মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৬- আদাব - শিষ্টাচার অধ্যায়

হাদীস নং: ৫০০৮
১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তাআলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৮। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আসিয়া বলিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এমন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার কি অভিমত? যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসে অথচ তাহাদের সাথে কখনও সাক্ষাৎ হয় নাই। তখন তিনি বলিলেনঃ সেই ব্যক্তি তাহাদের সাথেই রহিয়াছে যাহাদিগকে সে ভালবাসে। -মোত্তাঃ
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ تَقُولُ فِي رَجُلٍ أَحَبَّ قَوْمًا وَلَمْ يَلْحَقْ بِهِمْ؟ فَقَالَ: «المرءُ معَ من أحب» . مُتَّفق عَلَيْهِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বিভিন্ন বর্ণনার প্রতি লক্ষ করলে স্পষ্ট হয় যে, একাধিক সাহাবী আল্লাহ তাআলা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আল্লাহওয়ালাদেরকে মহব্বত করা সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। প্রত্যেকের জিজ্ঞাসার জবাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দেন যে, যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে, সে তার সঙ্গে থাকবে।

তাদের জিজ্ঞাসার এক কারণ তো ছিল নিজ আমল সম্পর্কে কমতির উপলব্ধি। বোঝানো উদ্দেশ্য যে, তাদের মত আমল না করলেও বাস্তবিকপক্ষে সে তাদেরকে ভালোবাসে। এ অবস্থায় তার সে ভালোবাসা কি বৃথা যাবে? আখেরাতে কি এটা কোনও কাজে আসবে না?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন যে- (যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে সে তার সঙ্গে থাকবে)। অর্থাৎ তার ভালোবাসা বৃথা যাবে না। কেননা ইখলাসের সঙ্গে চেষ্টাটাই আসল কথা। সে যখন তাদের মত আমলের চেষ্টা করেছে, তখন অনুরূপ আমল করতে না পারলেও তার চেষ্টাকেই দয়াময় আল্লাহ আমলরূপে গ্রহণ করে নেবেন। চেষ্টা সত্ত্বেও করতে না পারাটা একটা ওযর। যদি আদৌ চেষ্টাই না করা হয়, তবে ভালোবাসার দাবিই বৃথা। কেননা অন্তরে কারও প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা থাকলে তার মত আমলের চেষ্টাও থাকবে। সে চেষ্টা না থাকলে ভালোবাসার দাবি কৃত্রিম বলে গণ্য হবে। কৃত্রিম ভালোবাসা কোনও উপকারে আসবে না।

জিজ্ঞাসার দ্বিতীয় কারণ নিজ আমলের কমতি সম্পর্কিত উপলব্ধিরই ফলবিশেষ। অর্থাৎ যাকে বা যাদেরকে ভালোবাসা হচ্ছে, নিজ আমল যখন তাদের মত নয়, তখন আখেরাতে তাদের সঙ্গে থাকতে না পারার আশঙ্কা। অন্তরে ভালোবাসা থাকার কারণে আখেরাতে কাছে থাকার আকাঙ্ক্ষা তো আছেই। কিন্তু আমলের কমতির কারণে ভয়, না জানি সে আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায়! বলার অপেক্ষা রাখে না, সাহাবায়ে কেরাম তাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছাকাছি থাকতে পারার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। কিন্তু তিনি তো নবী; বরং শ্রেষ্ঠতম নবী। তাই নবীদের সঙ্গে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরেই তিনি থাকবেন। এ অবস্থায় আখেরাতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারার আকাঙ্ক্ষা কিভাবে পূরণ হতে পারে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে- (যে যাকে ভালোবাসে সে তার সঙ্গেই থাকবে)।

হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে এ কথাটি শুনে মুসলিমগণ এতটা আনন্দিত হয়েছিলেন যে, তাদেরকে আর কখনও কোনওকিছুতে অতটা আনন্দিত হতে দেখিনি।

কেননা এর মাধ্যমে তারা আখেরাতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থাকার সুসংবাদ পেয়ে গিয়েছিলেন। তারা তো সত্যিকারভাবেই তাঁকে ভালোবাসতেন। তাঁকে ভালোবাসতেন নিজ প্রাণের চেয়েও বেশি।

ইমাম ইবনুল আরাবী রহ. বাক্যটির ব্যাখ্যা করেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় আনুগত্য ও শর'ঈ রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থাকবে, সে আখেরাতে তাঁকে দেখতে পাবে এবং তাঁর চাক্ষুষ নৈকট্য লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তাঁর আনুগত্য করে না ও শরীআত অনুযায়ী চলে না, অথচ মহব্বতের দাবি করে, তার সে দাবি মিথ্যা।

(যে যাকে ভালোবাসে সে তার সঙ্গে থাকবে)— কথাটিকে একটি সাধারণ নীতিরূপে বলার দ্বারা এদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বিশ্বাসে, কর্মে, চিন্তা-চেতনায় ও ধরন-ধারণে ভালোবাসার জনের সঙ্গে থাকা চাই। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসবে, সে আল্লাহ তা'আলার সম্পর্কে সত্য-সঠিক বিশ্বাস লালন করবে। তাঁর বিধি-বিধান মেনে চলবে। অন্তরে সর্বদা তাঁকে স্মরণ রাখবে। যখন যেই কাজ করবে তাঁকে স্মরণ রেখেই করবে। সে সর্বদা তাঁরই সঙ্গে থাকবে, তাঁরই হয়ে থাকবে এবং তাঁরই জন্য নিবেদিত থাকবে।

যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসবে সে তাঁর রেখে যাওয়া দীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে সচেষ্ট থাকবে। সকল কাজে তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করবে। সুরত ও সীরাত, আকৃতি-প্রকৃতিতে তাঁর মত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।

যে ব্যক্তি আল্লাহওয়ালাদের ভালোবাসবে সে তাদের মত নেককাজ করতে সচেষ্ট থাকবে। নিজ বেশভূষায় তাদের অনুকরণ করবে। চিন্তা-চেতনায় তাদের দলভুক্ত থাকবে। কথাবার্তা ও কাজকর্মে তাদের প্রতিচ্ছবি হতে চেষ্টা করবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আমরা আল্লাহ তা'আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসায় সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের অনুসারী উলামা-মাশায়েখ, মুত্তাকী-পরহেযগার ব্যক্তিবর্গ ও আল্লাহওয়ালাদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসব, যাতে আল্লাহ তা'আলা তাদের সঙ্গে আমাদেরকেও নাজাত দিয়ে জান্নাতবাসী করেন।

খ. যারা নবীপ্রেমিক ও আল্লাহওয়ালাদের আশেক হওয়ার দাবিদার, তাদের নিজ আমল-আখলাক দ্বারা সে দাবির সত্যতা প্রমাণ করা চাই।

২৫৪. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৩৩১৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৫৬
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৫০০৮ | মুসলিম বাংলা