আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪২৫১
২২০৭. উমরাতুল কাযার বর্ণনা। আনাস (রাযিঃ) নবী কারীম (ﷺ) থেকে এ বিষয়ে বর্ণনা করেছেন
৩৯২৭। উবাইদুল্লাহ্ ইবনে মুসা (রাহঃ) .... বারা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম (ﷺ) যিলকদ মাসে উমরা আদায় করার ইচ্ছায় মক্কা অভিমুখে রওয়ানা করেন। মক্কাবাসীরা তাঁকে মক্কা নগরীতে প্রবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালো। অবশেষে তিনি তাদের সঙ্গে এ কথার উপর সন্ধি-চুক্তি সম্পাদন করেন যে, (আগামী বছর উমরা পালন করতে এসে) তিনি মাত্র তিন দিন মক্কায় অবস্থান করবেন। মুসলিমগণ সন্ধিপত্র লেখার সময় এভাবে লিখেছিলেন, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ আমাদের সঙ্গে এ চুক্তি সম্পাদন করেছেন। ফলে তারা (কথাটির উপর আপত্তি উঠিয়ে) বললো, আমরা তো এ কথা (মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) স্বীকার করিনি। যদি আমরা আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকারই করতাম তা হলে মক্কা প্রবেশে মোটেই বাধা দিতাম না। বরং আপনি তো মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। তখন তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল এবং মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (উভয়টিই)। তারপর তিনি আলী (রাযিঃ)-কে বললেন, “রাসূলুল্লাহ” শব্দটি মুছে ফেল। আলী (রাযিঃ) উত্তর দিলেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো এ কথা মুছতে পারবো না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন নিজেই চুক্তিপত্রটি হাতে নিলেন। তিনি (আক্ষরিকভাবে) লিখতে জানতেন না, তবুও তিনি (তার এক মু‘জিযা হিসেবে) লিখে দিলেন যে, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ এ চুক্তিপত্র সম্পাদন করে দিয়েছে যে, তিনি কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত অন্য কোন অস্ত্র নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করবেন না। মক্কার অধিবাসীদের কেউ তাঁর সাথে যেতে চাইলেও তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন না। তাঁর সাথীদের কেউ মক্কায় (পুনরায়) অবস্থান করতে চাইলে তিনি তাকে বাধা দেবেন না। (পরবর্তী বছর সন্ধি অনুসারে) যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ অতিক্রম হল তখন মুশরিকরা আলীর কাছে এসে বললো, আপনার সাথী [রাসূলুল্লাহ (ﷺ)]- কে বলুন যে, নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তাই তিনি যেন আমাদের নিকট থেকে চলে যান। নবী কারীম (ﷺ) সে মতে প্রত্যাবর্তন করলেন।
এ সময়ে হামযা (রাযিঃ)-এর কন্যা চাচা চাচা বলে ডাকতে ডাকতে তার পেছনে ছুটলো। আলী (রাযিঃ) তার হাত ধরে তুলে নিয়ে ফাতিমা (রাযিঃ)- কে দিয়ে বললেন, তোমার চাচার কন্যাকে নাও। ফাতিমা (রাযিঃ) বাচ্চাটিকে তুলে নিলেন। (কাফেলা মদীনা পৌঁছার পর) বাচ্চাটি নিয়ে আলী, যায়দ (ইবনে হারিসা) ও জা‘ফর [ইবনে আবু তালিব (রাযিঃ)]-এর মধ্যে ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গেল। আলী (রাযিঃ) বললেন, আমি তাকে (প্রথমে) কোলে নিয়েছি এবং সে আমার চাচার কন্যা (তাই সে আমার কাছে থাকবে)! জা‘ফর দাবি করলেন, সে আমার চাচার কন্যা এবং তার খালা হল আমার স্ত্রী। যায়দ [ইবনে হারিসা (রাযিঃ)] বললেন, সে আমার ভাইয়ের কন্যা (অর্থাৎ সবাই নিজ নিজ সম্পর্কের ভিত্তিতে নিজের কাছে রাখার অধিকার পেশ করলো)।
তখন নবী কারীম (ﷺ) মেয়েটিকে তার খালার জন্য (অর্থাৎ জা‘ফরের পক্ষে) ফায়সালা দিয়ে বললেন (আদর ও লালন-পালনের ব্যাপারে) খালা মায়ের সমপর্যায়ের। এরপর তিনি আলীর দিকে লক্ষ্য করে করে বললেন, তুমি আমার এবং আমি তোমার। জা‘ফর (রাযিঃ)- কে বললেন, তুমি দৈহিক গঠন এবং চারিত্রিক গুণে আামার মতো। আর যায়দ (রাযিঃ)- কে বললেন, তুমি আমাদের ঈমানী ভাই ও আযাদকৃত গোলাম। আলী (রাযিঃ) [নবী কারীম (ﷺ)- কে] বললেন, আপনি হামযার মেয়েটিকে বিয়ে করছেন না কেন? তিনি [নবী কারীম (ﷺ)] উত্তরে বললেন, সে আমার দুধ-ভাই (হামযা)-এর মেয়ে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬ষ্ঠ হিজরীতে উমরা আদায়ের লক্ষ্যে মক্কা মুকাররামার সফর করেছিলেন। কিন্তু হুদায়বিয়ায় পৌঁছার পর মক্কার মুশরিকদের পক্ষ থেকে তিনি বাধার সম্মুখীন হন। ফলে তার পক্ষে উমরা আদায় করা সম্ভব হয়নি। তিনি তাদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসেন। এটিই বিখ্যাত 'হুদায়বিয়ার সন্ধি' নামে পরিচিত। এ সন্ধির একটি শর্ত ছিল পরবর্তী বছর তিনি উমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় যেতে পারবেন। সেমতে পরের বছর সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি উমরা আদায় করেন। উমরা আদায়ের পর তিনি যখন মক্কা থেকে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হন, তখন হযরত হামযা রাযি.-এর শিশুকন্যা 'চাচা চাচা' বলে ছুটে আসল।

হযরত হামযা রাযি. হিজরী ৩য় সনে উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী সালমা বিনতে উমায়স রাযি. তখনও হিজরত করেননি। এ কারণে তাঁর কন্যা উমারা বর্ণনান্তরে উমামা মায়ের সঙ্গে মক্কা মুকাররামায় থেকে গিয়েছিলেন। এবার তিনি মদীনা মুনাউওয়ারায় যেতে চাইলেন এবং সে উদ্দেশ্যে চাচা চাচা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে ছুটে চললেন।

উমারা যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাতো বোন ছিলেন, তা সত্ত্বেও চাচা বলার কারণ হয়তো তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা অথবা তা বলেছিলেন এ কারণে যে, তার পিতা হযরত হামযা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হলেও তাঁরা দু'জন একই দুধমায়ের দুধ পান করেছিলেন। সে হিসেবে তাঁরা দুধভাইও।

যাহোক হযরত আলী রাযি. উমারাকে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। তিনি তাকে নিয়ে হযরত ফাতিমা রাযি.-এর হাতে তুলে দিলেন। বললেন, এ তোমার চাচাতো বোন। এর যত্ন নিও। তিনি তাকে নিজের সাথে বাহনে তুলে নিলেন। তারপর সেখানেই অথবা মদীনায় আসার পর তার লালন-পালনের অধিকার নিয়ে হযরত আলী রাযি.. হযরত জা'ফর রাযি. ও যায়দ ইবন হারিছা রাযি.-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। তাদের প্রত্যেকেই সে মেয়ের লালন-পালনের অধিকার দাবি করলেন। হযরত আলী রাযি. বললেন, সে আমার চাচাতো বোন এবং আমিই তাকে সঙ্গে করে এনেছি। হযরত জাফর রাযি. বলছিলেন, সে আমার চাচাতো বোন এবং তার খালা আমার স্ত্রী। হযরত যায়দ রাযি. বলছিলেন, সে আমার ভাইয়ের মেয়ে। ভাইয়ের মেয়ে এ হিসেবে যে, হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃবন্ধন স্থাপন করেন, তখন হযরত যায়দ রাযি.-কে হযরত হামযা রাযি.-এর ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে হিসেবেই উমারা হযরত যায়দ রাযি.-এর ভাতিজী হন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সে দাবি-দাওয়ার মধ্যে যখন ফয়সালা দান করেন, তখনই এ নীতিবাক্যটি উচ্চারণ করেন যে-
الخَالَةُ بِمَنْزِلَةِ الأُمِّ (খালা মায়ের সমতুল্য)। কাজেই একে এর খালার হাতে ন্যস্ত করা হোক। এই বলে তিনি উমারাকে তার খালা এবং হযরত জা'ফর রাযি.-এর স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়স রাযি.-এর কাছে সমর্পণ করেন। তারপর তাদের তিনওজনের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করলেন। হযরত আলী রাযি.-কে বললেন, আমি তোমার সঙ্গে এবং তুমি আমার সঙ্গে রয়েছ। হযরত জাফর রাযি.-কে বললেন, তুমি আকৃতি ও প্রকৃতিতে আমারই মত। আর হযরত যায়দ রাযি.-কে বললেন, তুমি আমার ভাই ও মাওলা (আদাযকৃত গোলাম বা বন্ধু)।

এর দ্বারা জানা গেল, প্রতিপালনের অধিকার খালারই জন্য সংরক্ষিত; আসাবা (যাবিল ফুরূয ব্যতীত অন্যান্য উত্তরাধিকারী)-এর জন্য নয়। হযরত হামযা রাযি.-এর আপন বোন সাফিয়্যা রাযি. তখনও জীবিত ছিলেন। যদিও জানা যায় না, তিনি লালন- পালন করতে চেয়েছিলেন কি না, কিন্তু তাঁর বর্তমান থাকা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, খালা মায়েরই মত। এ কথা বলেননি যে, ফুফুর দাবি না করার কারণে খালা মায়ের মত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. খালা মায়ের মত। কাজেই মায়ের মতই তার খেদমত ও ভক্তি-সম্মান করা উচিত।

খ. বিচারকের উচিত ন্যায়সম্মত ফয়সালা দানের পর বাদী-বিবাদী উভেয়ের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন