মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
২৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং: ৫১৭৬
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
৫১৭৬। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ সাবধান! নিশ্চয় দুনিয়া অভিশপ্ত, ইহার মধ্যে যাহা কিছু আছে তন্মধ্যে আল্লাহর যিকর ও আল্লাহ্ যাহা কিছু পছন্দ করেন এবং জ্ঞানী ও জ্ঞান অন্বেষণকারী ব্যতীত সব কিছুই অভিশপ্ত। —তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ্
وَعَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَلَا إِنَّ الدُّنْيَا مَلْعُونَةٌ مَلْعُونٌ مَا فِيهَا إِلا ذكرُ الله وَمَا وَالَاهُ وَعَالِمٌ أَوْ مُتَعَلِّمٌ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে দুনিয়ার কতটুকু বর্জনীয় ও কতটুকু গ্রহণীয় তা স্পষ্ট করা হয়েছে। প্রথমত সাধারণভাবেই দুনিয়া ও দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত সবকিছুকেই মালউন ও অভিশপ্ত বলা হয়েছে।
তারপর ব্যতিক্রম হিসেবে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো অভিশপ্ত তো নয়ই; বরং দুনিয়ায় যতদিন থাকা হয় ততদিন বান্দার অবশ্যকর্তব্য সেগুলোতে মনোযোগী থাকা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম ইরশাদ করেন-
أَلَا إِنَّ الدُّنْيَا مَلْعُوْنَةٌ، مَلْعُون مَا فِيهَا (শোন, দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছুই অভিশপ্ত)। অর্থাৎ দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তুসামগ্রী আল্লাহ তা'আলার কাছে অপ্রিয়। কেননা তা নিজ আকর্ষণ দ্বারা মানবমনকে ধোঁকায় ফেলে দেয়। মানুষ এর চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে বন্দেগীর পথ ছেড়ে অসৎ চাহিদা পূরণে লেগে পড়ে। হিদায়াতের পথ ছেড়ে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে যায়।
বাক্যটির এরকম অর্থও করা যায় যে, দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু পরিত্যক্ত। لعن এর এক অর্থ পরিত্যাগ করা। নবী-রাসূল ও আল্লাহওয়ালাগণ সর্বদাই দুনিয়ার মোহ-ভালোবাসা পরিত্যাগ করে চলেছেন। তাঁরা এর আনন্দ-আস্বাদ উপভোগে লিপ্ত হননি। এর প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের পেছনে পড়েননি। তাঁরা নারী-সৌন্দর্য, পুত্র-কন্যার আসক্তি, ধন- দৌলতের মোহ ও বহুদিন বেঁচে থাকার আশায় নিমজ্জিত হয়ে আখিরাতের করণীয় কাজ পিছিয়ে দেননি। তাতে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেননি। তাঁরা এসবকে নিজেদের বলে মনেই করেননি। এসবে মোহিত হয়ে যাওয়াকে তাঁরা কাফের-বেঈমানের কাজ বলেই গণ্য করতেন। কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাই ছিল-
اللهم لا عيش إلا عيش الآخره
"হে আল্লাহ! আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন।
একবার তিনি হযরত উমর ফারূক রাযি. কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
أَمَا تَرْضَى أَن تَكُونَ لَهُمُ الدُّنْيَا وَلَنَا الآخِرَةُ
'তুমি কি এতে খুশি নও যে, তাদের হবে দুনিয়া আর আমাদের আখিরাত?"
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি বিষয়কে আলাদা করেছেন, যেগুলো অভিশপ্ত নয়, বর্জনীয় নয়; বরং কাম্য ও বাঞ্ছনীয়। তিনি ইরশাদ করেন-
إِلا ذِكْرَ اللهِ تَعَالَى، وَمَا وَالاهُ، وَعَالِمًا وَمُتَعَلَّما (ব্যতিক্রম কেবল আল্লাহ তা'আলার যিকির এবং যা তিনি ভালোবাসেন (বা যা-কিছু তাঁর নিকটবর্তী করে দেয়) আর আলেম ও ইলম শিক্ষার্থী)। এর মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে আল্লাহর যিকির। এটা সমস্ত ইবাদত-বন্দেগীর প্রাণবস্তু। যেমন নামায সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وأقم الصلوة لذكري
“নামায কায়েম করো আমার যিকির ও স্মরণের জন্য।"
আরও ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الصَّلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَلَذِكرُ الله أكبر
'নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর যিকিরই তো সর্বাপেক্ষা বড় জিনিস।
যিকির মনে মনেও হতে পারে, মৌখিকভাবেও হতে পারে। মনের যিকির হল আল্লাহ তা'আলার কুদরত ও হিকমতের ধ্যান করা, তাঁর বড়ত্ব ও গৌরব কল্পনা করা, তাঁর নি'আমতরাজির মূল্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা, অন্তরে তাঁর ভয় রাখা ও তাঁর কাছে আশাবাদী থাকা। মৌখিক যিকির বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহ আল্লাহ ইত্যাদি যিকির করা। আল্লাহর কাছে দু'আ করা এবং তাওবা-ইস্তিগফার করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যিকির। যে-কোনও আমলের আগের ও পরের দু'আসমূহও অতি মূল্যবান যিকির বটে। কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত সর্বোত্তম যিকির। অবশ্য সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি যিকির হল আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করা ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। তবে এ হাদীছে যেহেতু এর পরে والاه শব্দটি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাই শরীআতের আদেশ-নিষেধ মানার বিষয়টি তার মধ্যে চলে যাবে। না হয় সাধারণভাবে যিকিরের মধ্যে সমগ্র দীন ও শরীআতই এসে যায়।
দ্বিতীয় যে বিষয়কে অভিশপ্তের বাইরে রাখা হয়েছে তা হল وَمَا وَالاهُ এর উৎপত্তি الموالاة থেকে। এর মূল ধাতু ولي অর্থ বন্ধুত্ব ও নৈকট্য। الموالاة এর অর্থ একে অন্যের নিকটবর্তী হওয়া, একে অন্যকে ভালোবাসা। এটা মৌলিকভাবে দ্বিপাক্ষিক হলেও কখনও কখনও একপাক্ষিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কারও নিকটবর্তী হওয়া বা কাউকে ভালোবাসা। তো শব্দটি দ্বারা বোঝানো হচ্ছে আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু ভালোবাসেন তা অভিশপ্ততার বাইরে। যেমন আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য, যা তিনি করতে বলেছেন তা করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকা। আবার এগুলো এমন কাজ, যা বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার নিকটবর্তীও করে দেয়। তাই এসব কাজ অভিশপ্ত তো নয়ই; বরং একান্ত বাঞ্ছনীয়।
তৃতীয়ত বলা হয়েছে عالما (আলেম)। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান রাখে এমন ব্যক্তি। ফিক্হ ও তাসাওউফ (ইসলামী আখলাক) কুরআন ও হাদীছের ইলমেরই সারনির্যাস। তাই এ সম্পর্কিত জ্ঞানও কুরআন ও হাদীছের জ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত। এর সমষ্টি হচ্ছে দীনী ইলম। সুতরাং সামগ্রিকভাবে যে ব্যক্তি যথেষ্ট পরিমাণ দীনী ইলম রাখেন তাকেই আলেম বলা যায়। একজন যথার্থ আলেমের জন্য ইলমের সঙ্গে আমলের চর্চা থাকাও শর্ত। বরং কুরআন ও হাদীছের পরিভাষায় প্রকৃত আলেম তাকেই বলা হয়, যিনি ইলম চর্চার পাশাপাশি আমলের সাধনায়ও রত থাকেন। আল্লাহ তা'আলার কাছে এরূপ আলেমের অনেক মর্যাদা। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَرْفَع اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أوتُوا الْعِلْمَ دَرَجتٍ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِير
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যাদেরকে ইলম দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন। তোমরা যা-কিছু কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে পরিপূর্ণ অবগত।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقههُ فِي الدِّينِ
'আল্লাহ তা'আলা যার কল্যাণ চান তাকে দীনের গভীর জ্ঞান-বুঝ দান করেন।
অপর এক হাদীছে আছে-
فَضْلُ الْعَالِم عَلَى الْعَابِدِ كَفَضلِي عَلى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ : إِنَّ الله وَمَلائِكَتَهُ وَأَهل السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا، وَحَتَّى الْحُوْت ليصَلُّونَ عَلى مُعَلِّمِي النَّاسِ الْخَيْر
আবেদের উপর আলেমের মর্যাদা ঠিক তেমনি, যেমন তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার মর্যাদা। নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ এবং আসমান ও যমীনের সকল বাসিন্দা এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও মাছ পর্যন্ত তার জন্য দু'আ করে, যে মানুষকে কল্যাণকর বিষয় শিক্ষা দেয়।
আরও এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ حَتَّى الْحيْتانُ فِي الْمَاءِ، وفضلُ الْعَالِم عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وَإِنَّ الْعُلَمَاء وَرَثة الأنبياء، وإن الأنبياء لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلا دِرْهَمَا، وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذ بحظ وافر
“নিশ্চয়ই আলেমের জন্য ইস্তিগফার করে থাকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকল বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত। সমস্ত তারকার উপর চাঁদের যেমন শ্রেষ্ঠত্ব, তেমনি আবেদের উপর রয়েছে আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব। আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ। নবীগণ দীনার ও দিরহামের মীরাছ রেখে যান না। তাঁরা ইলমের মীরাছ রেখে যান। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করে সে কল্যাণের ভরপুর অংশ বহন করে।"
এসব হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, আল্লাহর কাছে আলেমের মর্যাদা কত উঁচু। তাই আমাদেরও আলেমদেরকে বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা একান্ত কর্তব্য। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে সতর্ক করেন-
ليْسَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ لَمْ يُجِلَّ كَبِيرَنَا ، وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا، وَيَعْرِف لِعَالِمِنَا حَقَّهُ.
ওই ব্যক্তি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের মর্যাদা বোঝে না।
সবশেষে বলা হয়েছে متعلما (ইলম শিক্ষার্থী)। যারা ইলমে দীনের শিক্ষার্থী তথা তালিবে ইলম, আল্লাহ তা'আলার কাছে তারা অত্যন্ত মর্যাদাবান। বিভিন্ন হাদীছে তাদের উচ্চ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
من سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهلَ اللهُ لَهُ بِه طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ.
“যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে কোনও পথ চলে, আল্লাহ তা'আলা সে কারণে তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।”
অপর এক হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضَاء لِطَالِبِ الْعِلْمِ
