আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৪৪৭
২২৪৭. নবী কারীম (ﷺ)- এর রোগ ও তাঁর ওফাত।
৪১০০। ইসহাক (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, আলী ইবনে আবু তালীব (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছ হতে বের হয়ে আসেন যখন তিনি মৃত্যুরোগে আক্রান্ত ছিলেন। তখন সাহাবীগণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবুল হাসান, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আজ কেমন আছেন? তিনি বললেন, আল্-হামদুলিল্লাহ্, তিনি কিছুটা সুস্থ। তখন আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাযিঃ) তাঁর হাত ধরে তাঁকে বললেন, আল্লাহর কসম, তুমি তিন দিন পরে অন্যের দ্বারা পরিচালিত হবে। আল্লাহর শপথ, আমি মনে করি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এই রোগে অচিরেই ওফাত পাবেন। কারণ আমি আব্দুল মুত্তালিবের বংশের অনেকের মৃত্যুকালীন চেহারার অবস্থা লক্ষ্য করেছি।
চল যাই, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করি যে, তিনি (খিলাফতের) দায়িত্ব কার উপর ন্যস্ত করে যাচ্ছেন। যদি আমাদের মধ্যে থাকে তো তা আমরা জানবো। আর যদি আমাদের ছাড়া অন্যদের উপর ন্যস্ত করে যান, তাহলে তাও আমরা জানতে পারব এবং তিনি এ ব্যাপারে আমাদের তখন অসীয়ত করে যাবেন। তখন আলী (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, যদি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে আমরা জিজ্ঞাসা করি আর তিনি আমাদের নিষেধ করে দেন, তবে তারপরে লোকেরা আর আমাদের তা প্রদান করবে না। আল্লাহর কসম, এজন্য আমি কখনোই এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে জিজ্ঞাসা করবো না।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরী ১১ সনের সফর মাসের শেষদিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সর্বমোট ১৩ দিন অসুস্থ থাকেন। শেষের ৭টি দিন তাঁর অসুস্থতা ছিল তীব্র। তখন তাঁর পক্ষে হাঁটাচলা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় তিনি অন্যান্য স্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর ঘরে অবস্থান করতে থাকেন। তিনি মসজিদেও নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে পারছিলেন না।

ওফাতের আগের বৃহস্পতিবার তাঁর রোগযন্ত্রণা ছিল খুব বেশি। মাগরিবের সময় কিছুটা হালকা বোধ করলে দু'জনের কাঁধে ভর করে তিনি মসজিদে যান এবং মাগরিবের নামাযে ইমামত করেন। তারপর ইশার সময় তাঁর রোগযন্ত্রণা খুব বেড়ে যায়। তিনি বার বার বেহুঁশ হয়ে পড়ছিলেন। প্রতিবার তিনি ইশার নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাঁকে বলা হচ্ছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। মসজিদে সকলে আপনার অপেক্ষা করছে। প্রত্যেকবার তিনি পানি চান এবং তা দিয়ে গোসল করেন। তারপর যেই না ওঠার চেষ্টা করেন, এমনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান। শেষপর্যন্ত তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত করার হুকুম দেন। অতঃপর প্রত্যেক নামাযে তিনি ইমামত করতে থাকেন।

শুক্রবার সারাটা দিনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরেই অবস্থান - করেন। নামাযের জন্য মসজিদে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চারদিক থেকে বিপুল মানুষ জুমু'আর নামাযে হাজির হয়। কিন্তু এই ছিল প্রথম জুমু'আ, যা তারা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর পেছনে আদায় করেন। সম্ভবত এদিনই হযরত আলী রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে আসেন। তিনি তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে আসলে লোকজন জিজ্ঞেস করল, হে আবুল হাসান! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেমন আছেন? তিনি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন। এটা বলেছিলেন শুভকামনা স্বরূপ।

শনিবার ফজরের নামাযও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরেই আদায় করেন। যোহরের সময় কিছুটা হালকা বোধ করলে তিনি দু'জনের কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে যান। ততক্ষণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নামাযের ইমামত শুরু করে দিয়েছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সরে আসতে চাইলে তিনি তাঁকে নিষেধ করেন এবং নিজে তাঁর পাশে বসে নামায আদায় করেন। নামায আদায় করার পর তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ ভাষণ। এই ভাষণের পর যে মিম্বর থেকে নামেন, তারপর আর কখনও তিনি তাতে আরোহণ করেননি। এ ভাষণে তিনি বিশেষভাবে মুহাজির ও আনসারদের মর্যাদা তুলে ধরেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি, সম্পর্কে এমন কিছু বলেন, যা দ্বারা তাঁর খেলাফতের প্রতি ইঙ্গিত হয়। ভাষণ শেষে তিনি ঘরে ফিরে আসেন। এটাই ছিল মসজিদে তাঁর সর্বশেষ উপস্থিতি। তারপর আর তাঁর পক্ষে ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি।

রোববার তিনি ঘরেই অবস্থান করতে থাকেন। সাহাবীগণ যথারীতি আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর পেছনে নামায পড়তে থাকেন। সোমবারও তিনি সকলকে নিয়ে মসজিদে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। এ অবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরের পর্দা সরিয়ে সেদিকে মমতাভরে তাকালেন। নামাযরত সাহাবীদের দেখে তিনি খুব আনন্দিত হন। তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সাহাবীগণ ভাবছিলেন? তিনি বুঝি নামাযে অংশগ্রহণ করতে আসছেন। তাতে তারা এতটা খুশি হন যে, নামাযই ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু তিনি ইশারায় নামায পূর্ণ করতে বললেন এবং পর্দা ছেড়ে দিয়ে তিনি ভেতরে চলে আসলেন। এদিনই দুপুরের দিকে তিনি ইহজগৎ থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন।

প্রকাশ থাকে যে, তাঁর ওফাত তো সোমবারে হয়েছিল। তবে তাঁর অসুস্থতাকালীন অবস্থার বিবরণে দিন-বারের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে ভিন্নমতের অবকাশ আছে । কেননা হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থসমূহে এ সম্পর্কিত বর্ণনা বিভিন্ন রকম। তাই চূড়ান্ত ফয়সালা গ্রহণের জন্য গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন।

আলোচ্য হাদীছটিতে বলা হয়েছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের আগের দিনগুলোতে যখন অসুস্থ অবস্থায় থাকেন, তখন একদিন হযরত আলী রাযি. তাঁকে দেখতে আসেন। তিনি বের হয়ে যাওয়ার সময় লোকজন তাঁর কাছে প্রিয়নবীর অবস্থা জানতে চায়। এর কারণ প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকায় সাধারণের পক্ষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে প্রবেশ করে তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব ছিল না। হযরত আলী রাযি. তাঁর জামাতা ও অতি ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাঁর পক্ষে এটা সহজ ছিল। সাধারণ নিয়ম এটাই যে, কেউ বেশি অসুস্থ থাকলে তার কাছে সকলের ভিড় করতে নেই। ঘনিষ্ঠজনেরাই কাছে যাবে। বাকিরা তার কাছ থেকে জেনে নেবে বা পরিবারের লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করবে।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তিম রোগ ছিল তীব্র জ্বর। সেইসঙ্গে কয়েক বছর আগে এক ইহুদি নারী তাঁকে যে বিষ মেশানো খাবার খাইয়েছিল, তার বিষক্রিয়াও এ সময় দেখা দেয়। এতদিন আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় সে বিষের কোনও কুফল দেখা দেয়নি। তা দেখা দেয় এই অন্তিম মুহূর্তে। এটা তাঁর প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রিয় হাবীবকে শহীদী মর্যাদা দান করেন। যাহোক হযরত আলী রাযি.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন- أَصْبَحَ بِحَمْدِ اللهِ بَارِئًا (আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভালো আছেন)। তিনি এরূপ বলেছেন শুভকামনা স্বরূপ। নয়তো বাস্তবিকপক্ষে তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতা ছিল বিপজ্জনক পর্যায়ে। যে সাহাবীগণ তাঁকে ভালোবাসতেন প্রাণের চেয়েও বেশি, তাদের জন্য তাঁর সে কষ্টের খবর সহ্য করা সহজ ছিল না। ভক্ত-অনুরক্তদেরকে সর্বদা আশাভরা মনে তারা দু'আয় রত হওয়ার উৎসাহ পায়, সেরকম সংবাদ দেওয়াই শ্রেয়। বলাবাহুল্য শুভকামনার অর্থে এরূপ সংবাদ দেওয়াটা অসত্য সাব্যস্ত হয় না। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে 'ভালো আছেন'-এর অর্থ হয় আশা করি তিনি ভালো হয়ে যাবেন। আল্লাহ তা'আলা তাকে আরোগ্য দান করবেন। তাছাড়া অন্য দৃষ্টিতে তো তিনি ভালোই ছিলেন। কঠিন অসুখ-বিসুখে সাধারণত মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে। আল্লাহ তা'আলার ফয়সালাকে খুশিমনে গ্রহণ করে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আল্লাহর হাবীব। মহান বন্ধু আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায় তিনি উদ্বেলিত ছিলেন। বারবার বলছিলেন- اللهم الرفيق الأعلى (হে আল্লাহ! মহান বন্ধু!)। আম্মাজান আয়েশা রাযি.-ও বলছিলেন, এখন আর তিনি কিছুতেই আমাদের চাইবেন না। অর্থাৎ এখন আল্লাহর সঙ্গে মিলনই তাঁর একমাত্র কাম্য বিষয়। তা-ই যখন কাম্যবিষয়, তখন তিনি সে অন্তিম রোগে অস্থির হবেন কি; বরং সে রোগকে তিনি সাদরেই গ্রহণ করবেন। তা গ্রহণ করেছিলেনও, যে কারণে তখন তাঁর অজান্তে ওষুধ খাওয়ানো হলে হুঁশ ফিরে পাওয়ার পর তিনি সেজন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বস্তুত তিনি আল্লাহ তা'আলার ফয়সালায় পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলেন। তীব্র রোগের ভেতরও তিনি পুরোপুরি আল্লাহ তা'আলার দিকে রুজু' ছিলেন। দু'আয় রত ছিলেন। তাঁর সে সন্তুষ্টি ও শান্ত-সমাহিত ভাব দেখে হযরত আলী রাযি.-ও অভিভূত ছিলেন। তিনি এজন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করেন এবং বলেন- আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভালো আছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কঠিন রোগাক্রান্ত বা মুমূর্ষু রোগীর কাছে ভিড় করতে নেই।

খ. এরূপ রোগীর খোঁজখবর তার পরিবারবর্গের কাছ থেকে নিতে হয়।

গ. রোগীর অবস্থা খারাপ, এরূপ কথা তার ভক্ত-অনুরক্তদের বলতে নেই। বরং এমনকিছু বলা উচিত, যাতে তারা আশান্বিত হয়।

ঘ. আল্লাহ তা'আলার ফয়সালা মনে করে রোগ-ব্যাধিতে শান্ত ও স্থির থাকা এবং আল্লাহর ফয়সালায় খুশি থেকে তাঁর সমীপে দু'আ ও ইস্তিগফারে রত থাকা উচিত।

ঙ. রোগীর অবস্থা সন্তোষজনক দেখলে সেজন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা চাই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন