মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
৩০- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৯০৮
- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়
প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৯০৮। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একদা আবু তালহা (রাঃ) উম্মে সুলাইম (রাঃ)-কে বলিলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কণ্ঠস্বর খুব দুর্বল শুনিতে পাইলাম, ইহাতে আমি অনুভব করিলাম, তিনি ক্ষুধার্ত। তোমার কাছে খাওয়ার কিছু আছে কি? উম্মে সুলাইম বলিলেন, হ্যাঁ আছে। এই বলিয়া তিনি কিছু যবের রুটি বাহির করিলেন। অতঃপর ওড়নাটি বাহির করিয়া উহার একাংশ দিয়া রুটিগুলি বাঁধিয়া গোপনে আমার হাতে দিলেন এবং ওড়নার অপরাংশ আমার গায়ে জড়াইয়া দিলেন। তারপর আমাকে রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। (আনাস বলেন,) আমি গিয়া রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদে পাইলাম। (খন্দকের যুদ্ধের সময় সেইখানে নামাযের জন্য সাময়িকভাবে যেই জায়গা নির্ধারণ করিয়াছিলেন, মসজিদ মানে উক্ত স্থান।) তাহার সাথে আরও কিছু লোক ছিল। আমি সালাম দিয়া তাহাদের সম্মুখে দাড়াইলাম। তখন রাসুলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমাকে কি আবু তালহা পাঠাইয়াছে? আমি বলিলাম, হ্যাঁ। তিনি আরও জিজ্ঞাসা করিলেন, খাদ্য লইয়া পাঠাইয়াছে? আমি বলিলাম, হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহার সাহাবী যাঁহারা তথায় ছিলেন, সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন তোমরা উঠ এবং চল। (এই বলিয়া সমস্ত লোকজনসহ) তিনি রওয়ানা হইলেন আর আমিও তাহাদের সামনে সামনে (আবু তালহার বাড়ীর দিকে) চলিতে লাগিলাম এবং আবু তালহার নিকট আসিয়া তাহাকে [রাসুলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর আগমনী বার্তা] জানাইলাম। তখন আবু তালহা (স্ত্রীকে) বলিলেন, হে উম্মে সুলাইম। রাসুলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজনসহ তাশরীফ আনিয়াছেন। অথচ আমাদের কাছে এই পরিমাণ খাদ্য সামগ্রী নাই যাহা আমরা তাহাদের সকলকে খাইতে দিতে পারি। তখন উম্মে সুলাইম বলিলেন, আল্লাহ্ ও তাহার রাসূল (সবকিছু ভাল জানেন। অতঃপর আবু তালহা গিয়া রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরের দিকে আগাইয়া আসিলেন এবং আবু তালহাও তাহার সঙ্গে ছিলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, হে উম্মে সুলাইম। তোমার কাছে যাহাকিছু আছে আমার নিকট লইয়া আস। তখন তিনি ঐ রুটিগুলি আনিয়া হাযির করিলেন। ইহার পর রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে রুটিগুলি টুকরা টুকরা করা হইল; আর উম্মে সুলাইম ঘি-এর পাত্র হইতে ঘি বাহির করিয়া উহাকে তরকারি হিসাবে পেশ করিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে কিছু পড়িলেন। তারপর বলিলেন, দশজনকে আসিতে বল।তাহাদিগকে আসিতে বলা হইল। তাহারা সকলে খাইয়া পরিতৃপ্ত হইয়া বাহিরে গেলেন। তারপর বলিলেন, আরও দশজনকে আসিতে বল, ইহার পর আরও দশজন, এইভাবে সকলে পরিতৃপ্ত হইয়া খানা খাইলেন। তাহাদের সংখ্যা সত্তর অথবা আশিজন ছিল। মোত্তাঃ
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলিলেন দশজনকে আসিবার জন্য অনুমতি দাও। তাহারা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। অতঃপর তিনি বলিলেন, তোমরা বিসমিল্লাহ্ পড়িয়া খাও। তাহারা খাইলেন এবং এইভাবে (দশ দশজন করিয়া) আশিজন লোক খানা খাইলেন। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও গৃহবাসীরা সকলে খাইলেন এবং কিছু খানা অবশিষ্টও রহিয়া গেল।
বুখারীর অপর এক রেওয়ায়তে আছে তিনি বলিলেন দশজনকে আমার নিকট উপস্থিত কর। এইভাবে (দশ দশজন করিয়া) চল্লিশজনকে গণনা করিলেন। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে খাইলেন। আনাস বলেন, আমি দেখিতে লাগিলাম, খাদ্যের মধ্যে কিছু হ্রাস হইয়াছে কিনা ? মুসলিমের অপর এক রেওয়ায়তে আছে—সকলের খাওয়ার শেষে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) অবশিষ্ট খানাগুলি একত্রিত করিলেন, তারপর উহাতে বরকতের জন্য দো'আ করিলেন। তখন উহা ঐ পরিমাণ হইয়া গেল যেই পরিমাণ আগে ছিল। অতঃপর তিনি বলিলেন, লও, ইহা তোমাদের জন্য।
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলিলেন দশজনকে আসিবার জন্য অনুমতি দাও। তাহারা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। অতঃপর তিনি বলিলেন, তোমরা বিসমিল্লাহ্ পড়িয়া খাও। তাহারা খাইলেন এবং এইভাবে (দশ দশজন করিয়া) আশিজন লোক খানা খাইলেন। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও গৃহবাসীরা সকলে খাইলেন এবং কিছু খানা অবশিষ্টও রহিয়া গেল।
বুখারীর অপর এক রেওয়ায়তে আছে তিনি বলিলেন দশজনকে আমার নিকট উপস্থিত কর। এইভাবে (দশ দশজন করিয়া) চল্লিশজনকে গণনা করিলেন। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে খাইলেন। আনাস বলেন, আমি দেখিতে লাগিলাম, খাদ্যের মধ্যে কিছু হ্রাস হইয়াছে কিনা ? মুসলিমের অপর এক রেওয়ায়তে আছে—সকলের খাওয়ার শেষে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) অবশিষ্ট খানাগুলি একত্রিত করিলেন, তারপর উহাতে বরকতের জন্য দো'আ করিলেন। তখন উহা ঐ পরিমাণ হইয়া গেল যেই পরিমাণ আগে ছিল। অতঃপর তিনি বলিলেন, লও, ইহা তোমাদের জন্য।
كتاب الفضائل والشمائل
وَعَن أنسٍ قَالَ: قَالَ أَبُو طَلْحَةَ لِأُمِّ سُلَيْمٍ لَقَدْ سَمِعْتُ صَوْتَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ضَعِيفًا أَعْرِفُ فِيهِ الْجُوعَ فَهَلْ عِنْدَكِ من شَيْء؟ فَأَخْرَجَتْ أَقْرَاصًا مِنْ شَعِيرٍ ثُمَّ أَخْرَجَتْ خِمَارًا لَهَا فَلَفَّتِ الْخُبْزَ بِبَعْضِهِ ثُمَّ دَسَّتْهُ تَحْتَ يَدِي وَلَاثَتْنِي بِبَعْضِهِ ثُمَّ أَرْسَلَتْنِي إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فَذَهَبْتُ بِهِ فَوَجَدْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ وَمَعَهُ النَّاسُ فَقُمْتُ عَلَيْهِمْ فَقَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَرْسَلَكَ أَبُو طَلْحَةَ؟» قُلْتُ نَعَمْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِمَنْ مَعَهُ قُومُوا فَانْطَلَقَ وَانْطَلَقْتُ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ حَتَّى جِئْت أَبَا طَلْحَة فَقَالَ أَبُو طَلْحَةَ يَا أُمَّ سُلَيْمٍ قَدْ جَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالنَّاسِ وَلَيْسَ عِنْدَنَا مَا نُطْعِمُهُمْ فَقَالَتْ اللَّهُ وَرَسُوله أعلم قَالَ فَانْطَلَقَ أَبُو طَلْحَةَ حَتَّى لَقِيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبُو طَلْحَةَ مَعَهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَلُمِّي يَا أُمَّ سُلَيْمٍ مَا عِنْدَكِ فَأَتَتْ بذلك الْخبز فَأمر بِهِ ففت وعصرت أم سليم عكة لَهَا فأدمته ثمَّ قَالَ فِيهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَقُولَ ثُمَّ قَالَ ائْذَنْ لِعَشَرَةٍ فَأَذِنَ لَهُمْ فَأَكَلُوا حَتَّى شَبِعُوا ثُمَّ خَرَجُوا ثُمَّ قَالَ ائْذَنْ لِعَشَرَةٍ فَأَذِنَ لَهُمْ فَأَكَلُوا حَتَّى شَبِعُوا ثُمَّ خَرَجُوا ثُمَّ قَالَ ائْذَنْ لِعَشَرَةٍ فَأَذِنَ لَهُمْ فَأَكَلُوا حَتَّى شَبِعُوا ثمَّ خَرجُوا ثمَّ أذن لِعَشَرَةٍ فَأَكَلَ الْقَوْمُ كُلُّهُمْ وَشَبِعُوا وَالْقَوْمُ سَبْعُونَ أَوْ ثَمَانُونَ رَجُلًا. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ وَفِي رِوَايَةٍ لمُسلم أَنه قَالَ: «أذن لِعَشَرَةٍ» فَدَخَلُوا فَقَالَ: «كُلُوا وَسَمُّوا اللَّهَ» . فَأَكَلُوا حَتَّى فَعَلَ ذَلِكَ بِثَمَانِينَ رَجُلًا ثُمَّ أَكَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَهْلُ الْبَيْتِ وَتَرَكَ سُؤْرًا وَفِي رِوَايَةٍ لِلْبُخَارِيِّ قَالَ: «أَدْخِلْ عَلَيَّ عَشَرَةً» . حَتَّى عَدَّ أَرْبَعِينَ ثُمَّ أَكَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَجَعَلْتُ أَنْظُرُ هَلْ نَقَصَ مِنْهَا شَيْءٌ؟ وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ: ثُمَّ أَخَذَ مَا بَقِيَ فَجَمَعَهُ ثُمَّ دَعَا فِيهِ با لبركة فَعَاد كَمَا كَانَ فَقَالَ: «دونكم هَذَا»
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এই হাদীসটি বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনাগুলোর মাঝে ঘটনার বিবরণে বাহ্যত বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া কোন কোন বর্ণনা, সংক্ষিপ্ত আবার কোন কোন বর্ণনা বিস্তারিত। নিম্নে সকল বর্ণনার আলোকে ব্যাখ্যা পেশ করা হল।
এ হাদীছে বর্ণিত ঘটনাটি খন্দকের যুদ্ধকালীন। এ যুদ্ধের সময় একটি অস্থায়ী নামাযের স্থান তৈরি করা হয়েছিল। নামাযের সময় হলে সেখানে এসে সকলে নামায পড়তেন। এ সময়েরই ঘটনা যে, হযরত আবু তালহা আনসারী রাযি. সে নামাযের স্থানে প্রবেশ করে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার দিকে তাকালেন, তখন তাঁর চেহারায় ক্ষুধার ছাপ লক্ষ করলেন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তাঁকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন হযরত আনাস রাযি.। তিনি বাড়িতে গিয়ে হযরত আবূ তালহা রাযি.-কে তা অবহিত করেন। কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি.-এর কাছে কোনও সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষুধার্ত অবস্থার সংবাদ পৌঁছেছিল। তবে এসব বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হযরত আনাস রাযি.-এর সূত্রেই হোক বা অন্য কোনও সূত্রে, সংবাদ পেয়েই হযরত আবূ তালহা রাযি. দ্রুত মসজিদে ছুটে আসেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা দেখে নিজেও উপলব্ধি করতে পারেন যে, তিনি খুবই ক্ষুধার্ত। অমনি তিনি বাড়িতে ছুটে গেলেন এবং হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-কে বললেন-
قد سمعت صوت رسول الله ﷺ ضعيفا أعرف فيه الجوع (আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুর্বল কন্ঠস্বর শুনেছি। আমি তাতে ক্ষুধা অনুভব করেছি)। তিনি হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-এর কাছে যদিও দুর্বল কন্ঠস্বরের কথা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর ক্ষুধার্ত অবস্থার কথা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নানাভাবে। এক তো ক্ষুধায় তাঁর কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। এক বর্ণনায় আছে, তখন তিনি সাহাবীদেরকে সূরা নিসা পড়াচ্ছিলেন। দ্বিতীয়ত চেহারায় ক্লান্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল, তৃতীয়ত তখন তাঁর পেটে পাথর বাঁধা ছিল।
হাদীসে আছে, হযরত উম্মে সুলায়ম রাযি, হযরত আনাস রাযি.-কে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু খাবার পাঠিয়েছিলেন। হযরত আনাস রাযি. সে খাবার নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হলে পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করেছিলেন সে সম্পর্কে হযরত আনাস রাযি. বলেন-
فقال لي رسول الله صلى الله صلى الله عليه وسلم: أرسلك أبو طلحة؟ فقلت: نعم! فقال: للطعام؟ فقلت: نعم! فقال رسول الله صلى الله عليه لمن معه: قوموا! فانطلقوا
(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তোমাকে আবু তালহা পাঠিয়েছে? বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, খাবার দিয়ে? বললাম, হাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা ওঠো। তারা (উঠে আমাদের বাড়ির দিকে) চললেন)।
পাঠানো হল খাবার দিয়ে, অথচ তিনি নিজেই চলে আসলেন। এর কারণ কী? অন্য বর্ণনা দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়। তাতে আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি. বলেছিলেন, হে আনাস! তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। তিনি যখন মজলিস থেকে উঠবেন এবং লোকজন তাঁর থেকে সরে যাবে, তখন তুমি তাঁর পেছনে পেছনে চলবে। তিনি নিজ বাড়ির দরজায় পৌঁছলে তাঁকে বলবে যে, আব্বা আপনাকে যেতে বলেছেন।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন, তুমি তাঁকে বলবে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন আমাদের ওখানে গিয়ে খাবেন, তবে তাও করতে পারেন। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর বাড়িতে চলে এসেছেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন-
وانطلقت بين أيديهم حتى جئت أبا طلحة فاخبرته (আমি তাদের আগে আগে চললাম। আবূ তালহার কাছে এসে এ খবর তাকে দিলাম)। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে অনেক লোক আসায় আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। খাবার সামান্য। এত বেশি লোক আসছেন। এখন কী উপায় হবে? এ কারণেই তিনি আগে আগে এসে পিতাকে তাঁদের আগমনের খবর দেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, আমি ভীত-বিহ্বল অবস্থায় উম্মু সুলায়মের কাছে প্রবেশ করলাম। আরেক বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি. তাঁকে বলেছিলেন, হে আনাস! তুমি তো আমাদের অপদস্থ করলে!
বস্তুত হযরত আবূ তালহা রাযি. খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি নিজ ব্যাকুলতার কথা হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-এর কাছে প্রকাশ করলে হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. বললেন الله ورسوله اعلم (আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন)। অর্থাৎ খাবারের পরিমাণ এত অল্প হওয়া সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সঙ্গে অনেক লোক নিয়ে এসেছেন, তখন ধারণা করি তিনি বুঝেশুনেই এটা করেছেন। হয়তো ওহী মারফত তাঁকে জানানো হয়েছে যে, এ খাবারের ভেতর তাঁর মু'জিযা প্রকাশ পাবে। ফলে অল্প খাবারেই এত সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হয়ে যাবে।
এর দ্বারা বোঝা যায় হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. একজন বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন। আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাঁর যথেষ্ট নির্ভরশীলতা ছিল। নবুওয়াতের মর্যাদা ও মহিমা সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন।
তারপর হযরত আবূ তালহা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বের হয়ে পড়লেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন-
فانطلق ابو طلحة حتى لقي رسول الله ﷺ (তারপর আবূ তালহা রাযি. এগিয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মিলিত হলেন)। বোঝা গেল সামনে এগিয়ে গিয়ে অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসা চাই। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আনাসকে পাঠিয়েছিলাম একা আপনাকে নিয়ে আসার জন্য । আমাদের কাছে খাবার আছে সামান্য। যাদের দেখছি তাদের সকলকে তা দ্বারা আপ্যায়ন করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঘরে ঢোক। তোমার কাছে যে খাবার আছে তাতে আল্লাহ তা'আলা বরকত দেবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ঢুকে কতটুকু খাবারের ব্যবস্থা আছে তা জেনে নিলেন। তারপর বললেন-
هلمي ما عندك يا ام سليم (হে উম্মু সুলায়ম! তোমার কাছে যা আছে বের করো)। উম্মু সুলায়ম রাযি, তাঁর তৈরি করা রুটিগুলো নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশে সেগুলো টুকরো টুকরো করা হল। তারপর উম্মু সুলায়ম রাযি, তার উপর একটা কৌটা (থেকে ঘি) ঢেলে দিয়ে তরকারি বানালেন।
এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটুও ঘি আছে কি? উত্তরে আবূ তালহা রাযি. বলেন, একটা কৌটায় কিছুটা ঘি ছিল। তারপর তিনি সেটি নিয়ে আসলেন এবং দু'জনে অনেক ঝেড়েমুছে খানিকটা বের করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করলেন সে সম্পর্কে হযরত আনাস রাযি. সংক্ষেপে বলেন
ثم قال فيه رسول الله ﷺ ما شاء الله أن يقول (তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে আল্লাহ তা'আলার যা ইচ্ছা ছিল তাই বললেন)। এ সংক্ষিপ্ত কথার বিস্তারিত বিবরণ অন্যান্য বর্ণনায় পাওয়া যায়। যেমন এক বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে নিজ শাহাদাত আঙ্গুলে তা লাগালেন। তারপর তা রুটির টুকরোগুলোয় ছোঁয়ালেন। অমনি সেগুলো ফুলে উঠল। তিনি এরকম কয়েকবার করতে থাকলেন। রুটির টুকরোগুলোও ফুলতে থাকল। এমনকি যে ডিশে সেগুলো ছিল তা ভরে উপচে পড়ার উপক্রম করল। অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে সেগুলো আনা হলে তিনি পাত্র খুলে বলেছিলেন-
بسم الله، اللهم أعظم فيها البركة
"আল্লাহর নামে। হে আল্লাহ! আপনি এতে বিপুল বরকত দান করুন।"
অতঃপর হযরত আনাস রাযি বলেন- ثم قال : ائذن لعشرة فأذن لهم (তারপর বললেন, দশজনকে অনুমতি দাও। তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন)। বাহ্যত এর দ্বারা বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাই ঘরে ঢুকেছিলেন, বাকি সকলে বাইরে ছিলেন। এক বর্ণনায় স্পষ্টই তা আছে। তাতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ির দরজায় পৌছে সঙ্গীদের বললেন, তোমরা এখানে বসো। তারপর নিজে প্রবেশ করলেন। দশজন করে প্রবেশ করতে বলা হয়েছিল সম্ভবত ঘর ছোট হওয়ায়। অধিকাংশ বর্ণনায় দশ-দশজন করে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। এক বর্ণনায় আছে আটজন করে। হতে পারে সেটি ভিন্ন ঘটনা। আবার কোনও রাবীর দ্বারা বিভ্রমও ঘটতে পারে।
সে দশজন পরিতৃপ্ত হয়ে খাবার খেলেন। এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুটির টুকরোগুলোর মাঝখানে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, তোমরা বিসমিল্লাহ বলে খাও। তারা চারপাশ থেকে খেতে থাকলেন। এমনকি পরিতৃপ্ত হয়ে গেলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা উঠে যাও এবং তোমাদের স্থানে অপর দশজন আসুক। এভাবে দশ-দশজন করে এসে খেতে থাকলেন। সর্বমোট লোক ছিল সত্তর বা আশিজন। তারপরও সে খাবার আগে যেমন ছিল তেমনি থেকে গেল। তারপর পরিবারের লোকজন খেলেন। তারপর আরও বেঁচে থাকল। তাঁরা তা প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের অভাব-অনটন সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়।
খ. আরও জানা যায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবাযত্নে কেমন আন্তরিক ও তৎপর থাকতেন।
গ. ঘরে সামান্য খাবার থাকলেও তা দ্বারা অভুক্তের ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করা উচিত।
ঘ. ঘরের ছোটদেরকেও মেহমানের সেবাযত্নে অভ্যস্ত করে তোলা উচিত।
ঙ. মেহমানদারিতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক পরামর্শ থাকা বাঞ্ছনীয়। স্ত্রীর উচিত মেহমানদারিতে স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা করা।
চ. গৃহকর্তার উপর পূর্ণ আস্থা থাকলে আমন্ত্রিত ব্যক্তি সঙ্গে অতিরিক্ত লোক নিয়ে আসতে পারে।
ছ. খাবার সাদামাটা বা অল্প পরিমাণ হলে তাতে মেহমানদের অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। বরং আল্লাহর নামে ও দু'আর সঙ্গে তা-ই সন্তুষ্টিভরে গ্রহণ করা চাই।
জ. প্রয়োজনে আমন্ত্রিত ব্যক্তি মেহমানদারির কাজে গৃহকর্তার সহায়তা করবে।
ঝ. বাড়ি থেকে বের হয়ে মেহমানকে সংবর্ধনা দিয়ে আনা চাই।
ঞ. গৃহে স্থান সংকুলান না হলে অতিরিক্ত মেহমান বাইরে অপেক্ষা করতে বিরক্তি বোধ করবে না।
ট. মু'জিযা ও কারামাত সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা চাই।
ঠ. খাদ্যে বরকত হওয়ার বিষয়টি কুরআন-হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
ড. মেহমানদারির পর অবশিষ্ট খাবার সম্ভব হলে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করবে, বিশেষত তার মধ্যে যদি বরকতেরও প্রকাশ ঘটে।
ঢ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-এর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
এ হাদীছে বর্ণিত ঘটনাটি খন্দকের যুদ্ধকালীন। এ যুদ্ধের সময় একটি অস্থায়ী নামাযের স্থান তৈরি করা হয়েছিল। নামাযের সময় হলে সেখানে এসে সকলে নামায পড়তেন। এ সময়েরই ঘটনা যে, হযরত আবু তালহা আনসারী রাযি. সে নামাযের স্থানে প্রবেশ করে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার দিকে তাকালেন, তখন তাঁর চেহারায় ক্ষুধার ছাপ লক্ষ করলেন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তাঁকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন হযরত আনাস রাযি.। তিনি বাড়িতে গিয়ে হযরত আবূ তালহা রাযি.-কে তা অবহিত করেন। কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি.-এর কাছে কোনও সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষুধার্ত অবস্থার সংবাদ পৌঁছেছিল। তবে এসব বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হযরত আনাস রাযি.-এর সূত্রেই হোক বা অন্য কোনও সূত্রে, সংবাদ পেয়েই হযরত আবূ তালহা রাযি. দ্রুত মসজিদে ছুটে আসেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা দেখে নিজেও উপলব্ধি করতে পারেন যে, তিনি খুবই ক্ষুধার্ত। অমনি তিনি বাড়িতে ছুটে গেলেন এবং হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-কে বললেন-
قد سمعت صوت رسول الله ﷺ ضعيفا أعرف فيه الجوع (আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুর্বল কন্ঠস্বর শুনেছি। আমি তাতে ক্ষুধা অনুভব করেছি)। তিনি হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-এর কাছে যদিও দুর্বল কন্ঠস্বরের কথা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর ক্ষুধার্ত অবস্থার কথা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নানাভাবে। এক তো ক্ষুধায় তাঁর কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। এক বর্ণনায় আছে, তখন তিনি সাহাবীদেরকে সূরা নিসা পড়াচ্ছিলেন। দ্বিতীয়ত চেহারায় ক্লান্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল, তৃতীয়ত তখন তাঁর পেটে পাথর বাঁধা ছিল।
হাদীসে আছে, হযরত উম্মে সুলায়ম রাযি, হযরত আনাস রাযি.-কে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু খাবার পাঠিয়েছিলেন। হযরত আনাস রাযি. সে খাবার নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হলে পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করেছিলেন সে সম্পর্কে হযরত আনাস রাযি. বলেন-
فقال لي رسول الله صلى الله صلى الله عليه وسلم: أرسلك أبو طلحة؟ فقلت: نعم! فقال: للطعام؟ فقلت: نعم! فقال رسول الله صلى الله عليه لمن معه: قوموا! فانطلقوا
(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তোমাকে আবু তালহা পাঠিয়েছে? বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, খাবার দিয়ে? বললাম, হাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা ওঠো। তারা (উঠে আমাদের বাড়ির দিকে) চললেন)।
পাঠানো হল খাবার দিয়ে, অথচ তিনি নিজেই চলে আসলেন। এর কারণ কী? অন্য বর্ণনা দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়। তাতে আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি. বলেছিলেন, হে আনাস! তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। তিনি যখন মজলিস থেকে উঠবেন এবং লোকজন তাঁর থেকে সরে যাবে, তখন তুমি তাঁর পেছনে পেছনে চলবে। তিনি নিজ বাড়ির দরজায় পৌঁছলে তাঁকে বলবে যে, আব্বা আপনাকে যেতে বলেছেন।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন, তুমি তাঁকে বলবে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন আমাদের ওখানে গিয়ে খাবেন, তবে তাও করতে পারেন। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর বাড়িতে চলে এসেছেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন-
وانطلقت بين أيديهم حتى جئت أبا طلحة فاخبرته (আমি তাদের আগে আগে চললাম। আবূ তালহার কাছে এসে এ খবর তাকে দিলাম)। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে অনেক লোক আসায় আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। খাবার সামান্য। এত বেশি লোক আসছেন। এখন কী উপায় হবে? এ কারণেই তিনি আগে আগে এসে পিতাকে তাঁদের আগমনের খবর দেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, আমি ভীত-বিহ্বল অবস্থায় উম্মু সুলায়মের কাছে প্রবেশ করলাম। আরেক বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি. তাঁকে বলেছিলেন, হে আনাস! তুমি তো আমাদের অপদস্থ করলে!
বস্তুত হযরত আবূ তালহা রাযি. খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি নিজ ব্যাকুলতার কথা হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-এর কাছে প্রকাশ করলে হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. বললেন الله ورسوله اعلم (আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন)। অর্থাৎ খাবারের পরিমাণ এত অল্প হওয়া সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সঙ্গে অনেক লোক নিয়ে এসেছেন, তখন ধারণা করি তিনি বুঝেশুনেই এটা করেছেন। হয়তো ওহী মারফত তাঁকে জানানো হয়েছে যে, এ খাবারের ভেতর তাঁর মু'জিযা প্রকাশ পাবে। ফলে অল্প খাবারেই এত সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হয়ে যাবে।
এর দ্বারা বোঝা যায় হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. একজন বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন। আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাঁর যথেষ্ট নির্ভরশীলতা ছিল। নবুওয়াতের মর্যাদা ও মহিমা সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন।
তারপর হযরত আবূ তালহা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বের হয়ে পড়লেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন-
فانطلق ابو طلحة حتى لقي رسول الله ﷺ (তারপর আবূ তালহা রাযি. এগিয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মিলিত হলেন)। বোঝা গেল সামনে এগিয়ে গিয়ে অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসা চাই। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ তালহা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আনাসকে পাঠিয়েছিলাম একা আপনাকে নিয়ে আসার জন্য । আমাদের কাছে খাবার আছে সামান্য। যাদের দেখছি তাদের সকলকে তা দ্বারা আপ্যায়ন করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঘরে ঢোক। তোমার কাছে যে খাবার আছে তাতে আল্লাহ তা'আলা বরকত দেবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ঢুকে কতটুকু খাবারের ব্যবস্থা আছে তা জেনে নিলেন। তারপর বললেন-
هلمي ما عندك يا ام سليم (হে উম্মু সুলায়ম! তোমার কাছে যা আছে বের করো)। উম্মু সুলায়ম রাযি, তাঁর তৈরি করা রুটিগুলো নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশে সেগুলো টুকরো টুকরো করা হল। তারপর উম্মু সুলায়ম রাযি, তার উপর একটা কৌটা (থেকে ঘি) ঢেলে দিয়ে তরকারি বানালেন।
এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটুও ঘি আছে কি? উত্তরে আবূ তালহা রাযি. বলেন, একটা কৌটায় কিছুটা ঘি ছিল। তারপর তিনি সেটি নিয়ে আসলেন এবং দু'জনে অনেক ঝেড়েমুছে খানিকটা বের করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করলেন সে সম্পর্কে হযরত আনাস রাযি. সংক্ষেপে বলেন
ثم قال فيه رسول الله ﷺ ما شاء الله أن يقول (তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে আল্লাহ তা'আলার যা ইচ্ছা ছিল তাই বললেন)। এ সংক্ষিপ্ত কথার বিস্তারিত বিবরণ অন্যান্য বর্ণনায় পাওয়া যায়। যেমন এক বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে নিজ শাহাদাত আঙ্গুলে তা লাগালেন। তারপর তা রুটির টুকরোগুলোয় ছোঁয়ালেন। অমনি সেগুলো ফুলে উঠল। তিনি এরকম কয়েকবার করতে থাকলেন। রুটির টুকরোগুলোও ফুলতে থাকল। এমনকি যে ডিশে সেগুলো ছিল তা ভরে উপচে পড়ার উপক্রম করল। অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে সেগুলো আনা হলে তিনি পাত্র খুলে বলেছিলেন-
بسم الله، اللهم أعظم فيها البركة
"আল্লাহর নামে। হে আল্লাহ! আপনি এতে বিপুল বরকত দান করুন।"
অতঃপর হযরত আনাস রাযি বলেন- ثم قال : ائذن لعشرة فأذن لهم (তারপর বললেন, দশজনকে অনুমতি দাও। তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন)। বাহ্যত এর দ্বারা বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাই ঘরে ঢুকেছিলেন, বাকি সকলে বাইরে ছিলেন। এক বর্ণনায় স্পষ্টই তা আছে। তাতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ির দরজায় পৌছে সঙ্গীদের বললেন, তোমরা এখানে বসো। তারপর নিজে প্রবেশ করলেন। দশজন করে প্রবেশ করতে বলা হয়েছিল সম্ভবত ঘর ছোট হওয়ায়। অধিকাংশ বর্ণনায় দশ-দশজন করে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। এক বর্ণনায় আছে আটজন করে। হতে পারে সেটি ভিন্ন ঘটনা। আবার কোনও রাবীর দ্বারা বিভ্রমও ঘটতে পারে।
সে দশজন পরিতৃপ্ত হয়ে খাবার খেলেন। এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুটির টুকরোগুলোর মাঝখানে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, তোমরা বিসমিল্লাহ বলে খাও। তারা চারপাশ থেকে খেতে থাকলেন। এমনকি পরিতৃপ্ত হয়ে গেলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা উঠে যাও এবং তোমাদের স্থানে অপর দশজন আসুক। এভাবে দশ-দশজন করে এসে খেতে থাকলেন। সর্বমোট লোক ছিল সত্তর বা আশিজন। তারপরও সে খাবার আগে যেমন ছিল তেমনি থেকে গেল। তারপর পরিবারের লোকজন খেলেন। তারপর আরও বেঁচে থাকল। তাঁরা তা প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের অভাব-অনটন সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়।
খ. আরও জানা যায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবাযত্নে কেমন আন্তরিক ও তৎপর থাকতেন।
গ. ঘরে সামান্য খাবার থাকলেও তা দ্বারা অভুক্তের ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করা উচিত।
ঘ. ঘরের ছোটদেরকেও মেহমানের সেবাযত্নে অভ্যস্ত করে তোলা উচিত।
ঙ. মেহমানদারিতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক পরামর্শ থাকা বাঞ্ছনীয়। স্ত্রীর উচিত মেহমানদারিতে স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা করা।
চ. গৃহকর্তার উপর পূর্ণ আস্থা থাকলে আমন্ত্রিত ব্যক্তি সঙ্গে অতিরিক্ত লোক নিয়ে আসতে পারে।
ছ. খাবার সাদামাটা বা অল্প পরিমাণ হলে তাতে মেহমানদের অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। বরং আল্লাহর নামে ও দু'আর সঙ্গে তা-ই সন্তুষ্টিভরে গ্রহণ করা চাই।
জ. প্রয়োজনে আমন্ত্রিত ব্যক্তি মেহমানদারির কাজে গৃহকর্তার সহায়তা করবে।
ঝ. বাড়ি থেকে বের হয়ে মেহমানকে সংবর্ধনা দিয়ে আনা চাই।
ঞ. গৃহে স্থান সংকুলান না হলে অতিরিক্ত মেহমান বাইরে অপেক্ষা করতে বিরক্তি বোধ করবে না।
ট. মু'জিযা ও কারামাত সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা চাই।
ঠ. খাদ্যে বরকত হওয়ার বিষয়টি কুরআন-হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
ড. মেহমানদারির পর অবশিষ্ট খাবার সম্ভব হলে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করবে, বিশেষত তার মধ্যে যদি বরকতেরও প্রকাশ ঘটে।
ঢ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.-এর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)