"নিশ্চয়ই ফিরিশতাগণ তালিবে ইলমের সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেয়।"
হাদীছে যে চারটি বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম দু'টি হচ্ছে আমল আর দ্বিতীয় দু'টি আমলওয়ালা ব্যক্তি। এ হিসেবে হাদীছটির অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ তাআলার যিকর ও আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন ছাড়া দুনিয়ার যাবতীয় কাজকর্ম অভিশপ্ত। আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালনও তাঁর যিকরেরই অন্তর্ভুক্ত। কাজেই মূল আমল একটিই- আল্লাহর যিকর। শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন এরই শাখা-প্রশাখা।
দ্বিতীয় দু'টি বিষয়ের হাকীকতও এই যে, যাদের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার যিকর আছে কেবল তারাই অভিশাপ থেকে মুক্ত। আলেম ও তালিবে ইলম বলতে ইলমের চর্চাকারীকে বোঝায়। ইলমের চর্চাকারী মূলত আল্লাহ তা'আলার যিকরকারীই। আল্লাহপ্রদত্ত ইলম নিয়ে ব্যস্ত থাকা আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণে ব্যস্ত থাকা ছাড়া তো আর কিছুই নয়। কেননা তার কাজ হচ্ছে ইলম শেখা বা শেখানো এবং সে অনুযায়ী আমল করা। যারা উলামা নয় তারা সত্যিকারের আমলওয়ালা কেবল তখনই হবে, যখন কোনও না কোনও পর্যায়ের তালিবে ইলমও হবে। আনুষ্ঠানিক তালিবে ইলম না হলেও তার আমলের জন্য যতটুকু ইলম প্রয়োজন, ততটুকু ইলম তাকে শিখতেই হবে। যারা কোনও স্তরেরই ইলম শেখে না, তারা নিতান্তই জাহেল ও অজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে তাদের কোনও আমলও নেই। না যিকর, না নামায, না হালাল-হারামে পার্থক্যকরণ। সম্পূর্ণ জাহেলানা জীবনই সে যাপন করে। এরূপ জীবন অভিশপ্ত জীবনই বটে।
এ হাদীছের মূল বার্তা এটাই যে, বান্দা যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন তাকে আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণের সঙ্গেই থাকতে হবে। দুনিয়ার আসক্তিতে নিমজ্জিত হওয়া যাবে না। আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়াকে তুচ্ছ গণ্য করতে হবে। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাজই করা হবে, তবে মনঃপ্রাণ ডুবে থাকবে আল্লাহর ভালোবাসায়। সে আনন্দ পাবে আল্লাহর যিক্রে। তৃপ্তিবোধ করবে শরী'আত পালনে। ভাত-রুটি হবে তার দেহের খোরাক, কিন্তু প্রাণের খোরাক হবে শরী'আত পালন।
শরী'আত পালনে যত্নবান থাকলে সে আল্লাহর সাহায্য পাবে। আল্লাহ তা'আলা তাকে দুনিয়ার আসক্তি থেকে হেফাজত করবেন। ফলে কোনওরকম অবৈধ লিপ্ততা দ্বারা তার দেহমন কলঙ্কিত হবে না। নির্বিচার দুনিয়াদারী তাকে স্পর্শই করতে পারবে না। এরূপ ব্যক্তি যখন দুনিয়ার কাজকর্ম করবে, তখন তার ভেতর দিয়েও তার আখিরাতই সঞ্চিত হতে থাকবে। কেননা আল্লাহর যিকরের সঙ্গে যে কাজ হয় তা দুনিয়ার কাজ হলেও বান্দাকে আল্লাহর দিকেই টেনে নেয়। পক্ষান্তরে যে কাজ আল্লাহর যিকির ও স্মরণের সঙ্গে হয় না, তা বাহ্যদৃষ্টিতে আখিরাতের কাজ হলেও প্রকৃতপক্ষে তা দুনিয়ার কাজই বটে। এরূপ কাজও একরকম দুনিয়াদারী এবং তা অভিশপ্ত দুনিয়ারই অংশ।
কাজেই হাদীছে দুনিয়াকে যে অভিশপ্ত বলা হয়েছে তা দ্বারা দুনিয়ার এমন লিপ্ততাকে বোঝানো উদ্দেশ্য, যা আল্লাহ তা'আলার যিকরের সঙ্গে করা হয় না এবং যার লক্ষ্যবস্তু আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিও হয় না। তাঁর যিকরের সঙ্গে অর্থাৎ শরী'আতসম্মতভাবে ও তাঁর সন্তুষ্টিলাভের লক্ষ্যে দুনিয়ার যে কাজই করা হয়, শেষটায় তা আখিরাতই হয়। তাই এক বর্ণনায় এসেছে-
لا تسبوا الدُّنْيا فَنِعْمَ مَطيَّةُ الْمُؤمِن عَلَيْهَا ، يَبْلُغُ الْجَنَّةَ بِهَا وَيَنْجُو مِنَ النَّارِ.
"তোমরা দুনিয়াকে গালমন্দ করো না। কেননা দুনিয়া মুমিনের উৎকৃষ্ট বাহন। সে এর মাধ্যমে জান্নাতে পৌঁছে এবং এর মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়।"
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহর যিকির শ্রেষ্ঠতম আমল ও সমস্ত ইবাদতের প্রাণশক্তি।
খ. বান্দা কর্তৃক শরী'আতের আদেশ-নিষেধ পালন আল্লাহর কাছে প্রিয়। এর দ্বারাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। তাই দুনিয়ায় এটাকেই মূল কাজ বানানো চাই।
গ. আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণবিহীন যাবতীয় কাজ অভিশপ্ত কাজ। তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
ঘ. চাকচিক্যময় দুনিয়ার ভালোবাসায় নিমজ্জিত হওয়ার পরিণাম আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাওয়া। তাই দুনিয়ার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে হবে বটে, তবে অন্তরে এর ভালোবাসা স্থান দেওয়া যাবে না।
ঙ. আল্লাহর কাছে উলামায়ে কিরামের মর্যাদা অতি উঁচু। আল্লাহর ভালোবাসায় তাদেরকে মর্যাদা দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
চ. তালিবে ইলমের ইলমচর্চার কাজটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। একে মর্যাদার দৃষ্টিতেই দেখতে হবে।
তারপর ব্যতিক্রম হিসেবে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো অভিশপ্ত তো নয়ই; বরং দুনিয়ায় যতদিন থাকা হয় ততদিন বান্দার অবশ্যকর্তব্য সেগুলোতে মনোযোগী থাকা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম ইরশাদ করেন-
أَلَا إِنَّ الدُّنْيَا مَلْعُوْنَةٌ، مَلْعُون مَا فِيهَا (শোন, দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছুই অভিশপ্ত)। অর্থাৎ দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তুসামগ্রী আল্লাহ তা'আলার কাছে অপ্রিয়। কেননা তা নিজ আকর্ষণ দ্বারা মানবমনকে ধোঁকায় ফেলে দেয়। মানুষ এর চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে বন্দেগীর পথ ছেড়ে অসৎ চাহিদা পূরণে লেগে পড়ে। হিদায়াতের পথ ছেড়ে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে যায়।
বাক্যটির এরকম অর্থও করা যায় যে, দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু পরিত্যক্ত। لعن এর এক অর্থ পরিত্যাগ করা। নবী-রাসূল ও আল্লাহওয়ালাগণ সর্বদাই দুনিয়ার মোহ-ভালোবাসা পরিত্যাগ করে চলেছেন। তাঁরা এর আনন্দ-আস্বাদ উপভোগে লিপ্ত হননি। এর প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের পেছনে পড়েননি। তাঁরা নারী-সৌন্দর্য, পুত্র-কন্যার আসক্তি, ধন- দৌলতের মোহ ও বহুদিন বেঁচে থাকার আশায় নিমজ্জিত হয়ে আখিরাতের করণীয় কাজ পিছিয়ে দেননি। তাতে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেননি। তাঁরা এসবকে নিজেদের বলে মনেই করেননি। এসবে মোহিত হয়ে যাওয়াকে তাঁরা কাফের-বেঈমানের কাজ বলেই গণ্য করতেন। কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাই ছিল-
اللهم لا عيش إلا عيش الآخره
"হে আল্লাহ! আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন।
একবার তিনি হযরত উমর ফারূক রাযি. কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
أَمَا تَرْضَى أَن تَكُونَ لَهُمُ الدُّنْيَا وَلَنَا الآخِرَةُ
'তুমি কি এতে খুশি নও যে, তাদের হবে দুনিয়া আর আমাদের আখিরাত?"
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি বিষয়কে আলাদা করেছেন, যেগুলো অভিশপ্ত নয়, বর্জনীয় নয়; বরং কাম্য ও বাঞ্ছনীয়। তিনি ইরশাদ করেন-
إِلا ذِكْرَ اللهِ تَعَالَى، وَمَا وَالاهُ، وَعَالِمًا وَمُتَعَلَّما (ব্যতিক্রম কেবল আল্লাহ তা'আলার যিকির এবং যা তিনি ভালোবাসেন (বা যা-কিছু তাঁর নিকটবর্তী করে দেয়) আর আলেম ও ইলম শিক্ষার্থী)। এর মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে আল্লাহর যিকির। এটা সমস্ত ইবাদত-বন্দেগীর প্রাণবস্তু। যেমন নামায সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وأقم الصلوة لذكري
“নামায কায়েম করো আমার যিকির ও স্মরণের জন্য।"
আরও ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الصَّلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَلَذِكرُ الله أكبر
'নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর যিকিরই তো সর্বাপেক্ষা বড় জিনিস।
যিকির মনে মনেও হতে পারে, মৌখিকভাবেও হতে পারে। মনের যিকির হল আল্লাহ তা'আলার কুদরত ও হিকমতের ধ্যান করা, তাঁর বড়ত্ব ও গৌরব কল্পনা করা, তাঁর নি'আমতরাজির মূল্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা, অন্তরে তাঁর ভয় রাখা ও তাঁর কাছে আশাবাদী থাকা। মৌখিক যিকির বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহ আল্লাহ ইত্যাদি যিকির করা। আল্লাহর কাছে দু'আ করা এবং তাওবা-ইস্তিগফার করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যিকির। যে-কোনও আমলের আগের ও পরের দু'আসমূহও অতি মূল্যবান যিকির বটে। কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত সর্বোত্তম যিকির। অবশ্য সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি যিকির হল আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করা ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। তবে এ হাদীছে যেহেতু এর পরে والاه শব্দটি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাই শরীআতের আদেশ-নিষেধ মানার বিষয়টি তার মধ্যে চলে যাবে। না হয় সাধারণভাবে যিকিরের মধ্যে সমগ্র দীন ও শরীআতই এসে যায়।
দ্বিতীয় যে বিষয়কে অভিশপ্তের বাইরে রাখা হয়েছে তা হল وَمَا وَالاهُ এর উৎপত্তি الموالاة থেকে। এর মূল ধাতু ولي অর্থ বন্ধুত্ব ও নৈকট্য। الموالاة এর অর্থ একে অন্যের নিকটবর্তী হওয়া, একে অন্যকে ভালোবাসা। এটা মৌলিকভাবে দ্বিপাক্ষিক হলেও কখনও কখনও একপাক্ষিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কারও নিকটবর্তী হওয়া বা কাউকে ভালোবাসা। তো শব্দটি দ্বারা বোঝানো হচ্ছে আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু ভালোবাসেন তা অভিশপ্ততার বাইরে। যেমন আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য, যা তিনি করতে বলেছেন তা করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকা। আবার এগুলো এমন কাজ, যা বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার নিকটবর্তীও করে দেয়। তাই এসব কাজ অভিশপ্ত তো নয়ই; বরং একান্ত বাঞ্ছনীয়।
তৃতীয়ত বলা হয়েছে عالما (আলেম)। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান রাখে এমন ব্যক্তি। ফিক্হ ও তাসাওউফ (ইসলামী আখলাক) কুরআন ও হাদীছের ইলমেরই সারনির্যাস। তাই এ সম্পর্কিত জ্ঞানও কুরআন ও হাদীছের জ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত। এর সমষ্টি হচ্ছে দীনী ইলম। সুতরাং সামগ্রিকভাবে যে ব্যক্তি যথেষ্ট পরিমাণ দীনী ইলম রাখেন তাকেই আলেম বলা যায়। একজন যথার্থ আলেমের জন্য ইলমের সঙ্গে আমলের চর্চা থাকাও শর্ত। বরং কুরআন ও হাদীছের পরিভাষায় প্রকৃত আলেম তাকেই বলা হয়, যিনি ইলম চর্চার পাশাপাশি আমলের সাধনায়ও রত থাকেন। আল্লাহ তা'আলার কাছে এরূপ আলেমের অনেক মর্যাদা। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَرْفَع اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أوتُوا الْعِلْمَ دَرَجتٍ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِير
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যাদেরকে ইলম দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন। তোমরা যা-কিছু কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে পরিপূর্ণ অবগত।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقههُ فِي الدِّينِ
'আল্লাহ তা'আলা যার কল্যাণ চান তাকে দীনের গভীর জ্ঞান-বুঝ দান করেন।
অপর এক হাদীছে আছে-
فَضْلُ الْعَالِم عَلَى الْعَابِدِ كَفَضلِي عَلى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ : إِنَّ الله وَمَلائِكَتَهُ وَأَهل السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا، وَحَتَّى الْحُوْت ليصَلُّونَ عَلى مُعَلِّمِي النَّاسِ الْخَيْر
আবেদের উপর আলেমের মর্যাদা ঠিক তেমনি, যেমন তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার মর্যাদা। নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ এবং আসমান ও যমীনের সকল বাসিন্দা এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও মাছ পর্যন্ত তার জন্য দু'আ করে, যে মানুষকে কল্যাণকর বিষয় শিক্ষা দেয়।
আরও এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ حَتَّى الْحيْتانُ فِي الْمَاءِ، وفضلُ الْعَالِم عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وَإِنَّ الْعُلَمَاء وَرَثة الأنبياء، وإن الأنبياء لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلا دِرْهَمَا، وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذ بحظ وافر
“নিশ্চয়ই আলেমের জন্য ইস্তিগফার করে থাকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকল বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত। সমস্ত তারকার উপর চাঁদের যেমন শ্রেষ্ঠত্ব, তেমনি আবেদের উপর রয়েছে আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব। আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ। নবীগণ দীনার ও দিরহামের মীরাছ রেখে যান না। তাঁরা ইলমের মীরাছ রেখে যান। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করে সে কল্যাণের ভরপুর অংশ বহন করে।"
এসব হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, আল্লাহর কাছে আলেমের মর্যাদা কত উঁচু। তাই আমাদেরও আলেমদেরকে বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা একান্ত কর্তব্য। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে সতর্ক করেন-
ليْسَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ لَمْ يُجِلَّ كَبِيرَنَا ، وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا، وَيَعْرِف لِعَالِمِنَا حَقَّهُ.
ওই ব্যক্তি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের মর্যাদা বোঝে না।
সবশেষে বলা হয়েছে متعلما (ইলম শিক্ষার্থী)। যারা ইলমে দীনের শিক্ষার্থী তথা তালিবে ইলম, আল্লাহ তা'আলার কাছে তারা অত্যন্ত মর্যাদাবান। বিভিন্ন হাদীছে তাদের উচ্চ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
من سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهلَ اللهُ لَهُ بِه طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ.
“যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে কোনও পথ চলে, আল্লাহ তা'আলা সে কারণে তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।”
অপর এক হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضَاء لِطَالِبِ الْعِلْمِ
"নিশ্চয়ই ফিরিশতাগণ তালিবে ইলমের সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেয়।"
হাদীছে যে চারটি বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম দু'টি হচ্ছে আমল আর দ্বিতীয় দু'টি আমলওয়ালা ব্যক্তি। এ হিসেবে হাদীছটির অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ তাআলার যিকর ও আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন ছাড়া দুনিয়ার যাবতীয় কাজকর্ম অভিশপ্ত। আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালনও তাঁর যিকরেরই অন্তর্ভুক্ত। কাজেই মূল আমল একটিই- আল্লাহর যিকর। শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন এরই শাখা-প্রশাখা।
দ্বিতীয় দু'টি বিষয়ের হাকীকতও এই যে, যাদের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার যিকর আছে কেবল তারাই অভিশাপ থেকে মুক্ত। আলেম ও তালিবে ইলম বলতে ইলমের চর্চাকারীকে বোঝায়। ইলমের চর্চাকারী মূলত আল্লাহ তা'আলার যিকরকারীই। আল্লাহপ্রদত্ত ইলম নিয়ে ব্যস্ত থাকা আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণে ব্যস্ত থাকা ছাড়া তো আর কিছুই নয়। কেননা তার কাজ হচ্ছে ইলম শেখা বা শেখানো এবং সে অনুযায়ী আমল করা। যারা উলামা নয় তারা সত্যিকারের আমলওয়ালা কেবল তখনই হবে, যখন কোনও না কোনও পর্যায়ের তালিবে ইলমও হবে। আনুষ্ঠানিক তালিবে ইলম না হলেও তার আমলের জন্য যতটুকু ইলম প্রয়োজন, ততটুকু ইলম তাকে শিখতেই হবে। যারা কোনও স্তরেরই ইলম শেখে না, তারা নিতান্তই জাহেল ও অজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে তাদের কোনও আমলও নেই। না যিকর, না নামায, না হালাল-হারামে পার্থক্যকরণ। সম্পূর্ণ জাহেলানা জীবনই সে যাপন করে। এরূপ জীবন অভিশপ্ত জীবনই বটে।
এ হাদীছের মূল বার্তা এটাই যে, বান্দা যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন তাকে আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণের সঙ্গেই থাকতে হবে। দুনিয়ার আসক্তিতে নিমজ্জিত হওয়া যাবে না। আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়াকে তুচ্ছ গণ্য করতে হবে। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাজই করা হবে, তবে মনঃপ্রাণ ডুবে থাকবে আল্লাহর ভালোবাসায়। সে আনন্দ পাবে আল্লাহর যিক্রে। তৃপ্তিবোধ করবে শরী'আত পালনে। ভাত-রুটি হবে তার দেহের খোরাক, কিন্তু প্রাণের খোরাক হবে শরী'আত পালন।
শরী'আত পালনে যত্নবান থাকলে সে আল্লাহর সাহায্য পাবে। আল্লাহ তা'আলা তাকে দুনিয়ার আসক্তি থেকে হেফাজত করবেন। ফলে কোনওরকম অবৈধ লিপ্ততা দ্বারা তার দেহমন কলঙ্কিত হবে না। নির্বিচার দুনিয়াদারী তাকে স্পর্শই করতে পারবে না। এরূপ ব্যক্তি যখন দুনিয়ার কাজকর্ম করবে, তখন তার ভেতর দিয়েও তার আখিরাতই সঞ্চিত হতে থাকবে। কেননা আল্লাহর যিকরের সঙ্গে যে কাজ হয় তা দুনিয়ার কাজ হলেও বান্দাকে আল্লাহর দিকেই টেনে নেয়। পক্ষান্তরে যে কাজ আল্লাহর যিকির ও স্মরণের সঙ্গে হয় না, তা বাহ্যদৃষ্টিতে আখিরাতের কাজ হলেও প্রকৃতপক্ষে তা দুনিয়ার কাজই বটে। এরূপ কাজও একরকম দুনিয়াদারী এবং তা অভিশপ্ত দুনিয়ারই অংশ।
কাজেই হাদীছে দুনিয়াকে যে অভিশপ্ত বলা হয়েছে তা দ্বারা দুনিয়ার এমন লিপ্ততাকে বোঝানো উদ্দেশ্য, যা আল্লাহ তা'আলার যিকরের সঙ্গে করা হয় না এবং যার লক্ষ্যবস্তু আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিও হয় না। তাঁর যিকরের সঙ্গে অর্থাৎ শরী'আতসম্মতভাবে ও তাঁর সন্তুষ্টিলাভের লক্ষ্যে দুনিয়ার যে কাজই করা হয়, শেষটায় তা আখিরাতই হয়। তাই এক বর্ণনায় এসেছে-
لا تسبوا الدُّنْيا فَنِعْمَ مَطيَّةُ الْمُؤمِن عَلَيْهَا ، يَبْلُغُ الْجَنَّةَ بِهَا وَيَنْجُو مِنَ النَّارِ.
"তোমরা দুনিয়াকে গালমন্দ করো না। কেননা দুনিয়া মুমিনের উৎকৃষ্ট বাহন। সে এর মাধ্যমে জান্নাতে পৌঁছে এবং এর মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়।"
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহর যিকির শ্রেষ্ঠতম আমল ও সমস্ত ইবাদতের প্রাণশক্তি।
খ. বান্দা কর্তৃক শরী'আতের আদেশ-নিষেধ পালন আল্লাহর কাছে প্রিয়। এর দ্বারাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। তাই দুনিয়ায় এটাকেই মূল কাজ বানানো চাই।
গ. আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণবিহীন যাবতীয় কাজ অভিশপ্ত কাজ। তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
ঘ. চাকচিক্যময় দুনিয়ার ভালোবাসায় নিমজ্জিত হওয়ার পরিণাম আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাওয়া। তাই দুনিয়ার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে হবে বটে, তবে অন্তরে এর ভালোবাসা স্থান দেওয়া যাবে না।
ঙ. আল্লাহর কাছে উলামায়ে কিরামের মর্যাদা অতি উঁচু। আল্লাহর ভালোবাসায় তাদেরকে মর্যাদা দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
চ. তালিবে ইলমের ইলমচর্চার কাজটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। একে মর্যাদার দৃষ্টিতেই দেখতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
