মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
১২- ক্রয় - বিক্রয়ের অধ্যায়
হাদীস নং: ২৭৮৬
১. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - উপার্জন করা এবং হালাল রুযী অবলম্বনের উপায় সন্ধান করা
২৭৮৬। হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, আবু বকর (রাঃ)-এর একটি গোলাম ছিল; সে তাহার জন্য রোজগার করিত এবং তিনি তাহার উপার্জন খাইতেন। একদা সে কোন বস্তু নিয়া আসিলে আবু বকর (রাঃ) তাহা খাইলেন। গোলাম তাঁহাকে বলিল, আপনি জানেন—ইহা কিভাবে উপার্জিত ? আবু বকর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, ইহা কিভাবে উপার্জিত ? সে বলিল, ইসলাম-পূর্ব সময়ে আমি এক ব্যক্তির জন্য (গণক-ঠাকুরের ন্যায়) গণনা করিয়াছিলাম, অথচ আমি গণনার কাজও জানিতাম না। আমি উহার ভান করিয়া ঐ ব্যক্তিকে ঠকাইয়াছিলাম মাত্র। ঐ ব্যক্তির সঙ্গে অদ্য আমার সাক্ষাৎ হইলে সে আমাকে সেই গণনাকার্যের বিনিময়ে এই বস্তু দান করিয়াছে। আপনি তাহাই খাইয়াছেন।
এই কথা শুনামাত্র আবু বকর (রাঃ) গলার ভিতরে আঙ্গুল ঢুকাইয়া পেটের সমুদয় বস্তু বমন করিয়া ফেলিয়া দিলেন। — বোখারী
এই কথা শুনামাত্র আবু বকর (রাঃ) গলার ভিতরে আঙ্গুল ঢুকাইয়া পেটের সমুদয় বস্তু বমন করিয়া ফেলিয়া দিলেন। — বোখারী
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: كَانَ لِأَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ غُلَامٌ يُخْرِّجُ لَهُ الْخَرَاجَ فَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِهِ فَجَاءَ يَوْمًا بشيءٍ فأكلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلَامُ: تَدْرِي مَا هَذَا؟ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: وَمَا هُوَ؟ قَالَ: كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لِإِنْسَانٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحسِنُ الكهَانةَ إِلاَّ أَنِّي خدَعتُه فلَقيَني فَأَعْطَانِي بِذَلِكَ فَهَذَا الَّذِي أَكَلْتَ مِنْهُ قَالَتْ: فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهُ فَقَاءَ كُلَّ شَيْءٍ فِي بَطْنه. رَوَاهُ البُخَارِيّ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর যে গোলামের কথা বলা হয়েছে, ইবন হাজার আসকালানী রহ. তার সম্পর্কে বলেন যে, আমি তার নাম জানতে পারিনি। এখানে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে, অনুরূপ এক ঘটনা নু‘আইমান ইবন আমরের সঙ্গেও হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর ঘটেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন স্বাধীন ব্যক্তি। তিনিও সাহাবী ছিলেন। ইমাম আব্দুর রাযযাক রহ. বর্ণনা করেন যে, একবার সাহাবীগণ একটি জলাশয়ের কাছে যাত্রাবিরতি দেন। তখন নু'আইমান রাযি. সেখানকার লোকজনকে বলছিলেন যে, এরূপ এরূপ ঘটবে। এর বিনিময়ে তারা তার কাছে খাদ্যশস্য নিয়ে আসত। তিনি তা সাহাবীদের দিতেন। বিষয়টা জানতে পেরে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, আজ তো দেখছি আমি নু'আইমানের ওই উপার্জন থেকে খাচ্ছি, যা কিনা সে ভাগ্যগণনার বিনিময়ে অর্জন করছে। এই বলে তিনি গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বমি করে দেন।
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. ইবন সীরীন রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, আমার মতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছাড়া আর কেউ খেয়ে ফেলা খাবার বমি করে ফেলে দেননি। একবার তাঁকে কিছু খাদ্য দেওয়া হলে তিনি তা খেয়ে ফেলেন। তারপর তাঁকে বলা হল, এ খাদ্য ইবনুন নু'আইমান নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে ইবনুন নু'আইমানের ভাগ্যগণনার উপার্জন খাওয়ালে! এই বলে তিনি বমি করে দিলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর এ জাতীয় আরও ঘটনা বর্ণিত আছে।
يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ (সে তাঁকে নিজ উপার্জন থেকে নির্ধারিত পরিমাণ প্রদান করত)। الْخَرَاج অর্থ কর, নির্ধারিত প্রদেয়। এমনিভাবে গোলামের ওই প্রাত্যহিক প্রদেয়কেও الخراج বলা হয়, যা মনিবের পক্ষ থেকে তার উপর ধার্য করা হয়। নিজ আয় থেকে সে পরিমাণ মনিবকে প্রদান করার পর যা বেঁচে থাকে, তা গোলামের হয়ে যায়।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর গোলাম প্রতিদিন নিজ আয় থেকে সেই নির্ধারিত পরিমাণ তাঁকে প্রদান করত। তিনি তা ভোগ করতেন। এটা করা জায়েয। প্রকৃতপক্ষে গোলামের উপার্জনের সবটাই মনিবের হয়ে যায়। গোলামের নিজস্ব মালিকানা বলতে কিছু থাকে না। তার পানাহার ও পোশাক দেওয়া মনিবের দায়িত্ব।
যাহোক, হাদীছে বর্ণিত এ গোলাম একদিন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে কিছু খাবার দিলে তিনি তা খেয়ে ফেলেন। তারপর গোলামটি জানায় যে, এ খাবার সে পেয়েছে ভাগ্যগণনার বিনিময়ে। জাহিলী যুগে সে এটা করত। কিন্তু নিজে এ কাজ ভালো জানত না। প্রকৃতপক্ষে সে ভাগ্যগণনার ছলে মানুষকে ধোঁকা দিত। এভাবে সে কোনও এক ব্যক্তির ভাগ্যগণনা করেছিল। সে ব্যক্তি কে ছিল, হাদীছটিতে তা উল্লেখ করা হয়নি। তা যেই হোক, ভাগ্যগণনার 'দর্শনি' বাকি রয়েছিল। এতদিনে সে এসে তা পরিশোধ করেছে। গোলাম সেটাই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-কে খেতে দিয়েছে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সঙ্গে সঙ্গে তা বমি করে ফেলে দেন। তিনি তা ফেলে দেন এ কারণে যে, শরী'আতে ভাগ্যগণনা সম্পূর্ণ হারাম কাজ। এ কাজের কোনও বিনিময়গ্রহণ আদৌ জায়েয নয়। আবার এখানে সে এক নাজায়েযের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধোঁকা দেওয়ার অবৈধতা। কাজেই এরূপ অবৈধ উপায়ে উপার্জিত খাবার খাওয়ার কোনও বৈধতা থাকতে পারে না। তবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তা জেনেশুনে খাননি। খাওয়ার পর জেনেছেন। তাই প্রকৃতপক্ষে তাঁর দ্বারা কোনও নাজায়েয কাজ হয়নি। সুতরাং তাঁর গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে এত কষ্ট করে বমি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি তা করেছেন অধিকতর সতর্কতাবশত। এটা ছিল তাঁর উচ্চতর তাকওয়া-পরহেযগারী।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ভাগ্যগণনার কোনও বাস্তবতা নেই। এটা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয। এর মাধ্যমে উপার্জন করাও হারাম।
খ. কাউকে ধোঁকা দেওয়া হারাম। ধোঁকা দিয়ে যা উপার্জন করা হয় তা ভোগ করা জায়েয নয়।
গ. অজ্ঞতাবশত কোনও হারাম খাদ্য খেয়ে ফেললে অধিকতর সতর্কতাবশত তা বমি করে ফেলে দেওয়া উত্তম।
ঘ. কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে হলেও নিজেকে হারাম বস্তুর স্পর্শ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা প্রকৃত তাকওয়া-পরহেযগারীর পরিচায়ক।
ঙ. এ হাদীছটি দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর উচ্চতর তাকওয়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. ইবন সীরীন রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, আমার মতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছাড়া আর কেউ খেয়ে ফেলা খাবার বমি করে ফেলে দেননি। একবার তাঁকে কিছু খাদ্য দেওয়া হলে তিনি তা খেয়ে ফেলেন। তারপর তাঁকে বলা হল, এ খাদ্য ইবনুন নু'আইমান নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে ইবনুন নু'আইমানের ভাগ্যগণনার উপার্জন খাওয়ালে! এই বলে তিনি বমি করে দিলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর এ জাতীয় আরও ঘটনা বর্ণিত আছে।
يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ (সে তাঁকে নিজ উপার্জন থেকে নির্ধারিত পরিমাণ প্রদান করত)। الْخَرَاج অর্থ কর, নির্ধারিত প্রদেয়। এমনিভাবে গোলামের ওই প্রাত্যহিক প্রদেয়কেও الخراج বলা হয়, যা মনিবের পক্ষ থেকে তার উপর ধার্য করা হয়। নিজ আয় থেকে সে পরিমাণ মনিবকে প্রদান করার পর যা বেঁচে থাকে, তা গোলামের হয়ে যায়।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর গোলাম প্রতিদিন নিজ আয় থেকে সেই নির্ধারিত পরিমাণ তাঁকে প্রদান করত। তিনি তা ভোগ করতেন। এটা করা জায়েয। প্রকৃতপক্ষে গোলামের উপার্জনের সবটাই মনিবের হয়ে যায়। গোলামের নিজস্ব মালিকানা বলতে কিছু থাকে না। তার পানাহার ও পোশাক দেওয়া মনিবের দায়িত্ব।
যাহোক, হাদীছে বর্ণিত এ গোলাম একদিন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে কিছু খাবার দিলে তিনি তা খেয়ে ফেলেন। তারপর গোলামটি জানায় যে, এ খাবার সে পেয়েছে ভাগ্যগণনার বিনিময়ে। জাহিলী যুগে সে এটা করত। কিন্তু নিজে এ কাজ ভালো জানত না। প্রকৃতপক্ষে সে ভাগ্যগণনার ছলে মানুষকে ধোঁকা দিত। এভাবে সে কোনও এক ব্যক্তির ভাগ্যগণনা করেছিল। সে ব্যক্তি কে ছিল, হাদীছটিতে তা উল্লেখ করা হয়নি। তা যেই হোক, ভাগ্যগণনার 'দর্শনি' বাকি রয়েছিল। এতদিনে সে এসে তা পরিশোধ করেছে। গোলাম সেটাই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-কে খেতে দিয়েছে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সঙ্গে সঙ্গে তা বমি করে ফেলে দেন। তিনি তা ফেলে দেন এ কারণে যে, শরী'আতে ভাগ্যগণনা সম্পূর্ণ হারাম কাজ। এ কাজের কোনও বিনিময়গ্রহণ আদৌ জায়েয নয়। আবার এখানে সে এক নাজায়েযের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধোঁকা দেওয়ার অবৈধতা। কাজেই এরূপ অবৈধ উপায়ে উপার্জিত খাবার খাওয়ার কোনও বৈধতা থাকতে পারে না। তবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তা জেনেশুনে খাননি। খাওয়ার পর জেনেছেন। তাই প্রকৃতপক্ষে তাঁর দ্বারা কোনও নাজায়েয কাজ হয়নি। সুতরাং তাঁর গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে এত কষ্ট করে বমি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি তা করেছেন অধিকতর সতর্কতাবশত। এটা ছিল তাঁর উচ্চতর তাকওয়া-পরহেযগারী।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ভাগ্যগণনার কোনও বাস্তবতা নেই। এটা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয। এর মাধ্যমে উপার্জন করাও হারাম।
খ. কাউকে ধোঁকা দেওয়া হারাম। ধোঁকা দিয়ে যা উপার্জন করা হয় তা ভোগ করা জায়েয নয়।
গ. অজ্ঞতাবশত কোনও হারাম খাদ্য খেয়ে ফেললে অধিকতর সতর্কতাবশত তা বমি করে ফেলে দেওয়া উত্তম।
ঘ. কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে হলেও নিজেকে হারাম বস্তুর স্পর্শ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা প্রকৃত তাকওয়া-পরহেযগারীর পরিচায়ক।
ঙ. এ হাদীছটি দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর উচ্চতর তাকওয়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
