মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৩০- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৯৭০
- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়
তৃতীয় অনুচ্ছেদ - রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর ওফাতের পর সাহাবীদের মক্কাহ্ হতে হিজরত করা সম্পর্কে
৫৯৭০। হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, একদা তিনি বলিলেন, হায় আমার মাথা (ব্যথায় আমি মরণাপন্ন)। তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেনঃ যদি ইহা (অর্থাৎ, তোমার মৃত্যু) ঘটিয়া যায়, আর আমি বাচিয়া থাকি, তাহা হইলে (চিন্তার কোন কারণ নাই,) আমি তোমার জন্য মাগফিরাত কামনা করিব এবং তোমার জন্য দো'আ করিব। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলিলেন, হায় আফসোস! আল্লাহর কসম! আমার তো মনে হইতেছে, আপনি আমার মৃত্যুই কামনা করিতেছেন। আর যদি তাহাই ঘটে, তাহা হইলে তো আপনি সেইদিনের শেষাংশে আপনার অন্য কোন বিবির সাথে রাত্রি যাপন করিবেন। তখন নবী (ﷺ) বলিলেন, (নিজের মাথা ব্যথা এবং মৃত্যুর আলোচনা বাদ দাও ;) বরং আমার মাথা (আরও অধিক)। [অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেন,] আমি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলাম অথবা বলিয়াছেন, আমি ইচ্ছা করিয়াছিলাম কোন লোক পাঠাইয়া আবু বকর ও তাঁহার পুত্র (আব্দুর রহমান)-কে ডাকাইয়া আনিব এবং তাহাদিগকে (খেলাফত সম্পর্কে) অসিয়ত করিয়া যাইব, যেন লোকেরা বলিতে না পারে (অমুক ব্যক্তি খেলাফতের বেশী হকদার।) অথবা কেহ যেন আশা না করিতে পারে (আমিই খেলাফতের অধিক উপযোগী); কিন্তু পরে আমি ভাবিলাম, আল্লাহ্ তা'আলাই (আবু বকর ব্যতীত অন্যের খেলাফত) গ্রহণ করিবেন না। আর ঈমানদারগণও তাহা মানিয়া লইবে না। অথবা তিনি বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা'আলাই প্রতিহত করিবেন এবং ঈমানদারগণও গ্রহণ করিবে না। —বুখারী
كتاب الفضائل والشمائل
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب هِجْرَة أَصْحَابه صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من مَكَّة ووفاته)
وَعَن عَائِشَة أَنَّهَا قَالَت: وَا رأساه قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «ذَاكِ لَوْ كَانَ وَأَنَا حَيٌّ فَأَسْتَغْفِرُ لَكِ وَأَدْعُو لَكِ» فَقَالَتْ عَائِشَةُ: وَاثُكْلَيَاهْ وَاللَّهِ إِنِّي لَأَظُنُّكَ تُحِبُّ مَوْتِي فَلَوْ كَانَ ذَلِكَ لَظَلِلْتَ آخِرَ يَوْمِكَ مُعْرِسًا بِبَعْضِ أَزْوَاجِكَ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم: بل أَنا وَا رأساه لَقَدْ هَمَمْتُ أَوْ أَرَدْتُ أَنْ أُرْسِلَ إِلَى أَبِي بَكْرٍ وَابْنِهِ وَأَعْهَدُ أَنْ يَقُولَ الْقَائِلُونَ أَوْ يَتَمَنَّى الْمُتَمَنُّونَ ثُمَّ قُلْتُ: يَأْبَى اللَّهُ وَيَدْفَعُ الْمُؤْمِنُونَ أَوْ يَدْفَعُ اللَّهُ وَيَأْبَى الْمُؤْمِنُونَ . رَوَاهُ البُخَارِيّ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ধারণা হইয়াছিল, এই রোগে তাঁহার মৃত্যু ঘটিতে পারে। আল্লাহর পক্ষ হইতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) জানিতেন যে, এই রোগে তাঁহার মৃত্যু হইবে না, তাই তিনি প্রথমে তাঁহাকে সান্ত্বনা দেওয়ার পর এইদিকে তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করাইলেন যে, এই অসুখে আমি আর সারিয়া উঠিব বলিয়া আশা করি না। এখন আমার নিদারুণ চিন্তা মুসলিম উম্মাহর দায়িত্বভার কাহার উপর দিয়া যাই। এই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কাছে আবু বকরের কথাই মনে পড়িয়াছিল। কারণ, তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা যোগ্য ব্যক্তি, কাজেই অন্যের খেলাফত আল্লাহ্ও পছন্দ করিবেন না এবং জাতিও মানিয়া লইবে না; কিন্তু তারপরও নবী (ﷺ) আবু বকরকে মনোনীত করিয়া যান নাই কিংবা কিছু লিখিয়াও দেন নাই। কারণ, মুসলমানেরা নিজেদের ব্যাপার নিজেরাই চিন্তা করিয়া ঠিক করুক, ইজতেহাদের সওয়াব লাভ করুক এবং ভাবিয়া-চিন্তিয়া আবু বকরকে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচন করিয়া তাঁহার হাতে বায়আত করুক, ইহাই ছিল তাঁহার ইচ্ছা। এই জন্য খলীফা নির্বাচনের ভার তিনি জনগণের উপরই ন্যস্ত করিয়া গিয়াছেন। যাহা ইসলামী গণতন্ত্রের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর হযরত আয়েশা (রাঃ) নবী (ﷺ)-কে যেই কথাটি বলিয়াছেন, তাহা ছিল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক মান-অভিমানের ব্যাপার।

২. কাসিম ইবন মুহাম্মাদ রহ. এ হাদীছটি তাঁর ফুফু উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন। কাসিম হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর নাতি। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মাদ ইবন আবূ বকর। মুহাম্মাদ হিজরী ১০ম সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত আলী রাযি.-এর পক্ষ থেকে মিশরের গভর্নর ছিলেন। হিজরী ৩৮ সনে মিশরেই নিহত হন। তখন তাঁর পুত্র কাসিম একজন শিশু। ফুফু আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. তাঁকে লালন-পালন করেন। তিনি ফুফুর নিকট থেকে কুরআন-সুন্নাহর বিপুল জ্ঞান অর্জন করেন। আরও বহু সাহাবী থেকে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ ফকীহ।

কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির জানাযা ও দাফন-কাফন শেষ করার পর আল-বাকী' কবরস্থান থেকে ঘরে ফিরে আসেন। তখন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছিল। তিনি وَا رَأْسَاه (মাথাটা গেল) বলে যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করছিলেন। তিনি এভাবে কেন মাথাব্যথার কথা প্রকাশ করছেন, সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিষেধ বা তিরস্কার করেননি; উল্টো রসিকতা করেছেন যে, আমার আগে তুমি মারা গেলে তো ভালোই। কারণ তখন আমি তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করব ও দু'আ করব। এমনকি তিনি নিজ মাথাব্যথার কথাও প্রকাশ করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, অসুখ-বিসুখের কষ্টে উহ্-আহ্ করা বা অন্য কোনও ভাষায় সে কষ্টের কথা ব্যক্ত করা দূষণীয় নয়। এটা মানুষের স্বভাব যে, মাথা ব্যথা হলে বলে- উহ্, মাথাটা গেল বা মাথাব্যথায় মরে গেলাম। এমনিভাবে যে-কোনও অঙ্গে কঠিন ব্যথা-বেদনা হলে স্বভাবগতভাবেই মুখ দিয়ে তা প্রকাশ হয়ে যায়। এটা শরী'আতবিরোধী নয়। শরী'আতবিরোধী হয় তখনই, যখন সে কষ্টের কারণে আল্লাহ সম্পর্কে বা তাকদীরের ফয়সালা সম্পর্কে অনুচিত কোনও কথা বলা হয়। এমনিভাবে ব্যথা-বেদনায় অস্থিরতার প্রকাশে যদি সীমালঙ্ঘন হয় বা নিজ অস্থিরতা দ্বারা অন্যকেও অস্থির করে ফেলা হয়, তবে তাও সমীচীন নয়।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্ভবত ওহী দ্বারা জানতে পেরেছিলেন যে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর এ মাথাব্যথা সাময়িক। এটা ভালো হয়ে যাবে। বরং তিনি নিজেই আগে ইন্তিকাল করবেন। তাই তিনি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. -এর রসিকতায় হেসে দেন এবং বলে ওঠেন-
!بل أنا، وا رَأْساه (বরং আমি বলছি, হায়রে আমার মাথাব্যথা)! অর্থাৎ তুমি নিজ মাথাব্যথার কথা ছেড়ে দাও। তুমি আমার দিকে লক্ষ করো। আমারও প্রচণ্ড মাথাব্যথা। আর আমার এ মাথাব্যথা ভালো হওয়ার নয়। এটা আমার অন্তিম রোগের সূচনা। উল্লেখ্য, এর পরেই তাঁর জ্বর শুরু হয়ে যায়। তাঁর অসুস্থতা বাড়তেই থাকে। পরিশেষে এ অসুস্থতার ভেতরই তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যায়।

হাদীছটিতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর খেলাফতের প্রতিও ইঙ্গিত আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরিভাবে তাঁকে খলীফা বানিয়ে যাননি বটে, কিন্তু এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলার ফয়সালা সেটাই এবং মুমিনগণও আবু বকর সিদ্দীক রাযি. ছাড়া আর কাউকে খলীফা মানবে না। বাস্তবে তাই হয়েছিল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

রোগ-ব্যাধিতে উহ-আহ্ করা ও কষ্টের কথা প্রকাশ করা দোষের নয়।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান