আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ

হাদীস নং: ৪০০৭
আন্তর্জাতিক নং: ৪৩৪৪
২২২৪. বিদায় হজ্জের পূর্বে আবু মুসা আশ‘আরী (রাযিঃ) এবং মু‘আয ইবনে জাবাল (রাযিঃ)- কে ইয়ামানের উদ্দেশ্যে প্রেরণ
৪০০৭। মুসলিম (রাহঃ) .... আবু বুরদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তার দাদা আবু মুসা ও মু‘আয (রাযিঃ)- কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (গভর্নর হিসেবে) ইয়ামানে পাঠালেন। এ সময় তিনি (উপদেশ স্বরূপ) বলে দিয়েছিলেন, তোমরা লোকজনের সাথে কোমল আচরণ করবে। কখনো কঠিন আচরণ করবে না। মানুষের মনে সুসংবাদের মাধ্যমে উৎসাহ সৃষ্টি করবে। কখনো তাদের মনে অনীহা আসতে দিবে না এবং একে অপরকে মেনে চলবে। আবু মুসা বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমাদের এলাকায় মিযর নামের এক প্রকার শরাব যব থেকে তৈরী হয় আর বিত্উ নামের এক প্রকার শরাব মধু থেকে তৈরী করা হয় (অতএব এগুলোর হুকুম কি?)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, নেশা উৎপাদনকারী সকল বস্তুই হারাম।
এরপর দু’জনেই চলে গেলেন। মু‘আয আবু মুসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কিভাবে কুরআন তিলাওয়াত করেন? তিনি উত্তর দিলেন, দাঁড়িয়ে, বসে, সওয়ারীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় এবং কিছুক্ষণ পরপরই তিলাওয়াত করি। তিনি বললেন, তবে আমি রাতের প্রথমদিকে ঘুমিয়ে পড়ি তারপর (শেষ ভাগে তিলাওয়াতের জন্য নামাযে দাঁড়িয়ে যাই। এ রকমে আমি আমার নিদ্রার সময়কেও সাওয়াবের অন্তর্ভুক্ত মনে করি, যেভাবে আমি আমার নামাযে দাঁড়ানোকে সাওয়াবের বিষয় মনে করে থাকি।
এরপর (প্রত্যেকেই নিজ নিজ শাসন এলাকায় কার্য পরিচালনার জন্য) তাঁবু খাটালেন। এবং পরস্পরের সাক্ষাত বজায় রেখে চললেন। (সে মতে এক সময়) মু‘আয (রাযিঃ) আবু মুসা (রাযিঃ)- এর সাক্ষাতে এসে দেখলেন, সেখানে এক ব্যক্তি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ লোকটি কে? আবু মুসা (রাযিঃ) বললেন, লোকটি ইয়াহুদী ছিলো, ইসলাম গ্রহণ করার পর মুরতাদ হয়ে গেছে। মু‘আয (রাযিঃ) বললেন, আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দেবো।
শু‘বা (ইবনুল হাজ্জাজ) থেকে আফাদী এবং ওয়াহাব অনু্রূপ বর্ণনা করেছে।
আর ওকী (রাহঃ) নযর ও আবু দাউদ (রাহঃ) এ হাদীসের সনদে শু‘বা (রাহঃ)-সাঈদ-সাঈদের পিতা- সাঈদের দাদা নবী কারীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি জারীর ইবনে আব্দুল হামীদ (রাহঃ) শায়বানী (রাহঃ)- এর মাধ্যমে আবু বুরদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
بَابُ بَعْثُ أَبِي مُوسَى وَمُعَاذٍ إِلَى الْيَمَنِ قَبْلَ حَجَّةِ الْوَدَاعِ
4344 - حَدَّثَنَا مُسْلِمٌ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَدَّهُ أَبَا مُوسَى وَمُعَاذًا إِلَى اليَمَنِ، فَقَالَ: «يَسِّرَا وَلاَ تُعَسِّرَا، وَبَشِّرَا وَلاَ تُنَفِّرَا وَتَطَاوَعَا» ، فَقَالَ أَبُو مُوسَى: يَا نَبِيَّ اللَّهِ إِنَّ أَرْضَنَا بِهَا شَرَابٌ مِنَ الشَّعِيرِ المِزْرُ، وَشَرَابٌ مِنَ العَسَلِ البِتْعُ، فَقَالَ: «كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ» . فَانْطَلَقَا، فَقَالَ مُعَاذٌ لِأَبِي مُوسَى: كَيْفَ تَقْرَأُ القُرْآنَ؟ قَالَ: قَائِمًا وَقَاعِدًا وَعَلَى رَاحِلَتِي، وَأَتَفَوَّقُهُ تَفَوُّقًا، قَالَ: أَمَّا أَنَا فَأَنَامُ وَأَقُومُ، فَأَحْتَسِبُ نَوْمَتِي كَمَا أَحْتَسِبُ قَوْمَتِي، وَضَرَبَ فُسْطَاطًا، فَجَعَلاَ يَتَزَاوَرَانِ، فَزَارَ مُعَاذٌ أَبَا مُوسَى فَإِذَا رَجُلٌ مُوثَقٌ، فَقَالَ: مَا هَذَا؟ فَقَالَ أَبُو مُوسَى: يَهُودِيٌّ أَسْلَمَ ثُمَّ ارْتَدَّ، فَقَالَ مُعَاذٌ: لَأَضْرِبَنَّ عُنُقَهُ تَابَعَهُ العَقَدِيُّ، وَوَهْبٌ، عَنْ شُعْبَةَ، وَقَالَ وَكِيعٌ، وَالنَّضْرُ، وَأَبُو دَاوُدَ، عَنْ شُعْبَةَ، عَنْ سَعِيدٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَوَاهُ جَرِيرُ بْنُ عَبْدِ الحَمِيدِ، عَنِ الشَّيْبَانِيِّ، عَنْ أَبِي بُرْدَةَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'টি বিষয়ে আদেশ করেছেন এবং দু'টি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। সর্বপ্রথম আদেশ করেছেন- (তোমরা সহজতা প্রদর্শন করো)। অর্থাৎ সহজ ও সহনীয় আচরণ করো নিজের প্রতিও এবং অন্যের প্রতিও। আল্লাহ তা'আলা সহজ দীন দিয়েছেন। দীনের কোনও বিধানই পালন করা মানুষের পক্ষে সাধ্যের অতীত নয়। ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। (সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৭৮)

এ কারণেই সফরে নামায কসর করার বিধান দেওয়া হয়েছে। সফর অবস্থায় রোযা না রেখে পরে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কোনও কারণে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে না পারলে বসে পড়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ওযু করতে না পারলে তায়াম্মুম করার বিধান দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। কাজেই প্রত্যেকের কর্তব্য দীনের দেওয়া এ সহজতা অবলম্বন করা। শুধু শুধু নিজের প্রতি বা অন্যের প্রতি কঠোরতা আরোপ করা কিছুতেই উচিত নয়। যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায পড়তে না পারে, সে বসেই পড়বে। হাজার কষ্ট হলেও দাঁড়িয়ে পড়তে হবে, এমন কোনও কথা নেই; বরং তা বাঞ্ছনীয়ও নয়। এমনিভাবে অন্যের প্রতি আচরণও সহজ হওয়া কাম্য। শিক্ষকের কর্তব্য ছাত্রকে শিক্ষাদান করা সহজ পন্থায়। শিক্ষাদান পদ্ধতিও যেমন সহজ হওয়া চাই, তেমনি শিক্ষাদানের সময়টাও হওয়া চাই সহনীয় মাত্রায়। দলনেতা ও আমীরেরও কর্তব্য অধীনস্থদের পরিচালনায় কঠোরতা পরিহার করে সহজ কর্মপন্থা অবলম্বন করা। এটা শিক্ষা গ্রহণ করা, শিক্ষ অনুযায়ী আমল করা, আদেশ পালন করা এবং আনুগত্য বজায় রাখার পক্ষে অনেক বেশি সহায়ক।

সহজতা অবলম্বনের আদেশদানের পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করছেন- (কঠোরতা প্রদর্শন করো না)। এ নিষেধাজ্ঞাটি আগের আদেশ দ্বারা এমনিই বোঝা যায়। কেননা যে-কোনও বিষয়ের আদেশ করা হলে তার বিপরীত বিষয়টি আপনা-আপনিই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং যখন সহজতা অবলম্বনের আদেশ করা হয়েছে, তখন কঠোরতা অবলম্বন যে নিষিদ্ধ তা বলার প্রয়োজন পড়ে না। তা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নিষেধাজ্ঞা স্বতন্ত্রভাবেও ব্যক্ত করে দিয়েছেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য সহজতা অবলম্বনের আদেশকে জোরদার করা এবং কোনও অবস্থায়ই যেন কঠোরতা অবলম্বন না করা হয়, সে বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা আরোপ করা। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সহজ পন্থা অবলম্বন করা, তা নিজের প্রতি হোক বা অন্যের প্রতি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তৃতীয় পর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন- (সুসংবাদ শোনাও)। অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ তা'আলার দয়া ও অনুগ্রহের কথা শোনাও। তাদেরকে তাঁর মহাপ্রতিদান ও অকল্পনীয় পুরস্কারের সুসংবাদ দাও। তাদেরকে জানাও তিনি কত বড় ক্ষমাশীল এবং তাঁর মাগফিরাত ও দয়া-অনুগ্রহ কত ব্যাপক। এসব শোনালে মানুষ মনে আনন্দ পাবে। তারা আমলে উৎসাহী হবে। দাওয়াত ও ওয়াজ- নসীহতের মূল উদ্দেশ্যই মানুষকে নেক আমলের প্রতি উৎসাহিত করা। সুসংবাদ শোনানো এ উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয়ে থাকে।

চতুর্থ পর্যায়ে তিনি নিষেধ করেন যে- (অনাগ্রহ সৃষ্টি করো না)। অর্থাৎ এমনকিছু বলো না, যা দ্বারা মানুষ নেক আমলের প্রতি আগ্রহ হারায়। যেমন দীনের কোনও বিধানকে কঠিনরূপে তুলে ধরা, মানুষের মনে হতাশা সৃষ্টি করা, রহমত ও মাগফিরাতের উল্লেখ ব্যতিরেকে কেবল গজব ও শাস্তির কথা বর্ণনা করতে থাকা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেকের উচিত ইবাদত-বন্দেগীসহ যাবতীয় কাজকর্মে কঠোর-কঠিন পন্থা বাদ দিয়ে সহজ পন্থা ও সহজ মাত্রা অবলম্বন করা।

খ. অভিভাবক, শিক্ষক ও নেতৃবর্গের তাদের সংশ্লিষ্টজনদের প্রতি সর্বদা সহজ ও কোমল আচরণ করা উচিত। কিছুতেই কঠোরতা প্রদর্শন করা উচিত নয়।

গ. শিক্ষাগ্রহণ ও আমলে প্রস্তুত করার পক্ষে সুসংবাদ শোনানো ও উৎসাহদান অনেক বেশি সহায়ক হয়ে থাকে। তাই শিক্ষক ও উপদেশদাতাদের এ পন্থাই অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।

ঘ. কারও আপন কর্মপন্থা দ্বারা অন্যকে নেক আমলের প্রতি নিরুৎসাহিত করে তোলা উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)