আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪১৩৪
২১৯৫. যাতুর রিকার যুদ্ধ।
৩৮৩১। আবুল ইয়ামান (রাহঃ) .... জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নাজদ এলাকায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
(অন্য এক সনদে) ইসমাঈল (রাহঃ) .... জাবির ইবনে ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নাজদ এলাকায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করলে তিনিও তাঁর সাথে প্রত্যাবর্তন করলেন। পথিমধ্যে কাঁটা গাছ ভরা এক উপত্যকায় মধ্যাহ্নের সময় তাঁদের ভীষণ গরম অনুভূত হল।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এখানেই অবতরণ করলেন। লোকজন সবাই ছায়াবান গাছের খোঁজে কাঁটাবনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি বাবলা গাছের নীচে অবস্থান করে তরবারিখানা গাছে ঝুলিয়ে দিলেন।
জাবির (রাযিঃ) বলেন, সবেমাত্র আমরা নিদ্রা গিয়েছি। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে ডাকতে আরম্ভ করলেন। আমরা সকলেই তাঁর কাছে উপস্থিত হলাম। তখন তাঁর কাছে এক বেদুঈন বসা ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমি নিদ্রিত ছিলাম, এমতাবস্থায় সে আমার তরবারিখানা হস্তগত করে কোষমুক্ত অবস্থায় তা আমার উপর উঁচু করে ধরলে আমি জাগ্রত হই। তখন সে আমাকে বলল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করবে কে? আমি বললাম, আল্লাহ! দেখ না, এ-ই তো সে বসা আছে। (এ জঘন্যতম অপরাধের পরও) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে কোনো প্রকার শাস্তি প্রদান করেননি।
(অপর এক সনদে) আবান (রাহঃ) .... জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যাতুর রিকার যুদ্ধে আমরা নবী কারীম (ﷺ)- এর সঙ্গে ছিলাম। আমরা একটি ছায়াবান বৃক্ষের কাছে গিয়ে পৌঁছলে নবী কারীম (ﷺ)- এর আরামের জন্য আমরা তা ছেড়ে দিলাম। এমন সময় এক মুশরিক ব্যক্তি এসে গাছের সাথে ঝুলানো নবী কারীম (ﷺ)- এর তরবারীখানা হাতে নিয়ে তা তাঁর উপর উঁচিয়ে ধরে বলল, তুমি আমাকে ভয় পাও কি? তিনি বললেন না। এরপর সে বলল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করবে কে? তিনি বললেন, আল্লাহ। এরপর নবী কারীম (ﷺ)- এর সাহাবীগণ তাকে ধমক দিলেন। এরপর নামায আরম্ভ হলে তিনি মুসলমানদের একটি দলকে নিয়ে দু’রাকআত নামায আদায় করলেন। তারা এখান থেকে হটে গেলে অপর দলটি নিয়ে তিনি আরো দু’রাকআত নামায আদায় করলেন। এভাবে নবী কারীম (ﷺ)- এর হল চার রাকআত এবং সাহাবীদের হল দু’রাকআত নামায।
(অন্য এক সূত্রে) মুসাদ্দাদ (রাহঃ) .... আবু বিশর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম (ﷺ)- এর প্রতি যে লোকটি তলোয়ার উঁচু করেছিল তার নাম হল গাওরাস ইবনে হারিস। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযানে খাসাফার বংশধর মুহারিব গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
আবু যুবাইর (রাহঃ) .... জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, নাখল নামক স্থানে আমরা নবী কারীম (ﷺ)- এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি এ সময় সালাতুল খাওফ আদায় করেছেন। আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলেন, নাজদের যুদ্ধে আমি নবী কারীম (ﷺ)- এর সাথে সালাতুল খাওফ (নামায) আদায় করেছি। আবু হুরায়রা খায়বার যুদ্ধের সময় নবী কারীম (ﷺ)- এর কাছে এসেছিলেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ ঘটনাটি যাতুর-রিকার যুদ্ধকালীন। এ যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বনু মুহারিবের বিরুদ্ধে হিজরী ৬ষ্ঠ সালে। কারও মতে ৪র্থ সালে। যে লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল তার নাম গাওরাছ ইবনুল হারিছ। সে বনু মুহারিবেরই এক ব্যক্তি। সে তাদের সাথে সলাপরামর্শ করেই এ দুষ্কর্মটি করতে এসেছিল। সে যখন নাঙ্গা তরবারি নিয়ে আঘাত হানতে উদ্যত হয় এবং বলে উঠে, কে তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাবে, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিন্দুমাত্র ভয় পাননি। আল্লাহ তা'আলার উপর তাঁর ছিল শতভাগ তাওয়াক্কুল। আল্লাহর উপর নির্ভরতার এত উচ্চস্তরে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন যে, তিনি যেন সর্বক্ষণ আল্লাহ তা'আলাকে প্রত্যক্ষ করতেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর মুশাহাদা ও দর্শন এবং তাঁর যিকর ও স্মরণে যাঁর অন্তর সর্বক্ষণ নিমগ্ন থাকে, এক বেঈমান মুশরিকের উদ্যত তরবারি দেখে তিনি ভয় পাবেন? বরং তিনি যখন বললেন আল্লাহই আমাকে বাঁচাবে, তখন তাঁর আল্লাহ-নির্ভরতাজনিত হিম্মত ও উচ্চারণের বলিষ্ঠতায় সেই লোকটিরই অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠল। সে এমনই ভীত হয়ে পড়ল যে, তরবারিটি তার হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর তিনি যখন সেই তরবারি নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- এখন তোমাকে কে বাঁচাবে, তখন সে সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে গেল। আল্লাহর প্রতি যার ঈমান নেই, এরকম অবস্থায় সে কি-ই বা করতে পারে? অগত্যা সে আত্মসমর্পণ করল এবং তাঁর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করল। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদের আয়াত নাযিল হয়-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ هَمَّ قَوْمٌ أَنْ يَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ فَكَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর নি'আমত স্মরণ কর। যখন একদল লোক তোমাদের বিরুদ্ধে হাত বাড়াতে চেয়েছিল, তখন আল্লাহ তোমাদের (ক্ষতিসাধন করা) থেকে তাদের হাত নিবৃত্ত করেছিলেন এবং (তার কৃতজ্ঞতা এই যে,) আল্লাহকে ভয় কর আর মুমিনদের তো কেবল আল্লাহরই উপর নির্ভর করা উচিত।সূরা মায়িদা, আয়াত ১১
অর্থাৎ এ ঘটনায় যে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গাওরাছের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, এটা আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাঁর নির্ভরতার ফল। সুতরাং হে মু'মিনগণ! তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়ে তোমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা কর। তা যদি করতে পার, তবে তোমরাও তাঁর সাহায্য লাভ করবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাইলে গাওরাছকে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু এটা তাঁর চরিত্র ছিল না। তিনি ছিলেন ক্ষমাপ্রবণ। ছিলেন সহনশীল। তাঁর চরিত্র ছিল মহানুভবতায় ভরা। মক্কী জীবনের নিঃসঙ্গতাকালেও সকলের প্রতি ক্ষমাশীল আচরণ করেছেন। মাদানী জীবনে যখন পর্যায়ক্রমে লোকবল ও অস্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে উঠেছেন, তখনও প্রতিশোধপরায়ণ হননি। সর্বাবস্থায় মানুষ তাঁর কাছ থেকে মহানুভব আচরণই পেয়েছে। তিনি এর মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করেছেন। তাঁর এ শক্তিবলেই দলে দলে মানুষ ইসলামের কাছে পরাভব স্বীকার করেছে। এ লোকটিকেও তাঁর মহানুভবতার শক্তি স্পর্শ করেছিল। তখনই সে ইসলাম গ্রহণ না করলেও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তার অন্তরে ঠিকই দাগ কেটেছিল। ফলে সে তার কওমের কাছে ফিরে গিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল- আমি শ্রেষ্ঠতম মানুষের কাছ থেকে এসেছি। কারও কারও মতে তারপর তিনি বাস্তবেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য দ্বারা ধন্য হন। এ ঘটনাও সাক্ষ্য দেয় ইসলাম তলোয়ারে নয়, উদারতার জোরেই বিশ্বজয় করেছিল।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ ঘটনা দ্বারা বোঝা যায় এসময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহ 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনও পাহারাদার ছিল না। এর আগে সাহাবায়ে কিরাম পালাক্রমে তাঁকে পাহারা দিতেন। পরিশেষে আয়াত নাযিল হয়– وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ “আল্লাহই তোমাকে মানুষের হাত থেকে রক্ষা করবেন।"
এরপর থেকে তিনি আর কাউকে পাহারায় নিযুক্ত করতেন না। কোনও কোনও বর্ণনা অনুযায়ী এ আয়াত যাতুর-রিকা'র এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই নাযিল হয়েছে। ইব্ন হাজার ‘আসকালানী রহ. বলেন, সম্ভবত এর আগে পাহারাদার রাখার ব্যাপারে তাঁকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। সাধারণত সাহাবায়ে কিরাম তাঁর পাহারাদারি করতেন। কিন্তু কখনও কখনও ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুলের বলে তিনি একাকীও থাকতেন, কোনও পাহারাদার রাখতেন না। পরিশেষে যখন এ ঘটনা ঘটল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত আয়াত নাযিল হল, তখন পাহারাদার নিয়োগ সম্পূর্ণরূপেই বাদ দিলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কঠিন বিপদে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করলে আল্লাহ তা'আলা তা থেকে ঠিকই মুক্তিদান করেন।

খ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওয়াক্কুলের কত উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

গ. এ ঘটনা দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষমাশীলতা ও মহানুভবতারও পরিচয় পাওয়া যায়।

ঘ. আরও জানা যায় শত্রু থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, তবে সেটাই প্রকৃত মহানুভবতা।

ঙ. এর দ্বারা জানা যায় যে, মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য উদারতা ও ক্ষমাশীলতা একটি শক্তিশালী উপায়। সুতরাং ইসলামের দাওয়াতদাতার কর্তব্য এ গুণ অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন