মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৬- জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৭৬২
৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - কবর যিয়ারত।


‘যিয়ারত' অর্থ মোলাকাত করা, সাক্ষাৎ করা, দর্শন করা। শরীঅতে ইহার অর্থ মৃত ব্যক্তির কবরের নিকট যাইয়া তাহার জন্য দো'আ করা। যিয়ারত করা সকল আলেমের মতেই মোস্তাহাব। ইহা মানুষকে মউত ও আখেরাতের কথা স্মরণ করাইয়া দেয় এবং দুনিয়ার আসক্তি হ্রাস করে। যিয়ারতকালে কবরের ডান পার্শ্বে মুর্দার মুখামুখী দাঁড়াইয়া প্রথমে কবরবাসীকে সালাম দিবে। অতঃপর কিছু দো'আ কালাম পড়িয়া উহার সওয়াব মুর্দার প্রতি পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট নিবেদন করিবে এবং তাহাকে ক্ষমা করার ও তথায় তাহার সম্মান বৃদ্ধি করার জন্য দো'আ করিবে। যিয়ারত শুক্রবারে করা উত্তম। মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে শুক্রবারে সকাল বেলায় যিয়ারত করার নিয়ম চলিয়া আসিতেছে। (শুক্রবার সকালে যিয়ারত না করার রেওয়ায়ত সহীহ্ নহে।) সাতবার আর কাহারও মতে এগারবার সূরা এখলাস অথবা একবার সূরা ইয়াসীন পড়িয়া সওয়াব রেসানী করা মোস্তাহাব। মৃত্যুর পর সাতদিন পর্যন্ত মুর্দার জন্য কিছু দান করাও মোস্তাহাব।
অস্থিরতা প্রকাশ না করিলে নারীদের পক্ষেও আপন আত্মীয়-স্বজনের যিয়ারত করা কাহারও মতে জায়েয। জীবিতকালে মুর্দার যত নিকটে বা দূরে দাড়াইতে হইত, যিয়ারতকালেও তত নিকট বা দূরে দাঁড়াইবে এবং যে পরিমাণ সম্মান তখন করিতে হইত এখনও তাহাই করিবে।
কবরকে চুমা দেওয়া বা উহার ধূলিবালি লইয়া মুখে, শরীরে মাখা বেদআত বা গোনাহ্ কাজ। কবরকে সজদা করা হারাম ও শিরক। অপরদিকে কবরকে পয়মাল করা বা গরু-ছাগল দ্বারা উহাকে পয়মাল করানো এবং উহার অদূরে পায়খানা প্রস্রাব করা মকরূহ।
সূফীদের মতে ওলীআল্লাহরা দুনিয়াতে থাকিয়া যেরূপ মানুষকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতে পারেন, কবরে থাকিয়াও তাহা করিতে পারেন। অতএব, তাঁহাদের নিকটে আধ্যাত্মিক সাহায্য প্রার্থনা করা নিষেধ নহে। ফকীহগণের অনেকের মতে নবী ব্যতীত কাহারও নিকট এইরূপ সাহায্য প্রার্থনা করা জায়েয নহে।
কোন ওলীআল্লাহকে জীবিতকালে যেমন গায়েব জানে বলিয়া মনে করা শিরক, মৃত্যুর পরেও তাহাকে সেইরূপ মনে করা শিরক। কোন মানুষ আল্লাহর সাহায্য না পাইয়া কখনও কাহারও হাজত পূর্ণ করিতে পারে না। সুতরাং কোন মৃত ব্যক্তির নিকট এইরূপ হাজত প্রার্থনা করা কুফরী। অবশ্য কোন বুযুর্গ ব্যক্তির উসীলায় আল্লাহর নিকট হাজত প্রার্থনা করা জায়েয আছে। —অনুবাদক
১৭৬২। হযরত বুরায়দা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেনঃ আমি তোমাদিগকে কবর যিয়ারত করিতে নিষেধ করিয়াছিলাম, এখন তোমরা উহা যিয়ারত করিতে পার। এভাবে আমি তোমাদিগকে তিন দিনের অধিক কোরবানীর গোশত রাখিতে নিষেধ করিয়াছিলাম, এখন তোমরা উহা রাখিতে পার যতদিন তোমাদের ইচ্ছা। এ ছাড়া আমি তোমাদিগকে নিষেধ করিয়াছিলাম মশক ব্যতীত অন্য পাত্রে নাবীয' প্রস্তুত করিতে, এখন তোমরা সকল রকমের পাত্রে ( নাবীয় প্রস্তুত করিয়া) পান করিতে পার; কিন্তু কখনও মাদক দ্রব্য পান করিবে না। -মুসলিম
بَابُ زِيَارَةِ الْقُبُوْرِ
عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا وَنَهَيْتُكُمْ عَنْ لُحُومِ الْأَضَاحِي فَوْقَ ثَلَاثٍ فَأَمْسِكُوا مَا بَدَا لَكُمْ وَنَهَيْتُكُمْ عَنِ النَّبِيذِ إِلَّا فِي سِقَاءٍ فَاشْرَبُوا فِي الْأَسْقِيَةِ كُلِّهَا وَلَا تشْربُوا مُسكرا» . رَوَاهُ مُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. জাহেলিয়াত যুগে কবরস্তানে যাইয়া মানুষ যাহা করিত, তাহা হইতে বাঁচিয়া থাকার জন্যই হুযূর প্রথমে কবর যিয়ারত করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। অতঃপর যখন ইসলামের বিধানাবলী মুসলমানদের অন্তরে সুদৃঢ় হইয়া যায়, তখন তিনি উহার অনুমতি দেন। এই অনুমতিতে স্ত্রীলোকেরা শামিল আছে কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। অনেকের মতে তাহারাও ইহাতে শামিল আছে। প্রথমে মুসলমানদের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যা অধিক ছিল। হিজরতের কারণে তাঁহারা সকলেই দরিদ্র হইয়া পড়িয়াছিলেন। এ কারণে হুযূর সক্ষম ব্যক্তিদেরকে তিন দিনের অধিক গোশত না রাখিয়া গরীবদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিতে বলিয়া ছিলেন। পরে কর্মসংস্থান ও ছোটখাট ব্যবসায়-বাণিজ্য দ্বারা তাঁহাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিলে হুযূর এই বাধা উঠাইয়া দেন।
খেজুর, গম ও চাউল প্রভৃতি খাদ্য-দ্রব্যকে জ্বাল দেওয়া ব্যতীত অল্প সময় (১০/১২ ঘণ্টা) পানিতে ভিজাইয়া রাখিলে যে পানীয় প্রস্তুত হয়, তাহাকে 'নবীয' বলে। ইহা মাদকতার সীমায় পৌঁছে না, অথচ শক্তিবর্ধক। অতএব, ইহা পানে হুযূরের অনুমতি ছিল, তবে মশক ব্যতীত অন্য পাত্রে ভিজানের অনুমতি ছিল না। কারণ, অন্য পাত্রে পানি সহজে গরম হইয়া পানীয় মাদকতার সীমায় পৌঁছিয়া যাওয়ার আশংকা থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে মুসলমানগণ মাদকতা পরিহারে অভ্যস্ত হইয়া পড়িলে হুযূর অন্য পাত্র সম্পর্কীয় নিষেধ উঠাইয়া লন। (মাদকদ্রব্য পান সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ কিতাবের শেষের দিকে পানীয় অধ্যায়ে আসিবে।)

২. প্রথমদিকে কবর যিয়ারত করা নিষেধ ছিল। শাহ ওয়ালিয়্যুল্লাহ রহ.-এর মতে এর কারণ ছিল শিরকের পথ বন্ধ করা। তিনি বলেন, কবর যিয়ারত কবর পূজার দুয়ার খোলে। পরে যখন ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং মানুষের চিন্তা-চেতনায় গায়রুল্লাহর ইবাদত হারাম হওয়ার বিষয়টি বদ্ধমূল হয়ে যায়, তখন (কবরপূজার আশঙ্কা দূর হয়ে যায়, ফলে) কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়।

এ হাদীছে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আগে কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু সে নিষেধাজ্ঞা রহিত করে দেওয়া হয়েছে এবং যিয়ারত করার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন অনুমতি দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন হাদীছে তার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এরকম-
فَإِنَّهَا تُذَكَّرُنَا الْآخِرَةَ (কারণ তা আমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেয়)। অর্থাৎ কবরস্থানে গেলে সামনাসামনি লক্ষ করা যায় যারা একদিন এ মাটির উপর বিচরণ করত, দুনিয়ার হাজারও নি'আমত ভোগ ও উপভোগ করত, কীভাবে তারা সবকিছু থেকে চিরবিদায় নিয়ে একদম খালিহাতে মাটির নিচে চলে গেছে! সেখানে তারা সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। মাটির অন্ধকার কক্ষে সম্পূর্ণ অসহায়। যাদের চলে যাওয়া পুরোনো হয়ে গেছে, তারা তো মাটিতে মিশেই গেছে। একদিন আমারও এ দশা হবে। অতএব শুধু শুধু কেন লম্বা-চওড়া স্বপ্নের জাল বোনা? এভাবে চিন্তা করতে থাকলে দুনিয়ার লোভ-লালসা ঘুচে যায় এবং মন আখিরাতের দিকে ঝোঁকে। মন আখিরাতমুখী হলে আমলে তার আছর পড়ে। তখন মন্দকাজের প্রবণতা কমে এবং সৎকাজের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। সৎকাজ দ্বারাই আখিরাতে মুক্তিলাভ হয়। সুতরাং কবর যিয়ারত আখিরাতের মুক্তিলাভের পক্ষে খুব সহায়ক। তাই এটা মাঝেমধ্যেই করা উচিত।

কবর যিয়ারতের এ অনুমতি নারী-পুরুষ সকলের জন্যই। হযরত ফাতিমা রাযি. প্রতি জুমু'আর দিন হযরত হামযা রাযি.-এর কবর যিয়ারত করতে যেতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কবর যিয়ারতে গিয়ে কী বলব? তিনি বলেছিলেন-
قُوْلِي : السَّلَامُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ، وَيَرْحَمُ اللَّهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِينَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْن
‘তুমি বলবে, হে মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীগণ! তোমাদের প্রতি সালাম। আল্লাহ তা'আলা আমাদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ও যারা পশ্চাদবর্তী, সকলের প্রতি দয়া করুন। ইনশাআল্লাহ আমরাও তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব।’(সহীহ মুসলিম: ৯৭৪; মুসনাদে আহমাদ: ২৫৮৫৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৭১১০; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬৭১২; সুনানে নাসাঈ ২০৩৭; তাবারানী, আদ-দু'আ: ১২৪৬)

কোনও কোনও হাদীছে যে মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারতের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়, সে নিষেধাজ্ঞা সকলের জন্য সাধারণ নয়। তা কেবল তাদের জন্যই প্রযোজ্য, যারা বারবার কবরস্থানে যায়, সেখানে গিয়ে বিলাপ করে, পর্দারও বরখেলাফ করে ও নানারকম সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হয়। যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় এবং কোনওরকম সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হয় না, এরকম মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত নিষেধ নয়। কবর যিয়ারতের যে দীনী উপকারিতা, তা যেমন পুরুষের জন্য প্রয়োজন, তেমনি নারীদের জন্যও প্রয়োজন বটে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

দুনিয়ার মোহ ঘুচানো ও আখিরাতের ফিকির বাড়ানোর লক্ষ্যে মাঝেমাঝে কবর যিয়ারত করা চাই।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ১৭৬২ | মুসলিম বাংলা