আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫০- নবীজীর সাঃ যুদ্ধাভিযানসমূহ

হাদীস নং: ৩৮২৪
আন্তর্জাতিক নং: ৪১২৫ - ৪১২৮
২১৯৫. যাতুর রিকার যুদ্ধ। গাতফানের শাখা গোত্র বনু সালাবার অন্তর্গত খাসাফার বংশধর মুহারিব গোত্রের সাথে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নাখল নামক স্থানে অবতরণ করেছিলেন। খায়বার যুদ্ধের পর এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কেননা আবু মুসা (রাযিঃ) খায়বার যুদ্ধের পর (হাবশা থেকে ) এসেছিলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে রাজা (রাহঃ) .... জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম (ﷺ) সপ্তম যুদ্ধ তথা যাতুর রিকার যুদ্ধে তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে সালাতুল খাওফ আদায় করেছেন। ইবনে আব্বাস (রাহঃ) বলেছেন, নবী কারীম (ﷺ) যূকারাদের যুদ্ধে সালাতুল খাওফ আদায় করেছেন।
বকর ইবনে সাওয়াদা (রাহঃ) .... জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাবির ও সালাবা গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় নবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে সালাতুল খাওফ আদায় করেছেন।
ইবনে ইসহাক (রাহঃ) .... জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম (ﷺ) নাখল নামক স্থান থেকে যাতুর রিকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গাতফান গোত্রের একটি দলের সম্মুখীন হন। কিন্তু সেখানে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। উভয় পক্ষ পরস্পর ভীতি প্রদর্শন করেছিল মাত্র। তখন নবী কারীম (ﷺ) দু’রাকআত সালাতুল খাওফ আদায় করেন। ইয়াযীদ (রাহঃ) সালামা (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি নবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে যুকারাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম।
৩৮২৪। মুহাম্মাদ ইবনে আ‘লা (রাহঃ) .... আবু মুসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক যুদ্ধে আমরা নবী কারীম (ﷺ) এর সাথে রওয়ানা করলাম। আমরা ছিলাম ছয়জন। আমাদের একটি মাত্র উট ছিল। পালাক্রমে আমরা এর পিঠে আরোহণ করতাম। (হেঁটে হেঁটে) আমাদের পা ফেটে যায়। আমার পা দুখানাও ফেটে গেল, খসে পড়ল নখগুলো। এ কারণে আমরা আমাদের পায়ে নেকড়া জড়িয়ে বাঁধলাম। এ জন্য এ যুদ্ধকে যাতুর রিকা যুদ্ধ বলা হয়। কেননা এ যুদ্ধে আমরা আমাদের পায়ে নেকড়া দ্বারা পট্টি বেঁধেছিলাম। আবু মুসা (রাযিঃ) উক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি এ ঘটনা বর্ণনা করাকে অপছন্দ করেন। তিনি বলেন, আমি এভাবে বর্ণনা করাকে ভাল মনে করি না। সম্ভবতঃ তিনি তার কোন আমল প্রকাশ করাকে অপছন্দ করতেন।
بَابُ غَزْوَةِ ذَاتِ الرِّقَاعِ وَهِيَ غَزْوَةُ مُحَارِبِ خَصَفَةَ مِنْ بَنِي ثَعْلَبَةَ مِنْ غَطَفَانَ، فَنَزَلَ نَخْلًا، وَهِيَ بَعْدَ خَيْبَرَ، لِأَنَّ أَبَا مُوسَى جَاءَ بَعْدَ خَيْبَرَ»

قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ: وقَالَ لِي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَجَاءٍ، أَخْبَرَنَا عِمْرَانُ القَطَّانُ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا: «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى بِأَصْحَابِهِ فِي الخَوْفِ فِي غَزْوَةِ السَّابِعَةِ، غَزْوَةِ ذَاتِ الرِّقَاعِ» قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ صَلَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الخَوْفَ بِذِي قَرَدٍ

وَقَالَ بَكْرُ بْنُ سَوَادَةَ: حَدَّثَنِي زِيَادُ بْنُ نَافِعٍ، عَنْ أَبِي مُوسَى، أَنَّ جَابِرًا حَدَّثَهُمْ «صَلَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِهِمْ يَوْمَ مُحَارِبٍ، وَثَعْلَبَةَ»

وَقَالَ ابْنُ إِسْحَاقَ: سَمِعْتُ وَهْبَ بْنَ كَيْسَانَ، سَمِعْتُ جَابِرًا، خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى ذَاتِ الرِّقَاعِ مِنْ نَخْلٍ، فَلَقِيَ جَمْعًا مِنْ غَطَفَانَ، فَلَمْ يَكُنْ قِتَالٌ، وَأَخَافَ النَّاسُ بَعْضُهُمْ بَعْضًا، فَصَلَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَكْعَتَيِ الخَوْفِ " وَقَالَ يَزِيدُ: عَنْ سَلَمَةَ، غَزَوْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ القَرَدِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْعَلاَءِ، حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ بُرَيْدِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ أَبِي مُوسَى ـ رضى الله عنه ـ قَالَ خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي غَزَاةٍ وَنَحْنُ سِتَّةُ نَفَرٍ بَيْنَنَا بَعِيرٌ نَعْتَقِبُهُ، فَنَقِبَتْ أَقْدَامُنَا وَنَقِبَتْ قَدَمَاىَ وَسَقَطَتْ أَظْفَارِي، وَكُنَّا نَلُفُّ عَلَى أَرْجُلِنَا الْخِرَقَ، فَسُمِّيَتْ غَزْوَةَ ذَاتِ الرِّقَاعِ، لِمَا كُنَّا نَعْصِبُ مِنَ الْخِرَقِ عَلَى أَرْجُلِنَا، وَحَدَّثَ أَبُو مُوسَى بِهَذَا، ثُمَّ كَرِهَ ذَاكَ، قَالَ مَا كُنْتُ أَصْنَعُ بِأَنْ أَذْكُرَهُ. كَأَنَّهُ كَرِهَ أَنْ يَكُونَ شَىْءٌ مِنْ عَمَلِهِ أَفْشَاهُ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. যাতুর-রিকা'র যুদ্ধকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণ কী কঠিন অর্থসংকটের মধ্যে ছিলেন, তার খানিকটা বর্ণনা দিয়েছেন। যাতুর-রিকা'র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বনু গাতফান ও মুহারিবের বিরুদ্ধে। উহুদ ও বদরের যুদ্ধে তারা কুরায়শদের সাহায্য করেছিল। ৩য় হিজরিতে তারা একবার মদীনা আক্রমণেরও প্রস্তুতি নিয়েছিল। ৪র্থ হিজরী জুমাদাল উলা মাসে অথবা মুহাররাম মাসে তারা আবার মদীনা আক্রমণের উদ্যোগ নেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে চারশ' বা সাতশ' সাহাবীর একটি বাহিনী গঠন করেন এবং বনূ গাতফানের এলাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন।

মুসলিম বাহিনীর আগমন-সংবাদ পেয়ে বনূ গাতফান ও বনু মুহারিব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা প্রাণরক্ষার জন্য কাছের একটি পাহাড়ে আত্মগোপন করে। ফলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধের অবকাশ হয়নি। মুসলিম বাহিনী সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করে মদীনায় ফিরে আসে।

যুদ্ধটির বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত আবূ মূসা রাযি. বলেন- وَنَحْنُ سِتَّةُ نَفَرٍ بيْنَنَا بَعِيرٌ نَعْتَقِبُهُ (আমরা ছিলাম ছয়জন লোক। আমাদের মধ্যে ছিল একটি উট। আমরা সেটিতে পালাক্রমে চড়তাম)। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল চারশ', কোনও মতে সাতশ'। হযরত আবু মুসা আশ'আরী রাযি. যে বলেছেন আমরা ছিলাম ছয়জন, তার অর্থ আশ'আর গোত্রের সৈন্য ছিল ছয়জন। সে ছয়জন কে কে, তাদের নাম জানা যায় না। এই ছয়জনের জন্য ছিল একটি মাত্র উট। তারা একজনের পর একজন সেটিতে চড়তেন। যখন একজন সেটিতে চড়তেন, তখন বাকি পাঁচজনকে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হতে হতো। এভাবে তারা পালাক্রমে কখনও উটে চড়ে, কখনও পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেন। এতে করে তাদের পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। হযরত আবূ মূসা রাযি. বলেন, ফলে আমাদের পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। আমার পা’ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। আমার পায়ের নখ পড়ে গেল।

ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পায়ে পট্টি বেঁধে নিতে হয়েছিল। হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি.-এর বর্ণনা অনুযায়ী এ কারণেই যুদ্ধটির নাম হয়েছিল 'যাতুর-রিকা'-এর যুদ্ধ। ‘রিকা’ (رقاعٌ) শব্দটি رُقعَةٌ-এর বহুবচন। رُقعَةٌ অর্থ কাপড়ের টুকরা। তারা তাদের পায়ে কাপড়ের টুকরো দ্বারা পট্টি বেঁধেছিলেন বলে যুদ্ধটির এ নাম। কেউ কেউ এ নামকরণের ভিন্ন কারণও বলেছেন। যেমন কেউ বলেন, যাতুর- রিকা' একটি খেজুর বাগানের নাম। সে বাগানের নামেই এ যুদ্ধের নাম রাখা হয়েছে। কারও মতে সেখানকার এক প্রকার গাছের নাম। সে হিসেবে এ যুদ্ধের নাম 'গাযওয়া যাতুর-রিকা'। আবার কেউ বলেন, এখানকার ভূমির কোনও অংশ সাদা ও কোনও অংশ কালো বর্ণের ছিল। দেখলে মনে হয়- যেন বিভিন্ন রঙের কাপড়ের টুকরা দ্বারা তালি লাগানো হয়েছে। সে কারণেই এলাকাটির নাম হয়ে গেছে যাতুর-রিকা।

হাদীছটি বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ণনাকারী আবু বুরদা রহ. বলেন যে, হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. এ যুদ্ধকালে যে কঠিন কষ্ট-ক্লেশ ভোগ করেছিলেন, সে কথা আমাদের সামনে প্রকাশ তো করে ফেললেন, কিন্তু পরক্ষণেই এটা তাঁর কাছে অপসন্দ লাগল। কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে এরূপ কষ্ট-ক্লেশ ভোগ ও তাতে ধৈর্য-স্থৈর্যের পরিচয় দান করাটা ছিল তাঁর অতি উঁচু একটা নেক আমল। নিজ নেক আমলের কথা প্রকাশ করা পসন্দনীয় নয়। এতে এক তো আত্মপ্রশংসা করা হয়, দ্বিতীয়ত এতে রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা সৃষ্টির ভয় থাকে। তাই বিনা প্রয়োজনে নিজ সৎকর্ম প্রকাশ করা সমীচীন নয়। এটাই কুরআন- সুন্নাহর শিক্ষা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ
‘আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর, তবে তা তোমাদের পক্ষে কতইনা শ্রেয়!(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭১)
এর দ্বারা বোঝা যায় দান-খয়রাত প্রভৃতি সৎকর্ম গোপনে করাই শ্রেয়। তবে কোনও দীনী উপকার থাকলে প্রকাশ্যেও করা যায়। সুতরাং সূরা বাকারার এ আয়াতের শুরুতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ
‘তোমরা দান-সদাকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো'।

হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. যদিও নিজ তাকওয়া-পরহেযগারী ও বিনয়ের উচ্চতর অবস্থান থেকে তাঁর এ সৎকর্মের প্রকাশকে অপসন্দ করেছেন, কিন্তু বহুবিধ ফায়দার দিকে লক্ষ করলে এ প্রকাশ করাটাও তাঁর একটি উচ্চ নেক আমলরূপেই গণ্য হবে। কেননা এ প্রকাশের মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম শিক্ষা। এর দ্বারা আমরা এক তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতী জীবনের ঘটনাবলি জানতে পারি, দ্বিতীয়ত এর দ্বারা আমরা দীনের জন্য আপন জান-মাল কুরবানী করার অনুপ্রেরণাও লাভ করি। এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যত লোক দীনের পথে ত্যাগ স্বীকার করবে, সে ত্যাগস্বীকারের কারণে এ মহান সাহাবীর আমলনামায়ও তাদের সমান ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যত কঠিন কষ্ট-ক্লেশই হোক না কেন, সর্বাবস্থায় দীনের পথে সবরের পরিচয় দেওয়া চাই।

খ. অপ্রয়োজনে নিজ সৎকর্মের কথা প্রকাশ করতে নেই।

গ. দীনী ফায়দা লক্ষ করা গেলে নিজ সৎকর্ম প্রকাশ করারও অবকাশ আছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাতে সদাকায়ে জারিয়ার ছাওয়াব লাভেরও সম্ভাবনা থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন