আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৪১৮
২২৪৩. কা‘ব ইবনে মালিকের ঘটনা এবং আল্লাহর বাণী: এবং তিনি ক্ষমা করলেন অপর তিন জনকেও যাদের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল (৯ঃ ১১৮ )
৪০৭৬। ইয়াহয়া ইবনে বুকায়র (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে কা‘ব ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, কা‘ব (রাযিঃ) অন্ধ হয়ে গেলে তাঁর সন্তানদের মধ্যে থেকে যিনি তাঁর সাহায্যকারী ও পথ-প্রদর্শনকারী ছিলেন, তিনি (আব্দুল্লাহ) বলেন, আমি কা‘ব ইবনে মালিক (রাযিঃ)- কে বলতে শুনেছি, যখন তাবুক যুদ্ধ থেকে তিনি পশ্চাতে থেকে যান তখনকার অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যতগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তার মধ্যে তাবুক যুদ্ধ ছাড়া আমি কোন যুদ্ধ থেকে পেছনে থাকিনি। তবে আমি বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করিনি। কিন্তু উক্ত যুদ্ধ থেকে যারা পেছনে পড়ে গেছেন, তাদের কাউকে ভৎর্সনা করা হয়নি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেবল কুরাইশ দলের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। অবশেষে আল্লাহ্ তাআলা তাঁদের এবং তাঁদের শত্রুবাহিনীর মধ্যে অঘোষিত যুদ্ধ সংঘটিত করেন। আর আকাবা রজনীতে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের থেকে ইসলামের উপর অটল থাকার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন, আমি তখন তাঁর সঙ্গে ছিলাম। ফলে বদর প্রান্তরের উপস্থিতিকে আমি প্রিয়তর ও শ্রেষ্ঠতর বলে বিবেচনা করিনি। যদিও আকাবার ঘটনা অপেক্ষা লোকদের মধ্যে বদরের ঘটনা অধিক প্রসিদ্ধ ছিল।
আর আমার অবস্থার বিবরন এই- তাবুক যুদ্ধ থেকে আমি যখন পেছনে থাকি তখন আমি এত অধিক সুস্থ, শক্তিশালী ও সচ্ছল ছিলাম যে আল্লাহর কসম, আমার কাছে কখনো ইতিপূর্বে কোন যুদ্ধে একই সাথে দু’টো যানবাহন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, যা আমি এ যুদ্ধের সময় সংগ্রহ করেছিলাম। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে অভিযান পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করতেন, দৃশ্যত তার বিপরীত ভাব দেখাতেন। এ যুদ্ধ ছিল ভীষণ উত্তাপের সময়, অতি দূরের সফর, বিশাল মরুভূমি এবং অধিক সংখ্যক শত্রুসেনার মুকাবিলা করার। কাজেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযানের অবস্থা মুসলমানদের কাছে প্রকাশ করে দেন যেন তারা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সম্বল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সঙ্গী লোক সংখ্যা ছিল অধিক যাদের হিসাব কোন রেজিষ্ট্রারে লিখিত ছিল না।
কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, যার ফলে যেকোনো লোক যুদ্ধাভিযান থেকে বিরত থাকতে ইচ্ছা করলে তা সহজেই করতে পারত এবং ওহী মারফত এ খবর পরিজ্ঞাত না করা পর্যন্ত তা সংগোপন থাকবে বলে সে ধারণা করত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এমন সময় যখন ফল-ফলাদি পাকার ও গাছের ছায়ায় আরাম উপভোগের সময় ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং এবং তাঁর সঙ্গী মুসলিম বাহিনী অভিযানে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেলেন। আমিও প্রতি সকালে তাঁদের সঙ্গে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। মনে মনে ধারণা করতে থাকি, আমি তো যখন ইচ্ছা যেতে সক্ষম। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আমার সময় কেটে যেতে লাগল। এদিকে অন্য লোকেরা পুরোপুরি প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলল। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তাঁর সাথী মুসলিমগণ রওয়ানা করলেন অথচ আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আমি মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা ঠিক আছে, এক দু’দিনের মধ্যে আমি প্রস্তুত হয়ে পরে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হব।
এভাবে আমি প্রতিদিন বাড়ি হতে প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন করার মানসে বের হই, কিন্তু কিছু না করেই ফিরে আসি। আবার বের হই, আবার কিছু না করে ঘরে ফিরে আসি। ইত্যবসরে বাহিনী অগ্রসর হয়ে অনেক দূর চলে গেল। আর আমি রওয়ানা করে তাদের সাথে পথে মিলে যাবার ইচ্ছা পোষন করতে থাকলাম। আফসোস যদি আমি তাই করতাম! কিন্তু তা আমার ভাগ্যে জোটেনি। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রওয়ানা হওয়ার পর আমি লোকদের মধ্যে বের হয়ে তাদের মাঝে বিচরন করতাম। একথা আমার মনকে পীড়া দিত যে, আমি তখন (মদীনায়) মুনাফিক এবং দুর্বল ও অক্ষম লোক ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাবুক পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আমার কথা আলোচনা করেননি। অনন্তর তাবুকে একথা জনতার মধ্যে উপবিষ্টাবস্থায় জিজ্ঞাসা করে বসলেন, কা‘ব কি করল? বনী সালামা গোত্রের এক লোক বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার ধন-সম্পদ ও আত্মগরিমা তাকে আসতে দেয়নি।
একথা শুনে মুআয ইবনে জাবাল (রাযিঃ) বললেন, তুমি যা বললে তা ঠিক নয়। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম, আমরা তাঁকে উত্তম ব্যক্তি বলে জানি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নীরব রইলেন। কা‘ব ইবনে মালিক (রাযিঃ) বলেন আমি যখন অবগত হলাম যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা মুনাওয়ারার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন, তখন আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম এবং মিথ্যার বাহানা খুঁজতে থাকলাম। মনে স্থির করলাম, আগামীকাল এমন কথা বলব, যাতে করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর ক্রোধকে প্রশমিত করতে পারি। আর এ সম্পর্কে আমার পরিবারস্থ জ্ঞানীগুণীদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে থাকি।
এরপর যখন প্রচারিত হল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় এসে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন আমার অন্তর থেকে মিথ্যা তিরোহিত হয়ে গেল। আর মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো যে, এমন কোন পন্থা অবলম্বন করে আমি তাঁকে কখনো ক্রোধমুক্ত করতে সক্ষম হবো না, যাতে মিথ্যার নামগন্ধ থাকে। অতএব আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম যে, আমি সত্যই বলব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রাতে মদীনায় পদার্পন করলেন। তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দু’রাকআত নামায আদায় করতেন, তারপর লোকদের সামনে বসতেন। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ করলেন, তখন যারা পশ্চাদপদ ছিলেন তারা তাঁর কাছে এসে শপথ করে করে অক্ষমতা ও আপত্তি পেশ করতে লাগল। এরা সংখ্যায় আশির অধিক ছিল। অনন্তর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাহ্যিকভাবে তাদের ওযর-আপত্তি গ্রহণ করলেন, তাদের বায়আত করলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু তাদের অন্তর্নিহিত অবস্থা আল্লাহর হাওয়ালা করে দিলেন।
[কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] আমিও এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। আমি যখন তাঁকে সালাম দিলাম তখন তিনি রাগান্বিত চেহারায় মুচকি হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, এসো। আমি সে অনুসারে অগ্রসর হয়ে একেবারে তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি কারণে তুমি অংশগ্রহণ করলে না? তুমি কি যানবাহন ক্রয় করনি? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, করেছি। আল্লাহর কসম, এ কথা সুনিশ্চিত যে, আমি যদি আপনি ছাড়া অন্য কোন দুনিয়াদার ব্যক্তির সামনে বসতাম তাহলে আমি তাঁর অসন্তুষ্টিকে ওযর-আপত্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রশমিত করার প্রয়াস চালাতাম। আর আমি তর্কে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি পরিজ্ঞাত যে, আজ যদি আমি আপনার কাছে মিথ্যা বলে আমার প্রতি আপনাকে রাযী করার চেষ্টা করি, তাহলেই অচিরেই মহান আল্লাহ্ তাআলা আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দিতে পারেন। আর যদি আপনার কাছে সত্য প্রকাশ করি, যাতে আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তবুও আমি এতে মহান আল্লাহ্ তাআলার ক্ষমা পাওয়ার নির্ঘাত আশা রাখি। না, আল্লাহর কসম, আমার কোন ওযর ছিল না।
আল্লাহর কসম, সেই অভিযানে আপনার সাথে না যাওয়াকালীন সময় আমি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সে সত্য কথাই বলেছে। তুমি এখন চলে যাও, যতদিন না তোমার সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা ফায়সালা করে দেন। তাই আমি উঠে চলে গেলাম। তখন বনী সালিমার কতিপয় লোক আমার অনুসরণ করল। তারা আমাকে বলল, আল্লাহর কসম, তুমি ইতিপূর্বে কোন গুনাহ্ করেছ বলে আমাদের জানা নেই। তুমি কি অন্যান্য পশ্চাদগামীর মতো তোমার অক্ষমতার একটি ওযর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে পেশ করে দিতে পারতে না? আর তোমার এ অপরাধের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাই তো যথেষ্ট ছিল। আল্লাহর কসম, তারা আমাকে অনবরত কঠিনভাবে ভৎর্সনা করতে থাকে। ফলে আমি পূর্ব স্বীকারোক্তি থেকে প্রত্যাবর্তন করে মিথ্যা বলার বিষয়ে মনে মনে চিন্তা করতে থাকি।
এরপর আমি তাদের বললাম, আমার মতো এ কাজ আর কেউ করেছে কি? তারা জওয়াব দিল, হ্যাঁ, আরও দু’জন তোমার মতো বলেছে। এবং তাদের ক্ষেত্রেও তোমার মতো একই রূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কে কে? তারা বললো, একজন মুরারা ইবনে রবী আমরী এবং অপরজন হলেন হিলাল ইবনে উমাইয়া ওয়াকিফী। এরপর তারা আমাকে অবহিত করল যে, তারা উভয়ে উত্তম মানুষ এবং তারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সেজন্য উভয়ে আদর্শবান। যখন তারা তাদের নাম উল্লেখ করল, তখন আমি পূর্ব মতের উপর অটল রইলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের মধ্যকার যে তিনজন তাবুকে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল তাদের সাথে কথা বলতে মুসলমানদের নিষেধ করে দিলেন। তদনুসারে মুসলমানরা আমাদের পরিহার করে চললো। আমাদের প্রতি তাদের আচরণ পরিবর্তন করে নিল। এমনকি এদেশ যেন আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল। এ অবস্থায় আমরা পঞ্চাশ রাত অতিবাহিত করলাম।
আমার অপর দু’জন সাথী তো সংকট ও শোচনীয় অবস্থায় নিপতিত হলেন। তারা নিজেদের ঘরে বসে কাঁদতে থাকেন। আর আমি যেহেতু অধিকতর যুবক ও শক্তিশালী ছিলাম তাই বাইরে বের হয়ে আসতাম, মুসলমানদের জামাআতে নামায আদায় করতাম। এবং বাজারে চলাফেরা করতাম কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর খেদমতে হাযির হয়ে তাঁকে সালাম দিতাম। যখন তিনি নামায শেষে মজলিসে বসতেন তখন আমি মনে মনে বলতাম ও লক্ষ করতাম, তিনি আমার সালামের জবাবে তাঁর ঠোঁটদ্বয় নেড়েছেন কিনা? তারপর আমি তাঁর নিকটবর্তী স্থানে নামায আদায় করতাম এবং গোপন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে দেখতাম যে, আমি যখন নামায মগ্ন হতাম তখন তিনি আমার প্রতি দৃষ্টি দিতেন, আর যখন আমি তাঁর দিকে তাকাতাম তখন তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে আমার প্রতি লোকদের কঠোরতা ও এড়িয়ে চলার আচরণ দীর্ঘকাল ধরে বিরাজমান থাকে।
একদা আমি আমার চাচাত ভাই ও প্রিয় বন্ধু আবু কাতাদা (রাযিঃ)- এর বাগানের প্রাচীর টপকে প্রবেশ করে তাঁকে সালাম দেই। কিন্তু আল্লাহর কসম, তিনি আমার সালামের জওয়াব দিলেন না। আমি তখন বললাম, হে আবু কাতাদা, আপনাকে আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি জানেন যে, আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি? তখন তিনি নীরবতা পালন করলেন। আমি পূনরায় তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি এবারও কোন জবাব দিলেন না। আমি পূনঃ (তৃতীয়বারও) তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন আমার চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। অগত্যা আমি পূনরায় প্রাচীর টপকে ফিরে এলাম।
কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, একদা আমি মদীনার বাজারে বিচরন করছিলাম। এমতাবস্থায় সিরিয়ার এক কৃষক বণিক যে মদীনার বাজারে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করার উদ্দেশ্যে এসেছিল, সে বলছে, আমাকে কা‘ব ইবনে মালিককে কেউ পরিচয় করিয়ে দিতে পারে কি? তখন লোকেরা তাকে আমার প্রতি ইশারায় দেখাচ্ছিল। তখন সে এসে গাসসানি বাদশার একটি পত্র আমার কাছে হস্তান্তর করল। তাতে লেখা ছিল, পর সমাচার এই, আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সাথী আপনার প্রতি যুলুম করেছে। আর আল্লাহ্ আপনাকে মর্যাদাহীন ও আশ্রয়হীন করে সৃষ্টি করেননি। আপনি আমাদের দেশে চলে আসুন, আমরা আপনাকে সাহায্য-সহানুভূতি করব। আমি যখন এ পত্র পড়লাম, তখন আমি বললাম, এটাও আর একটি পরীক্ষা। তখন আমি চুলা খোঁজ করে তার মধ্যে পত্রটি নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিলাম। এ সময় পঞ্চাশ দিনের চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে।
এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর পক্ষ থেকে এক সংবাদবাহক আমার কাছে এসে বলল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি আপনার স্ত্রী হতে পৃথক থাকবেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি তাকে তালাক দিয়ে দিব, না অন্য কিছু করব? তিনি উত্তর দিলেন, তালাক দিতে হবে না বরং তার থেকে পৃথক থাকুন এবং তার নিকটবর্তী হবেন না। আমার অপর দু’জন সঙ্গীর প্রতি একই আদেশ পৌঁছালেন। তখন আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার পিত্রালয়ে চলে যাও। আমার এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত তুমি তথায় অবস্থান কর। কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, আমার সঙ্গী হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হিলাল ইবনে উমাইয়া অতি বৃদ্ধ, এমন বৃদ্ধ যে, তাঁর কোন খাদিম নেই। আমি তাঁর খেদমত করি, এটা কি অপছন্দ করেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, না তবে সে তোমার বিছানায় আসতে পারবে না। সে বলল, আল্লাহর কসম, এ সম্পর্কে তার কোন অনুভূতিই নেই। আল্লাহর কসম, তিনি এ নির্দেশ পাওয়া অবধি সর্বদা কান্নাকাটি করেছেন।
[কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] আমার পরিবারের কেউ আমাকে পরামর্শ দিল যে, আপনিও যদি আপনার স্ত্রী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে অনুমতি চাইতেন, যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রীকে তাঁর (স্বামীর) খেদমত করার অনুমতি দিয়েছেন। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি কখনো তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে অনুমতি চাইবো না। আমি যদি তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)- এর অনুমতি চাই, তবে তিনি কি বলবেন, তা আমার জানা নেই। আমি তো নিজেই আমার খেদমতে সক্ষম। এরপর আরও দশরাত অতিবাহিত করলাম। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন থেকে আমাদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করেন তখন থেকে পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হল।
এরপর আমি পঞ্চাশতম রাত শেষে ফজরের নামায আদায় করলাম এবং আমাদের এক ঘরের ছাদে এমন অবস্থায় বসে ছিলাম যা আল্লাহ্ তাআলা (কুরআনে) বর্ণনা করেছেন। আমার জান-প্রাণ দুর্বিষহ এবং গোটা জগতটা যেন আমার জন্য প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও সংকীর্ন হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় শুনতে পেলাম এক চিৎকারকারীর চিৎকার। সে সালা পাহাড়ের উপর চড়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করছে, হে কা‘ব ইবনে মালিক! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, এ শব্দ আমার কানে পৌঁছামাত্র আমি সিজদায় লুটে পড়লাম। আর আমি অনুভব করলাম যে, আমার সুদিন ও খুশীর খবর এসেছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফজরের নামায আদায়ের পর আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ হতে আমাদের তাওবা কবুল হওয়ার সুসংবাদ প্রকাশ করেন।
তখন লোকেরা আমার এবং আমার সঙ্গীদ্বয়ের কাছে সুসংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। এবং তড়িঘড়ি একজন অশ্বারোহী লোক আমার কাছে আসে এবং আসলাম গোত্রের অপর এক ব্যক্তি দ্রুত আগমন করে পাহাড়ের উপর আরোহণ করত চিৎকার দিতে থাকে। তার চিৎকারের শব্দ ঘোড়া অপেক্ষাও দ্রুত পৌঁছল। যার শব্দ আমি শুনেছিলাম সে যখন আমার কাছে সুসংবাদ প্রদান করতে আসল, আমি তখন আমার নিজের পরিধেয় দুটো কাপড় তাকে সুসংবাদ দেয়ার জন্য দান করলাম। আর আমি আল্লাহর কসম করে বলছি যে, ঐ সময় সেই দুটো কাপড় ছাড়া আমার কাছে আর কোন কাপড় ছিলো না। আমি দুটো কাপড় ধার করে পরিধান করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে রওয়ানা হলাম। লোকেরা দলে দলে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে আসতে লাগল। তারা তাওবা কবুলের মুবারকবাদ জানাচ্ছিল। তারা বলছিল, তোমাকে মুবারকবাদ যে মহান আল্লাহ্ রাববুল আলামিন তোমার তাওবা কবুল করেছেন।
কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, অবশেষে আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে বসা ছিলেন এবং তাঁর চতুষ্পার্শ্বে জনতার সমাবেশ ছিল। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রাযিঃ) দ্রুত উঠে এসে আমার সাথে মুসাফাহা করলেন ও মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম, তিনি ব্যতীত আর কোন মুহাজির আমার জন্য দাঁড়াননি। আমি তালহার ব্যবহার ভুলতে পারব না। কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, এরপর আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে সালাম জানালাম, তখন তাঁর চেহারা আনন্দের আতিশয্যে ঝকঝক করছিল। তিনি আমাকে বললেন, তোমার মাতা তোমাকে জন্মদানের দিন হতে যতদিন তোমার উপর অতিবাহিত হয়েছে তার মধ্যে উৎকৃষ্ট ও উত্তম দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর।
কা‘ব বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, আমার পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন খুশী হতেন তখন তাঁর চেহারা মুবারক এতো উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল হতো যেন পূর্ণিমার চাঁদের ফালি। এতে আমরা তাঁর সন্তুষ্টি বুঝতে পারতাম। আমি যখন তাঁর সম্মুখে বসলাম তখন আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার তাওবা কবুলের শুকরিয়া স্বরূপ আমার ধন-সম্পদ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পথে দান করতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার কিছু মাল তোমার কাছে রেখে দাও। তা তোমার জন্য উত্তম। আমি বললাম, খায়বারে অবস্থিত আমার অংশটি আমার জন্য রাখলাম।
আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মহান আল্লাহ্ তাআলা সত্য বলার কারণে আমাকে রক্ষা করেছেন, তাই আমার তাওবা কবুলের নিদর্শন অক্ষুণ্ণ রাখতে আমার অবশিষ্ট জীবনে সত্যই বলব। আল্লাহর কসম! যখন থেকে আমি এ সত্য বলার কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে জানিয়েছি, তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার জানামতে কোন মুসলিমকে সত্য কথার বিনিময়ে এরূপ নিআমত আল্লাহ্ দান করেননি যে নিআমত আমাকে দান করেছেন। [কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] যেদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সম্মুখে সত্য কথা বলেছি সেদিন হতে আজ পর্যন্ত অন্তরে মিথ্যা বলার ইচ্ছাও করিনি। আমি আশা পোষন করি যে, বাকী জীবনও আল্লাহ্ তাআলা আমাকে মিথ্যা থেকে হিফাজত করবেন।
এরপর আল্লাহ্ তাআলা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর উপর এই আয়াত নাযিল করেন (لَقَدْ تَابَ اللَّهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ) অর্থাৎ আল্লাহ্ অনুগ্রহ পরায়ন হলেন রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)- এর প্রতি এবং মুহাজিরদের প্রতি এবং তোমরা সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও। (৯ঃ ১১৭-১১৯)।
[কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] আল্লাহর শপথ, ইসলাম গ্রহণের পর থেকে কখনো আমার উপর এতো উৎকৃষ্ট নিআমত আল্লাহ্ প্রদান করেননি যা আমার কাছে শ্রেষ্ঠতর, তা হল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে আমার সত্য বলা ও তাঁর সাথে মিথ্যা না বলা, যদি মিথ্যা বলতাম তবে মিথ্যাবাদীদের মতো আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম। সেই মিথ্যাবাদিদের সম্পর্কে যখন ওহী নাযিল হয়েছে তখন জঘন্য অন্তরের সেই লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ
( سَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ إِذَا انْقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ .... فَإِنَّ اللَّهَ لاَ يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ)
অর্থাৎ, তোমরা তাদের নিকট ফিরে আসলে তারা আল্লাহর শপথ করবে আল্লাহ্ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের প্রতি তুষ্ট হবেন না। (৯ঃ ৯৫-৯৬)।
কা‘ব (রাযিঃ) বলে, আমাদের তিনজনের তাওবা কবুল করতে বিলম্ব করা হয়েছে--- যাদের তাওবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কবুল করেছেন যখন তারা তাঁর কাছে শপথ করেছে, তিনি তাদের বায়আত গ্রহণ করেছেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আমাদের বিষয়টি আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্থগিত রেখেছেন। এর প্রেক্ষাপটে আল্লাহ্ বলেন--- সেই তিনজনের প্রতিও যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। (৯ঃ ১১৮) কুরআনের এই আয়াতে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি যারা তাবুক যুদ্ধ থেকে পিছনে ছিল ও মিথ্যা কসম করে ওযর-আপত্তি পেশ করেছিল এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তা গ্রহণ করেছিলেন। বরং এই আয়াতে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে আমরা যারা পেছনে ছিলাম এবং যাদের প্রতি সিদ্ধান্ত দেয়া স্থগিত রাখা হয়েছিল।
আর আমার অবস্থার বিবরন এই- তাবুক যুদ্ধ থেকে আমি যখন পেছনে থাকি তখন আমি এত অধিক সুস্থ, শক্তিশালী ও সচ্ছল ছিলাম যে আল্লাহর কসম, আমার কাছে কখনো ইতিপূর্বে কোন যুদ্ধে একই সাথে দু’টো যানবাহন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, যা আমি এ যুদ্ধের সময় সংগ্রহ করেছিলাম। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে অভিযান পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করতেন, দৃশ্যত তার বিপরীত ভাব দেখাতেন। এ যুদ্ধ ছিল ভীষণ উত্তাপের সময়, অতি দূরের সফর, বিশাল মরুভূমি এবং অধিক সংখ্যক শত্রুসেনার মুকাবিলা করার। কাজেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযানের অবস্থা মুসলমানদের কাছে প্রকাশ করে দেন যেন তারা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সম্বল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সঙ্গী লোক সংখ্যা ছিল অধিক যাদের হিসাব কোন রেজিষ্ট্রারে লিখিত ছিল না।
কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, যার ফলে যেকোনো লোক যুদ্ধাভিযান থেকে বিরত থাকতে ইচ্ছা করলে তা সহজেই করতে পারত এবং ওহী মারফত এ খবর পরিজ্ঞাত না করা পর্যন্ত তা সংগোপন থাকবে বলে সে ধারণা করত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এমন সময় যখন ফল-ফলাদি পাকার ও গাছের ছায়ায় আরাম উপভোগের সময় ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং এবং তাঁর সঙ্গী মুসলিম বাহিনী অভিযানে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেলেন। আমিও প্রতি সকালে তাঁদের সঙ্গে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। মনে মনে ধারণা করতে থাকি, আমি তো যখন ইচ্ছা যেতে সক্ষম। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আমার সময় কেটে যেতে লাগল। এদিকে অন্য লোকেরা পুরোপুরি প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলল। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তাঁর সাথী মুসলিমগণ রওয়ানা করলেন অথচ আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আমি মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা ঠিক আছে, এক দু’দিনের মধ্যে আমি প্রস্তুত হয়ে পরে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হব।
এভাবে আমি প্রতিদিন বাড়ি হতে প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন করার মানসে বের হই, কিন্তু কিছু না করেই ফিরে আসি। আবার বের হই, আবার কিছু না করে ঘরে ফিরে আসি। ইত্যবসরে বাহিনী অগ্রসর হয়ে অনেক দূর চলে গেল। আর আমি রওয়ানা করে তাদের সাথে পথে মিলে যাবার ইচ্ছা পোষন করতে থাকলাম। আফসোস যদি আমি তাই করতাম! কিন্তু তা আমার ভাগ্যে জোটেনি। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রওয়ানা হওয়ার পর আমি লোকদের মধ্যে বের হয়ে তাদের মাঝে বিচরন করতাম। একথা আমার মনকে পীড়া দিত যে, আমি তখন (মদীনায়) মুনাফিক এবং দুর্বল ও অক্ষম লোক ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাবুক পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আমার কথা আলোচনা করেননি। অনন্তর তাবুকে একথা জনতার মধ্যে উপবিষ্টাবস্থায় জিজ্ঞাসা করে বসলেন, কা‘ব কি করল? বনী সালামা গোত্রের এক লোক বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার ধন-সম্পদ ও আত্মগরিমা তাকে আসতে দেয়নি।
একথা শুনে মুআয ইবনে জাবাল (রাযিঃ) বললেন, তুমি যা বললে তা ঠিক নয়। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম, আমরা তাঁকে উত্তম ব্যক্তি বলে জানি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নীরব রইলেন। কা‘ব ইবনে মালিক (রাযিঃ) বলেন আমি যখন অবগত হলাম যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা মুনাওয়ারার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন, তখন আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম এবং মিথ্যার বাহানা খুঁজতে থাকলাম। মনে স্থির করলাম, আগামীকাল এমন কথা বলব, যাতে করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর ক্রোধকে প্রশমিত করতে পারি। আর এ সম্পর্কে আমার পরিবারস্থ জ্ঞানীগুণীদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে থাকি।
এরপর যখন প্রচারিত হল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় এসে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন আমার অন্তর থেকে মিথ্যা তিরোহিত হয়ে গেল। আর মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো যে, এমন কোন পন্থা অবলম্বন করে আমি তাঁকে কখনো ক্রোধমুক্ত করতে সক্ষম হবো না, যাতে মিথ্যার নামগন্ধ থাকে। অতএব আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম যে, আমি সত্যই বলব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রাতে মদীনায় পদার্পন করলেন। তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দু’রাকআত নামায আদায় করতেন, তারপর লোকদের সামনে বসতেন। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ করলেন, তখন যারা পশ্চাদপদ ছিলেন তারা তাঁর কাছে এসে শপথ করে করে অক্ষমতা ও আপত্তি পেশ করতে লাগল। এরা সংখ্যায় আশির অধিক ছিল। অনন্তর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাহ্যিকভাবে তাদের ওযর-আপত্তি গ্রহণ করলেন, তাদের বায়আত করলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু তাদের অন্তর্নিহিত অবস্থা আল্লাহর হাওয়ালা করে দিলেন।
[কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] আমিও এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। আমি যখন তাঁকে সালাম দিলাম তখন তিনি রাগান্বিত চেহারায় মুচকি হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, এসো। আমি সে অনুসারে অগ্রসর হয়ে একেবারে তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি কারণে তুমি অংশগ্রহণ করলে না? তুমি কি যানবাহন ক্রয় করনি? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, করেছি। আল্লাহর কসম, এ কথা সুনিশ্চিত যে, আমি যদি আপনি ছাড়া অন্য কোন দুনিয়াদার ব্যক্তির সামনে বসতাম তাহলে আমি তাঁর অসন্তুষ্টিকে ওযর-আপত্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রশমিত করার প্রয়াস চালাতাম। আর আমি তর্কে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি পরিজ্ঞাত যে, আজ যদি আমি আপনার কাছে মিথ্যা বলে আমার প্রতি আপনাকে রাযী করার চেষ্টা করি, তাহলেই অচিরেই মহান আল্লাহ্ তাআলা আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দিতে পারেন। আর যদি আপনার কাছে সত্য প্রকাশ করি, যাতে আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তবুও আমি এতে মহান আল্লাহ্ তাআলার ক্ষমা পাওয়ার নির্ঘাত আশা রাখি। না, আল্লাহর কসম, আমার কোন ওযর ছিল না।
আল্লাহর কসম, সেই অভিযানে আপনার সাথে না যাওয়াকালীন সময় আমি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সে সত্য কথাই বলেছে। তুমি এখন চলে যাও, যতদিন না তোমার সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা ফায়সালা করে দেন। তাই আমি উঠে চলে গেলাম। তখন বনী সালিমার কতিপয় লোক আমার অনুসরণ করল। তারা আমাকে বলল, আল্লাহর কসম, তুমি ইতিপূর্বে কোন গুনাহ্ করেছ বলে আমাদের জানা নেই। তুমি কি অন্যান্য পশ্চাদগামীর মতো তোমার অক্ষমতার একটি ওযর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে পেশ করে দিতে পারতে না? আর তোমার এ অপরাধের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাই তো যথেষ্ট ছিল। আল্লাহর কসম, তারা আমাকে অনবরত কঠিনভাবে ভৎর্সনা করতে থাকে। ফলে আমি পূর্ব স্বীকারোক্তি থেকে প্রত্যাবর্তন করে মিথ্যা বলার বিষয়ে মনে মনে চিন্তা করতে থাকি।
এরপর আমি তাদের বললাম, আমার মতো এ কাজ আর কেউ করেছে কি? তারা জওয়াব দিল, হ্যাঁ, আরও দু’জন তোমার মতো বলেছে। এবং তাদের ক্ষেত্রেও তোমার মতো একই রূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কে কে? তারা বললো, একজন মুরারা ইবনে রবী আমরী এবং অপরজন হলেন হিলাল ইবনে উমাইয়া ওয়াকিফী। এরপর তারা আমাকে অবহিত করল যে, তারা উভয়ে উত্তম মানুষ এবং তারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সেজন্য উভয়ে আদর্শবান। যখন তারা তাদের নাম উল্লেখ করল, তখন আমি পূর্ব মতের উপর অটল রইলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের মধ্যকার যে তিনজন তাবুকে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল তাদের সাথে কথা বলতে মুসলমানদের নিষেধ করে দিলেন। তদনুসারে মুসলমানরা আমাদের পরিহার করে চললো। আমাদের প্রতি তাদের আচরণ পরিবর্তন করে নিল। এমনকি এদেশ যেন আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল। এ অবস্থায় আমরা পঞ্চাশ রাত অতিবাহিত করলাম।
আমার অপর দু’জন সাথী তো সংকট ও শোচনীয় অবস্থায় নিপতিত হলেন। তারা নিজেদের ঘরে বসে কাঁদতে থাকেন। আর আমি যেহেতু অধিকতর যুবক ও শক্তিশালী ছিলাম তাই বাইরে বের হয়ে আসতাম, মুসলমানদের জামাআতে নামায আদায় করতাম। এবং বাজারে চলাফেরা করতাম কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর খেদমতে হাযির হয়ে তাঁকে সালাম দিতাম। যখন তিনি নামায শেষে মজলিসে বসতেন তখন আমি মনে মনে বলতাম ও লক্ষ করতাম, তিনি আমার সালামের জবাবে তাঁর ঠোঁটদ্বয় নেড়েছেন কিনা? তারপর আমি তাঁর নিকটবর্তী স্থানে নামায আদায় করতাম এবং গোপন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে দেখতাম যে, আমি যখন নামায মগ্ন হতাম তখন তিনি আমার প্রতি দৃষ্টি দিতেন, আর যখন আমি তাঁর দিকে তাকাতাম তখন তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে আমার প্রতি লোকদের কঠোরতা ও এড়িয়ে চলার আচরণ দীর্ঘকাল ধরে বিরাজমান থাকে।
একদা আমি আমার চাচাত ভাই ও প্রিয় বন্ধু আবু কাতাদা (রাযিঃ)- এর বাগানের প্রাচীর টপকে প্রবেশ করে তাঁকে সালাম দেই। কিন্তু আল্লাহর কসম, তিনি আমার সালামের জওয়াব দিলেন না। আমি তখন বললাম, হে আবু কাতাদা, আপনাকে আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি জানেন যে, আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি? তখন তিনি নীরবতা পালন করলেন। আমি পূনরায় তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি এবারও কোন জবাব দিলেন না। আমি পূনঃ (তৃতীয়বারও) তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন আমার চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। অগত্যা আমি পূনরায় প্রাচীর টপকে ফিরে এলাম।
কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, একদা আমি মদীনার বাজারে বিচরন করছিলাম। এমতাবস্থায় সিরিয়ার এক কৃষক বণিক যে মদীনার বাজারে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করার উদ্দেশ্যে এসেছিল, সে বলছে, আমাকে কা‘ব ইবনে মালিককে কেউ পরিচয় করিয়ে দিতে পারে কি? তখন লোকেরা তাকে আমার প্রতি ইশারায় দেখাচ্ছিল। তখন সে এসে গাসসানি বাদশার একটি পত্র আমার কাছে হস্তান্তর করল। তাতে লেখা ছিল, পর সমাচার এই, আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সাথী আপনার প্রতি যুলুম করেছে। আর আল্লাহ্ আপনাকে মর্যাদাহীন ও আশ্রয়হীন করে সৃষ্টি করেননি। আপনি আমাদের দেশে চলে আসুন, আমরা আপনাকে সাহায্য-সহানুভূতি করব। আমি যখন এ পত্র পড়লাম, তখন আমি বললাম, এটাও আর একটি পরীক্ষা। তখন আমি চুলা খোঁজ করে তার মধ্যে পত্রটি নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিলাম। এ সময় পঞ্চাশ দিনের চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে।
এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর পক্ষ থেকে এক সংবাদবাহক আমার কাছে এসে বলল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি আপনার স্ত্রী হতে পৃথক থাকবেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি তাকে তালাক দিয়ে দিব, না অন্য কিছু করব? তিনি উত্তর দিলেন, তালাক দিতে হবে না বরং তার থেকে পৃথক থাকুন এবং তার নিকটবর্তী হবেন না। আমার অপর দু’জন সঙ্গীর প্রতি একই আদেশ পৌঁছালেন। তখন আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার পিত্রালয়ে চলে যাও। আমার এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত তুমি তথায় অবস্থান কর। কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, আমার সঙ্গী হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হিলাল ইবনে উমাইয়া অতি বৃদ্ধ, এমন বৃদ্ধ যে, তাঁর কোন খাদিম নেই। আমি তাঁর খেদমত করি, এটা কি অপছন্দ করেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, না তবে সে তোমার বিছানায় আসতে পারবে না। সে বলল, আল্লাহর কসম, এ সম্পর্কে তার কোন অনুভূতিই নেই। আল্লাহর কসম, তিনি এ নির্দেশ পাওয়া অবধি সর্বদা কান্নাকাটি করেছেন।
[কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] আমার পরিবারের কেউ আমাকে পরামর্শ দিল যে, আপনিও যদি আপনার স্ত্রী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে অনুমতি চাইতেন, যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রীকে তাঁর (স্বামীর) খেদমত করার অনুমতি দিয়েছেন। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি কখনো তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে অনুমতি চাইবো না। আমি যদি তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)- এর অনুমতি চাই, তবে তিনি কি বলবেন, তা আমার জানা নেই। আমি তো নিজেই আমার খেদমতে সক্ষম। এরপর আরও দশরাত অতিবাহিত করলাম। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন থেকে আমাদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করেন তখন থেকে পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হল।
এরপর আমি পঞ্চাশতম রাত শেষে ফজরের নামায আদায় করলাম এবং আমাদের এক ঘরের ছাদে এমন অবস্থায় বসে ছিলাম যা আল্লাহ্ তাআলা (কুরআনে) বর্ণনা করেছেন। আমার জান-প্রাণ দুর্বিষহ এবং গোটা জগতটা যেন আমার জন্য প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও সংকীর্ন হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় শুনতে পেলাম এক চিৎকারকারীর চিৎকার। সে সালা পাহাড়ের উপর চড়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করছে, হে কা‘ব ইবনে মালিক! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, এ শব্দ আমার কানে পৌঁছামাত্র আমি সিজদায় লুটে পড়লাম। আর আমি অনুভব করলাম যে, আমার সুদিন ও খুশীর খবর এসেছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফজরের নামায আদায়ের পর আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ হতে আমাদের তাওবা কবুল হওয়ার সুসংবাদ প্রকাশ করেন।
তখন লোকেরা আমার এবং আমার সঙ্গীদ্বয়ের কাছে সুসংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। এবং তড়িঘড়ি একজন অশ্বারোহী লোক আমার কাছে আসে এবং আসলাম গোত্রের অপর এক ব্যক্তি দ্রুত আগমন করে পাহাড়ের উপর আরোহণ করত চিৎকার দিতে থাকে। তার চিৎকারের শব্দ ঘোড়া অপেক্ষাও দ্রুত পৌঁছল। যার শব্দ আমি শুনেছিলাম সে যখন আমার কাছে সুসংবাদ প্রদান করতে আসল, আমি তখন আমার নিজের পরিধেয় দুটো কাপড় তাকে সুসংবাদ দেয়ার জন্য দান করলাম। আর আমি আল্লাহর কসম করে বলছি যে, ঐ সময় সেই দুটো কাপড় ছাড়া আমার কাছে আর কোন কাপড় ছিলো না। আমি দুটো কাপড় ধার করে পরিধান করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে রওয়ানা হলাম। লোকেরা দলে দলে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে আসতে লাগল। তারা তাওবা কবুলের মুবারকবাদ জানাচ্ছিল। তারা বলছিল, তোমাকে মুবারকবাদ যে মহান আল্লাহ্ রাববুল আলামিন তোমার তাওবা কবুল করেছেন।
কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, অবশেষে আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে বসা ছিলেন এবং তাঁর চতুষ্পার্শ্বে জনতার সমাবেশ ছিল। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রাযিঃ) দ্রুত উঠে এসে আমার সাথে মুসাফাহা করলেন ও মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম, তিনি ব্যতীত আর কোন মুহাজির আমার জন্য দাঁড়াননি। আমি তালহার ব্যবহার ভুলতে পারব না। কা‘ব (রাযিঃ) বলেন, এরপর আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে সালাম জানালাম, তখন তাঁর চেহারা আনন্দের আতিশয্যে ঝকঝক করছিল। তিনি আমাকে বললেন, তোমার মাতা তোমাকে জন্মদানের দিন হতে যতদিন তোমার উপর অতিবাহিত হয়েছে তার মধ্যে উৎকৃষ্ট ও উত্তম দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর।
কা‘ব বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, আমার পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন খুশী হতেন তখন তাঁর চেহারা মুবারক এতো উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল হতো যেন পূর্ণিমার চাঁদের ফালি। এতে আমরা তাঁর সন্তুষ্টি বুঝতে পারতাম। আমি যখন তাঁর সম্মুখে বসলাম তখন আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার তাওবা কবুলের শুকরিয়া স্বরূপ আমার ধন-সম্পদ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পথে দান করতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার কিছু মাল তোমার কাছে রেখে দাও। তা তোমার জন্য উত্তম। আমি বললাম, খায়বারে অবস্থিত আমার অংশটি আমার জন্য রাখলাম।
আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মহান আল্লাহ্ তাআলা সত্য বলার কারণে আমাকে রক্ষা করেছেন, তাই আমার তাওবা কবুলের নিদর্শন অক্ষুণ্ণ রাখতে আমার অবশিষ্ট জীবনে সত্যই বলব। আল্লাহর কসম! যখন থেকে আমি এ সত্য বলার কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে জানিয়েছি, তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার জানামতে কোন মুসলিমকে সত্য কথার বিনিময়ে এরূপ নিআমত আল্লাহ্ দান করেননি যে নিআমত আমাকে দান করেছেন। [কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] যেদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সম্মুখে সত্য কথা বলেছি সেদিন হতে আজ পর্যন্ত অন্তরে মিথ্যা বলার ইচ্ছাও করিনি। আমি আশা পোষন করি যে, বাকী জীবনও আল্লাহ্ তাআলা আমাকে মিথ্যা থেকে হিফাজত করবেন।
এরপর আল্লাহ্ তাআলা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর উপর এই আয়াত নাযিল করেন (لَقَدْ تَابَ اللَّهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ) অর্থাৎ আল্লাহ্ অনুগ্রহ পরায়ন হলেন রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)- এর প্রতি এবং মুহাজিরদের প্রতি এবং তোমরা সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও। (৯ঃ ১১৭-১১৯)।
[কা‘ব (রাযিঃ) বলেন] আল্লাহর শপথ, ইসলাম গ্রহণের পর থেকে কখনো আমার উপর এতো উৎকৃষ্ট নিআমত আল্লাহ্ প্রদান করেননি যা আমার কাছে শ্রেষ্ঠতর, তা হল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর কাছে আমার সত্য বলা ও তাঁর সাথে মিথ্যা না বলা, যদি মিথ্যা বলতাম তবে মিথ্যাবাদীদের মতো আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম। সেই মিথ্যাবাদিদের সম্পর্কে যখন ওহী নাযিল হয়েছে তখন জঘন্য অন্তরের সেই লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ
( سَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ إِذَا انْقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ .... فَإِنَّ اللَّهَ لاَ يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ)
অর্থাৎ, তোমরা তাদের নিকট ফিরে আসলে তারা আল্লাহর শপথ করবে আল্লাহ্ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের প্রতি তুষ্ট হবেন না। (৯ঃ ৯৫-৯৬)।
কা‘ব (রাযিঃ) বলে, আমাদের তিনজনের তাওবা কবুল করতে বিলম্ব করা হয়েছে--- যাদের তাওবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কবুল করেছেন যখন তারা তাঁর কাছে শপথ করেছে, তিনি তাদের বায়আত গ্রহণ করেছেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আমাদের বিষয়টি আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্থগিত রেখেছেন। এর প্রেক্ষাপটে আল্লাহ্ বলেন--- সেই তিনজনের প্রতিও যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। (৯ঃ ১১৮) কুরআনের এই আয়াতে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি যারা তাবুক যুদ্ধ থেকে পিছনে ছিল ও মিথ্যা কসম করে ওযর-আপত্তি পেশ করেছিল এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তা গ্রহণ করেছিলেন। বরং এই আয়াতে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে আমরা যারা পেছনে ছিলাম এবং যাদের প্রতি সিদ্ধান্ত দেয়া স্থগিত রাখা হয়েছিল।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি তাওবা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। এতে হযরত কা'ব ইবনে মালিক রাযি.-এর নিজ জবানীতে তার তাওবা কবুলের বৃত্তান্ত বিবৃত হয়েছে। তাঁর এ ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষাপ্রদ।
তাবুকের যুদ্ধ
তাবুকের যুদ্ধাভিযান সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৯ সালের রজব মাসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ পেলেন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা মুনাওয়ারায় এক জোরদার হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি সে শাম ও আরবের সীমান্ত এলাকায় এক বিশাল বাহিনীও মোতায়েন করেছে। যদিও সাহাবায়ে কিরান এ যাবতকাল বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু তার সবক'টিই হয়েছিল জাযিরাতুল আরবের ভেতরে। কোনও বহিঃশক্তির সাথে এ পর্যন্ত মোকাবেলা হয়নি। এবার তারা সেই পরীক্ষার সম্মুখীন। তাও দুনিয়ার এক বৃহৎ শক্তির সাথে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই সামনে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সুতরাং তিনি সকল মুসলিমকে এ যুদ্ধে শরীক হওয়ার হুকুম দিলেন।
মুসলিমদের পক্ষে এটা ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। কেননা দীর্ঘ ১০ বছর উপর্যুপরি যুদ্ধ শেষে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। এই যুদ্ধে যাওয়া মানে সেই সুযোগটিও হারানো। দ্বিতীয়ত সময়টা ছিল এমন, যখন বাগানের খেজুর পাকছিল, যেই খেজুরের উপর মদীনাবাসীদের সারা বছরের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। তৃতীয়ত ছিল প্রচণ্ড গরমের মৌসুম। যেন আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। ভূমি থেকেও যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। তদুপরি ছিল তাবুকের সুদীর্ঘ সফর। মদীনা হতে তাবুক প্রায় ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত। দুর্গম মরুভূমির পথ। বাহনের সংখ্যাও খুব কম। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেই বৃহত্তম শক্তির রণকৌশল সম্পর্কেও মুসলিমদের জানাশোনা ছিল না। কিন্তু এতকিছু সংকট সত্ত্বেও শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত সাহাবীগণ এ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। তারা দলে দলে এসে নাম লেখালেন। যথাসাধ্য প্রস্তুতি শেষে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ত্রিশ হাজার সাহাবায়ে কিরামের এক বাহিনী নিয়ে তাবুকের উদ্দেশে বের হয়ে পড়লেন। আল্লাহ তা'আলা হিরাক্লিয়াস ও তার বাহিনীর উপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দুঃসাহসিক অভিযানের এমন প্রভাব ফেললেন যে, তারা কালবিলম্ব না করে ফেরত চলে গেল। ফলে যুদ্ধ আর হল না। তবে যুদ্ধ না হলেও এ অভিযানে ইসলাম ও মুসলিম বাহিনীর বিজয় ঠিকই অর্জিত হল। কেননা একে তো সেকালের বৃহত্তম শক্তির উপর ইসলামী শক্তির প্রভাব পড়েছিল এবং তারা ইসলাম ও তার অনুসারীদের আমলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয়ত তাদের ফিরে যাওয়ায় আশপাশের ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গ ক্রমবর্ধমান ইসলামী শক্তির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা কালবিলম্ব না করে তাবুকে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করে এবং তাঁর সংগে সন্ধি স্থাপন করে। তাছাড়া এ অভিযানের মাধ্যমেই কে খাঁটি মুসলিম এবং কে মুনাফিক তা ভালোভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়, যা কুরআন মাজীদের সূরা তাওবায় বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে।
মুনাফিকদের অধিকাংশই এ যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। তাদের কিছুসংখ্যক দুরভিসন্ধীমূলকভাবে এতে শরীক হয়েছিল। তিনজন খাঁটি মুসলিমেরও এতে যোগদান করা হয়নি। তাদের দ্বারা গড়িমসি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ গড়িমসির দরুন তারা যারপরনাই অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং এজন্য তাদেরকে এমন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, তাওবার ইতিহাসে যা এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সেই পরীক্ষায় উত্তর এ মহান সাহাবীদেরকে মহত্তর মানবরূপে চিরস্মরণীয় করে তুলেছে। সেই তিনজনের একজন হলেন হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি.। এই সুদীর্ঘ হাদীছখানিতে মূলত তাঁর জবানীতে তাদের তাওবা কবুলের বৃত্তান্তই বিবৃত হয়েছে।
‘আকাবার বাই'আতের ঘটনা
‘আকাবা জামরাতুল-উখরার নিকটবর্তী একটি উপত্যকার নাম। এখানে মদীনার আনসারগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাংগে সাক্ষাত করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারা মদীনার ইহুদীদের কাছ থেকে শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। সে নবী কেমন হবেন, তাঁর হুলিয়া ও বৈশিষ্ট্যাবলী কী, তাদের কাছ থেকে তারা তা অবহিত হয়েছিল। আগে থেকেই তাদের হজ্জ উপলক্ষে পবিত্র মক্কা মুকাররামায় আসা-যাওয়া ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের পরও তাদের সে যাতায়াত অব্যাহত ছিল।
হজ্জের মৌসুমে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনা-মুযদালিফায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এই দাওয়াতী ব্যস্ততার এক পর্যায়ে একদল আনসারের সংগে তাঁর সাক্ষাত হয়। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ছিল তাঁর দীনকে বিজয়ী করবেন এবং তাঁর নবীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের বীজ এই সাক্ষাতকারেই বপন হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কুরআন মাজীদ পড়ে শোনালেন এবং আল্লাহর দীন বোঝালেন। কুরআন মাজীদের আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য তাদের অন্তরে রেখাপাত করে। ফলে সেই মুহূর্তেই তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং নিজ দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দীপনা নিয়ে ফিরে যায়। তারা মদীনায় ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিষয়ে মানুষকে অবহিত করলেন এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। সে আহ্বানে মদীনার লোকজন স্বতঃস্ফূর্ত সাড়াদান করে। ফলে মদীনার আনসারদের ভেতর ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
পরের বছর হজ্জ মৌসুমে ১২জন আনসার মক্কায় আগমন করেন। তারা ‘আকাবায় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এটাই ‘আকাবার প্রথম বাই'আত। এ বাই'আতের বিষয়বস্তু ছিল এই যে, তারা আল্লাহর সংগে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না,সন্তান হত্যা করবে না, কারও নামে অপবাদ রটাবে না এবং কোনও সৎকাজে বাধা দেবে না। যদি তারা এগুলো পূরণ করে, তবে জান্নাত লাভ করবে। আর এর অন্যথা করলে বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। তিনি চাইলে শাস্তি দেবেন অথবা ক্ষমা করবেন। বাইআত শেষে তারা মদীনায় ফিরে গেলেন। তাদেরকে কুরআনের তালীম, ইসলাম শিক্ষা ও দীনী বিধি-বিধান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য শিক্ষকরূপে হযরত মুসআব ইবন উমায়র রাযি.-কে পাঠিয়ে দিলেন।
অতঃপর পবিত্র মদীনায় ইসলাম প্রচার বেগবান হয়ে উঠল। মদীনার প্রধান দুই গোত্র আওস ও খাযরাজের নেতৃবর্গসহ প্রায় অধিকাংশ লোকই ইসলাম গ্রহণ করে ফেলল। পরের বছর বিপুল উদ্দীপনায় তাদের একটি বড়সড় দল মক্কা মুকাররামায় আগমন করল। এ দলের লোকসংখ্যা ছিল পঁচাত্তরজন। তিয়াত্তরজন পুরুষ দু’জন মহিলা। এবারে তাদের আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদীনায় গমনের প্রস্তাব দেওয়া। তাদের জানা ছিল পবিত্র মক্কায় তিনি ইসলাম প্রচারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন এবং মক্কাবাসীগণ নতুন ধর্ম প্রচারের কারণে তাঁকে ও তাঁর মুষ্টিমেয় অনুসারীকে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন করছে। তাদের লক্ষ্য সেই জুলুম নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষা করা এবং মদীনা মুনাওয়ারাকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করা।
তারা রাতের বেলা ‘আকাবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করলেন। সেখানে জরুরি সব কথার এক পর্যায়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরতের দাওয়াত দিলেন। তাদের এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে চাচা আব্বাস রাযি. জানতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি তখনও পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি, কিন্তু মহান ভাতিজার মর্যাদা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজ ভাই আবূ তালিবের মতই সচেতন ছিলেন। কাজেই তিনি 'আকাবার আলোচনায় নিজের উপস্থিত থাকা জরুরি মনে করলেন। সময়মত তিনি এসেও গেলেন। তিনি আনসারদের লক্ষ্য করে একটি সারগর্ভ বক্তৃতা দিলেন। তাতে বললেন“হে খাযরাজ (ও আওস) গোত্রের লোকেরা! আমাদের কাছে মুহাম্মাদের কী মর্যাদা তা আপনাদের অজানা নয়। আমরা তাঁকে আমাদের সম্প্রদায়ের হাত থেকে এ যাবত রক্ষা করে এসেছি। তাঁর প্রতিপক্ষও আমাদেরই মত ধারণা রাখে। কাজেই তাঁর দেশ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত সুরক্ষিত। কিন্তু তবুও তিনি আপনাদের কাছে চলে যেতে এবং আপনাদের মাঝে থাকতে ইচ্ছুক। চিন্তা করে দেখুন, আপনারা যদি তাঁকে প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেন এবং শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার সামর্থ্য আপনাদের থাকে, তবে এ দায়িত্ব গ্রহণ করুন। পক্ষান্তরে যদি মনে করেন আপনারা তাঁকে রক্ষা করতে পারবেন না এবং তাঁকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন, তবে আপনারা এর থেকে বিরত থাকুন। তিনি নিজ দেশে ও নিজ গোত্রে নিরাপদে আছেন।”
আনসারগণ বললেন, আমরা আপনার বক্তব্য শুনলাম। এবার ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কথা বলুন এবং নিজের পক্ষে ও নিজ রব্বের পক্ষে আমাদের থেকে যে অঙ্গীকার নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন তা নিয়ে নিন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বললেন। তিনি প্রথমে কুরআন তিলাওয়াত করলেন, তারপর তাদের সামনে ইসলামের ব্যাখ্যা দিলেন এবং ইসলামের প্রতি তাদের উৎসাহ দান করলেন। তারপর বললেন, আমি এ মর্মে তোমাদের থেকে বাই'আত (প্রতিশ্রুতি) গ্রহণ করছি যে, তোমরা তোমাদের নারী ও শিশুদের যেভাবে রক্ষা কর তেমনি আমাকেও রক্ষা করবে।
তারা আল্লাহর নামে শপথ করে এই প্রতিশ্রুতি তাঁকে দান করলেন। তারপর বললেন, মদীনার ইহুদীদের সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক আছে। এ বাই'আতের মাধ্যমে আমরা তা ছিন্ন করতে চাচ্ছি। পরে এমন তো হবে না যে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ যখন আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের ছেড়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কথা শুনে মৃদু হাসলেন। তারপর এই বলে তাদের আশ্বস্ত করলেন যে, তোমাদের রক্ত আমার রক্ত। তোমাদের জীবন-মরণের সাথে আমার জীবন-মরণ গাঁথা থাকবে। আমি তোমাদের, তোমরা আমার। তোমরা যাদের সাথে লড়বে, আমি তাদের সাথে লড়ব। তোমরা যাদের সাথে শান্তি স্থাপন করবে, আমিও তাদের সাথে শান্তি স্থাপন করব। এভাবে 'আকাবার দ্বিতীয় বাই'আত সম্পন্ন হল।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আনসারদের পক্ষে এ বাই'আত ছিল এক চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপ। এটা ছিল সমগ্র আরব: বরং সমস্ত বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর। সমগ্র বিশ্ব তখন শিরক-কবলিত। তাওহীদের দাওয়াত ছিল শিরকী আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রত্যক্ষ আঘাত। অন্ধকারাচ্ছন্ন মুশরিকদের সে আঘাত সহ্য করার কথা নয়। বরং এ দাওয়াত আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী ইহুদী-খৃষ্টানদের জন্যও প্রীতিকর ছিল না, যেহেতু তারাও প্রকৃত তাওহীদের বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিল। ফলে এ দাওয়াতের পক্ষাবলম্বন দ্বারা ইহুদী-খৃষ্টানসহ সারা বিশ্বের সমস্ত পৌত্তলিক ও নাস্তিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত শক্তির মুখোমুখি হওয়া ছিল অনিবার্য। খোদ মদীনার ভেতরই শক্তিশালী ইহুদী গোত্রসমূহের বসবাস। এহেন পরিস্থিতিতে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশ্রয় দান করলে যে ভেতরের ও বাইরের সবরকম শক্তির বিরুদ্ধে জানবাজি রেখে লড়তে হবে, মুষ্টিমেয় আনসারদের সে কথা ভালোভাবেই জানা ছিল। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার তো তাঁর দীনকে বিজয় করার ছিল। তিনি আনসারদের অন্তরে হিম্মত দিলেন, ঈমানী উদ্দীপনা দিলেন এবং দিলেন কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতে অটল-অবিচল থাকার দৃঢ় সংকল্প। ফলে সম্ভাব্য সকল ঝুঁকি মাথায় নিয়েই তারা ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সাথে বাই'আত সম্পন্ন করলেন।
‘আকাবার এই বাই'আত ইসলামী ইতিহাসের এক মহিমময় ঘটনা। মদীনা মুনাওয়ারার ইসলামের কেন্দ্রীয় মর্যাদালাভ, বদর যুদ্ধে জয়লাভ, মক্কাবিজয়, ইসলামী খেলাফতের বিপুল বিস্তার এবং বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারের ভিত্তি এই বাই'আতের মাধ্যমেই স্থাপিত হয়েছিল। যারা এই বাই'আতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই সুমহান ব্যক্তিবর্গের অন্তরে এর মূল্য ও মর্যাদাবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে এটা স্বাভাবিক কথা। মূল্যবোধের সেই অবস্থান থেকেই হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি. বলেছিলেন, ‘আকাবার বাই'আতের বিপরীতে বদর যুদ্ধের উপস্থিতিকে আমি পসন্দ করব না, (অর্থাৎ এমন যদি হত যে, আমি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি কিন্তু ‘আকাবার বাই'আতে শরীক থাকিনি, এটা আমার পক্ষে প্রীতিকর হত না) যদিও বদর যুদ্ধ মানুষের কাছে ‘আকাবা অপেক্ষা বেশি আলোচিত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও নেককাজে গড়িমসি করতে নেই। গড়িমসি করলে অনেক সময়ই সেই নেককাজ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে, যেমন হযরত কা'ব রাযি. ও তাঁর দুই সঙ্গী তাবুকের যুদ্ধাভিযানে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছিলেন।
খ. ইসলাম গ্রহণের বাই'আত ছাড়াও দীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাই'আত জায়েয। ‘আকাবার বাই'আত সে রকমেরই ছিল। এর দ্বারা খাঁটি পীরের হাতে বাই'আতের বৈধতা প্রমাণিত হয়।
গ. সর্বাবস্থায় সত্য বলা উচিত। সত্য বললে প্রথমদিকে কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হলেও পরিণাম সর্বদা শুভই হয়ে থাকে। হযরত কা'ব রাযি.-এর সত্যবলা সে কথাই প্রমাণ করে। পক্ষান্তরে মিথ্যার পরিণাম সর্বদা অশুভই হয়, তাতে সাময়িক যত সুবিধাই দেখা যাক না কেন।
ঘ. সর্বাবস্থায় আমীর, উসতায ও শায়খের হুকুম শিরোধার্য করা উচিত। তাদের কঠিন থেকে কঠিনতর হুকুম পালন করতে পারলে তা অভাবনীয় সুফল বয়ে আনে।
ঙ. মিথ্যা অজুহাত প্রদর্শন মুনাফিকদের কাজ। তা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।
চ. নিজেদের পরিকল্পনা ও গতিবিধি সম্পর্কে শত্রুপক্ষ যাতে অবহিত হতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাগ্রহণ অধিনায়কের যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক এটা বিজয় ও সাফল্য লাভের পক্ষে সহায়ক।
ছ. কারও দ্বারা কোনও অপরাধ হয়ে গেলে তার সংশোধনকল্পে তার সংগে কথা বন্ধের শাস্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
জ. সফর থেকে ফিরে আসার পর প্রথমেই ঘরে না ঢুকে মসজিদে যাওয়া এবং দু' রাক'আত নামায পড়া মুস্তাহাব।
ঝ. কারও ভালো কিছু ঘটলে তাকে সে সম্পর্কে সুসংবাদ শোনানো একটি ইসলামী আদব। এর দ্বারা সুসংবাদদাতার মনের ঔদার্য প্রকাশ পায় এবং পরস্পরে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
ঞ. সুসংবাদদাতাকে পুরস্কৃত করা মুস্তাহাব।
ট, কারও সুখকর কিছু ঘটলে সেজন্যে তাকে অভিনন্দন জানানো চাই।
ঠ. আগুম্ভককে স্বাগত জানানোর জন্য উঠে এগিয়ে যাওয়া ও তার সাথে মুসাফাহা করা একটি প্রশংসনীয় কাজ।
ড. অমুসলিম শত্রুর তোষামোদে ভুলতে নেই। অনেক সময় তা ঈমান হরণেরও কারণ হয়ে থাকে। সেজন্যই হযরত কা'ব রাযি. গাস্সানের রাজার চিঠিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সেটি আগুনে পুড়ে ফেলেছেন।
ঢ. দীনের স্বার্থ আত্মীয়তারও উপরে। কাজেই দীনের কারণে যদি আত্মীয়কে পরিত্যাগ করতে হয়, তবে তা করাই বাঞ্ছনীয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে দিলে হযরত কা'ব রাযি.-এর সাথে তাঁর চাচাত ভাই কথা বলতে রাজি হননি।
ণ. আমীরের কর্তব্য তার অধীনস্থদের খোঁজখবর রাখা ও তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ত. আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে কোনও নি'আমত লাভ হলে তার শোকরস্বরূপ দান-সদাকা করা মুস্তাহাব।
থ. ইসলামের সাধারণ শিক্ষা এটাই যে, যার অর্থ-সম্পদ আছে সে সমস্ত সম্পদ দান-সদাকা না করে একটা অংশ ওয়ারিশদের জন্য রেখে দেবে, যাতে তাদের অন্যদের কাছে হাত পেতে বেড়াতে না হয়।
দ. বিশেষ কোনও আমলের বদৌলতে কোনও নি'আমত লাভ হলে তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেই আমলে আরও বেশি যত্নবান হওয়া উচিত, যেমন হযরত কা'ব রাযি. সত্য বলার বদৌলতে আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমাপ্রাপ্তির নি'আমত লাভ করেছিলেন। ফলে তিনি জীবনভর সত্যবাদিতায় অবিচল থাকবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
ধ. কারও সামনে অন্য কারও গীবত ও সমালোচনা করা হলে তার কর্তব্য প্রতিবাদ করা এবং তার প্রশংসনীয় দিক তুলে ধরা, যেমন হযরত কা'ব রাযি.-এর সমালোচনা করা হলে হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি. প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আমরা তো কা'বকে ভালো বলেই জানি।
ন. কারও পক্ষ থেকে কোনও উপকার ও সদাচরণ পেলে তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। হযরত কা'ব রাযি. হযরত তালহা রাযি.-এর সদাচরণ জীবনভর মনে রেখেছিলেন।
এ হাদীছে এছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার লক্ষ্যে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।
তাবুকের যুদ্ধ
তাবুকের যুদ্ধাভিযান সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৯ সালের রজব মাসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ পেলেন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা মুনাওয়ারায় এক জোরদার হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি সে শাম ও আরবের সীমান্ত এলাকায় এক বিশাল বাহিনীও মোতায়েন করেছে। যদিও সাহাবায়ে কিরান এ যাবতকাল বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু তার সবক'টিই হয়েছিল জাযিরাতুল আরবের ভেতরে। কোনও বহিঃশক্তির সাথে এ পর্যন্ত মোকাবেলা হয়নি। এবার তারা সেই পরীক্ষার সম্মুখীন। তাও দুনিয়ার এক বৃহৎ শক্তির সাথে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই সামনে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সুতরাং তিনি সকল মুসলিমকে এ যুদ্ধে শরীক হওয়ার হুকুম দিলেন।
মুসলিমদের পক্ষে এটা ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। কেননা দীর্ঘ ১০ বছর উপর্যুপরি যুদ্ধ শেষে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। এই যুদ্ধে যাওয়া মানে সেই সুযোগটিও হারানো। দ্বিতীয়ত সময়টা ছিল এমন, যখন বাগানের খেজুর পাকছিল, যেই খেজুরের উপর মদীনাবাসীদের সারা বছরের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। তৃতীয়ত ছিল প্রচণ্ড গরমের মৌসুম। যেন আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। ভূমি থেকেও যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। তদুপরি ছিল তাবুকের সুদীর্ঘ সফর। মদীনা হতে তাবুক প্রায় ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত। দুর্গম মরুভূমির পথ। বাহনের সংখ্যাও খুব কম। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেই বৃহত্তম শক্তির রণকৌশল সম্পর্কেও মুসলিমদের জানাশোনা ছিল না। কিন্তু এতকিছু সংকট সত্ত্বেও শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত সাহাবীগণ এ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। তারা দলে দলে এসে নাম লেখালেন। যথাসাধ্য প্রস্তুতি শেষে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ত্রিশ হাজার সাহাবায়ে কিরামের এক বাহিনী নিয়ে তাবুকের উদ্দেশে বের হয়ে পড়লেন। আল্লাহ তা'আলা হিরাক্লিয়াস ও তার বাহিনীর উপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দুঃসাহসিক অভিযানের এমন প্রভাব ফেললেন যে, তারা কালবিলম্ব না করে ফেরত চলে গেল। ফলে যুদ্ধ আর হল না। তবে যুদ্ধ না হলেও এ অভিযানে ইসলাম ও মুসলিম বাহিনীর বিজয় ঠিকই অর্জিত হল। কেননা একে তো সেকালের বৃহত্তম শক্তির উপর ইসলামী শক্তির প্রভাব পড়েছিল এবং তারা ইসলাম ও তার অনুসারীদের আমলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয়ত তাদের ফিরে যাওয়ায় আশপাশের ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গ ক্রমবর্ধমান ইসলামী শক্তির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা কালবিলম্ব না করে তাবুকে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করে এবং তাঁর সংগে সন্ধি স্থাপন করে। তাছাড়া এ অভিযানের মাধ্যমেই কে খাঁটি মুসলিম এবং কে মুনাফিক তা ভালোভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়, যা কুরআন মাজীদের সূরা তাওবায় বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে।
মুনাফিকদের অধিকাংশই এ যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। তাদের কিছুসংখ্যক দুরভিসন্ধীমূলকভাবে এতে শরীক হয়েছিল। তিনজন খাঁটি মুসলিমেরও এতে যোগদান করা হয়নি। তাদের দ্বারা গড়িমসি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ গড়িমসির দরুন তারা যারপরনাই অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং এজন্য তাদেরকে এমন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, তাওবার ইতিহাসে যা এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সেই পরীক্ষায় উত্তর এ মহান সাহাবীদেরকে মহত্তর মানবরূপে চিরস্মরণীয় করে তুলেছে। সেই তিনজনের একজন হলেন হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি.। এই সুদীর্ঘ হাদীছখানিতে মূলত তাঁর জবানীতে তাদের তাওবা কবুলের বৃত্তান্তই বিবৃত হয়েছে।
‘আকাবার বাই'আতের ঘটনা
‘আকাবা জামরাতুল-উখরার নিকটবর্তী একটি উপত্যকার নাম। এখানে মদীনার আনসারগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাংগে সাক্ষাত করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারা মদীনার ইহুদীদের কাছ থেকে শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। সে নবী কেমন হবেন, তাঁর হুলিয়া ও বৈশিষ্ট্যাবলী কী, তাদের কাছ থেকে তারা তা অবহিত হয়েছিল। আগে থেকেই তাদের হজ্জ উপলক্ষে পবিত্র মক্কা মুকাররামায় আসা-যাওয়া ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের পরও তাদের সে যাতায়াত অব্যাহত ছিল।
হজ্জের মৌসুমে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনা-মুযদালিফায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এই দাওয়াতী ব্যস্ততার এক পর্যায়ে একদল আনসারের সংগে তাঁর সাক্ষাত হয়। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ছিল তাঁর দীনকে বিজয়ী করবেন এবং তাঁর নবীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের বীজ এই সাক্ষাতকারেই বপন হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কুরআন মাজীদ পড়ে শোনালেন এবং আল্লাহর দীন বোঝালেন। কুরআন মাজীদের আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য তাদের অন্তরে রেখাপাত করে। ফলে সেই মুহূর্তেই তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং নিজ দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দীপনা নিয়ে ফিরে যায়। তারা মদীনায় ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিষয়ে মানুষকে অবহিত করলেন এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। সে আহ্বানে মদীনার লোকজন স্বতঃস্ফূর্ত সাড়াদান করে। ফলে মদীনার আনসারদের ভেতর ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
পরের বছর হজ্জ মৌসুমে ১২জন আনসার মক্কায় আগমন করেন। তারা ‘আকাবায় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এটাই ‘আকাবার প্রথম বাই'আত। এ বাই'আতের বিষয়বস্তু ছিল এই যে, তারা আল্লাহর সংগে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না,সন্তান হত্যা করবে না, কারও নামে অপবাদ রটাবে না এবং কোনও সৎকাজে বাধা দেবে না। যদি তারা এগুলো পূরণ করে, তবে জান্নাত লাভ করবে। আর এর অন্যথা করলে বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। তিনি চাইলে শাস্তি দেবেন অথবা ক্ষমা করবেন। বাইআত শেষে তারা মদীনায় ফিরে গেলেন। তাদেরকে কুরআনের তালীম, ইসলাম শিক্ষা ও দীনী বিধি-বিধান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য শিক্ষকরূপে হযরত মুসআব ইবন উমায়র রাযি.-কে পাঠিয়ে দিলেন।
অতঃপর পবিত্র মদীনায় ইসলাম প্রচার বেগবান হয়ে উঠল। মদীনার প্রধান দুই গোত্র আওস ও খাযরাজের নেতৃবর্গসহ প্রায় অধিকাংশ লোকই ইসলাম গ্রহণ করে ফেলল। পরের বছর বিপুল উদ্দীপনায় তাদের একটি বড়সড় দল মক্কা মুকাররামায় আগমন করল। এ দলের লোকসংখ্যা ছিল পঁচাত্তরজন। তিয়াত্তরজন পুরুষ দু’জন মহিলা। এবারে তাদের আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদীনায় গমনের প্রস্তাব দেওয়া। তাদের জানা ছিল পবিত্র মক্কায় তিনি ইসলাম প্রচারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন এবং মক্কাবাসীগণ নতুন ধর্ম প্রচারের কারণে তাঁকে ও তাঁর মুষ্টিমেয় অনুসারীকে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন করছে। তাদের লক্ষ্য সেই জুলুম নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষা করা এবং মদীনা মুনাওয়ারাকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করা।
তারা রাতের বেলা ‘আকাবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সাক্ষাত করলেন। সেখানে জরুরি সব কথার এক পর্যায়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরতের দাওয়াত দিলেন। তাদের এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে চাচা আব্বাস রাযি. জানতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি তখনও পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি, কিন্তু মহান ভাতিজার মর্যাদা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজ ভাই আবূ তালিবের মতই সচেতন ছিলেন। কাজেই তিনি 'আকাবার আলোচনায় নিজের উপস্থিত থাকা জরুরি মনে করলেন। সময়মত তিনি এসেও গেলেন। তিনি আনসারদের লক্ষ্য করে একটি সারগর্ভ বক্তৃতা দিলেন। তাতে বললেন“হে খাযরাজ (ও আওস) গোত্রের লোকেরা! আমাদের কাছে মুহাম্মাদের কী মর্যাদা তা আপনাদের অজানা নয়। আমরা তাঁকে আমাদের সম্প্রদায়ের হাত থেকে এ যাবত রক্ষা করে এসেছি। তাঁর প্রতিপক্ষও আমাদেরই মত ধারণা রাখে। কাজেই তাঁর দেশ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত সুরক্ষিত। কিন্তু তবুও তিনি আপনাদের কাছে চলে যেতে এবং আপনাদের মাঝে থাকতে ইচ্ছুক। চিন্তা করে দেখুন, আপনারা যদি তাঁকে প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেন এবং শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার সামর্থ্য আপনাদের থাকে, তবে এ দায়িত্ব গ্রহণ করুন। পক্ষান্তরে যদি মনে করেন আপনারা তাঁকে রক্ষা করতে পারবেন না এবং তাঁকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন, তবে আপনারা এর থেকে বিরত থাকুন। তিনি নিজ দেশে ও নিজ গোত্রে নিরাপদে আছেন।”
আনসারগণ বললেন, আমরা আপনার বক্তব্য শুনলাম। এবার ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কথা বলুন এবং নিজের পক্ষে ও নিজ রব্বের পক্ষে আমাদের থেকে যে অঙ্গীকার নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন তা নিয়ে নিন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বললেন। তিনি প্রথমে কুরআন তিলাওয়াত করলেন, তারপর তাদের সামনে ইসলামের ব্যাখ্যা দিলেন এবং ইসলামের প্রতি তাদের উৎসাহ দান করলেন। তারপর বললেন, আমি এ মর্মে তোমাদের থেকে বাই'আত (প্রতিশ্রুতি) গ্রহণ করছি যে, তোমরা তোমাদের নারী ও শিশুদের যেভাবে রক্ষা কর তেমনি আমাকেও রক্ষা করবে।
তারা আল্লাহর নামে শপথ করে এই প্রতিশ্রুতি তাঁকে দান করলেন। তারপর বললেন, মদীনার ইহুদীদের সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক আছে। এ বাই'আতের মাধ্যমে আমরা তা ছিন্ন করতে চাচ্ছি। পরে এমন তো হবে না যে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ যখন আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের ছেড়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কথা শুনে মৃদু হাসলেন। তারপর এই বলে তাদের আশ্বস্ত করলেন যে, তোমাদের রক্ত আমার রক্ত। তোমাদের জীবন-মরণের সাথে আমার জীবন-মরণ গাঁথা থাকবে। আমি তোমাদের, তোমরা আমার। তোমরা যাদের সাথে লড়বে, আমি তাদের সাথে লড়ব। তোমরা যাদের সাথে শান্তি স্থাপন করবে, আমিও তাদের সাথে শান্তি স্থাপন করব। এভাবে 'আকাবার দ্বিতীয় বাই'আত সম্পন্ন হল।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আনসারদের পক্ষে এ বাই'আত ছিল এক চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপ। এটা ছিল সমগ্র আরব: বরং সমস্ত বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর। সমগ্র বিশ্ব তখন শিরক-কবলিত। তাওহীদের দাওয়াত ছিল শিরকী আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রত্যক্ষ আঘাত। অন্ধকারাচ্ছন্ন মুশরিকদের সে আঘাত সহ্য করার কথা নয়। বরং এ দাওয়াত আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী ইহুদী-খৃষ্টানদের জন্যও প্রীতিকর ছিল না, যেহেতু তারাও প্রকৃত তাওহীদের বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিল। ফলে এ দাওয়াতের পক্ষাবলম্বন দ্বারা ইহুদী-খৃষ্টানসহ সারা বিশ্বের সমস্ত পৌত্তলিক ও নাস্তিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত শক্তির মুখোমুখি হওয়া ছিল অনিবার্য। খোদ মদীনার ভেতরই শক্তিশালী ইহুদী গোত্রসমূহের বসবাস। এহেন পরিস্থিতিতে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশ্রয় দান করলে যে ভেতরের ও বাইরের সবরকম শক্তির বিরুদ্ধে জানবাজি রেখে লড়তে হবে, মুষ্টিমেয় আনসারদের সে কথা ভালোভাবেই জানা ছিল। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার তো তাঁর দীনকে বিজয় করার ছিল। তিনি আনসারদের অন্তরে হিম্মত দিলেন, ঈমানী উদ্দীপনা দিলেন এবং দিলেন কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতে অটল-অবিচল থাকার দৃঢ় সংকল্প। ফলে সম্ভাব্য সকল ঝুঁকি মাথায় নিয়েই তারা ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সাথে বাই'আত সম্পন্ন করলেন।
‘আকাবার এই বাই'আত ইসলামী ইতিহাসের এক মহিমময় ঘটনা। মদীনা মুনাওয়ারার ইসলামের কেন্দ্রীয় মর্যাদালাভ, বদর যুদ্ধে জয়লাভ, মক্কাবিজয়, ইসলামী খেলাফতের বিপুল বিস্তার এবং বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারের ভিত্তি এই বাই'আতের মাধ্যমেই স্থাপিত হয়েছিল। যারা এই বাই'আতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই সুমহান ব্যক্তিবর্গের অন্তরে এর মূল্য ও মর্যাদাবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে এটা স্বাভাবিক কথা। মূল্যবোধের সেই অবস্থান থেকেই হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি. বলেছিলেন, ‘আকাবার বাই'আতের বিপরীতে বদর যুদ্ধের উপস্থিতিকে আমি পসন্দ করব না, (অর্থাৎ এমন যদি হত যে, আমি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি কিন্তু ‘আকাবার বাই'আতে শরীক থাকিনি, এটা আমার পক্ষে প্রীতিকর হত না) যদিও বদর যুদ্ধ মানুষের কাছে ‘আকাবা অপেক্ষা বেশি আলোচিত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও নেককাজে গড়িমসি করতে নেই। গড়িমসি করলে অনেক সময়ই সেই নেককাজ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে, যেমন হযরত কা'ব রাযি. ও তাঁর দুই সঙ্গী তাবুকের যুদ্ধাভিযানে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছিলেন।
খ. ইসলাম গ্রহণের বাই'আত ছাড়াও দীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাই'আত জায়েয। ‘আকাবার বাই'আত সে রকমেরই ছিল। এর দ্বারা খাঁটি পীরের হাতে বাই'আতের বৈধতা প্রমাণিত হয়।
গ. সর্বাবস্থায় সত্য বলা উচিত। সত্য বললে প্রথমদিকে কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হলেও পরিণাম সর্বদা শুভই হয়ে থাকে। হযরত কা'ব রাযি.-এর সত্যবলা সে কথাই প্রমাণ করে। পক্ষান্তরে মিথ্যার পরিণাম সর্বদা অশুভই হয়, তাতে সাময়িক যত সুবিধাই দেখা যাক না কেন।
ঘ. সর্বাবস্থায় আমীর, উসতায ও শায়খের হুকুম শিরোধার্য করা উচিত। তাদের কঠিন থেকে কঠিনতর হুকুম পালন করতে পারলে তা অভাবনীয় সুফল বয়ে আনে।
ঙ. মিথ্যা অজুহাত প্রদর্শন মুনাফিকদের কাজ। তা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।
চ. নিজেদের পরিকল্পনা ও গতিবিধি সম্পর্কে শত্রুপক্ষ যাতে অবহিত হতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাগ্রহণ অধিনায়কের যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক এটা বিজয় ও সাফল্য লাভের পক্ষে সহায়ক।
ছ. কারও দ্বারা কোনও অপরাধ হয়ে গেলে তার সংশোধনকল্পে তার সংগে কথা বন্ধের শাস্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
জ. সফর থেকে ফিরে আসার পর প্রথমেই ঘরে না ঢুকে মসজিদে যাওয়া এবং দু' রাক'আত নামায পড়া মুস্তাহাব।
ঝ. কারও ভালো কিছু ঘটলে তাকে সে সম্পর্কে সুসংবাদ শোনানো একটি ইসলামী আদব। এর দ্বারা সুসংবাদদাতার মনের ঔদার্য প্রকাশ পায় এবং পরস্পরে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
ঞ. সুসংবাদদাতাকে পুরস্কৃত করা মুস্তাহাব।
ট, কারও সুখকর কিছু ঘটলে সেজন্যে তাকে অভিনন্দন জানানো চাই।
ঠ. আগুম্ভককে স্বাগত জানানোর জন্য উঠে এগিয়ে যাওয়া ও তার সাথে মুসাফাহা করা একটি প্রশংসনীয় কাজ।
ড. অমুসলিম শত্রুর তোষামোদে ভুলতে নেই। অনেক সময় তা ঈমান হরণেরও কারণ হয়ে থাকে। সেজন্যই হযরত কা'ব রাযি. গাস্সানের রাজার চিঠিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সেটি আগুনে পুড়ে ফেলেছেন।
ঢ. দীনের স্বার্থ আত্মীয়তারও উপরে। কাজেই দীনের কারণে যদি আত্মীয়কে পরিত্যাগ করতে হয়, তবে তা করাই বাঞ্ছনীয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে দিলে হযরত কা'ব রাযি.-এর সাথে তাঁর চাচাত ভাই কথা বলতে রাজি হননি।
ণ. আমীরের কর্তব্য তার অধীনস্থদের খোঁজখবর রাখা ও তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ত. আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে কোনও নি'আমত লাভ হলে তার শোকরস্বরূপ দান-সদাকা করা মুস্তাহাব।
থ. ইসলামের সাধারণ শিক্ষা এটাই যে, যার অর্থ-সম্পদ আছে সে সমস্ত সম্পদ দান-সদাকা না করে একটা অংশ ওয়ারিশদের জন্য রেখে দেবে, যাতে তাদের অন্যদের কাছে হাত পেতে বেড়াতে না হয়।
দ. বিশেষ কোনও আমলের বদৌলতে কোনও নি'আমত লাভ হলে তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেই আমলে আরও বেশি যত্নবান হওয়া উচিত, যেমন হযরত কা'ব রাযি. সত্য বলার বদৌলতে আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমাপ্রাপ্তির নি'আমত লাভ করেছিলেন। ফলে তিনি জীবনভর সত্যবাদিতায় অবিচল থাকবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
ধ. কারও সামনে অন্য কারও গীবত ও সমালোচনা করা হলে তার কর্তব্য প্রতিবাদ করা এবং তার প্রশংসনীয় দিক তুলে ধরা, যেমন হযরত কা'ব রাযি.-এর সমালোচনা করা হলে হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি. প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আমরা তো কা'বকে ভালো বলেই জানি।
ন. কারও পক্ষ থেকে কোনও উপকার ও সদাচরণ পেলে তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। হযরত কা'ব রাযি. হযরত তালহা রাযি.-এর সদাচরণ জীবনভর মনে রেখেছিলেন।
এ হাদীছে এছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার লক্ষ্যে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।
