মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৮- রোযার অধ্যায়

হাদীস নং: ২১০৮
৯. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - ইতিকাফ
২১০৮। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এ'তেকাফকারী সম্পর্কে বলিয়াছেন সে গোনাহসমূহ হইতে বাঁচিয়া থাকে এবং তাহার জন্য নেকীসমূহ লেখা হয় ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে ( বাহিরে থাকিয়া) যাবতীয় নেক কাজ করে। —ইবনে মাজাহ্
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فِي الْمُعْتَكَفِ: «هُوَ يَعْتَكِفُ الذُّنُوبَ وَيُجْرَى لَهُ مِنَ الْحَسَنَاتِ كَعَامِلِ الْحَسَنَات كلهَا» . رَوَاهُ ابْن مَاجَه

হাদীসের ব্যাখ্যা:

পরিশিষ্ট

চাঁদ, রোযা ও এ'তেকাফের মাসায়েল।

এখানে কেবল কয়েকটি জরুরী মাসআলা দেওয়া গেল। অন্যান্য মাসআলার জন্য ফেকাহর কিতাব দেখুন।
১। আকাশ পরিষ্কার থাকিলে দুই চারি ব্যক্তির চাঁদ দেখাতে চাঁদ প্রমাণিত হইবে না এবং রোযা বা ঈদ করা চলিবে না। বহু লোকের দেখা আবশ্যক ।
২। আকাশ পরিষ্কার না থাকিলে একজন দ্বীনদার মুসলমান পুরুষ বা নারী ২৯শে শা’বান রমযানের চাঁদ দেখিয়াছে বলিয়া সাক্ষ্য দিলে সকলেরই রোযা রাখিতে হইবে।
৩। আকাশ পরিষ্কার না থাকিলেও ঈদের চাঁদে একজনের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নহে। সে যত বড় দ্বীনদারই হউক না কেন ? ইহাতে কম পক্ষে দুইজন দ্বীনদার মুসলমান পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুইজন নারীর চাঁদ দেখিয়াছে বলিয়া সাক্ষ্য দিতে হইবে, তবেই ঈদ করিবে। অন্যথায় রমযান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করিবে।
৪। জোর খবর হইল, চাঁদ দেখা গিয়াছে, চাঁদ দেখিয়াছে; কিন্তু কেহই চাঁদ দেখিয়াছে অথবা কোন সাক্ষ্য গ্রহণকারীকে সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়া রোযা রাখা বা ঈদ করার জন্য হুকুম দিতে দেখিয়াছে বলিয়া সাক্ষ্য দিল না। ইহাতে রোযা রাখা বা ঈদ করা চলিবে না।
৫। কেহ চাঁদ দেখিয়াছে বলিল না। কিন্তু টেলিগ্রাম, টেলিফোন ও রেডিওগ্রাম দ্বারা জানা গেল, চাঁদ দেখা গিয়াছে। ইহাতে বিশ্বাস করিয়া রোযা রাখা বা ঈদ করা যায় কিনা তাহা জানার জন্য প্রথমে জানা আবশ্যক যে, খবর বা সংবাদ এবং সাক্ষ্য এক কিনা? উভয়ে এক নহে। সাক্ষ্যের জন্য আবশ্যক। (ক) সাক্ষীর সাক্ষ্যস্থলে হাযির থাকা যাহাতে আবশ্যক অনুসারে তাহার যেরা করা যাইতে পারে বা তাহার চেহারা সুরত বা হালচাল দেখিয়া তাহার কথার সত্যতা অনুধাবন করা যাইতে পারে এবং (খ) ‘আমি সাক্ষ্য দিতেছি'—এই বলিয়া শপথ করা । সুতরাং সাক্ষাতে ঐ সকল যন্ত্রের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নহে। দুনিয়ার কোন আদালতই ইহা গ্রহণ করে না। অবশ্য উপযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা চাঁদের সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করার পর উহার প্রচারে ঐ সকল যন্ত্র ব্যবহার করা যাইতে পারে যেমন আমরা বন্ধুক, গোলা, ঢোল ও প্রচার পত্র ব্যবহার করি। আপনি যদি টেলিগ্রাম প্রভৃতিকে প্রচারে ব্যবহৃত বলিয়া মনে করেন, তবে আপনার জানিতে হইবে যে, উহার সাক্ষ্য গ্রহণকারী কে বা কাহারা এবং শরীঅত অনুযায়ী সাক্ষ্য গ্রহণ করা হইয়াছে কিনা ?
৬। চাঁদ চর্ম চোখে দেখা গেল না কিন্তু যন্ত্র দ্বারা (যথা - দূরবিক্ষণ ও অনুবিক্ষণ দ্বারা) দেখা গেল। ইহাতে রোযা রাখা বা ঈদ করা যায় কিনা তাহা ১৮৭৩ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হইয়াছে।
৭। কেহ রোযার চাঁদ দেখিল কিন্তু সাক্ষ্য গ্রহীতার নিকট তাহার সাক্ষ্য গৃহীত হইল না। তাহার পক্ষে রোযা রাখা ফরয। তাহার ঈদের তারিখে অন্য সকলে রোযা রাখিলে সেও রোযা রাখিবে এবং পরদিন সকলের সাথেই ঈদ করিবে।
৮। কেহ এবং ঈদের চাঁদ দেখিল (যাহা গ্রহণযোগ্য নহে) 'এহতিয়াত' বা সতর্কতামূলকভাবে পরদিন রোযা রাখিবে।
৯। ২৯শে শা'বান মেঘ ইত্যাদির কারণে চাঁদ দেখা না গেলে পরদিন দুপুর পর্যন্ত পানাহার না করিয়া থাকা মোস্তাহাব। ইতিমধ্যে চাঁদের খবর পাওয়া গেলে রোযার নিয়ত করিবে; কিন্তু এমনি নফল রোযা বা সন্দেহ করিয়া রোযা রাখিবে না। ইহা মকরূহ। তবে যাহার কোন নির্দিষ্ট দিনে নফল রোযা রাখার অভ্যাস আছে আর ইহা সেই দিন হয়, তাহার পক্ষে নফল নিয়তে রোযা রাখা উত্তম। বাস্তবে চাঁদ উঠিলে তাহার উহা ফরযে পরিণত হইবে।
১০। রোযাতে দুইটি ফরয রহিয়াছে। (১) মনে মনে রোযার নিয়ত বা সংকল্প করা। সুবহে সাদেক হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কে দুই ভাগ করিয়া প্রথম ভাগের মধ্যে নিয়ত না করা হইলে রোযা হইবে না। কাযা রোযা, কাফ্ফারার রোযা বা অনির্দিষ্ট মানসের রোযায় রাত্রি হইতে নিয়ত না করিলে রোযা হইবে না, (২) সারা দিন পানাহার ও সহবাস না করা।
১১। রোযা রাখিয়া নাকে লোবান ইত্যাদির ধোয়া টানিলে, হোক্কা বা বিড়ি সিগারেট পান করিলে, নাকে নস্যি টানিলে বা ঔষধ ঢালিলে বা কানে তৈল ঢালিলে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে।
১২। দিনে স্বপ্নদোষ হইলে বা শিঙ্গা লইলে, গায়ে তৈল মাখিলে, চোখে সুমা দিলে, কানে পানি ঢালিলে, মেসওয়াক করিলে, থুথু বা নাকের শ্লেষ্মা গিলিলে অথবা আতর গোলাব ইত্যাদি ধোয়াহীন কোন জিনিসের সুগন্ধি গ্রহণ করিলে রোযা নষ্ট বা মকরূহ হইবে না।
১৩। অনিচ্ছায় গলা দিয়া মাছি, মশা, ধোঁয়া বা কাকর ইত্যাদি অখাদ্য বস্তু ভিতরে প্রবেশ করিলে রোযা নষ্ট হইবে না। কিন্তু ইচ্ছা করিয়া গিলিলে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে।
১৪। পান খাইয়া বারবার কুল্লি করিল কিন্তু উহার লালচে গেল না, ইহার দ্বারা রোযার ক্ষতি হইবে না।
১৫। রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় ওযূর সময় অনিচ্ছায় গলার ভিতর পানি প্রবেশ করিল। ইহাতে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে।
১৬। বিনা ইচ্ছায় বমি হইলে অল্প হউক বা বেশী হউক উহাতে রোযা নষ্ট হইবে না; কিন্তু ইচ্ছা করিয়া বেশী বমি করিলে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে।
১৭। দাঁতের ফাঁকের কোন জিনিস গিলিয়া ফেলিলে রোযা যাইবে না যদি উহা ছোলা অপেক্ষা ছোট হয় অথবা উহা বাহির করিয়া না গিলে।
১৮। মুখ হইতে বাহির হওয়া রক্ত গিলিয়া ফেলিলে রোযা নষ্ট হইবে না যদি উহা থুথুর সমান না হয় এবং রক্তের স্বাদ মালুম না হয়।
১৯। জিহ্বা দ্বারা কোন জিনিসের স্বাদ গ্রহণ করিলে রোযা যাইবে না; ব্যতীত এইরূপ করা মকরূহ।
২০। ইঞ্জেকশান লইলে রোযা যাইবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে মাওলানা থানবী তাঁহার কিন্তু অত্যাবশ্যক 'হাওয়াদিসুল ফতওয়া'তে যাইবে না বলিয়া ফতওয়া দিয়াছেন।
২১। রোযা রাখিয়া কয়লা বা মাঞ্জন দ্বারা দাঁত মাজা মকরূহ্। ইহার কিছু পেটে চলিয়া গেলে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে।
২২। রোযা অবস্থায় ভুলে পানাহার বা সহবাস করিলে রোযা যাইবে না। কোন দুর্বল ব্যক্তিকে ভুলে পানাহার করিতে দেখিলে বাধাও দিবে না।
২৩। রোযা রাখিয়া ইচ্ছার সাথে (ভুলে নহে) পান বা আহার করিলে, ঔষধ খাইলে বা সহবাস করিলে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে এবং উহার কাযা ও কাফফারা উভয় আদায় করিতে হইবে।
২৪। এক রমযানের একাধিক রোযার জন্য একটি কাফ্ফারাই যথেষ্ট। কিন্তু একাধিক রমযানের রোযার জন্য এক কাফ্ফারা যথেষ্ট নহে।
২৫। কৃতদাস আযাদ করা, তাহা না পারিলে দুই মাস একাধারে (বিনা কামাইতে) রোযা রাখা, তাহা না পারিলে ৬০ জন মিসকীনকে দৈনিক দুই বেলা খানা খাওয়ান অথবা উহার মূল্য দানকে 'কাফ্ফারা' বলে। এক সাথে এক দিনে খাওয়াইলে বা মূল্য দিলে ৬০ দিনের কাফ্ফারা আদায় হইবে না। মাত্র এক দিনের কাফ্ফারাই আদায় হইবে। প্রত্যহ পৃথকভাবে দিবে।
২৬। বার্ধক্য অথবা রোগের কারণে রোযা রাখিতে অক্ষম হইলে এবং ভাল হইয়াও রোযা রাখার মত আশা না থাকিলে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খানা খাওয়াইবে বা উহার মূল্য দিবে। ইহাকে 'ফিদিয়া' বলে। ফিদিয়া জমা হইয়া গেলে এক সাথে দিলেও চলে।
২৭। রোগে রোযা রাখার ক্ষমতাহীন অবস্থায় অথবা সফর অবস্থায় মারা গেলে উহার কাযা বা ফিদিয়া লাগিবে না।
২৮। রোগাক্রান্তের বা রোগ বৃদ্ধির আশংকা থাকিলে এবং কোন দ্বীনদার ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোযা না রাখার পরামর্শ দিলে অথবা নিজের অভিজ্ঞতায় উহা প্রমাণিত হইলে তাহার পক্ষে তখনকার জন্য রোযা না রাখা জায়েয। পরে রাখিবে। পরেও রাখার সম্ভাবনা না থাকিলে সাথে সাথে ফিদিয়া দিবে।
২৯। ফিদিয়া দেওয়ার পর রোযা রাখার শক্তি লাভ করিলে উহার কাযা রাখিতে হইবে। ফিদিয়ার পৃথক সওয়াব পাওয়া যাইবে।
৩০। গর্ভবতী বা দুগ্ধবতী স্ত্রীলোকের পক্ষে তখনকার জন্য রোযা না রাখা জায়েয—যদি উহাতে নিজের বা সন্তানের বড় রকমের ক্ষতির আশংকা থাকে।
৩১। মুসাফির বা ভ্রমণকারীর পক্ষে ভ্রমণকালে রোযা না রাখা জায়েয; কিন্তু কষ্ট না হইলে তখন রাখাই উত্তম।
৩২। কোন কারণে রোযা নষ্ট হইয়া গেলেও বাকি সময় রোযাদারের ন্যায় কিছু না খাইয়া থাকা ওয়াজিব।
৩৩। এক রমযানের কাযা রোযা অপর রমযান পর্যন্ত রাখা না গেলে প্রথমে এ রমযানের রোযা এবং পরে কাযা রোযা রাখিবে।
৩৪। কাযা রোযা এক সাথে বা মধ্যে মধ্যে বিরতি দিয়াও রাখা জায়েয।
৩৫। রোযা, নামায ঘাড়ে রাখিয়া মারা যাওয়ারকালে নিজের মাল থাকিলে উহার ফিদিয়া দেওয়ার জন্য ওয়ারিশগণকে ওসিয়ত করিয়া যাওয়া উচিত। তখন এক তৃতীয়াংশ মালে যে পর্যন্ত কুলায় সে পর্যন্ত ফিদিয়া দেওয়া ওয়ারিশগণের পক্ষে ওয়াজিব হইয়া যাইবে। বিনা ওসিয়তে ওয়ারিশগণ স্বেচ্ছায় আদায় করিলেও ফিদিয়া আদায় হইয়া যাইবে। মুরব্বীগণকে পরকালের শাস্তি হইতে বাচাইবার জন্য ওয়ারিশগণের ইহা করা উচিত।
৩৬। এ'তেকাফকালে স্ত্রী সহবাস বা উহার উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কিছু করিলে এ'তেকাফ বাতিল হইয়া যাইবে।
৩৭। কোন মানবীয় যরূরত, যথা- পায়খানা প্রস্রাব অথবা শরয়ী যরূরত, যথা—জুমার নামাযে শরীক হওয়া ব্যতীত মসজিদ হইতে বাহির হইলে এ'তেকাফ বাতিল হইয়া যাইবে। এ সকল অনুমোদিত যরূরতে বাহির হইয়াও আবশ্যকের অতিরিক্ত গৌণ করিলে এ'তেকাফ থাকিবে না।
৩৮। কেহ এ'তেকাফ শুরু করিয়া কোন কারণে ছাড়িয়া দিলে পরে উহা কাযা করিতে হইবে এবং রোযার সহিত কাযা করিতে হইবে।
৩৯। যাহারা গোছল ব্যতীত থাকিতে পারে না তাহাদের গোছল সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইয়া হযরত মাওলানা যফর আহমদ ওসমানী বলেন, পায়খানা হইতে ফিরিবারকালে পথে পানি পাইলে এবং তাড়াতাড়ি ডুব দিয়া লইলে অথবা পূর্বে পানির বন্দোবস্ত করাইয়া ফিরিবারকালে তাড়াতাড়ি গায়ে মাথায় পানি ঢালিয়া লইলে উহাতে এ'তেকাফ নষ্ট হইবে না। – মাওঃ শামছুল হক অনুদিত বাংলা বেহেশতী জেওর— তৃতীয় খণ্ড—এ'তেকাফ অধ্যায়।
৪০। খানা বা ওযুর পানি আনিয়া দেওয়ার কোন লোক না থাকিলে উহার জন্য এবং পেটের বায়ু ছাড়ার জন্য মসজিদ হইতে বাহির হওয়া দুরস্ত আছে, তবে খুব তাড়াতাড়ি ফিরিবে। —কুদুরী, শামী, তাহতাবী, বেহেশতী জেওর ও রূইয়তে হিলাল — মুফতী শফী রহ.
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ২১০৮ | মুসলিম বাংলা