মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
২৬- আদাব - শিষ্টাচার অধ্যায়
হাদীস নং: ৫১২৭
২১. প্রথম অনুচ্ছেদ - অত্যাচার
৫১২৭। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ তোমরা কি জান দরিদ্র কে? সাহাবীগণ বলিলেন, আমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই তো দরিদ্র যাহার টাকা-কড়ি ও ধন-সম্পদ নাই। তখন হুযূর (ﷺ) বলিলেনঃ কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই (সর্বাপেক্ষা) দরিদ্র হইবে, যে দুনিয়া হইতে নামায, রোযা ও যাকাত আদায় করিয়া আসিবে এবং সাথে সাথে ঐসমস্ত লোকেরাও আসিবে, সে কাহাকেও গালি দিয়াছে, কাহারও উপর অপবাদ রটাইয়াছে, কাহারও মাল-সম্পদ গ্রাস করিয়াছে, কাহাকেও হত্যা করিয়াছে এবং কাহাকেও প্রহার করিয়াছে। সুতরাং এই হকদারকে তাহার নেকী প্রদান করা হইবে, আবার ঐ হকদারকে তাহার নেকী হইতে প্রদান করা হইবে। এভাবে হকদারের হক পরিশোধ করার পূর্বে যদি তাহার নেকী নিঃশেষ হইয়া যায় তখন তাহাদের গুনাহ্সমূহ ঐ ব্যক্তির উপরে চাপাইয়া দেওয়া হইবে। অতঃপর তাহাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হইবে। —মুসলিম
وَعَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟» . قَالُوا: الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ. فَقَالَ: «إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ يَأْتِي يَوْم الْقِيَامَة بِصَلَاة وَصِيَام وَزَكَاة وَيَأْتِي وَقَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا. وَأَكَلَ مَالَ هَذَا. وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يَقْضِيَ مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرح فِي النَّار» . رَوَاهُ مُسلم
হাদীসের ব্যাখ্যা:
১. আল্লাহর বাণীঃ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ অর্থঃ একজনের কৃত পাপ অন্য কেহ * বহন করিবে না। আলোচ্য হাদীসটি উক্ত আয়াতের পরিপন্থী নহে। কেননা, আয়াতটির মর্মার্থ হইল, অন্যায়ভাবে একজনের গুনাহ্ আরেক জনের ঘাড়ে চাপান হইবে না। আর হাদীসের মর্মার্থ হইল, সে অন্যের গুনাহ্ নিজের ঘাড়ে বহন করার কারণ হইবে। মোটকথা, যালিম তাহার কৃত যুমের শাস্তিস্বরূপ মামের পাপ বহন করিতে বাধ্য হইবে। বস্তুতঃ ইহাই ইনসাফের দাবী।
২. এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞেস করেছেন- ؟أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ (তোমরা জান মুফলিস কে?)। الْمُفْلِسُ (মুফলিস) শব্দটির উৎপত্তি فلس থেকে। فلس অর্থ পয়সা। الْمُفْلِسُ অর্থ যার কোনও টাকা-পয়সা নেই, একদম নিঃস্ব, মিসকীন ও কপর্দকহীন। সাহাবায়ে কিরাম উত্তরে এ কথাই বলেছেন যে, মুফলিস ওই ব্যক্তি, যার কোনও দিরহাম-দীনার ও মাল-সামানা নেই। তাদের এ উত্তর ছিল শব্দটির প্রচলিত ও ব্যবহারিক অর্থ অনুযায়ী। স্বাভাবিকভাবে তাদের এরকম উত্তর দেওয়ারই কথা। তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এ প্রশ্ন করেছেন এই জন্য যে, এর পরে তিনি তাদের সামনে যে বক্তব্য পেশ করবেন তা যাতে তাদের অন্তরে বিশেষভাবে রেখাপাত করে। কেননা কোনও শব্দের প্রচলিত অর্থের বাইরে যখন অন্য কোনও অর্থ কানে পড়ে, তখন তা মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরকম অর্থ মানুষের মনোযোগ কাড়ে এবং মানুষ সে অর্থ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করে। সাধারণত মানুষ বিশেষ কোনও বক্তব্য দানের আগে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ জাতীয় প্রশ্ন করে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এর পরে যে কথা বলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা বিশেষভাবে চিন্তা করার বিষয়ই বটে।
তিনি ইরশাদ করেন- আমার উম্মতের মধ্যে কিয়ামতের দিন মুফলিস ও কপর্দকশূন্য হবে ওই ব্যক্তি, যে (বিপুল) নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে। অর্থাৎ তোমরা যাদেরকে মুফলিস ও নিঃস্ব বলছ, দুনিয়ার বিচারে তারাও নিঃস্ব বটে, কিন্তু প্রকৃত নিঃস্ব তো আখিরাতের নিঃস্ব। তা ওই ব্যক্তি, যে অনেক ইবাদত-বন্দেগী এবং বিপুল ছাওয়াব ও পুণ্য নিয়ে হাজির হবে। ছাওয়াবের দিক থেকে সে হবে বিরাট ধনী। কিন্তু সেইসঙ্গে তার উপস্থিতি হবে এমন অবস্থায় যে, সে দুনিয়ায় বিভিন্ন মানুষের প্রতি নানাভাবে জুলুম করেছে। তাদের বিভিন্ন হক নষ্ট করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে মারধর করেছে, কাউকে গালাগাল করেছে এবং কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। এভাবে সে মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত তিন প্রকার হক নষ্ট করেছে। ওদিকে আল্লাহ তাআলা ন্যায়বিচারক। তাঁর আদালতে সমস্ত জুলুম ও অন্যায়-অনাচারের বিচার হবে। দুনিয়ায় অন্যের প্রতি জুলুম করে এবং মানুষের হক নষ্ট করে বাঁচতে পারলেও আল্লাহর আদালতে বাঁচার কোনও উপায় নেই। সেখানে জুলুমের প্রতিকার হবেই হবে। অন্যের যেসব হক নষ্ট করা হয়েছে, আল্লাহর আদালতে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। কিন্তু সেখানে তো দুনিয়ার টাকা-পয়সা অচল। সোনা-রুপা ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে সেখানে দেনা শোধ করা যাবে না। সেখানে যা চলবে তা কেবলই ছাওয়াব ও নেকী।
সুতরাং যে ব্যক্তি বিভিন্নভাবে অন্যের হক নষ্ট করেছে আর এভাবে মানুষের প্রতি জুলুম করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, আল্লাহর আদালতে তার সে জুলুমের প্রতিকার করা হবে তার নেকীর বিনিময়ে। যার যতটুকু হক নষ্ট করেছে, ততটুকু পরিমাণ নেকী তাকে তার দিয়ে দিতে হবে। এভাবে মানুষের হক পরিশোধের বিনিময়ে তার নেকী দিতে দিতে একপর্যায়ে দেখা যাবে তার সবটা নেকী শেষ হয়ে গেছে। পাহাড় সমান নেকী নিয়ে সে হাজির হয়েছিল, কিন্তু হক পরিশোধ করতে গিয়ে সবটা শেষ হয়ে গেছে। অথচ এখনও তার ওপর অন্যদের হক অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সে হক পরিশোধ হবে কিসের দ্বারা? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান-
فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ، أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ
'যদি তার নেক আমলসমূহ তার দেনা পরিশোধ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়, তবে তাদের থেকে তাদের গুনাহসমূহ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।'
কী ভয়াবহ অবস্থা! একে দুনিয়ায় যা-কিছু ছাওয়াব অর্জন করা হয়েছিল সব শেষ, তার ওপর কত রকম গুনাহ করা হয়েছিল, সেসব গুনাহের বোঝা তো আছেই, তাতে যোগ হল অন্যের হক আদায়ের বিপরীতে চলে আসা বিপুল গুনাহের নতুন বোঝা। এ অবস্থায় জাহান্নাম ছাড়া কোনও গতি থাকে কি? সুতরাং গুনাহের ডবল বোঝাসহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এই পরিণতি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
'তাযকিরাতুল মুহিব্বীন' শীর্ষক গ্রন্থে ইবনুর রাসসা' রহ. বলেন, কোনও তত্ত্বজ্ঞ বুযুর্গ এ হাদীছটি উল্লেখপূর্বক বলেছেন, এটি এক কঠোর সতর্কবাণী। বুঝমানদের পক্ষে এ এক কঠিন হুঁশিয়ারী বার্তা। কেননা মানুষ যা-কিছুই আমল করে তা একদম খালেস ও রিয়ামুক্ত কমই হয়। শয়তান তার ভেতর নানা কৌশলে ভেজাল ঢুকিয়ে দেয়। যদি কোনওক্রমে তার দু'-চারটি আমল নির্ভেজাল হয়ও, তবে মানুষকে কষ্টদানের ব্যাপারটা থেকেই যায়। এ জাতীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকা হয় কমই। সুতরাং ওহে আত্মপ্রবঞ্চক! যখন কিয়ামত হবে, তখন তোমার কোনও কোনও ইবাদত খুঁত-খামতিসহ যাচাই-বাছাইতে টিকে গেলেও যাদেরকে তুমি কোনওভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলেছ, সেই প্রতিপক্ষরা তোমার ওইসব ইবাদতের ছাওয়াব দাবি করবে। আর তখন তোমার মাওলার ফয়সালায় সেসব নেকী তারা পেয়ে যাবে। সেদিন তো টাকা-পয়সা ধন-দৌলত থাকবে না, যা দ্বারা তুমি তোমার দেনা শোধ করবে; বরং তা শোধ করা হবে তোমার নেকী দ্বারাই। তুমি যদি দিন কাটাও রোযা রেখে, রাত কাটাও নামায পড়ে আর রহমানের ইবাদত- আনুগত্যে সময় পার কর, অন্যদিকে মুমিন-মুসলিমদের গীবত করে বেড়াও, তাদের অর্থ-সম্পদ হরণ কর আর বিভিন্নভাবে তাদেরকে কষ্ট দিয়ে থাক, তবে হে বদনসীব! তাদের বদলা দিয়েই তোমার সব পুণ্য খতম হয়ে যাবে। ভেবে দেখ তারপর পরিণাম কী দাঁড়াবে!
وتمامه: تذكرة المحبين في شرح أسماء سيد المرسلين للإمام العلامة محمد بن قاسم أبي عبد الله الأنصاري التونسي المالكي المتوفى سنة ٨٩٤ هـ (دار التصنيف)
এই যদি হয় ইবাদতগুযারদের অবস্থা, তখন আমাদের মত পাপাচারী, যারা বদী সঞ্চয়ে মশগুল, খায় হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাবার, ইবাদত-বন্দেগীতে করে অবহেলা আর সদা নাফরমানির দিকে ধাবিত থাকে, তাদের কী গতি হবে?
(দালীলুল-ফালিহীন অবলম্বনে)
এ হাদীছটি আমাদের জন্য অতি বড় সতর্কবাণী। আমাদের এখনই সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত। যথাযথভাবে ইবাদত-বন্দেগী করার পাশাপাশি লক্ষ রাখা উচিত যাতে কোনওভাবেই আল্লাহর কোনও বান্দার হক নষ্ট হয়ে না যায়। খুন-খারাবীর তো প্রশ্নই আসে না, অন্যায়ভাবে কারও গায়ে হাত তোলা ও শারীরিক কষ্ট দেওয়া থেকেও সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। আমরা যেন কারও টাকা-পয়সা ও জমি-জায়েদাদ অন্যায়ভাবে দখল না করি। কাউকে গালাগালি করা, অন্যের গীবত-শেকায়েত করা, কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা এবং অন্যের মর্যাদা নষ্ট এমন যে-কোনও আচরণ করা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে, যদি আমরা চাই আমাদের টুটাফাটা ইবাদতের ছাওয়াব হাতছাড়া না হয়ে যাক এবং সামান্য যা ছাওয়াব অর্জিত হয় তার অছিলায় আল্লাহর রহমতে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত পেয়ে যাই। যদি ইতোমধ্যে আমাদের কারও দ্বারা এরকম কিছু হয়ে গিয়ে থাকে, তবে এখনই খাঁটি তাওবা করে যথাসম্ভব অন্যের হক ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং মজলুমদের কাছ থেকে ক্ষমা হাসিল করে নিতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক নষ্ট করা ও তাদের প্রতি জুলুম করার দ্বারা আখিরাতে মিসকীন হয়ে যাওয়া অবধারিত। তাই এর থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।
খ. কিয়ামতে ন্যায়বিচার হবেই হবে। তখন প্রত্যেক মজলুমের পক্ষে জালেমের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে দেওয়া হবে।
গ. দুনিয়া থেকে জালেমরূপে বিদায় না নিয়ে মজলুমরূপে বিদায় নিয়ে নেওয়াই শ্রেয়।
ঘ. নামায-রোযা তো অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আখিরাতে কেবল তা দ্বারাই বাঁচা যাবে না, বান্দার হকও আদায় করতে হবে।
২. এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞেস করেছেন- ؟أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ (তোমরা জান মুফলিস কে?)। الْمُفْلِسُ (মুফলিস) শব্দটির উৎপত্তি فلس থেকে। فلس অর্থ পয়সা। الْمُفْلِسُ অর্থ যার কোনও টাকা-পয়সা নেই, একদম নিঃস্ব, মিসকীন ও কপর্দকহীন। সাহাবায়ে কিরাম উত্তরে এ কথাই বলেছেন যে, মুফলিস ওই ব্যক্তি, যার কোনও দিরহাম-দীনার ও মাল-সামানা নেই। তাদের এ উত্তর ছিল শব্দটির প্রচলিত ও ব্যবহারিক অর্থ অনুযায়ী। স্বাভাবিকভাবে তাদের এরকম উত্তর দেওয়ারই কথা। তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এ প্রশ্ন করেছেন এই জন্য যে, এর পরে তিনি তাদের সামনে যে বক্তব্য পেশ করবেন তা যাতে তাদের অন্তরে বিশেষভাবে রেখাপাত করে। কেননা কোনও শব্দের প্রচলিত অর্থের বাইরে যখন অন্য কোনও অর্থ কানে পড়ে, তখন তা মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরকম অর্থ মানুষের মনোযোগ কাড়ে এবং মানুষ সে অর্থ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করে। সাধারণত মানুষ বিশেষ কোনও বক্তব্য দানের আগে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ জাতীয় প্রশ্ন করে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এর পরে যে কথা বলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা বিশেষভাবে চিন্তা করার বিষয়ই বটে।
তিনি ইরশাদ করেন- আমার উম্মতের মধ্যে কিয়ামতের দিন মুফলিস ও কপর্দকশূন্য হবে ওই ব্যক্তি, যে (বিপুল) নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে। অর্থাৎ তোমরা যাদেরকে মুফলিস ও নিঃস্ব বলছ, দুনিয়ার বিচারে তারাও নিঃস্ব বটে, কিন্তু প্রকৃত নিঃস্ব তো আখিরাতের নিঃস্ব। তা ওই ব্যক্তি, যে অনেক ইবাদত-বন্দেগী এবং বিপুল ছাওয়াব ও পুণ্য নিয়ে হাজির হবে। ছাওয়াবের দিক থেকে সে হবে বিরাট ধনী। কিন্তু সেইসঙ্গে তার উপস্থিতি হবে এমন অবস্থায় যে, সে দুনিয়ায় বিভিন্ন মানুষের প্রতি নানাভাবে জুলুম করেছে। তাদের বিভিন্ন হক নষ্ট করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে মারধর করেছে, কাউকে গালাগাল করেছে এবং কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। এভাবে সে মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত তিন প্রকার হক নষ্ট করেছে। ওদিকে আল্লাহ তাআলা ন্যায়বিচারক। তাঁর আদালতে সমস্ত জুলুম ও অন্যায়-অনাচারের বিচার হবে। দুনিয়ায় অন্যের প্রতি জুলুম করে এবং মানুষের হক নষ্ট করে বাঁচতে পারলেও আল্লাহর আদালতে বাঁচার কোনও উপায় নেই। সেখানে জুলুমের প্রতিকার হবেই হবে। অন্যের যেসব হক নষ্ট করা হয়েছে, আল্লাহর আদালতে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। কিন্তু সেখানে তো দুনিয়ার টাকা-পয়সা অচল। সোনা-রুপা ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে সেখানে দেনা শোধ করা যাবে না। সেখানে যা চলবে তা কেবলই ছাওয়াব ও নেকী।
সুতরাং যে ব্যক্তি বিভিন্নভাবে অন্যের হক নষ্ট করেছে আর এভাবে মানুষের প্রতি জুলুম করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, আল্লাহর আদালতে তার সে জুলুমের প্রতিকার করা হবে তার নেকীর বিনিময়ে। যার যতটুকু হক নষ্ট করেছে, ততটুকু পরিমাণ নেকী তাকে তার দিয়ে দিতে হবে। এভাবে মানুষের হক পরিশোধের বিনিময়ে তার নেকী দিতে দিতে একপর্যায়ে দেখা যাবে তার সবটা নেকী শেষ হয়ে গেছে। পাহাড় সমান নেকী নিয়ে সে হাজির হয়েছিল, কিন্তু হক পরিশোধ করতে গিয়ে সবটা শেষ হয়ে গেছে। অথচ এখনও তার ওপর অন্যদের হক অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সে হক পরিশোধ হবে কিসের দ্বারা? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান-
فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ، أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ
'যদি তার নেক আমলসমূহ তার দেনা পরিশোধ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়, তবে তাদের থেকে তাদের গুনাহসমূহ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।'
কী ভয়াবহ অবস্থা! একে দুনিয়ায় যা-কিছু ছাওয়াব অর্জন করা হয়েছিল সব শেষ, তার ওপর কত রকম গুনাহ করা হয়েছিল, সেসব গুনাহের বোঝা তো আছেই, তাতে যোগ হল অন্যের হক আদায়ের বিপরীতে চলে আসা বিপুল গুনাহের নতুন বোঝা। এ অবস্থায় জাহান্নাম ছাড়া কোনও গতি থাকে কি? সুতরাং গুনাহের ডবল বোঝাসহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এই পরিণতি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
'তাযকিরাতুল মুহিব্বীন' শীর্ষক গ্রন্থে ইবনুর রাসসা' রহ. বলেন, কোনও তত্ত্বজ্ঞ বুযুর্গ এ হাদীছটি উল্লেখপূর্বক বলেছেন, এটি এক কঠোর সতর্কবাণী। বুঝমানদের পক্ষে এ এক কঠিন হুঁশিয়ারী বার্তা। কেননা মানুষ যা-কিছুই আমল করে তা একদম খালেস ও রিয়ামুক্ত কমই হয়। শয়তান তার ভেতর নানা কৌশলে ভেজাল ঢুকিয়ে দেয়। যদি কোনওক্রমে তার দু'-চারটি আমল নির্ভেজাল হয়ও, তবে মানুষকে কষ্টদানের ব্যাপারটা থেকেই যায়। এ জাতীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকা হয় কমই। সুতরাং ওহে আত্মপ্রবঞ্চক! যখন কিয়ামত হবে, তখন তোমার কোনও কোনও ইবাদত খুঁত-খামতিসহ যাচাই-বাছাইতে টিকে গেলেও যাদেরকে তুমি কোনওভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলেছ, সেই প্রতিপক্ষরা তোমার ওইসব ইবাদতের ছাওয়াব দাবি করবে। আর তখন তোমার মাওলার ফয়সালায় সেসব নেকী তারা পেয়ে যাবে। সেদিন তো টাকা-পয়সা ধন-দৌলত থাকবে না, যা দ্বারা তুমি তোমার দেনা শোধ করবে; বরং তা শোধ করা হবে তোমার নেকী দ্বারাই। তুমি যদি দিন কাটাও রোযা রেখে, রাত কাটাও নামায পড়ে আর রহমানের ইবাদত- আনুগত্যে সময় পার কর, অন্যদিকে মুমিন-মুসলিমদের গীবত করে বেড়াও, তাদের অর্থ-সম্পদ হরণ কর আর বিভিন্নভাবে তাদেরকে কষ্ট দিয়ে থাক, তবে হে বদনসীব! তাদের বদলা দিয়েই তোমার সব পুণ্য খতম হয়ে যাবে। ভেবে দেখ তারপর পরিণাম কী দাঁড়াবে!
وتمامه: تذكرة المحبين في شرح أسماء سيد المرسلين للإمام العلامة محمد بن قاسم أبي عبد الله الأنصاري التونسي المالكي المتوفى سنة ٨٩٤ هـ (دار التصنيف)
এই যদি হয় ইবাদতগুযারদের অবস্থা, তখন আমাদের মত পাপাচারী, যারা বদী সঞ্চয়ে মশগুল, খায় হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাবার, ইবাদত-বন্দেগীতে করে অবহেলা আর সদা নাফরমানির দিকে ধাবিত থাকে, তাদের কী গতি হবে?
(দালীলুল-ফালিহীন অবলম্বনে)
এ হাদীছটি আমাদের জন্য অতি বড় সতর্কবাণী। আমাদের এখনই সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত। যথাযথভাবে ইবাদত-বন্দেগী করার পাশাপাশি লক্ষ রাখা উচিত যাতে কোনওভাবেই আল্লাহর কোনও বান্দার হক নষ্ট হয়ে না যায়। খুন-খারাবীর তো প্রশ্নই আসে না, অন্যায়ভাবে কারও গায়ে হাত তোলা ও শারীরিক কষ্ট দেওয়া থেকেও সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। আমরা যেন কারও টাকা-পয়সা ও জমি-জায়েদাদ অন্যায়ভাবে দখল না করি। কাউকে গালাগালি করা, অন্যের গীবত-শেকায়েত করা, কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা এবং অন্যের মর্যাদা নষ্ট এমন যে-কোনও আচরণ করা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে, যদি আমরা চাই আমাদের টুটাফাটা ইবাদতের ছাওয়াব হাতছাড়া না হয়ে যাক এবং সামান্য যা ছাওয়াব অর্জিত হয় তার অছিলায় আল্লাহর রহমতে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত পেয়ে যাই। যদি ইতোমধ্যে আমাদের কারও দ্বারা এরকম কিছু হয়ে গিয়ে থাকে, তবে এখনই খাঁটি তাওবা করে যথাসম্ভব অন্যের হক ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং মজলুমদের কাছ থেকে ক্ষমা হাসিল করে নিতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক নষ্ট করা ও তাদের প্রতি জুলুম করার দ্বারা আখিরাতে মিসকীন হয়ে যাওয়া অবধারিত। তাই এর থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।
খ. কিয়ামতে ন্যায়বিচার হবেই হবে। তখন প্রত্যেক মজলুমের পক্ষে জালেমের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে দেওয়া হবে।
গ. দুনিয়া থেকে জালেমরূপে বিদায় না নিয়ে মজলুমরূপে বিদায় নিয়ে নেওয়াই শ্রেয়।
ঘ. নামায-রোযা তো অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আখিরাতে কেবল তা দ্বারাই বাঁচা যাবে না, বান্দার হকও আদায় করতে হবে।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
