মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
২৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং: ৫২৮৭
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - ইবাদতের জন্য হায়াত ও দৌলতের আকাঙ্ক্ষা করা
৫২৮৭। হযরত আবু কাবশা আনসারী (রাঃ) হইতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)কে বলিতে শুনিয়াছেন। এমন তিনটি ব্যাপার আছে, যাহার (সত্যতার) উপর আমি শপথ করিতে পারি এবং আমি তোমাদের সামনে অপর একটি হাদীস বর্ণনা করিব, উহাকেও ভালভাবে স্মরণ রাখিবে। আর যেই ব্যাপারে আমি শপথ করিতেছি তাহা ইহলঃ (ক) সদকা-খয়রাতের দরুন কোন বান্দার সম্পদে হ্রাস হয় না। (খ) যেই মম বান্দা যুমের শিকার হইয়া ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ্ তা'আলা তাহার সম্মান বৃদ্ধি করিবেন। (গ) আর যেই বান্দা ভিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে, আল্লাহ্ তা'আলা তাহার অভাব ও দরিদ্রতার দরজা খুলিয়া দেন। অতঃপর তিনি বলিলেনঃ আমি যেই হাদীসটি তোমাদিগকে বলিব, উহাকে খুব ভালভাবে সংরক্ষণ কর। তাহা হইল—প্রকৃতপক্ষে দুনিয়া হইল চার শ্রেণীর লোকের জন্য। (১) এমন বান্দা— আল্লাহ্ যাহাকে মাল ও এলম উভয়টি দান করিয়াছেন। তবে সে উহা খরচ করিতে আপন রবকে ভয় করে (অর্থাৎ, হারাম পথে ব্যয় করে না)। আত্মীয়-স্বজনের সহিত সদ্ব্যবহার করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মালের হক মোতাবেক আমল করে (অর্থাৎ, খরচ করে।) এই ব্যক্তির মর্যাদা সর্বোত্তম। (২) এমন বান্দা— যাহাকে আল্লাহ্ এলম দান করিয়াছেন, কিন্তু তাহাকে সম্পদ দান করেন নাই। তবে সে এই সত্য এবং সঠিক নিয়তে বলে, যদি আমার মাল-সম্পদ থাকিত তাহা হইলে আমি অমুকের ন্যায় নেকীর পথে খরচ করিতাম। এই দুই ব্যক্তির সওয়াব একই সমান । (৩) এমন বান্দা—যাহাকে আল্লাহ্ মাল-সম্পদ দিয়াছেন, কিন্তু এলম দান করেন নাই। তাহার এলম না থাকার দরুন সে নিজের সম্পদের ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হইয়া পড়ে, ইহাতে সে খোদাকে ভয় করে না। আত্মীয়-স্বজনদের সহিত আর্থিক সদ্ব্যবহার রাখে না এবং নিজ সম্পদ হক পথে ব্যয় করে না। এই ব্যক্তি হইল সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পর্যায়ের। (৪) এমন বান্দা—যাহার কাছে মালও নাই এলমও নাই। সে আকাঙ্ক্ষা করিয়া বলে, যদি আমার কাছে মাল থাকিত, তাহা হইলে আমি উহা অমুক ব্যক্তির মত ব্যয় করিতাম। এই বান্দাও তাহার এই মন্দ নিয়তের দরুন গুনাহর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির সমান। – তিরমিযী। তিনি বলিয়াছেন এই হাদীসটি সহীহ্।
وَعَن أبي كبشةَ الأنماريِّ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «ثَلَاثٌ أُقْسِمُ عَلَيْهِنَّ وَأُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا فَاحْفَظُوهُ فَأَمَّا الَّذِي أُقْسِمُ عَلَيْهِنَّ فَإِنَّهُ مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ وَلَا ظُلِمَ عَبْدٌ مَظْلِمَةً صَبَرَ عَلَيْهَا إِلَّا زَادَهُ اللَّهُ بِهَا عِزًّا وَلَا فَتَحَ عَبْدٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ إِلَّا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْهِ بَابَ فَقْرٍ وَأَمَّا الَّذِي أُحَدِّثُكُمْ فَاحْفَظُوهُ» فَقَالَ: إِنَّمَا الدُّنْيَا لِأَرْبَعَةِ نفرٍ: عبدٌ رزقَه اللَّهُ مَالا وعلماً فهوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلُ رَحِمَهُ وَيَعْمَلُ لِلَّهِ فِيهِ بِحَقِّهِ فَهَذَا بِأَفْضَلِ الْمَنَازِلِ. وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالًا فَهُوَ صَادِقُ النيَّةِ وَيَقُول: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلَانٍ فأجرُهما سواءٌ. وعبدٌ رزَقه اللَّهُ مَالا وَلم يَرْزُقْهُ عِلْمًا فَهُوَ يَتَخَبَّطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ لَا يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَلَا يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَلَا يَعْمَلُ فِيهِ بِحَقٍّ فَهَذَا بأخبثِ المنازلِ وعبدٌ لم يرزُقْه اللَّهُ مَالا وَلَا عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلَانٍ فَهُوَ نِيَّتُهُ وَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ صَحِيح
হাদীসের ব্যাখ্যা:
১. অর্থাৎ, নেক কাজে খরচ করার জন্য মাল-সম্পদের কামনা করিলেও তাহাতে সওয়াব পাওয়া যাইবে, যদিও মাল না থাকে। পক্ষান্তরে মন্দ পথে ব্যয় করার নিয়তে মালের আকাঙ্ক্ষা করিলে গুনাহ্ হইবে, যদিও বাস্তবে উহা ব্যবহার নাও করে।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে যে কথাটি স্মরণ রাখতে বলেছেন তা নিম্নরূপ-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لِأَرْبَعَةِ نَفَرٍ (দুনিয়া কেবল চার শ্রেণির লোকের জন্য)। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদের দিক থেকে মানুষের অবস্থা চার রকম। তারপর সে চার রকম লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা নিম্নরূপ-
عَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا ، فَهُوَ يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ ، وَيَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মাল ও 'ইলম দান করেছেন। সে এ বিষয়ে তার প্রতিপালককে ভয় করে, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে এবং এর ভেতর সে আল্লাহর হক সম্পর্কে সচেতন থাকে)। অর্থাৎ সম্পদের সঙ্গে যেহেতু তার ইলমও আছে, তাই সে ইলম অনুযায়ী সম্পদের ব্যবহার করে। ফলে সে তার সম্পদ কোনও পাপকর্মে ব্যয় করে না। যে খাতে ব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা নারাজ হতে পারেন, তা থেকে বিরত থাকে। কেবল শরী'আত অনুযায়ীই তা খরচ করে। তার মধ্যে একটা বিশেষ দিক হল আত্মীয়তা রক্ষা করা। সে নিজ অর্থ-সম্পদ দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের খেদমত করে। পাশাপাশি তাতে বান্দার যত হক আছে তাও আদায় করে। এমনিভাবে তার সম্পদে আল্লাহ তা'আলার কি কি হক আছে তাও বুঝে বুঝে আদায় করে। যেমন যাকাত, সদাকায়ে ফিতর, মানত ও কাফফারা। এগুলো আদায় করা ফরয। সে তা যথাযথভাবে আদায় করে। তাছাড়া 'ফরযে কিফায়া' হিসেবে যেসকল খাতে অর্থব্যয় করা জরুরি, সেসব খাতেও ব্যয় করে। যেমন মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া ইত্যাদি।
فَهذَا بِأَفْضَلِ الْمَنازِلِ (এটা হল সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর)। অর্থাৎ এ ব্যক্তি জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরে থাকবে। কেননা সে দীন শিখেছে, সেই শিক্ষা অনুযায়ী অর্থ-সম্পদের ব্যবহার করেছে, অর্থ-সম্পদকে নিষিদ্ধ খাতে ব্যয় করা হতে বিরত থেকেছে এবং আল্লাহর সন্তোষজনক খাতে তা ব্যয় করেছে। এভাবে নিজের ইলম ও মাল আল্লাহ তা'আলার মর্জিমতো ব্যবহার করায় আল্লাহর কাছে সে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا ، وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالًا، فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ، يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ 'ইলম দিয়েছেন, কিন্তু মাল দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আমার যদি ধন-সম্পদ থাকত, তবে আমি অমুক ব্যক্তির আমলের মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ দীনী ইলমের অধিকারী হওয়ার কারণে সে তার নিয়ত খালেস করতে পারে। সে জানে অর্থ-সম্পদ কীভাবে অর্জন করতে হয় এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করতে হয়। তাই সে সংকল্প করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে সম্পদ দিলে শরী'আত মোতাবেক তা খরচ করবে এবং তা থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করবে, যেমন প্রথমোক্ত ব্যক্তি করে থাকে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ، فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ (তাকে তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচনা করা হয়। এ দুই ব্যক্তির প্রতিদান সমান সমান)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার খালেস নিয়ত অনুসারে তার সঙ্গে ব্যবহার করেন। তার সংকল্প অনুযায়ী তাকে প্রতিদান দেন। তার সংকল্প যেহেতু প্রথম ব্যক্তির আমলের মতো আমল করা, তাই তার মতোই ছাওয়াব তাকে দেওয়া হয়। এভাবে সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সে সম্পদশালী ব্যক্তির সমান ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য তার এ সৌভাগ্য হয় দীনী ইলমের বদৌলতে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمَ يَرْزُقْهُ عِلْمًا، فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ، لَا يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ وَلَا يَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَلَا يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, কিন্তু 'ইলম দেননি। সে 'ইলম ছাড়াই তার মালের ভেতর খেয়াল-খুশির আচরণ করে। এ বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে না, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং এর ভেতর সে আল্লাহ তা'আলার কোনও হক জানে না)। অর্থাৎ ইলম না থাকার কারণে সে আল্লাহ তা'আলাকে চিনতে পারে না। আর তাঁকে চিনতে না পারায় তাঁকে ভয়ও করে না। ফলে অর্জিত মাল সে নাজায়েয পন্থায় খরচ করে। না তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করে, না বান্দার হক। উল্টো সে মালের লোভে পড়ে যায়। লোভ পূরণের জন্য সে নানা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। সে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। হয়ে যায় অহংকারী ও ঈর্ষাকাতর। এভাবে সম্পদ তার জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তার পাপের বোঝা ভারী হতে থাকে।
فَهذَا بأَخْبَثِ الْمَنازِل (এটা হল সর্বনিকৃষ্ট স্তর)। অর্থাৎ দীনী ইলম না থাকার কারণে সে যে তার অর্থ-সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন ও অবৈধ খাতে খরচ করতে থাকে, আর সম্পদের নেশায় পড়ে হাজারও কুকর্মে জড়িত হয়ে যায়, তার পরিণামে পাপীদের মধ্যেও সর্বনিকৃষ্ট স্তরে সে পৌঁছে যায়।
وَعَبْد لَمْ يَرْزُقهُ اللَّهُ مَالًا وَلَا عِلْمًا فَهُوَ يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ فِيْهِ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মালও দেননি, 'ইলমও না। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে আমি তাতে অমুক ব্যক্তির মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ এ ব্যক্তির মালও নেই, ইলমও নেই। মাল না থাকার কারণে দরকার ছিল সবর করা। কিন্তু ইলম না থাকায় সে উল্টো আক্ষেপ করে আর বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে ওই ব্যক্তির মতো বিলাসিতা করতাম। আমিও তার মতো সে মাল পাপাচারে ব্যয় করতাম। অর্থাৎ তার নিয়ত হল কোনওভাবে সম্পদ অর্জিত হয়ে গেলে সে বিলাসিতায় গা ডুবিয়ে দেবে এবং অসৎপথে তা খরচ করবে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ (সেও তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচিত হয়। এদের দু'জনের পাপভার সমান সমান)। অর্থাৎ তার নিয়ত যেহেতু খারাপ, তাই আল্লাহ তা'আলা তাকে সে অনুসারে প্রতিফল দেন। তার নিয়ত তৃতীয় ব্যক্তির মতো সম্পদের অসৎ ব্যবহার করা। তাই অসৎ ব্যবহারের দরুন ওই ব্যক্তির আমলনামায় যেমন পাপ লেখা হয়, এই ব্যক্তির আমলনামায়ও তদ্রূপ পাপ লেখা হয়ে থাকে। এভাবে উভয়ের পাপভার সমান সমান হয়ে যায়।
দেখা যাচ্ছে এই চতুর্থ ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও মালের অসৎ ব্যবহার করার যে গুনাহ, সেই গুনাহের ভারে আক্রান্ত হয়ে গেল। এর কারণ কেবল তার দীনী ইলমে অজ্ঞতা। ইলম না থাকার দরুনই সে মাল সম্পর্কে ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা পোষণ করেছে। প্রথম ব্যক্তি মালের সদ্ব্যবহার করেছে দীনী ইলম থাকার কারণে। দ্বিতীয় ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও সৎপথে মাল খরচ করার ছাওয়াব পেয়ে গেছে, তাও দীনী ইলমের বদৌলতে। তৃতীয় ব্যক্তি অসৎপথে মাল খরচ করে গুনাহগার হয়েছে দীনী ইলমের অভাবে। চতুর্থ ব্যক্তিও মাল না থাকা সত্ত্বেও অসৎপথে মাল খরচ করার গুনাহে গুনাহগার হয়েছে, এরও কারণ কেবল ইলম না থাকা। সুতরাং ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। যে ব্যক্তি ইলম পেয়ে যায়, সে এক মহাদৌলত পায়। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় এর মাধ্যমে সে বহুবিধ পাপ থেকে বাঁচতে পারে এবং দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হতে পারে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মূল্যবান কথা যাতে অবহেলার শিকার না হয়; বরং শ্রোতা তা মনে রাখে, সেজন্য তাদেরকে বিশেষভাবে তাগিদ করা চাই।
খ. সম্পদের পাশাপাশি যদি দীনী ইলমও অর্জিত হয়, তবে তা বড়ই সৌভাগ্য।
গ. যার সম্পদ আছে তার কর্তব্য তাতে আল্লাহর ও বান্দার হক বুঝে নেওয়া।
ঘ. সম্পদশালী ব্যক্তির উচিত তার সম্পদ দ্বারা বিশেষভাবে আত্মীয়-স্বজনের সেবা করা।
ঙ. যার সম্পদ নেই কিন্তু ইলম আছে, সেও একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। তার উচিত নিজ ইলমের জন্য শোকরগুযার হয়ে থাকা।
চ. যার সম্পদ আছে কিন্তু ইলম নেই, তার কর্তব্য সম্পদের ক্ষতি থেকে বাঁচা ও তার উপকার লাভ করার উদ্দেশ্যে দীনের জরুরি ইলম শিখে নেওয়া।
ছ. যার সম্পদও নেই ইলমও নেই, তাকে অবশ্যই উপার্জনের চেষ্টা করার পাশাপাশি দীনের জরুরি ইলমও শিখতে হবে।
জ. নেক আমল না করেও কেবল নিয়তের দ্বারা আমলের ছাওয়াব অর্জন করা যেতে পারে, যদি সে নিয়ত খালেস হয়। অনুরূপ অসৎকর্ম না করেও মানুষ গুনাহগার হতে পারে, যদি নিয়ত মন্দ হয়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য নিজ নিয়ত খালেস করে নেওয়া।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে যে কথাটি স্মরণ রাখতে বলেছেন তা নিম্নরূপ-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لِأَرْبَعَةِ نَفَرٍ (দুনিয়া কেবল চার শ্রেণির লোকের জন্য)। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদের দিক থেকে মানুষের অবস্থা চার রকম। তারপর সে চার রকম লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা নিম্নরূপ-
عَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا ، فَهُوَ يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ ، وَيَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মাল ও 'ইলম দান করেছেন। সে এ বিষয়ে তার প্রতিপালককে ভয় করে, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে এবং এর ভেতর সে আল্লাহর হক সম্পর্কে সচেতন থাকে)। অর্থাৎ সম্পদের সঙ্গে যেহেতু তার ইলমও আছে, তাই সে ইলম অনুযায়ী সম্পদের ব্যবহার করে। ফলে সে তার সম্পদ কোনও পাপকর্মে ব্যয় করে না। যে খাতে ব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা নারাজ হতে পারেন, তা থেকে বিরত থাকে। কেবল শরী'আত অনুযায়ীই তা খরচ করে। তার মধ্যে একটা বিশেষ দিক হল আত্মীয়তা রক্ষা করা। সে নিজ অর্থ-সম্পদ দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের খেদমত করে। পাশাপাশি তাতে বান্দার যত হক আছে তাও আদায় করে। এমনিভাবে তার সম্পদে আল্লাহ তা'আলার কি কি হক আছে তাও বুঝে বুঝে আদায় করে। যেমন যাকাত, সদাকায়ে ফিতর, মানত ও কাফফারা। এগুলো আদায় করা ফরয। সে তা যথাযথভাবে আদায় করে। তাছাড়া 'ফরযে কিফায়া' হিসেবে যেসকল খাতে অর্থব্যয় করা জরুরি, সেসব খাতেও ব্যয় করে। যেমন মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া ইত্যাদি।
فَهذَا بِأَفْضَلِ الْمَنازِلِ (এটা হল সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর)। অর্থাৎ এ ব্যক্তি জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরে থাকবে। কেননা সে দীন শিখেছে, সেই শিক্ষা অনুযায়ী অর্থ-সম্পদের ব্যবহার করেছে, অর্থ-সম্পদকে নিষিদ্ধ খাতে ব্যয় করা হতে বিরত থেকেছে এবং আল্লাহর সন্তোষজনক খাতে তা ব্যয় করেছে। এভাবে নিজের ইলম ও মাল আল্লাহ তা'আলার মর্জিমতো ব্যবহার করায় আল্লাহর কাছে সে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا ، وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالًا، فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ، يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ 'ইলম দিয়েছেন, কিন্তু মাল দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আমার যদি ধন-সম্পদ থাকত, তবে আমি অমুক ব্যক্তির আমলের মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ দীনী ইলমের অধিকারী হওয়ার কারণে সে তার নিয়ত খালেস করতে পারে। সে জানে অর্থ-সম্পদ কীভাবে অর্জন করতে হয় এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করতে হয়। তাই সে সংকল্প করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে সম্পদ দিলে শরী'আত মোতাবেক তা খরচ করবে এবং তা থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করবে, যেমন প্রথমোক্ত ব্যক্তি করে থাকে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ، فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ (তাকে তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচনা করা হয়। এ দুই ব্যক্তির প্রতিদান সমান সমান)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার খালেস নিয়ত অনুসারে তার সঙ্গে ব্যবহার করেন। তার সংকল্প অনুযায়ী তাকে প্রতিদান দেন। তার সংকল্প যেহেতু প্রথম ব্যক্তির আমলের মতো আমল করা, তাই তার মতোই ছাওয়াব তাকে দেওয়া হয়। এভাবে সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সে সম্পদশালী ব্যক্তির সমান ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য তার এ সৌভাগ্য হয় দীনী ইলমের বদৌলতে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمَ يَرْزُقْهُ عِلْمًا، فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ، لَا يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ وَلَا يَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَلَا يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, কিন্তু 'ইলম দেননি। সে 'ইলম ছাড়াই তার মালের ভেতর খেয়াল-খুশির আচরণ করে। এ বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে না, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং এর ভেতর সে আল্লাহ তা'আলার কোনও হক জানে না)। অর্থাৎ ইলম না থাকার কারণে সে আল্লাহ তা'আলাকে চিনতে পারে না। আর তাঁকে চিনতে না পারায় তাঁকে ভয়ও করে না। ফলে অর্জিত মাল সে নাজায়েয পন্থায় খরচ করে। না তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করে, না বান্দার হক। উল্টো সে মালের লোভে পড়ে যায়। লোভ পূরণের জন্য সে নানা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। সে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। হয়ে যায় অহংকারী ও ঈর্ষাকাতর। এভাবে সম্পদ তার জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তার পাপের বোঝা ভারী হতে থাকে।
فَهذَا بأَخْبَثِ الْمَنازِل (এটা হল সর্বনিকৃষ্ট স্তর)। অর্থাৎ দীনী ইলম না থাকার কারণে সে যে তার অর্থ-সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন ও অবৈধ খাতে খরচ করতে থাকে, আর সম্পদের নেশায় পড়ে হাজারও কুকর্মে জড়িত হয়ে যায়, তার পরিণামে পাপীদের মধ্যেও সর্বনিকৃষ্ট স্তরে সে পৌঁছে যায়।
وَعَبْد لَمْ يَرْزُقهُ اللَّهُ مَالًا وَلَا عِلْمًا فَهُوَ يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ فِيْهِ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মালও দেননি, 'ইলমও না। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে আমি তাতে অমুক ব্যক্তির মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ এ ব্যক্তির মালও নেই, ইলমও নেই। মাল না থাকার কারণে দরকার ছিল সবর করা। কিন্তু ইলম না থাকায় সে উল্টো আক্ষেপ করে আর বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে ওই ব্যক্তির মতো বিলাসিতা করতাম। আমিও তার মতো সে মাল পাপাচারে ব্যয় করতাম। অর্থাৎ তার নিয়ত হল কোনওভাবে সম্পদ অর্জিত হয়ে গেলে সে বিলাসিতায় গা ডুবিয়ে দেবে এবং অসৎপথে তা খরচ করবে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ (সেও তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচিত হয়। এদের দু'জনের পাপভার সমান সমান)। অর্থাৎ তার নিয়ত যেহেতু খারাপ, তাই আল্লাহ তা'আলা তাকে সে অনুসারে প্রতিফল দেন। তার নিয়ত তৃতীয় ব্যক্তির মতো সম্পদের অসৎ ব্যবহার করা। তাই অসৎ ব্যবহারের দরুন ওই ব্যক্তির আমলনামায় যেমন পাপ লেখা হয়, এই ব্যক্তির আমলনামায়ও তদ্রূপ পাপ লেখা হয়ে থাকে। এভাবে উভয়ের পাপভার সমান সমান হয়ে যায়।
দেখা যাচ্ছে এই চতুর্থ ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও মালের অসৎ ব্যবহার করার যে গুনাহ, সেই গুনাহের ভারে আক্রান্ত হয়ে গেল। এর কারণ কেবল তার দীনী ইলমে অজ্ঞতা। ইলম না থাকার দরুনই সে মাল সম্পর্কে ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা পোষণ করেছে। প্রথম ব্যক্তি মালের সদ্ব্যবহার করেছে দীনী ইলম থাকার কারণে। দ্বিতীয় ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও সৎপথে মাল খরচ করার ছাওয়াব পেয়ে গেছে, তাও দীনী ইলমের বদৌলতে। তৃতীয় ব্যক্তি অসৎপথে মাল খরচ করে গুনাহগার হয়েছে দীনী ইলমের অভাবে। চতুর্থ ব্যক্তিও মাল না থাকা সত্ত্বেও অসৎপথে মাল খরচ করার গুনাহে গুনাহগার হয়েছে, এরও কারণ কেবল ইলম না থাকা। সুতরাং ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। যে ব্যক্তি ইলম পেয়ে যায়, সে এক মহাদৌলত পায়। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় এর মাধ্যমে সে বহুবিধ পাপ থেকে বাঁচতে পারে এবং দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হতে পারে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মূল্যবান কথা যাতে অবহেলার শিকার না হয়; বরং শ্রোতা তা মনে রাখে, সেজন্য তাদেরকে বিশেষভাবে তাগিদ করা চাই।
খ. সম্পদের পাশাপাশি যদি দীনী ইলমও অর্জিত হয়, তবে তা বড়ই সৌভাগ্য।
গ. যার সম্পদ আছে তার কর্তব্য তাতে আল্লাহর ও বান্দার হক বুঝে নেওয়া।
ঘ. সম্পদশালী ব্যক্তির উচিত তার সম্পদ দ্বারা বিশেষভাবে আত্মীয়-স্বজনের সেবা করা।
ঙ. যার সম্পদ নেই কিন্তু ইলম আছে, সেও একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। তার উচিত নিজ ইলমের জন্য শোকরগুযার হয়ে থাকা।
চ. যার সম্পদ আছে কিন্তু ইলম নেই, তার কর্তব্য সম্পদের ক্ষতি থেকে বাঁচা ও তার উপকার লাভ করার উদ্দেশ্যে দীনের জরুরি ইলম শিখে নেওয়া।
ছ. যার সম্পদও নেই ইলমও নেই, তাকে অবশ্যই উপার্জনের চেষ্টা করার পাশাপাশি দীনের জরুরি ইলমও শিখতে হবে।
জ. নেক আমল না করেও কেবল নিয়তের দ্বারা আমলের ছাওয়াব অর্জন করা যেতে পারে, যদি সে নিয়ত খালেস হয়। অনুরূপ অসৎকর্ম না করেও মানুষ গুনাহগার হতে পারে, যদি নিয়ত মন্দ হয়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য নিজ নিয়ত খালেস করে নেওয়া।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
