মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
১২- ক্রয় - বিক্রয়ের অধ্যায়
হাদীস নং: ২৭৭৪
১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উপার্জন করা এবং হালাল রুযী অবলম্বনের উপায় সন্ধান করা
২৭৭৪। হযরত ওয়াবেসা ইবনে মা'বাদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, একদা (তিনি রাসূলুল্লাহ [ﷺ]-এর দরবারে উপস্থিত হইলে) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ হে ওয়াবেসা! তুমি আসিয়াছ ভাল ও মন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য। আমি আরয করিলাম, হ্যাঁ, তাহাই। রাবী বলেন, তখন হযরত (ﷺ) স্বীয় হস্তকে মুষ্টিবদ্ধ করিয়া (আঘাতস্বরূপ) তাঁহার বক্ষে মারিলেন এবং বলিলেন, তোমার মনকে জিজ্ঞাসা কর, তোমার অন্তরকে জিজ্ঞাসা কর। এই কথা তিনবার বলার পর বলিলেন, ভাল ও নেক কাজে মন স্থির থাকিবে, অন্তর শান্ত ও দ্বিধামুক্ত থাকিবে। মন্দ ও গোনাহের কাজে মনে খটকা লাগিবে, অন্তরে দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি হইবে—যদিও জনগণ উহার পক্ষে মত প্রকাশ করে। —আহমদ ও দারেমী
وَعَن وابصَةَ بن مَعْبدٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَا وَابِصَةُ جِئْتَ تَسْأَلُ عَنِ الْبِرِّ وَالْإِثْمِ؟» قُلْتُ: نَعَمْ قَالَ: فَجَمَعَ أَصَابِعَهُ فَضَرَبَ صَدْرَهُ وَقَالَ: «اسْتَفْتِ نَفْسَكَ اسْتَفْتِ قَلْبَكَ» ثَلَاثًا «الْبِرُّ مَا اطْمَأَنَّتْ إِلَيْهِ النَّفْسُ وَاطْمَأَنَّ إِلَيْهِ الْقَلْبُ وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِي النَّفْسِ وَتَرَدَّدَ فِي الصَّدْرِ وَإِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ والدارمي
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত ওয়াবিসা ইবন মা‘বাদ রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছিলেন পাপ-পুণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে। অর্থাৎ কোন কাজ পাপ এবং কোন কাজ পুণ্য, তা জানতে এসেছিলেন। কিন্তু নিজ আগমনের উদ্দেশ্য প্রকাশ করার আগেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন-
جِئْتَ تَسْأَلُ عَنِ الْبِرِّ؟ (তুমি কি পুণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছ)? অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন, হে ওয়াবিসা! তুমি যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে এসেছ তা কি আমি তোমাকে বলব, নাকি আগেই তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে? হযরত ওয়াবিসা রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিই আমাকে বলুন। তখন তিনি বললেন, তুমি আমার কাছে এসেছ পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মু'জিযা। একজনের মনের কথা আরেকজনের পক্ষে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, যদি না আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে হযরত ওয়াবিসা রাযি.-এর আগমনের উদ্দেশ্য জানিয়ে দিয়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এটা বলা সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং এটাও তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার একটি দলীল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে নির্দেশনা দিতে গিয়ে হযরত ওয়াবিসা রাযি.-কে বললেন- اِسْتَفْتِ قَلْبَكَ (তোমার অন্তরকে জিজ্ঞেস করো)। অর্থাৎ তুমি যদি কোনও কাজের সম্মুখীন হও এবং সেটি করবে কি করবে না এ নিয়ে যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগ, তবে নিজ অন্তরের কাছে সমাধান চাও। সৃষ্টিগতভাবে অন্তর সুস্থ ও শুদ্ধ থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাইরের মলিনতায় মলিন না হয় ও মন্দ পরিবেশ-পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তর মানুষকে সঠিক নির্দেশনা দান করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্তর বুঝতে পারে কোন কাজ প্রশংসনীয় ও কোনটি নিন্দনীয়। সুতরাং তুমি নিজ অন্তরকে জিজ্ঞেস করো। তা তোমাকে সঠিক নির্দেশনা দেবে।
এর দ্বারা বোঝা যায় হযরত ওয়াবিসা রাযি.-এর অন্তরের স্বভাবগত সুস্থতা ও পরিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারেনি। তা সর্বপ্রকার পারিপার্শ্বিক মলিনতা থেকে মুক্ত ছিল। এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজ অন্তরের কাছে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন। কাজেই এ কথাটি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যারা তাদের অন্তরের স্বাভাবিক সুস্থতা নষ্ট করে ফেলেছে, খেয়াল-খুশির অনুসরণ ও পরিবেশ-পরিস্থিতির অনুকরণ দ্বারা যাদের হৃদয়-মন দূষিত হয়ে গেছে, তারা নিজ অন্তরের দ্বারস্থ হলে সঠিক নির্দেশনা নাও পেতে পারে। তাদের কর্তব্য হবে আগে মুজাহাদা-সাধনা দ্বারা অন্তর পরিশুদ্ধ করে তোলা। হক্কানী উলামা ও সত্যিকার আল্লাহওয়ালার পরামর্শ মোতাবেক শরী'আতের অনুসরণ অব্যাহত রাখতে থাকলে এক পর্যায়ে হৃদয়-মনের শুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়ে যায়। এ পর্যায়ে পৌঁছতে পারলে তখন অন্তরের কাছে ঠিকই সুপরামর্শ পাওয়া যায়।
البر : ما اطمأنت إلَيْهِ النَّفْسُ، وَاطْمَان إِلَيْهِ الْقَلْبُ (পুণ্য তাই, যাতে তোমার মন আশ্বস্ত থাকে এবং তোমার হৃদয় তাতে সন্তুষ্ট থাকে)। অর্থাৎ পরিশুদ্ধ মন সৎকর্মে স্বস্তিবোধ করে। সুতরাং কোনও কাজের বেলায় যদি অন্তরে খটকা না লাগে; বরং স্বস্তিবোধ কর, তবে তুমি সে কাজটি করতে পার।
النَّفْسُ-এর আভিধানিক অর্থ মন। আর الْقَلْبُ-এর আভিধানিক অর্থ হৃদয় বা হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ড মনের আধার। রূপকার্থে অনেক সময় আধার দ্বারা আধেয়কেও বোঝানো হয়। সে হিসেবে এখানে উভয় শব্দ দ্বারা একই অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য। বক্তব্যে দৃঢ়তা আনার জন্য উভয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
وَالْإِثْمُ: مَا حَاكَ فِي النَّفْسِ، وَتَرَدَّدَ فِي الصَّدْرِ (আর গুনাহ তাই, যে সম্পর্কে অন্তরে খটকা দেখা দেয় ও মনে সন্দেহ থাকে)। অর্থাৎ পরিশুদ্ধ মন যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তা করা যাবে কি করা যাবে না সে ফয়সালা দিতে পারে না; বরং অনেক চিন্তা-ভাবনার পরও সন্দেহ বাকি থেকে যায়, তা থেকে বিরত থেকো। কেননা প্রকৃতপক্ষে তা গুনাহ।
وَإِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ وَأَفْتوْكَ (যদিও লোকে তার সপক্ষে তোমাকে ফাতওয়া দেয় এবং তারা তোমাকে ফাতওয়া দেয়)। এখানে 'লোক' বলে সাধারণ পর্যায়ের লোক বোঝানো হয়েছে। যাদের না আছে ইলম, না আছে তাকওয়া-পরহেযগারী। এরূপ লোক ফাতওয়া দিলে তা নিজেদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ীই দেবে। খেয়াল-খুশি মানুষকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। সুতরাং এরূপ লোকের ফাতওয়া অনুযায়ী চললে গুনাহে লিপ্ত হওয়া অনিবার্য। তারা কোনও কাজ সম্পর্কে যতই বৈধতার ফাতওয়া দিক না কেন, মন যদি তা বৈধ বলে সাক্ষ্য না দেয়, তবে কিছুতেই তা করা যাবে না।
বোঝা গেল ফাতওয়া দানকারী যদি বিজ্ঞ আলেম ও মুত্তাকী-পরহেযগার হয়, তবে তার কথাই অনুসরণযোগ্য। কেননা তিনি যা বলবেন, কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে বলবেন। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনাই অগ্রগণ্য। তার বিপরীতে অন্যকিছু ভ্রুক্ষেপযোগ্য নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোনও বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা দান করেন, তখন কোনও মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর নিজেদের বিষয়ে কোনও এখতিয়ার বাকি থাকে না।’(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৩৬)
কুরআন-সুন্নাহে কোনও ফয়সালা পেয়ে গেলে বান্দার কর্তব্য তাতে পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া এবং বিনাবাক্যে তা মেনে নেওয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (65)
‘না, (হে নবী!) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানবে, তারপর তুমি যে রায় দাও, সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনওরূপ কুণ্ঠাবোধ না করবে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেবে।’(সূরা নিসা (৪), আয়াত ৬৫)
বলাবাহুল্য, সাহাবা ও তাবি'ঈনের অভিমত এবং মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত কুরআন-সুন্নাহ থেকেই গৃহীত। কাজেই তার অনুসরণও প্রকৃতপক্ষে কুরআন-সুন্নাহরই অনুসরণ। যদি কোনও বিষয়ে মনে সন্দেহ দেখা দেয় এবং সেটি হালাল না হারাম, বৈধ না অবৈধ, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা না যায়, তবে প্রথম কাজ হবে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হওয়া। তাতে সুস্পষ্ট বক্তব্য না পাওয়া গেলে সাহাবা-তাবি'ঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত লক্ষণীয়। অবশ্য এ নীতি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা কেবল বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের কাজ। আমসাধারণের কর্তব্য এরূপ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হয়ে তাদের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করা। যদি এমন কোনও বিজ্ঞ ও পরহেযগার আলেম না পাওয়া যায়, যার কাছ থেকে সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া যাবে, তবে সে ক্ষেত্রে মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য খটকাযুক্ত বিষয় পরিহার করা এবং যার বৈধাবৈধ সম্পর্কে মনে সন্দেহ থাকে তা এড়িয়ে চলা, তাতে সাধারণ লোকজন যাই বলুক না কেন কিংবা সুদক্ষ নয় বা মুত্তাকী-পরহেযগার নয় এমন আলেমগণ তার বৈধতার পক্ষে যতই ফাতাওয়া দিক না কেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. পুণ্য ও সৎকর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য। আমাদেরকেও এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে।
খ. কোনটা সৎকর্ম ও কোনটা পাপকর্ম, মানুষের মনও তার সাক্ষ্য দেয়।
গ. সৎকর্ম মানুষের অন্তরে প্রশান্তি যোগায়।
ঘ. অসৎকর্ম মানসিক অশান্তির কারণ।
ঙ. সুযোগ্য ও পরহেযগার আলেমের ফাতওয়া ছাড়া সন্দেহযুক্ত বিষয় অবলম্বন করা কিছুতেই উচিত নয়।
চ. যে আলেম সুযোগ্য ও পরহেযগার নয়, তার ফাতওয়া গ্রাহ্য করা উচিত নয়।
ছ. আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূলগণকে কোনও কোনও গায়েবী বিষয় জানিয়ে দিতেন। এটা হতো তাদের মু'জিযা ও অলৌকিকত্ব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরূপ বহু মু'জিযা ছিল।
جِئْتَ تَسْأَلُ عَنِ الْبِرِّ؟ (তুমি কি পুণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছ)? অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন, হে ওয়াবিসা! তুমি যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে এসেছ তা কি আমি তোমাকে বলব, নাকি আগেই তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে? হযরত ওয়াবিসা রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিই আমাকে বলুন। তখন তিনি বললেন, তুমি আমার কাছে এসেছ পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মু'জিযা। একজনের মনের কথা আরেকজনের পক্ষে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, যদি না আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে হযরত ওয়াবিসা রাযি.-এর আগমনের উদ্দেশ্য জানিয়ে দিয়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এটা বলা সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং এটাও তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার একটি দলীল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে নির্দেশনা দিতে গিয়ে হযরত ওয়াবিসা রাযি.-কে বললেন- اِسْتَفْتِ قَلْبَكَ (তোমার অন্তরকে জিজ্ঞেস করো)। অর্থাৎ তুমি যদি কোনও কাজের সম্মুখীন হও এবং সেটি করবে কি করবে না এ নিয়ে যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগ, তবে নিজ অন্তরের কাছে সমাধান চাও। সৃষ্টিগতভাবে অন্তর সুস্থ ও শুদ্ধ থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাইরের মলিনতায় মলিন না হয় ও মন্দ পরিবেশ-পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তর মানুষকে সঠিক নির্দেশনা দান করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্তর বুঝতে পারে কোন কাজ প্রশংসনীয় ও কোনটি নিন্দনীয়। সুতরাং তুমি নিজ অন্তরকে জিজ্ঞেস করো। তা তোমাকে সঠিক নির্দেশনা দেবে।
এর দ্বারা বোঝা যায় হযরত ওয়াবিসা রাযি.-এর অন্তরের স্বভাবগত সুস্থতা ও পরিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারেনি। তা সর্বপ্রকার পারিপার্শ্বিক মলিনতা থেকে মুক্ত ছিল। এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজ অন্তরের কাছে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন। কাজেই এ কথাটি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যারা তাদের অন্তরের স্বাভাবিক সুস্থতা নষ্ট করে ফেলেছে, খেয়াল-খুশির অনুসরণ ও পরিবেশ-পরিস্থিতির অনুকরণ দ্বারা যাদের হৃদয়-মন দূষিত হয়ে গেছে, তারা নিজ অন্তরের দ্বারস্থ হলে সঠিক নির্দেশনা নাও পেতে পারে। তাদের কর্তব্য হবে আগে মুজাহাদা-সাধনা দ্বারা অন্তর পরিশুদ্ধ করে তোলা। হক্কানী উলামা ও সত্যিকার আল্লাহওয়ালার পরামর্শ মোতাবেক শরী'আতের অনুসরণ অব্যাহত রাখতে থাকলে এক পর্যায়ে হৃদয়-মনের শুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়ে যায়। এ পর্যায়ে পৌঁছতে পারলে তখন অন্তরের কাছে ঠিকই সুপরামর্শ পাওয়া যায়।
البر : ما اطمأنت إلَيْهِ النَّفْسُ، وَاطْمَان إِلَيْهِ الْقَلْبُ (পুণ্য তাই, যাতে তোমার মন আশ্বস্ত থাকে এবং তোমার হৃদয় তাতে সন্তুষ্ট থাকে)। অর্থাৎ পরিশুদ্ধ মন সৎকর্মে স্বস্তিবোধ করে। সুতরাং কোনও কাজের বেলায় যদি অন্তরে খটকা না লাগে; বরং স্বস্তিবোধ কর, তবে তুমি সে কাজটি করতে পার।
النَّفْسُ-এর আভিধানিক অর্থ মন। আর الْقَلْبُ-এর আভিধানিক অর্থ হৃদয় বা হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ড মনের আধার। রূপকার্থে অনেক সময় আধার দ্বারা আধেয়কেও বোঝানো হয়। সে হিসেবে এখানে উভয় শব্দ দ্বারা একই অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য। বক্তব্যে দৃঢ়তা আনার জন্য উভয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
وَالْإِثْمُ: مَا حَاكَ فِي النَّفْسِ، وَتَرَدَّدَ فِي الصَّدْرِ (আর গুনাহ তাই, যে সম্পর্কে অন্তরে খটকা দেখা দেয় ও মনে সন্দেহ থাকে)। অর্থাৎ পরিশুদ্ধ মন যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তা করা যাবে কি করা যাবে না সে ফয়সালা দিতে পারে না; বরং অনেক চিন্তা-ভাবনার পরও সন্দেহ বাকি থেকে যায়, তা থেকে বিরত থেকো। কেননা প্রকৃতপক্ষে তা গুনাহ।
وَإِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ وَأَفْتوْكَ (যদিও লোকে তার সপক্ষে তোমাকে ফাতওয়া দেয় এবং তারা তোমাকে ফাতওয়া দেয়)। এখানে 'লোক' বলে সাধারণ পর্যায়ের লোক বোঝানো হয়েছে। যাদের না আছে ইলম, না আছে তাকওয়া-পরহেযগারী। এরূপ লোক ফাতওয়া দিলে তা নিজেদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ীই দেবে। খেয়াল-খুশি মানুষকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। সুতরাং এরূপ লোকের ফাতওয়া অনুযায়ী চললে গুনাহে লিপ্ত হওয়া অনিবার্য। তারা কোনও কাজ সম্পর্কে যতই বৈধতার ফাতওয়া দিক না কেন, মন যদি তা বৈধ বলে সাক্ষ্য না দেয়, তবে কিছুতেই তা করা যাবে না।
বোঝা গেল ফাতওয়া দানকারী যদি বিজ্ঞ আলেম ও মুত্তাকী-পরহেযগার হয়, তবে তার কথাই অনুসরণযোগ্য। কেননা তিনি যা বলবেন, কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে বলবেন। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনাই অগ্রগণ্য। তার বিপরীতে অন্যকিছু ভ্রুক্ষেপযোগ্য নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোনও বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা দান করেন, তখন কোনও মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর নিজেদের বিষয়ে কোনও এখতিয়ার বাকি থাকে না।’(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৩৬)
কুরআন-সুন্নাহে কোনও ফয়সালা পেয়ে গেলে বান্দার কর্তব্য তাতে পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া এবং বিনাবাক্যে তা মেনে নেওয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (65)
‘না, (হে নবী!) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানবে, তারপর তুমি যে রায় দাও, সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনওরূপ কুণ্ঠাবোধ না করবে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেবে।’(সূরা নিসা (৪), আয়াত ৬৫)
বলাবাহুল্য, সাহাবা ও তাবি'ঈনের অভিমত এবং মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত কুরআন-সুন্নাহ থেকেই গৃহীত। কাজেই তার অনুসরণও প্রকৃতপক্ষে কুরআন-সুন্নাহরই অনুসরণ। যদি কোনও বিষয়ে মনে সন্দেহ দেখা দেয় এবং সেটি হালাল না হারাম, বৈধ না অবৈধ, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা না যায়, তবে প্রথম কাজ হবে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হওয়া। তাতে সুস্পষ্ট বক্তব্য না পাওয়া গেলে সাহাবা-তাবি'ঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত লক্ষণীয়। অবশ্য এ নীতি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা কেবল বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের কাজ। আমসাধারণের কর্তব্য এরূপ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হয়ে তাদের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করা। যদি এমন কোনও বিজ্ঞ ও পরহেযগার আলেম না পাওয়া যায়, যার কাছ থেকে সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া যাবে, তবে সে ক্ষেত্রে মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য খটকাযুক্ত বিষয় পরিহার করা এবং যার বৈধাবৈধ সম্পর্কে মনে সন্দেহ থাকে তা এড়িয়ে চলা, তাতে সাধারণ লোকজন যাই বলুক না কেন কিংবা সুদক্ষ নয় বা মুত্তাকী-পরহেযগার নয় এমন আলেমগণ তার বৈধতার পক্ষে যতই ফাতাওয়া দিক না কেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. পুণ্য ও সৎকর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য। আমাদেরকেও এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে।
খ. কোনটা সৎকর্ম ও কোনটা পাপকর্ম, মানুষের মনও তার সাক্ষ্য দেয়।
গ. সৎকর্ম মানুষের অন্তরে প্রশান্তি যোগায়।
ঘ. অসৎকর্ম মানসিক অশান্তির কারণ।
ঙ. সুযোগ্য ও পরহেযগার আলেমের ফাতওয়া ছাড়া সন্দেহযুক্ত বিষয় অবলম্বন করা কিছুতেই উচিত নয়।
চ. যে আলেম সুযোগ্য ও পরহেযগার নয়, তার ফাতওয়া গ্রাহ্য করা উচিত নয়।
ছ. আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূলগণকে কোনও কোনও গায়েবী বিষয় জানিয়ে দিতেন। এটা হতো তাদের মু'জিযা ও অলৌকিকত্ব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরূপ বহু মু'জিযা ছিল।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
