মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

১৪- বিবাহ-শাদী সম্পর্কিত অধ্যায়

হাদীস নং: ৩২৪২
১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - স্ত্রীদের সাথে সদ্ব্যবহার এবং তাদের প্রত্যেকের (স্বামী-স্ত্রীর) পারস্পরিক হক ও অধিকার সংক্রান্ত
৩২৪২। ’আব্দুল্লাহ ইবনু যাম্’আহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যেন ক্রীতদাসীর ন্যায় স্ত্রীকে না মারে (অত্যাচার না করা হয়), অথচ দিনের শেষেই তার সাথে সহবাস করে।

অন্য বর্ণনায় হাদীসটি কিছুটা ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।
তোমাদের কেউ কেউ এ কি ধরণের আচরণে উদ্যত হয়? গোলামের মত স্ত্রীদের মারতে শুরু করে দেয় অথচ এই দিনের শেষ ভাগেই হয়ত সে তার সাথে সহবাস করবে।
আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বলেনঃ এরপর নবী (ﷺ) কারো বাৎকর্মের দরুন হাসার বিষয়ে তাদের নসীহত করলেন। বললেনঃ কি বিষয়ে তোমাদের লোকেরা হাসে! অথচ নিজেই তো এটা করে।
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زَمَعَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَجْلِدْ أَحَدُكُمُ امْرَأَتَهُ جَلْدَ الْعَبْدِ ثُمَّ يُجَامِعْهَا فِي آخِرِ الْيَوْمِ» وَفِي رِوَايَةٍ: «يَعْمِدُ أَحَدُكُمْ فَيَجْلِدُ امْرَأَتَهُ جَلْدَ الْعَبْدِ فَلَعَلَّهُ يُضَاجِعُهَا فِي آخِرِ يَوْمِهِ» . ثُمَّ وَعَظَهُمْ فِي ضَحِكِهِمْ مِنَ الضَّرْطَةِ فَقَالَ: «لِمَ يَضْحَكُ أَحَدُكُمْ مِمَّا يفعل؟»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

স্ত্রীকে মারধর করা কেন

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীকে দাস (দাসী)-এর মত পেটাতে নিষেধ করেছেন। দাস-দাসীর সঙ্গে তুলনা করার উদ্দেশ্য সাধারণভাবে দাস-দাসীকে মারার বৈধতাদানের জন্য নয়। বিভিন্ন হাদীছে দাস-দাসীকেও মারধর করতে নিষেধ করা হয়েছে। হাঁ, কারও সংশোধনের জন্য হালকা মারধরের প্রয়োজন বোধ হলে সেটা ভিন্ন কথা। না হয় কেবল নিজের মনের ঝাল মেটানোর জন্য দাস-দাসীকে পেটানো বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত শাস্তিদান করা কোনওক্রমেই বৈধ নয়। তাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে মূলত সেকালের মানুষের সাধারণ রেওয়াজ হিসেবে।
জাহিলী যুগে দাস-দাসীকে মানুষই মনে করা হত না। তাই তাদের সঙ্গে আচার আচরণও মানবিক ছিল না। কথায় কথায় মারধর করা হত। মারতে মারতে অনেক সময় মেরেই ফেলা হত। এ অন্যায় প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করেই বলা হয়েছে যে, দাস দাসীকে যেমন অন্যায়ভাবে মারধর করতে দ্বিধাবোধ করা হয় না, তেমনি তোমাদের অনেকেও স্ত্রীকেও অন্যায়ভাবে মারধর করে থাকে। এটা কিছুতেই সমীচীন নয়। দাস দাসীকেই যখন অন্যায়ভাবে মারা যায় না, তখন স্ত্রীকে কিভাবে অন্যায় মারধর করা যায়? তোমরা যেমন আদমসন্তান, তারাও তেমনি একই আদমসন্তান। আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে যে তাদের অভিভাবক বানিয়েছেন, সেটা মারধর করার জন্য নয়; বরং দাম্পত্যজীবন যাতে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ হয় সেজন্য। তোমাদের কর্তব্য তাদের যথাযথ হক আদায় করা ও তাদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলা।
তাদেরকে মারধর করা যে কত ঘৃণ্য কাজ, তা স্পষ্ট করার জন্য এর পরই তিনি দিনশেষে তার সঙ্গে মেলামেশা করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এটা কোনও বুদ্ধিমান ও রুচিশীল লোকের কাজ হতে পারে না যে, দিনের বেলা স্ত্রীকে মারবে এবং দিনশেষে তার সঙ্গে মেলামেশা করবে। মানবিক মেলামেশা করাটা পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং আগ্রহ-উৎসাহের উপর নির্ভরশীল। সবকিছু গায়ের জোরে সারাটা একরকম পশুত্ব, তা মানুষের কাজ হতে পারে না। মেলামেশা করাটা যখন দাম্পত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, তখন তা যাতে সম্পূর্ণ মানবিক হয় সেজন্য মন-মানসিকতা সম্পূর্ণ অমলিন ও স্ফুর্তিপূর্ণ থাকা জরুরি। অন্যায় মারধর করাটা এর সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান।

হাস্যকর অহেতুক হাসি

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়ুত্যাগের বিষয়টি নিয়ে হাসতে নিষেধ করেছেন। হাদীসে আছে, তিনি বলেছেন (তোমাদের প্রত্যেকে এমন কাজে কেন হাসে, যা নিজে করে?!)। অর্থাৎ বায়ুত্যাগের বিষয়টি মানুষের স্বভাবগত, যা সকলেই করে। যে কাজ স্বাভাবিকভাবেই সকলেই করে তা কোনও হাসির বিষয় হতে পারে না। হাসির কারণ হল এমন বিষয়, যে বিষয়টি হয় আশ্চর্যজনক ও বিরল। এরূপ ক্ষেত্রে মানুষ মুচকি হাসবে। আশ্চর্য ও বিরলতার মাত্রা একটু বেশি হলে সে হাসি হবে শব্দ করে। যদি অধিকতর আশ্চর্যজনক হয়, তখন আসে অট্টহাসির পালা। কিন্তু যে বিষয়টি স্বভাবগত এবং যা সচরাচরই ঘটে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই হাসিরও ব্যাপার নেই, বিশেষত যখন সকলের দ্বারাই তা হয়ে যায়। বরং এরূপ ক্ষেত্রে হাসাহাসি করাই হবে হাস্যকর। এটা ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী কাজ ও লঘু চরিত্রের পরিচায়ক। আবার এরকম হাসি যার প্রতি হয়, তাকে একরকম হেয় করা হয় ও লজ্জা দেওয়া হয়। সেদিক থেকে এটি অনুচিত কাজও বটে।
অবশ্য অধিকাংশ লোকেরই চরিত্রে ব্যক্তিত্বের বড় অভাব। একরকম লঘুত্ব দ্বারাই যেন সকলে চালিত। তাই এ জাতীয় কাজে অধিকাংশের আপনা-আপনিই হাসি এসে যায়। অতএব যাদের বায়ুচাপ দেখা দেয়, তাদের নিজেদেরই সতর্ক হওয়া ভালো। তাদের উচিত লোকসম্মুখ থেকে উঠে গিয়ে নিরালা কোথাও সেরে আসা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. স্ত্রীর সঙ্গে দাসীসুলভ আচরণ করতে নেই।

খ. স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে মারা জায়েয নয়। এমনকি স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা ভদ্র ও রুচিশীল ব্যক্তির কাজ নয়।

গ. স্বভাব-প্রকৃতিগত কাজ হাসির কারণ হতে পারে না। কাজেই এরূপ কাজে হাসতে নেই।

ঘ. যে দোষ নিজের মধ্যেও আছে, সে দোষের কারণে অন্যকে নিন্দা-তিরস্কার করা একটি নিন্দনীয় কাজ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৩২৪২ | মুসলিম বাংলা