মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৬- আদাব - শিষ্টাচার অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৬২৮
শিষ্টাচার পর্ব:
১. প্রথম অনুচ্ছেদ - সালাম
৪৬২৮। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন : আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আদম (আঃ)-কে তাঁহার আকৃতিতেই সৃষ্টি করিয়াছেন। তাহার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। আল্লাহ্ তা'আলা যখন তাহাকে সৃষ্টি করিলেন,বলিলেনঃ যাও এবং অবস্থানরত ফিরিশতাদের ঐ দলটিকে সালাম কর। আর তাঁহারা তোমার সালামের কি জওয়াব দেয় তাহা শ্রবণ কর। উহাই হইবে তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালাম। তখন তিনি গিয়া বলিলেন, 'আস্সালামু আলাইকুম'। তাহারা (জওয়াবে ) বলিলেন, “আস্সালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ্”। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তাহারা 'ওয়া রাহমাতুল্লাহ্' অংশটি বৃদ্ধি করিলেন। অতঃপর তিনি বলিলেন : প্রত্যেক ব্যক্তিই, যে বেহেশতে প্রবেশ করিবে সে হযরত আদমের আকৃতিতেই হইবে এবং তাহার উচ্চতা হইবে ষাট হাত। তখন হইতে সৃষ্টিকুলের উচ্চতা অদ্যাবধি ক্রমাগত হ্রাস পাইয়া আসিতেছে । – মোত্তাঃ
كتاب الْآدَاب: بَابُ السَّلَامِ. الْفَصْل الأول
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ على صورته طوله ذِرَاعًا فَلَمَّا خَلَقَهُ قَالَ اذْهَبْ فَسَلِّمْ عَلَى أُولَئِكَ النَّفَرِ وَهُمْ نَفَرٌ مِنَ الْمَلَائِكَةِ جُلُوسٌ فَاسْتَمِعْ مَا يُحَيُّونَكَ فَإِنَّهَا تَحِيَّتُكَ وَتَحِيَّةُ ذُرِّيَّتِكَ فَذَهَبَ فَقَالَ: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ فَقَالُوا: السَّلَامُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللَّهِ قَالَ: «فَزَادُوهُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ» . قَالَ: «فَكُلُّ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ عَلَى صُورَةِ آدَمَ وَطُولُهُ سِتُّونَ ذِرَاعًا فَلَمْ يَزَلِ الْخَلْقُ يَنْقُصُ بعدَه حَتَّى الْآن»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

الآداب বহুবচন। একবচনে الآدب 'আল-আদাবু'। আভিধানিক অর্থ হইল, স্থান, কাল ও পাত্রভেদে বুদ্ধিমত্তা ও শালীনতার সহিত কথা বলা বা কাজ করা, প্রতিটি কাজকে বুঝিয়া শুনিয়া বিচক্ষণতার সহিত আঞ্জাম দেওয়া। আর পারিভাষিক অর্থ হইল, সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা, কথায় ও কাজে এমন আচরণ প্রকাশ করা যাহার দ্বারা প্রশংসালাভ করা যায়। আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) বলেনঃ উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়াকে 'আদব' বলে। মূলতঃ উহাই আদবের বুনিয়াদ। আবার কাহারও কাহারও মতে সৎ ও নেক্ কর্মের উপর অবিচল থাকিয়া অসৎ ও অন্যায় কার্যসমূহ হইতে বিরত থাকাকেই 'আদব' বলে। আবার অনেকের মতে বড়দের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ ও মমতা প্রদর্শন করাকেই 'আদব' বলা হয়। ফলকথা, 'আদব' একটি মানবীয় বিশেষ গুণ, যাহার দ্বারা মানুষ নিজেই অন্যের কাছে সম্মানের পাত্র হইয়া থাকে। কেননা, বে-আদব আল্লাহর কাছেও ঘৃণিত। বস্তুতঃ আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি বিশেষ গুণ, যাহা অর্জিত হইলে মানুষ সর্বক্ষেত্রে সম্মানিত ও সমাদৃত হইয়া থাকে।


