মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

১২- ক্রয় - বিক্রয়ের অধ্যায়

হাদীস নং: ২৮০১
৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ে পছন্দের স্বাধীনতা (অবকাশ থাকা)
২৮০১। হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য অবকাশ থাকে একজন অপরজনের ক্রয় বা বিক্রয়কে প্রত্যাখ্যান করার, যাবৎ না তাহারা পৃথক হইয়া যায়। অবশ্য (পৃথক না হইয়াও) যদি একজন বলে, 'গ্রহণ করিলেন তো?" তদুত্তরে অপরজন বলিল, 'গ্রহণ করিলাম।' (সেই ক্ষেত্রে পৃথক হওয়ার পূর্বেই ঐ অবকাশ রহিত হইয়া যাইবে।) — মোত্তাঃ

মুসলিমের বর্ণনায় আছে— ক্রেতা ও বিক্রেতা যখন ক্রয়-বিক্রয় সাব্যস্ত করে, তখন তাহাদের প্রত্যেকের জন্যই অবকাশ থাকে উক্ত ক্রয়-বিক্রয়কে প্রত্যাখ্যান করার, যাবৎ না তাহারা একে অপর হইতে পৃথক হইয়া যায়, কিম্বা গ্রহণ করার কথা বলিয়া দেয়। ক্রয়-বিক্রয়কে গ্রহণ করার কথা বলিয়া নিলে সেই ক্ষেত্রে (পৃথক হওয়ার পূর্বেই) ক্রয়-বিক্রয় ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) হইয়া যাইবে। (অর্থাৎ, প্রত্যাখ্যানের অবকাশ থাকিবে না।)

তিরমিযীর বর্ণনায় আছে— ক্রেতা ও বিক্রেতার জন্য অবকাশ থাকে (প্রত্যাখ্যান করার), যাবৎ না একে অপর হইতে পৃথক হয় বা গ্রহণ করার কথা বলিয়া নেয়। বোখারী ও মুসলিম উভয়ের বর্ণনায় কিংবা গ্রহণ করার কথা বলিয়া দেয়" বাক্যের পরিবর্তে রহিয়াছে—বা একজন অপরজনকে বলে, গ্রহণ কর (অপরজন বলে, গ্রহণ করিলাম)।
بَابُ الْخِيَارِ: الْفَصْل الأول
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمُتَبَايِعَانِ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا بِالْخِيَارِ عَلَى صَاحِبِهِ مَا لَمْ يَتَّفَرَقَا إِلَّا بيع الْخِيَار»

وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ: «إِذَا تَبَايَعَ الْمُتَبَايِعَانِ فَكُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا بِالْخِيَارِ مِنْ بَيْعِهِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ يَكُونَ بَيْعُهُمَا عَنْ خِيَارٍ فَإِذَا كانَ بيعُهما عَن خيارٍ فقد وَجَبَ»

وَفَى رِوَايَةٍ لِلتِّرْمِذِيِّ: «الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ يَخْتَارَا» . وَفِي الْمُتَّفَقِ عَلَيْهِ: أَوْ يَقُولَ أَحَدُهُمَا لِصَاحِبِهِ: اخْتَرْ «بَدَلَ» أَوْ يختارا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ক্রয়-বিক্রয়ে এখতিয়ার থাকার বয়ান

ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার জন্য শরীঅতমতে বিভিন্ন প্রকারের “খেয়ারের” (এখতিয়ার) অবকাশ থাকে। যথা—
(১) ক্রেতা ক্রয়-বস্তুকে দেখে নাই, শুধু মৌখিক কথাবার্তার উপর ক্রয় করিয়াছে। এই ক্ষেত্রে বস্তুকে দেখিবার পর কোন প্রকার দোষ-ত্রুটি ইত্যাদি কারণ ব্যতিরেকেই শুধু পূর্বে না দেখার কারণে ক্রেতার জন্য অবকাশ থাকে একতরফাভাবে উক্ত ক্রয়কে প্রত্যাখ্যান করিবার। এই ব্যাপারে বিক্রেতা কোন প্রকার অসৌজন্য ব্যবহার করিলে তাহার গোনাহ্ হইবে, এই অবকাশকে “খেয়ারে রুইয়াত” বলা হয়।
(২) ক্রয়-বিক্রয় পূর্ণ সাব্যস্ত করার, এমন কি মূল্য পরিশোধ করার পরেও যদি ক্রয়-বস্তুর মধ্যে কোন দোষ পরিদৃষ্ট হয় (যাহা সম্পর্কে পূর্বে কোন মীমাংসা হয় নাই), সেই ক্ষেত্রেও ক্রেতার জন্য অবকাশ থাকে উক্ত ক্রয়কে প্রত্যাখ্যান করিবার। ইহাতে বিক্রেতা কোন আপত্তি করিতে পারিবে না। এই অবকাশকে “খেয়ারে আয়েব” বলা হয়।
(৩) ক্রেতা বা বিক্রেতা যেকোন এক পক্ষ বা উভয়পক্ষ যদি ক্রয়-বিক্রয় সাব্যস্তকালেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় ভঙ্গের অবকাশ শর্ত করিয়া থাকে, সেই ক্ষেত্রেও শর্তকারী ঐ ক্রয় বা বিক্রয়কে প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবে। এই অবকাশকে “খেয়ারে শর্ত” বলা হয়।
(৪) বিক্রেতা কোন বস্তুকে কোন মূল্যে বিক্রয়ের কথা দিয়াছে; ক্রেতা ঐ বস্তুকে ঐ মূল্যে বিক্রয়ের জন্য বিক্রেতাকে বাধ্য করিতে পারিবে, যাবৎ না তাহারা উভয়ে ক্রয়-বিক্রয় পূর্ণ সাব্যস্ত করার পূর্বে একে অপর হইতে পৃথক হইয়া যায়। তদ্রূপ ক্রেতা কোন বস্তুকে কোন মূল্যে ক্রয়ের কথা দিয়াছে; বিক্রেতা ঐ বস্তুকে ঐ মূল্যে ক্রয়ের জন্য ক্রেতাকে বাধ্য করিতে পারিবে, যাবৎ না তাহারা উভয়ে ক্রয়-বিক্রয় পূর্ণ সাব্যস্ত করার পূর্বে একে অপর হইতে পৃথক হইয়া যায় ।
উল্লিখিত উভয় ক্ষেত্রে পূর্ণ সাব্যস্তের পূর্বে পৃথক হইয়া যাওয়ার পর একে অপরকে তাহার কথার উপর থাকিবার জন্য বাধ্য করিতে পারিবে না; তাহারা বিক্রয় বা ক্রয়কে অস্বীকার করিতে পারিবে। অস্বীকার করার দরুন খারাপ ব্যবহার করা হইলে গোনাহ্ হইবে। এই অবকাশকে “খেয়ারে আকদ” বলা হয়।
উল্লিখিত চারি প্রকারের অবকাশ সর্বসম্মতরূপে বাধ্যতামূলক। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকার শুধু ক্রেতার জন্য এবং তৃতীয় ও চতুর্থ প্রকার ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য।
(৫) ক্রয় ও বিক্রয়ের কথাবার্তা ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বীকৃতিতে পূর্ণরূপে সাব্যস্ত হইয়া গিয়াছে এবং উভয়ে এখনও একজন অপরজন হইতে পৃথক হয় নাই; এখনও তাহারা নিজ নিজ স্থানেই রহিয়াছে। এমতাবস্থায়ও ক্রেতা বা বিক্রেতা কোন কারণ ব্যতিরেকেই উক্ত ক্রয়-বিক্রয়কে প্রত্যাখ্যান করিতে পারে। এই অবকাশকে “খেয়ারে মজলিস” বলা হয়—ইহা উভয়পক্ষের জন্যই রহিয়াছে। তবে হানাফী মাযহাব মতে ইহা বাধ্যতামূলক (ওয়াজিব) নহে, সৌজন্যমূলক মাত্র। অর্থাৎ, মোস্তাহাব। অন্যান্য মাযহাব মতে ইহাও বাধ্যতামূলক (ওয়াজিব)। কিন্তু ক্রয়-বিক্রয়ের কথা সাব্যস্ত হওয়ার পর যদি উভয়ের একজন বলিল, গ্রহণ করিলেন তো? তদুত্তরে অপরজন বলিল, 'গ্রহণ করিলাম', তবে উক্ত অবকাশ থাকিবে না।

মূল হাদীসটির যে অনুবাদ করা হইয়াছে সেই অনুপাতে এবং উহার অন্যান্য বর্ণনা অনুযায়ী হাদীসখানার মর্ম ৫ নং অবকাশ সাব্যস্ত হয়। অনেকে মূল হাদীসখানার মর্ম ৪ নং অবকাশ সাব্যস্ত করিয়াছেন। সেমতে উহার অনুবাদ এইরূপ হইবে, 'ক্রেতা ও বিক্রেতা একে অপরকে (তাহার কথার উপর) বাধ্য করার অধিকারী হইবে পরস্পর পৃথক হওয়ার পূর্বে। (সেমতে পৃথক হওয়ার পর একে অপরকে বাধ্য করিয়া উক্ত ক্রয়-বিক্রয় প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ আর থাকিবে না—) অবশ্য যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যাখ্যানের অবকাশ শর্ত করিয়া থাকে । (অর্থাৎ, যদি কোন এক পক্ষ বা উভয়পক্ষ ৩ নং অবকাশের সুযোগ রাখিয়া থাকে, তবে সেই অনুযায়ী প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবে।)
৪ নং অবকাশ শরীআতের একটি সুনির্দিষ্ট বিধান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ইহাকে লঙ্ঘন করিতে দেখা যায়। যথা— বিক্রেতা তাহার বস্তুর মূল্য পাঁচ টাকা বলিল, ক্রেতা তিন টাকা দিতে চাহিল, বিক্রেতা অস্বীকার করায় ক্রেতা চলিয়া যাইতে লাগিল, সে তাহার স্থানচ্যুত হইলে পর বিক্রেতা তিন টাকায়ই দিতে সম্মত হইয়া ক্রেতাকে তিন টাকায় ঐ বস্তু লইতে বলে। তখন ক্রেতা তিন টাকায়ও উহাকে গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলে অনেক ক্ষেত্রে তাহার প্রতি অভদ্র ব্যবহার করা হয়। তদ্রূপ বিক্রেতা পাঁচ টাকা মূল্য চাহিয়াছে, তখন ক্রেতা পাঁচ টাকায় ঐ জিনিস গ্রহণে সম্মত হয় নাই। একটু ঘুরিয়া আসিয়া এখন ঐ পাঁচ টাকায়ই গ্রহণ করিতে ক্রেতা সম্মত হইয়াছে। তখন বিক্রেতা উহা পাঁচ টাকায় দিতে অস্বীকার করিলে অনেক ক্ষেত্রে তাহার প্রতি খারাব ব্যবহার করা হয়। এইরূপ ক্ষেত্রে অসৌজন্য ব্যবহার জুলুম ও অন্যায়ে পরিগণিত হইবে এবং উহাতে গোনাহ্ হইবে। কারণ, শরীআতের বিধান ৪ নং অবকাশ অনুযায়ী ঐরূপ ক্ষেত্রে ক্রয় বিক্রয় প্রত্যাখ্যান করার অধিকার দেয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান