মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

১০- যাবতীয় দোয়া-যিক্‌র

হাদীস নং: ২৪৬৩
৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৬৩। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিতেন, “আল্লাহ্! আমি তোমারই প্রতি আত্মসমর্পণ করিলাম, তোমারই প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিলাম, তোমারই প্রতি ভরসা করিলাম, তোমারই দিকে রুজু করিলাম এবং তোমারই সাহায্যে (তোমার শত্রুর সাথে) লড়িলাম। আল্লাহ্, আমি তোমার প্রতাপের শরণ লইতেছি—তুমি ব্যতীত কোন মা'বূদ নাই—আমাকে পথভ্রষ্ট করা হইতে, তুমি চিরঞ্জীব, কখনও মরিবে না, আর জিন ও ইনসান মরিবে।”-- মোত্তাঃ
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِعِزَّتِكَ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَنْ تُضِلَّنِي أَنْتَ الْحَيُّ الَّذِي لَا يَمُوتُ وَالْجِنُّ وَالْإِنْسُ يموتون»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ দু‘আয় দুটি অংশ আছে। প্রথম অংশে আল্লাহর প্রতি বান্দার ঈমান ও আনুগত্যের স্বীকারোক্তি আর দ্বিতীয় অংশে আল্লাহর কাছে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রার্থনা।

প্রথম অংশে পাঁচটি কথা আছে। প্রথম কথা হচ্ছে- اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছি”। অর্থাৎ তোমার যাবতীয় বিধিবিধান মেনে নিয়েছি। আমার জানমাল ও আমার সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয়ে তোমার যত আদেশ-নিষেধ আছে, আমি তা মেনে চলব বলে অঙ্গিকার করেছি। আমি তা মেনে চলব। কোনও ক্ষেত্রেই তোমার অবাধ্যতা করব না।

দ্বিতীয় কথা- وَبِكَ آمَنْتُ “আমি তোমার প্রতি ঈমান এনেছি”। অর্থাৎ আমি বিশ্বাস করি তুমি আমার ও বিশ্বজগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তুমি এক। তোমার কোনও শরীক নেই। হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার নবী ও রাসূল। তাঁর প্রতি তুমি যে কিতাব নাযিল করেছ তা সত্য। তা এক হিদায়াতগ্রন্থ। এর হিদায়াত মেনে চলার মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবী।

তৃতীয় কথা- وَعَليْك تَوَكَّلْتُ “আমি তোমার উপর নির্ভর করেছি”। অর্থাৎ আমার যাবতীয় বিষয় তোমার উপরই ন্যস্ত করলাম। ইহজগত আসবাব-উপকরণের জগত। সে হিসেবে তোমার হুকুম মোতাবেক আমি আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করি বটে, কিন্তু তার উপর আমার কোনও ভরসা নেই। আমি জানি তুমি যা চাও তাই হয়। আসবাব-উপকরণের ফলাফলও তোমার ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল। তাই সবকিছুর উপর থেকে নির্ভরতা ছিন্ন করে কেবল তোমার উপরই আমি নির্ভর করি।

চতুর্থ কথা- وَإِلَيْكَ أنَبْتُ “আমি তোমারই অভিমুখী হয়েছি। অর্থাৎ আমি তোমার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি চাই। সে লক্ষ্যে আমি তোমার ইবাদত-উপাসনার দিকে ফিরেছি এবং যা-কিছু দ্বারা তোমার নৈকট্য লাভ হয় তা অবলম্বন করেছি। সুতরাং আমার দ্বারা যেসব ভুলত্রুটি ও গুনাহ হয়ে গেছে, সে ব্যাপারে আমি তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যেহেতু তা তোমার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের অন্তরায়। তাছাড়া তুমিই যেহেতু সবকিছুর প্রকৃত কর্তা, তাই আমার যাবতীয় বিষয়ে তোমার অভিমুখী হয়েছি, যাতে তুমি তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দাও।

পঞ্চম কথা হচ্ছে- وَبِكَ خَاصَمْتُ “তোমার সাহায্যে লড়াই করছি”। অর্থাৎ তুমি আমাকে যে বিবেকবুদ্ধি দান করেছ এবং দিয়েছ কুরআনের হিদায়াত, আমি তোমার তাওফীকে তার মাধ্যমে লড়াই করি নফসের বিরুদ্ধে, শয়তানের বিরুদ্ধে এবং দীনের সকল শত্রুর বিরুদ্ধে। যখন প্রয়োজন হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বাহুবলও ব্যবহার করেছি। ভবিষ্যতেও আমি তা ব্যবহার করতে প্রস্তুত আছি। মোটকথা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি টিকে আছি কেবল তোমারই সাহায্যে। এতে আমার নিজের কোনও কৃতিত্ব নেই।

দ্বিতীয় অংশে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনও মা‘বুদ নেই’- এ সাক্ষ্য দিয়ে তাঁর সর্বময় শক্তি ও ক্ষমতার আশ্রয় নিয়ে প্রার্থনা করা হয়েছে যে, তুমি আমাকে পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রেখো।
দু'আটি শেষ করা হয়েছে এ কথা বলে যে-

أَنْتَ الحَيُّ الَّذِي لاَ تَمُوتُ، وَالجِنُّ والإنْسُ يَمُوتُونَ

“তুমিই চিরঞ্জীব। তোমার কোনও মৃত্যু নেই। সকল জিন্ন ও ইনসানের মৃত্যু আছে।”

-এর দ্বারা যেন আল্লাহর প্রতি ভরসা করা, তাঁর অভিমুখী হওয়া ও তাঁর আশ্রয় গ্রহণের কারণ বলে দেওয়া হয়েছে। কেননা আল্লাহ ছাড়া সবকিছু যখন মরণশীল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের সকলেরই শক্তি-ক্ষমতা অতি সীমিত। তাই তাদের উপর ভরসা করা ও তাদের আশ্রয় গ্রহণের কোনও অর্থ হয় না। যে নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, সে অন্যকে কী রক্ষা করবে? যার নিজের ক্ষমতা অতি সীমিত, সে অন্যের কী সাহায্য করবে? যার নিজের কোনও ভরসা নেই, তার উপর ভরসা করে কার কী লাভ হতে পারে? পক্ষান্তরে আল্লাহ অমর অক্ষয়। চিরঞ্জীব সর্বশক্তিময়। কাজেই তাঁর উপর ভরসা করলে ব্যর্থতার কোনও ভয় নেই। নেই পথ হারানোর আশঙ্কা। আল্লাহ যার সহায়, তার আর কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই। দুনিয়ায় ইজ্জত-সম্মান তার পদচুম্বন করবে এবং তার আখিরাত হবে সাফল্যমণ্ডিত। সুতরাং বান্দার কর্তব্য সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে কেবল তাঁরই অভিমুখী হওয়া, তাঁরই উপর ভরসা করা, তাঁরই আশ্রয় গ্রহণ করা এবং তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা দু‘আর আদব জানা গেল যে, প্রথমে কর্তব্য আল্লাহর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করা এবং তাঁর কাছে নিজ দীনতা ও আনুগত্য প্রকাশ করা। তারপর নিজ কাম্যবস্তু তাঁর কাছে প্রার্থনা করা।

খ. শিক্ষা পাওয়া গেল যে, বান্দার সর্বাপেক্ষা বেশি কাম্যবস্তু হওয়া উচিত গোমরাহী থেকে মুক্তি ও হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। সুতরাং আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে এর প্রার্থনা করা উচিত।

গ. সৃষ্টি সর্বতোপ্রকারে অক্ষম ও দুর্বল। তার সবকিছুই অতি সীমিত। সুতরাং কোনও সৃষ্টির কাছে আশাবাদী না হয়ে এক আল্লাহর কাছেই আশা প্রকাশ করা উচিত।

ঘ. হাদীছে বর্ণিত দু‘আটি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে পড়তেন। সুতরাং আমাদেরও কর্তব্য এ দু‘আটি মুখস্থ করে বেশি বেশি পড়া।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ২৪৬৩ | মুসলিম বাংলা