সালাম প্রসঙ্গ

سلام - 'সালাম' ইহার আভিধানিক অর্থ— বিপদ-আপদ কিংবা দোষ-ত্রুটি হইতে নিরাপদে থাকা। কুরআন মজীদে ইহা শান্তি ও নিরাপত্তা অর্থেও ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমনঃ
تَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ - سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ

ইত্যাদি। ইসলামী শরী'আতে সালাম একটি দো'আবিশেষ। যাহা মুসলমানগণ পরস্পর সাক্ষাতে বিনিময় করিয়া থাকে। ইতিহাস হইতে জানা যায়, মানব সভ্যতার সূচনা হইতেই একে অপরের সহিত সাক্ষাতের সময় উপস্থিতকে স্বাগত জানানোর জন্য বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। বর্তমান চলমান বিশ্বের প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ে তাহাদের নিজ নিজ রুচি ও সংস্কৃতি অনুযায়ী সেই ভাব বিনিময়ের পৃথক পৃথক পদ্ধতি চালু রহিয়াছে।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবদের মধ্যে এমন কিছু বাক্য প্রচলিত ছিল যাহা ইসলামের সূচনালগ্ন হইতেই মহানবী হযরত (ﷺ) পরিবর্তন করিয়া প্রচলিত সালামের শব্দগুলি ব্যবহার করিতে আদেশ করেন। তাহারা যেই সমস্ত শব্দ ব্যবহার করিত উহার অর্থ—‘আল্লাহ্ আপনার চক্ষু ঠাণ্ডা করুন', 'সু-প্রভাত' বা 'শুভ প্রভাত', 'শুভ সন্ধ্যা' ইত্যাদি। অথচ গভীরভাবে লক্ষ্য করিলে দেখা যায়ঃ 'আসসালামু আলাইকুম' এই বাক্যটি সার্বজনীন ও আন্তর্জাতিক মানের। বড়-ছোট, আমীর-গরীব—এক কথায় সকলের ক্ষেত্রে উহা সর্বসময়ে সমানভাবে প্রযোজ্য।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়—অন্য কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের ভাব প্রকাশের প্রচলিত সম্ভাষণ পদ্ধতির মধ্যে সেই সার্বজনীনতা বা ব্যাপকতা নাই, যাহা মুসলমানের 'সালামের' মধ্যে নিহিত রহিয়াছে।
সালামের কার্যকারিতা বা উপকারিতাও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। একজন অপরিচিত ব্যক্তির সহিত পরিচয় অর্জন, ভাব-সম্প্রসারণ এবং তাহাকে খুব সহজেই আপন করিয়া ফেলার জন্য সাক্ষাতের সাথেই প্রথম সম্ভাষণ হিসাবে ইসলামের সালামই যথেষ্ট। অন্য কথায় ইহা যেন একটি জাদুমন্ত্র। আর পরিচিত ব্যক্তির সহিত সালাম বিনিময়ে হৃদ্যতা আরো সুদৃঢ় হয়। এতদ্ভিন্ন 'সালাম' আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে উত্তম সহায়ক। সামাজিকভাবে সালামের দ্বারা পারস্পরিক শত্রুতা দূর হয় এবং বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। সম্প্রীতির পরিবেশ গড়িয়া উঠে, আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সর্বাপেক্ষা বড় কথা, 'সালাম' হইল ইসলামী শে'আর বা প্রতীক।
‘সালাম’ করা বা সালামের জওয়াব দেওয়া উভয়টির মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে শান্তি ও নিরা পদে থাকার কামনা। সুতরাং যখন কোন ব্যক্তি সালাম করিল সে যেন যাহাকে সালাম করিল তাহার অনিষ্ট হইতে নিরাপদে থাকার কামনা করিল। আর যদি সে জওয়াব না দেয় তখন তাহার পক্ষ হইতে কোন প্রকারের ক্ষতি বা অনিষ্টকর কিছু প্রকাশ হওয়ার ধারণা সৃষ্টি হয়। কাজেই সালামের সঙ্গে সঙ্গেই জওয়াব প্রদান করিয়া উক্ত ধারণাটি দূর করিয়া দেওয়া ওয়াজিব হইয়া যায়। ফলে সালামের জওয়াব দেওয়া শরী'আতের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। অবশ্য প্রায় বিশ একুশ অবস্থায় সালাম করা উচিত নয়। যাহার বিবরণ ফেকাহর কিতাবসমূহে রহিয়াছে। এমতাবস্থায় সালাম করিলেও জওয়াব দেওয়া ওয়াজিব নহে। – আনওয়ারুল মাহমুদ, প্রথম জিলদ, পৃষ্ঠা ৮

“আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আদম (আঃ)-কে তাঁহার আকৃতিতেই সৃষ্টি করিয়াছেন।" ইহার ব্যাখ্যায় উলামাদের বিভিন্ন অভিমত রহিয়াছে।
(১) আমাদের সলফে ছালেহীনগণ বলেন, ইহা ‘মুতাশাবিহ্’-এর অন্তর্ভুক্ত, কাজেই ইহার প্রকৃত অর্থ একমাত্র আল্লাহ্ জানেন। অন্যের পক্ষে ইহা জানা সম্ভব নহে। সুতরাং তাঁহারা ইহার ব্যাখ্যা প্রদানে বিরত রহিয়াছেন। (২) কাহারও কাহারও মতে হাদীসের শব্দ صورة 'সূরাৎ’ অর্থ গুণাবলী। অর্থাৎ, আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করিয়া তাঁহার স্বীয় কুদ্রত ও বিশেষ গুণাবলীর বিকাশ ঘটাইয়াছেন। (৩) আবার কাহারও মতে আদমের সম্মান প্রকাশ করার জন্য সূরাৎ শব্দ আল্লাহ্ পাক নিজের দিকে সম্পর্কিত করিয়াছেন। যেমন বলা হয় روح الله এবং بيت الله
সালাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞাতব্যঃ মুসলমানদের পরস্পর সাক্ষাতে সালাম দ্বারা অভিবাদন জানানো সুন্নত। ‘আসসালামু আলাইকুম' বাক্য দ্বারা সালাম করিতে হয়। ইহার পরিবর্তে অন্য কোন শব্দ বা সংকেত ব্যবহার করিলে শরয়ী সালাম তথা সুন্নত আদায় হইবে না। সালামের জওয়াব দেওয়া ওয়াজিব। জওয়াবে ন্যূনতম 'ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম' বলিতে হইবে। সালামে ‘আসসালামু আলাইকুম' বা ‘সালামুন আলাইকুম' উভয়ভাবে সালাম করা জায়েয। তবে প্রথম নিয়মে সালাম করাই উত্তম। ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ্' ও ‘ওয়া বারাকাতুহু' ইত্যাদি সালামে ও জওয়াবে ব্যবহার করাও উত্তম। প্রায় বিশ একুশ অবস্থায় সালাম করা মাকরূহ। তন্মধ্যে নামাযে রত, পানাহারে লিপ্ত, মল-মূত্র ত্যাগে ব্যস্ত, কুরআন পাঠ, ওয়ায নসীহত কিংবা পাঠদান ও যিকির আকারে মশগুল ইত্যাদি অন্যতম। অনুরূপ অবস্থায় কেহ সালাম করিলে উহার জওয়াব দেওয়া ওয়াজিব নহে। পরস্পর উভয়ে একত্রে সালাম করিয়া বসিলে উভয়ের উপরেই জওয়াব দেওয়া ওয়াজিব হইয়া যাইবে। মুসলিম ও অমুসলিম সম্মিলিত থাকিলে তখন—
السلام على من اتبع الهدى ‘আসসালামু আলা মান এত্তাবাআ’লহুদা' বলিয়া সম্বোধন করিবে এবং নিয়তের মধ্যে শুধু মুসলমানকে রাখিবে। মুখে সালাম করার সাথে সাথে হাত উঠান ইসলামী রীতি নহে। তবে দূর হইতে সালাম করিলে তাহা বুঝাইবার জন্য হাত উঠানতে কোন দোষ নাই। কিন্তু সালামের বাক্য উচ্চারণ না করিয়া শুধু হাত বা অঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করিলে ইহাতে সালাম আদায় হইবে না। ফলে জওয়াব দেওয়াও ওয়াজিব নহে। আর এইরূপ করা নিষিদ্ধ। কেননা, ইহা অমুসলিমদের রীতি। — তা'লীক
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান