মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫১৭৮
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
৫১৭৮। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ তোমরা বাগ-বাগিচা ও ক্ষেত-খামার ( আগ্রহের সহিত) গ্রহণ করিও না। ফলে তোমরা দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িবে। —তিরমিযী ও বায়হাকী
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَتَّخِذُوا الضَّيْعَةَ فَتَرْغَبُوا فِي الدُّنْيَا» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَالْبَيْهَقِيُّ فِي «شعب الْإِيمَان»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. অর্থাৎ, জীবনধারণের জন্য যেই পরিমাণ প্রয়োজন উহাতেই তুষ্ট থাক। অধিক সম্পদ সংগ্রহের প্রতি মনোনিবেশ আল্লাহর যিকর হইতে গাফেল ও উদাসীন করিয়া ফেলে, প্রকৃত মু'মিনের পরিচয় হইল, رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ “এমন সব লোক আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করিয়া থাকে, যাহাদিগকে ক্রয় ও বিক্রয় গাফেল করিয়া রাখিতে পারে না আল্লাহর যিকর হইতে এবং নামায আদায় করা ও যাকাত দেওয়া হইতে।” –সূরা নূর

২. হাদীসে الضيعة শব্দটির মূল অর্থ ভূমি। আন-নিহায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, শিল্পকর্ম, ব্যবসা, চাষাবাদ ইত্যাদি যা-কিছু দ্বারাই কারও জীবিকা নির্বাহ হয়, তাকেই তার ضيعة বলা হয়। আল-কামূস গ্রন্থে আছে, ضيعة হল স্থাবর সম্পত্তি ও এমন জমি, যা দ্বারা আয় করা যায়।

এ হাদীছে জমি অর্জন করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ বলা হয়েছে- فَتَرْغَبُوا في الدُّنْيَا (তাহলে তোমরা দুনিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়বে)। অর্থাৎ তোমরা চাষাবাদে লিপ্ত হয়ে আখিরাত ভুলে যাবে। বোঝা গেল এ নিষেধাজ্ঞা সাধারণভাবে সকলের জন্য নয়; বরং যারা জমি-জমায় এমনভাবে লিপ্ত হয়, যদ্দরুন ইবাদত-বন্দেগীর কথা ভুলে যায় ও আখিরাত সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে, এ নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্যই প্রযোজ্য। ইমাম তীবী রহ. বলেন, এর অর্থ হল তোমরা জমি-জমা গ্রহণে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়ে যেয়ো না, যদ্দরুন আল্লাহর যিকির থেকে উদাসীন হয়ে পড়। কেননা আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
رجالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلوةِ وَإِيتَاءِ الزَّكوة
"এমন লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচাকেনা আল্লাহর স্মরণ, নামায কায়েম ও যাকাত আদায় থেকে গাফেল করতে পারে না।"

ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন, হাদীছটির অর্থ হল তোমরা যদি এ আশঙ্কা বোধ কর যে, জমি-জমায় লিপ্ত হলে আখিরাত সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়বে, তবে এতে লিপ্ত হয়ো না। পক্ষান্তরে সে ভয় না থাকলে তোমরা তাতে লিপ্ত হতে পার। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজেরও জমি ছিল। খায়বার ও ফাদাকের কিছু ভূমি তিনি নিজের জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন। তিনি তা দ্বারা স্ত্রীদের বার্ষিক খরচা দিতেন। তাছাড়া দীনী বিভিন্ন জরুরতেও তা থেকে খরচ করতেন। আনসার সাহাবাগন অনেকেরই ক্ষেত-খামার ছিল। অনেকে বড় বড় খেজুর বাগানের মালিক ছিলেন। মদীনা মুনাওয়ারার অধিবাসীদের উপার্জনের মূল উৎসই ছিল খেজুর বাগান।

বিভিন্ন হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাষাবাদের প্রতি উৎসাহও যুগিয়েছেন। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
ما مِنْ مُسلِم يَغرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا، فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانُ أَوْ بَهِيمَةٌ، إِلَّا كان له به صدقة
যে-কোনও মুসলিম কোনও গাছ লাগায় বা ফসল বোনে, তারপর তা থেকে কোনও পাখি, মানুষ বা পশু খায়, তার জন্য তার বিনিময়ে সদাকার ছাওয়াব হয়।

কুরআন মাজীদে ভূমি থেকে ফসল উৎপন্ন করাকে আল্লাহ তা'আলা বান্দার প্রতি তাঁর বিশেষ এক নি'আমতরূপে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
{أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَحْرُثُونَ (63) أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونَ } [الواقعة: 63، 64]
“তোমরা কি ভেবে দেখেছ, তোমরা জমিতে যা-কিছু বোন, তা কি তোমরা উদগত কর, না আমিই তার উদগতকারী?"

সুতরাং হাদীছটিতে জমি-জমায় লিপ্ত হওয়াকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেউ যাতে এর আসক্তিতে পড়ে না যায় সে ব্যাপারে সাবধান করা। কেননা জমি-জায়েদাদে বাড়তি আকর্ষণ রয়েছে।

কুরআনে ইরশাদ হয়েছে
كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ
যেন এক শস্যক্ষেত্র, যা তার কুঁড়ি বের করল, তারপর তাকে শক্ত করল। তারপর তা পুষ্ট হল। তারপর তা নিজ কাণ্ডের উপর এভাবে সোজা দাঁড়িয়ে গেল যে, তা কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে ফেলে।

তাছাড়া অন্যান্য উপার্জনমাধ্যম অপেক্ষা এ মাধ্যমটি একটু জটিলও। এর পেছনে অতিরিক্ত মেহনতের দরকার হয়। খুব বেশি খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। নিয়মিত খবর না নিলে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হওয়ার বিষয়টি এর নামের মধ্যেই নিহিত আছে। ضيع এর আক্ষরিক অর্থ নষ্ট হওয়া, খোওয়া যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া। জনৈক বিজ্ঞজন বলেন, জমি-জমা বহু পেরেশানির সিঁড়ি। তুমি যদি এর খোঁজখবর রাখ তবে ভালো থাকবে। আর খোঁজখবর না রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে।

খলীফা হিশাম আবরাশকে একখণ্ড জমি দিয়েছিলেন। পরে তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিয়েছিল, আমি জানি না সেটির কী অবস্থা। হিশাম বললেন, যদি না এমন হতো যে, হিবা প্রত্যাহারকারী নিজ বমি পুনরায় গলাধঃকরণকারীতুল্য, তবে আমি তোমার কাছ থেকে এ জমি ফেরত নিয়ে নিতাম। তুমি জান না জমিকে বলা হয়ই এ কারণে যে, খোঁজখবর না রাখলে তা নষ্ট হয়ে যায়।
ইমাম গাযালী রহ. বলেন, জমি-জমায় লিপ্ত হওয়াটা আল্লাহর যিকির হতে উদাসীন করে দেয়। অথচ আল্লাহর যিকিরই পরকালীন সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। উদাসীন হয়ে পড়ার কারণ এই যে, তাতে লিপ্ত হওয়ার কারণে অন্তরে অনেকগুলো পেরেশানি জমা হয়ে যায়। চাষীসুলভ কঠিন-কঠোর আচরণ, অংশীদার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ, ক্ষয়-ক্ষতি হতে রক্ষণাবেক্ষণের চিন্তা-ভাবনা, আয় ও ফসল বৃদ্ধির ব্যবস্থাপনা, ফসল ঘরে তোলার দৌড়ঝাঁপ, হেফাজতের ব্যবস্থাকরণ, তারপর তা কোথায় কিভাবে খরচ করা হবে তার চিন্তা-ফিকির, এর প্রত্যেকটিই এমন যে, তাতে অন্তর মলিন হয়, কলবের সচ্ছতা নষ্ট হয় এবং আল্লাহর যিকির সম্পর্কে উদাসীনতা জন্মায়। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ
একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জীবিকা নির্বাহের জন্য জমি-জমা অপেক্ষা অন্য কোনও সহজ মাধ্যম পাওয়া গেলে তাই অবলম্বন করা শ্রেয়।

খ. জমি-জমার মাধ্যমে আয়-রোযগার করলে সে ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকা জরুরি, যাতে এর কারণে আখিরাতের প্রতি উদাসীনতা না এসে যায়।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৫১৭৮ | মুসলিম বাংলা