মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৬- আদাব - শিষ্টাচার অধ্যায়

হাদীস নং: ৫১৪২
২২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - ভালো কাজের আদেশ
৫১৪২। হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) হইতে বর্ণিত, একদা তিনি (সমবেত লোকদের উদ্দেশে) বলেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমরা নিশ্চয় এই আয়াতটি পাঠ করঃ “হে ঈমানদারগণ। নিজকে রক্ষা করাই তোমাদের কর্তব্য। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হইয়াছে, সে তোমাদের কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না।” কেননা, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)কে বলিতে শুনিয়াছি, মানুষ যখন কোন খারাপ কাজ দেখে, আর তাহারা উহাকে পরিবর্তন করে না, তখন আল্লাহ্ তা'আলা অচিরেই তাহাদের উপর ব্যাপকভাবে আযাব নাযিল করিতে পারেন। – ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি সহীহ্ বলিয়াছেন। আর আবু দাউদের এক বর্ণনায় আছে, যখন লোকেরা যালিমকে (যুলম করিতে) দেখিয়াও তাহার হস্তদ্বয় ধরিয়া ফেলে না, অচিরেই আল্লাহ্ তা'আলা তাহাদের উপর ব্যাপক আযাব নাযিল করিতে পারেন। উহার অপর এক বর্ণনায় আছে, যেই সম্প্রদায়ের মধ্যে পাপাচার হইতে থাকে, অতঃপর তাহারা উহাকে পরিবর্তন করিবার ক্ষমতা রাখিয়াও পরিবর্তন করে না, তখন অচিরেই আল্লাহ্ তা'আলা তাহাদের উপর ব্যাপক আযাব নাযিল করিবেন। উহার অপর বর্ণনায় আছে, যেই জাতি পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং পাপাচারীদের অপেক্ষা পাপে নির্লিপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক বেশী। (তবুও তাহারা উহাতে বাধা না দেওয়ায় তাহাদের উপর আল্লাহর আযাব নাযিল হইবে।)
وَعَنْ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنكم تقرؤونَ هذهِ الْآيَة: (يَا أيُّها الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ)

فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوْا مُنْكَرًا فَلَمْ يُغَيِّرُوهُ يُوشِكُ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللَّهُ بِعِقَابِهِ» . رَوَاهُ ابْنُ مَاجَهْ وَالتِّرْمِذِيُّ وَصَحَّحَهُ. وَفِي رِوَايَةِ أبي دَاوُد: «إِذا رَأَوْا الظَّالِم فَم يَأْخُذُوا عَلَى يَدَيْهِ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللَّهُ بِعِقَابٍ» . وَفِي أُخْرَى لَهُ: «مَا مِنْ قَوْمٍ يُعْمَلُ فِيهِمْ بِالْمَعَاصِي ثُمَّ يَقْدِرُونَ عَلَى أَنْ يُغَيِّرُوا ثُمَّ لَا يُغَيِّرُونَ إِلَّا يُوشِكُ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللَّهُ بِعِقَابٍ» . وَفِي أُخْرَى لَهُ: «مَا مِنْ قَوْمٍ يُعْمَلُ فِيهِمْ بِالْمَعَاصِي هُمْ أَكْثَرُ مِمَّن يعمله»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. আয়াত ও হাদীসের সমন্বয়ে হযরত ছিদ্দীকে আকবর (রাঃ) ইহাই বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, সমাজবিরোধী মন্দ লোকের তুলনায় সৎ ও নেক্কার লোকের সংখ্যা অধিক হওয়া সত্ত্বেও মন্দ কাজে বাধা না দেওয়া হইলে তাহাদের মন্দের কুফল ঐ সমস্ত সৎ লোকদিগকেও ভোগ করিতে হইবে। ‘যে পাপ করে তাহার পাপ তাহাকেই খাইবে, ইহা সঠিক কথা নহে। সুতরাং উক্ত আয়াতের মর্ম এই দাঁড়ায় যে, মন্দ কাজ হইতে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও যদি কেহ উহা গ্রহণ না করে, তবে নিজে হেদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিলে তাহার পাপ তোমাদের উপর আরোপিত হইবে না। কারণ, হেদায়তের মালিক একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলা এবং চেষ্টা করা বান্দার কাজ।

২. এ বর্ণনায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. যে আয়াত উল্লেখ করেছেন, বাহ্যদৃষ্টিতে তা দ্বারা বোঝা যায়- কেউ যদি নিজে শরী'আতের আদেশ-নিষেধ মেনে চলে তবে তার মুক্তির জন্য সেটাই যথেষ্ট, অন্যে কী করল না করল তা দেখার প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ এ আয়াতটি দ্বারা সে অর্থই বুঝেছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি, তাদের সে ধারণা ভুল সাব্যস্ত করেন এবং হাদীছ দ্বারা এ আয়াতটির প্রকৃত অর্থ তাদেরকে বুঝিয়ে দেন।

তিনি যে হাদীছ উল্লেখ করেছেন তাতে স্পষ্টই বলা হয়েছে- জালেমকে তার জুলুমের কাজে বাধা না দেওয়া হলে যারা জুলুম করে এবং যারা জুলুম করে না আল্লাহ তা'আলা তাদের সকলকেই শাস্তিদান করবেন। জালেমকে শাস্তিদান করবেন তার জুলুমের কারণে আর অন্যদেরকে শাস্তিদান করবেন জুলুমে বাধা না দিয়ে নীরবদর্শক হয়ে থাকার কারণে। বোঝা গেল জুলুমে বাধা দান করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। এর আগে যতগুলো হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে তার সবগুলোতেই সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করাকে জরুরি সাব্যস্ত করা হয়েছে।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, হাদীছটির উল্লেখ দ্বারা বোঝাতে চাচ্ছেন যে, তোমরা আসলে আয়াতটির ভুল ব্যাখ্যা করছ। এক বর্ণনায় আছে, তিনি তাদেরকে এ কথাও বলেছিলেন যে-

وَتَضَعُونَهَا غَيْرَ مَوْضِعِهَا

এবং তোমরা একে ভুল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছ। মুসনাদে আহমান, হাদীছ নং ১৬
বস্তুত সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা অবশ্যই জরুরি এবং সাধ্যমত এটা করতেই হবে। আয়াতটির বক্তব্য এর পরিপন্থী নয়। আয়াতে বোঝানো হচ্ছে যে, তোমরা নিজেরা সৎকর্মে প্রতিষ্ঠিত ও অসৎকর্ম হতে বিরত থেকে যারা সৎকর্ম করে না তাদেরকে যদি সৎকর্ম করতে বল এবং যারা অসৎকর্ম করে তাদেরকে সাধ্যমত বাধাদান কর আর তা সত্ত্বেও তারা তা থেকে ফিরে না আসে, তবে তাদের এ বিপথগামিতা দ্বারা তোমাদের কোনও ক্ষতি হবে না, যেহেতু তোমরা তোমাদের কর্তব্য পালন করেছ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারাও অন্যায়-অসৎকাজে বাধা দেওয়ার আবশ্যিকতা বোঝা যায়।

খ. এর দ্বারা জানা যায় যে, হাদীছ কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যা। কুরআন মাজীদের কোনও আয়াতে কোনও বিষয় অস্পষ্ট থাকলে হাদীছে তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাই কুরআন বোঝার জন্য হাদীছের দ্বারস্থ হওয়া জরুরি।

গ. যারা কুরআন ও হাদীছের যথেষ্ট জ্ঞান রাখে না তাদের উচিত নয় নিজে নিজে কোনও আয়াত বা হাদীছের ব্যাখ্যা করতে যাওয়া বা তাদের নিজেদের যা বুঝে আসে তা নিয়ে বসে থাকা। তাদের কর্তব্য আলেমদের শরণাপন্ন হয়ে নিজেদের বুঝ সঠিক না ভুল—তা তাদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া।

ঘ. এটা উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব যে, তারা যদি কাউকে কুরআন-হাদীছের ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা করতে দেখেন, তবে সে ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করবেন এবং মানুষের মধ্যে তা প্রচার হয়ে গেলে মানুষকেও সে ব্যাপারে সাবধান করে দেবেন। সে ক্ষেত্রে মানুষের কর্তব্য তাদের সমালোচনা না করে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করে নেওয়া, যেহেতু তারা তাদের ওপর অর্পিত যিম্মাদারীই পালন করেছেন।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৫১৪২ | মুসলিম বাংলা