٍ، قَالَ: أَخْبَرَنِي ابْنُ أَبِي مُلَيْكَةَ، أَنَّ أَبَا عَمْرٍو ذَكْوَانَ، مَوْلَى عَائِشَةَ، أَخْبَرَهُ أَنَّ عَائِشَةَ كَانَتْ تَقُولُ: إِنَّ مِنْ نِعَمِ اللَّهِ عَلَيَّ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تُوُفِّيَ فِي بَيْتِي، وَفِي يَوْمِي، وَبَيْنَ سَحْرِي وَنَحْرِي، وَأَنَّ اللَّهَ جَمَعَ بَيْنَ رِيقِي وَرِيقِهِ عِنْدَ مَوْتِهِ: دَخَلَ عَلَيَّ عَبْدُ الرَّحْمَنِ، وَبِيَدِهِ السِّوَاكُ، وَأَنَا مُسْنِدَةٌ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَرَأَيْتُهُ يَنْظُرُ إِلَيْهِ، وَعَرَفْتُ أَنَّهُ يُحِبُّ السِّوَاكَ، فَقُلْتُ: آخُذُهُ لَكَ؟ فَأَشَارَ بِرَأْسِهِ: «أَنْ نَعَمْ» فَتَنَاوَلْتُهُ، فَاشْتَدَّ عَلَيْهِ، وَقُلْتُ: أُلَيِّنُهُ لَكَ؟ فَأَشَارَ بِرَأْسِهِ: «أَنْ نَعَمْ» فَلَيَّنْتُهُ، فَأَمَرَّهُ، وَبَيْنَ يَدَيْهِ رَكْوَةٌ أَوْ عُلْبَةٌ - يَشُكُّ عُمَرُ - فِيهَا مَاءٌ، فَجَعَلَ يُدْخِلُ يَدَيْهِ فِي المَاءِ فَيَمْسَحُ بِهِمَا وَجْهَهُ، يَقُولُ: «لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ» ثُمَّ نَصَبَ يَدَهُ، فَجَعَلَ يَقُولُ: «فِي الرَّفِيقِ الأَعْلَى» حَتَّى قُبِضَ وَمَالَتْ يَدُهُ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতকালীন অবস্থা বর্ণনা করেছেন। এতে উল্লেখ আছে, তিনি ওফাতকালে একটি বিশেষ দু'আ পড়ছিলেন।

দুয়াটি বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সবচেয়ে বিস্তারিত হলো- «اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وارْحَمْنِي، وأَلْحِقْنِي بالرَّفِيقِ الأَعْلَى».

তিনি দু'আ করছিলেন- اللهم اغفرلي وارحمني (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। আমার প্রতি রহম করুন)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মা'সুম। তাঁর কোনও গুনাহ ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি এরূপ দু'আ করেছেন। এটা ছিল তাঁর বিনয়। ছিল আল্লাহ তা'আলার প্রতি চরম আত্মনিবেদন। ছিল আল্লাহ তা'আলার প্রতি পরম শ্রদ্ধা-ভক্তি ও তাঁর গৌরব-গরিমার প্রকাশ। এর মাধ্যমে তিনি নিজ উম্মতকেও শিক্ষা দিয়েছেন যে, মৃত্যুকালে আল্লাহ তা'আলার কাছে নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া ও তাঁর রহমতের আশাবাদী থাকা উচিত। যেই মহানবীর কোনও গুনাহ ছিল না আর তা সত্ত্বেও তিনি এভাবে রহমত ও মাগফিরাত কামনা করেছেন, তাঁর উম্মতের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের কামনা কতইনা বেশি জরুরি, যখন তারা নানারকম গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত থাকে।

দু'আটির শেষাংশ হল- وألحقني بالرفيق الأعلى (আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিয়ে দিন)। الرفيق الأعلى এর দ্বারা যেমন আল্লাহ তা'আলাকে বোঝানো হয়, তেমনি জান্নাত ও জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম বাসিন্দা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামকেও বোঝানো হয়ে থাকে। সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহগণও এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا
'যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা সেইসকল লোকের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। কতইনা উত্তম সঙ্গী তারা!’ (সূরা নিসা, আয়াত ৬৯)

এ দু'আটি দ্বারা বাহ্যত মনে হয় তিনি মৃত্যু কামনা করেছিলেন। বস্তুত বিষয়টি সেরকম নয়। সাধারণভাবে মৃত্যুকামনা করা উচিত নয়। নিষেধ আছে। তিনি এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার ফয়সালায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি তখন জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর আয়ু শেষ হয়ে গেছে। তাঁর জান কবজের ফয়সালা হয়ে গেছে। তিনি তা জানতে পেরেছিলেন ফিরিশতাদের আগমন দ্বারা। সাধারণ নেককারদেরও মৃত্যুর সময় সুসংবাদ দানকারী ফিরিশতাদের আগমন ঘটে। নবীগণের ক্ষেত্রে তো তা ঘটেই থাকে। এমনকি মৃত্যুর ফিরিশতা এসে নবীগণের কাছে জান কবজের অনুমতিও চেয়ে থাকে। হাদীছ দ্বারা এটা প্রমাণিত। তিনি যে নিজ মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন তা প্রমাণ হয় এর দ্বারাও যে, তিনি নিজ কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরা রাযি.-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, আজকের পর তোমার পিতার আর কোনও কষ্ট নেই। তো যখন মৃত্যুর ফয়সালা হয়ে গেছে এবং জান কবজকারী ফিরিশতাগণও এসে গেছেন, তখন তাঁর জন্য এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি সে ফয়সালায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন এবং পরম বন্ধু আল্লাহ তা'আলা ও আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবেন। এ দু'আটি দ্বারা তিনি তাই করেছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নবীগণও মানুষ। অপরাপর মানুষের মতো তাঁদেরও রোগ-ব্যাধি হয় এবং তাঁরাও মৃত্যুবরণ করেন।

খ. মৃত্যুকালে আল্লাহ তা'আলার কাছে নিজ গুনাহের জন্য মাগফিরাতের দু'আ করা উচিত এবং তাঁর রহমতের আশাবাদী থাকা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)